সাক্ষাৎকার: যোগেন চৌধুরী: পর্ব ২

পর্ব ১

আপনার ছবিতে রূপকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায়, যেমন সত্তরের দশকের ‘টাইগার ইন দ্য মুনলাইট’ (১৯৭৭), বা পরে নৃশংস অত্যাচারকান্ডের প্রেক্ষাপটে আঁকা ‘আবু ঘ্রাইব’। আপনার ছবিতে জাদুবাস্তববাদ কি কখনও রেখাপাত করে গেছে? 

আমি গেব্রিয়েল গারসিয়া-মার্কেসের ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড’ কিছুটা পড়ে আর শেষ করে উঠতে পারিনি (হেসে ওঠেন)… এত বড় বই! কষ্ট হয় যে শুরু করলাম, কিন্তু শেষ করতে পারলাম না।     

এটা বোধহয় আমার মধ্যে কিছুটা ভিতর থেকেই আছে। স্বপ্ন, সুররিয়ালিজম— এই বিষয়গুলো আমার কাছে ইন্টারেস্টিং, কিন্তু এগুলো আমার কাজে নিজের মতো করে এসেছে, কারুর অনুগামী হয়ে নয়। আমার ছবিতে একটা ছন্দোবদ্ধতা আছে, একটা রিদমিক, লিরিকাল মাত্রা আছে, কবিতার মতো। আমার ছবির লাইনগুলো কবিতার মতো হয়। পাশাপাশি থাকে সামাজিক বিষয় এবং স্যাটায়ার।   

‘ফ্লাওয়ার সার্কল’, ২০০৬
ছবি সৌজন্য গ্যালারি ৮৮

জীবনদর্শনে আপনি রাজনৈতিক মতবাদ থেকে কখনওই সরে দাঁড়াননি। আপনার ছবি কতটা রাজনৈতিক? 

যাঁরা রাজনীতির বিষয় বা সামাজিক চেতনা নিয়ে ভাবেন, তাদের ছবিতে সামাজিক বিষয় উঠে আসবে। আবার না-ও আসতে পারে, যেমন ধরা যাক মাতিস, যাঁর ছবিতে পারিবারিক, ঘরোয়া বিষয়, রং, স্পেস প্রাধান্য পেয়েছে। তার আলাদা তাৎপর্য আছে। আবার (নরওয়ের এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী) এডভার্ড মুংখ-এর ‘দ্য স্ক্রিম’-এর মতো ছবিতে মানুষের সমস্যা, অস্তিত্ব বা অবস্থার একটা দারুণ প্রতিফলন ঘটেছে। রুশোর ছবিতে আছে ড্রিম, ফ্যান্টাসি। পিকাসোর ‘গ্যের্নিকা’ এবং সিনথেটিক কিউবিজম-এ আর এক রকম এক্সপ্রেশন আছে, ফিজিকাল এক্সপ্রেশনগুলো দারুণ ভাবে এসে গেছে এক-এক জায়গায়। পিকাসো নানা ভাবে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন; সেখানে ভিসুয়াল কোয়ালিটি, ফর্ম, স্পেস, কালার, এগুলো প্রাধান্য পেয়েছে, মানুষটা পেছনে চলে গেছে। এক-এক জনের এক-এক রকম মন— কেউ যদি আকাশে উড়তে চায়, সে মাটির উপর হাঁটতে পারে না। 

এখানে একটা কথা বলি, পশ্চিমবঙ্গের আর্ট কিন্তু বম্বে বা দিল্লির মতো কখনওই ছিল না। আমরা আলাদা, এবং তার কারণ আমাদের ইতিহাস, যে ইতিহাস অন্য কোনও রাজ্যের সঙ্গে মেলে না। বম্বের আর্টের একটা অন্য রকম জায়গা আছে, সেটা অনেকটাই ফর্মাল। কিন্তু আমরা কতগুলি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে গেছি, যেমন মন্বন্তর, দেশভাগ, দাঙ্গা, নকশালবাড়ি আন্দোলন, আর এখন আবার একটা অদ্ভুত সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে। এই যে অভিজ্ঞতাগুলো, এই যে জীবনযাত্রার আলাদা জায়গা আমাদের, তার ফলে আমাদের এখানে ছবিতে দেখা যায় মানুষের কথা বেশি, হিউম্যান ফিগার বেশি। আমাদের কাজের মধ্যে জীবনের ক্ষত, সমস্যা, ডিসট্রেস, অন্ধকারের আধিপত্য; এগুলোই আমাদের পরিবেশ, কেননা আমাদের ছোটবেলাটা তো এভাবেই কেটেছে। আমাদের সমসাময়িক রবীন মন্ডল, বিজন চৌধুরী, গণেশ পাইন, বিকাশ কিংবা আমিআমাদের সবারই বিষয়বস্তুর মধ্যে কোথাও একটা সংযোগ আছে। এক্সপ্রেশনটা আলাদা। গণেশদার মধ্যে একটা ট্র্যাডিশনাল অ্যাপ্রোচ আছে, ইউরোপীয় প্রভাবও আছে; বিকাশ রিয়ালিজম-এর একটা ব্যক্তিগত স্টাইলে কাজ করে গেছে। সোমনাথ হোড়ের একটা ভাবনা-চিন্তা ছিল, রাজনৈতিক মতবাদ ছিল। পরের দিকে একটু একাকী হয়ে গেলেও, এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই তাঁর ছবি তৈরি হয়। 

আমাদের কাজের মধ্যে জীবনের ক্ষত, সমস্যা, ডিসট্রেস, অন্ধকারের আধিপত্য; এগুলোই আমাদের পরিবেশ, কেননা আমাদের ছোটবেলাটা তো এভাবেই কেটেছে। আমাদের সমসাময়িক রবীন মন্ডল, বিজন চৌধুরী, গণেশ পাইন, বিকাশ (ভট্টাচার্য) কিংবা আমিআমাদের সবারই বিষয়বস্তুর মধ্যে কোথাও একটা সংযোগ আছে। এক্সপ্রেশনটা আলাদা।

আমার কাজ অন্য রকম, তাতে লিরিক আছে, স্যাটায়ার আছে, রূপক আছে; অনেকটা কাটা-ছেঁড়া বেশি করেছি। কিন্তু আমাদের সবার কোথাও একটা মিল আছে। বম্বের ছবিতে ফর্ম, ভিসুয়াল এলিমেন্ট বেশি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, আমাদের কাজে বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের চরিত্র, এটাকে স্বীকার করতে হয়। 

আর একটা জিনিস আমি মনে করিসমস্ত দেশ জুড়ে আমাদের সামাজিক অবস্থার মধ্যে কয়েকটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জায়গা হচ্ছে ধর্ম নিয়ে মারামারি, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক সমস্যা, জীবনযাত্রার মধ্যে ডিসিপ্লিনের অভাব। এসব নিয়ে বিচিত্র একটা ক্যারেক্টার আমাদের দেশের মধ্যে বিরাজ করে। আমাদের লিডাররা এক-এক রকম অদ্ভুত ক্যারেক্টার, তারা সেজেগুজে পার্লামেন্টে বসে। এই চরিত্রগুলো আমাদের প্রভাবিত করে, করা উচিত। এগুলো আমাদের উপকরণ দেয়, যা সত্যি। এর থেকে বেরিয়ে গিয়ে শিল্পচর্চা করাটা ঠিক হবে না।   

আমাদের মধ্যে একটা বুদ্ধিজীবীর চরিত্রগুণও আছে, যেটার চর্চা আমরা করি জীবনের সঙ্গে, কাজের সঙ্গে মিলিয়ে। ছবি আঁকার সঙ্গে আবার সেগুলোকে মেলাতে চাই আমরা। 

পশ্চিমবঙ্গের বাইরের শিল্পীরা অনেক বেশি বিদেশ-ভ্রমণ করেন; এক-এক জন শিল্পী বছরে তিন বার করে বিদেশে এগজিবিশন করেন, ফলে তাঁরা অনেকটাই ইন্টারন্যাশনাল হয়ে গেছেন। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে তাঁদের ছবির গুণগত মান নেমে গেছে, বরং তাঁদের সৌন্দর্যতত্ত্ব, ভিসুয়াল কোয়ালিটি, শিল্প সম্বন্ধে ধারণা কিন্তু খুবই উচ্চ মানের। জীবনযাত্রার প্রভাব ছবিতে পড়বেই, সেটাই স্বাভাবিক। আমার জীবনযাপনটা আমার।

আপনার সৃষ্ট নারীচরিত্র, নারীদেহের উদযা‌পন অননুকরণীয়, কিন্তু এক্ষেত্রেও আপনি ভারতীয় ঐতিহ্যের বাস্তববাদী পথের কিছুটা বিপরীতেই হেঁটেছেন। এটা কি কোনও সচেতন সিদ্ধান্তের ফল? 

না, ঠিক সেভাবে নয়, ছবির সূত্রে কোথাও একটা পৌঁছনোর ব্যাপার থাকে। আমি শুধু কিছু একটা আঁকলাম, ব্যাপারটা তা নয়। আমি ফর্মের মধ্যে দিয়ে, তার স্পেস ইত্যাদি দিয়ে, স্ট্রেস এবং ডিস্টর্শন (distortion) নিয়ে কিছু বলতে চাই, ছবিটাকে শুধুমাত্র ড্রয়িং হিসেবে দেখলে হবে না। এটার একটা ফিজিক্যালিটি আছে, একটা সাইকলজিকাল এক্সপ্রেশন আছে। সেটা আমি নিজের মতো করে প্রকাশ করে এসেছি। 

‘স্কাল’, ২০০৯
ছবি সৌজন্য গ্যালারি ৮৮

আমি প্রথম থেকেই স্থির করে নিয়েছিলাম, অন্যের মতো আঁকব না, রিপিট করব না। ক্রিয়েটিভ জায়গা থেকে এমন একটা কিছু করতে হবে, যা আলাদা। দশ জন শিল্পী কাজ করে গেছেন অলরেডি; ধরা যাক সোমনাথ হোড়, রামকিংকর বেজ, নন্দলাল। তাঁরা শিল্পের ক্ষেত্রে একটা পরিসর তৈরি করেছেন। আমরা অনুকরণ করব না, বরং সেই পরিসরকে বিস্তৃত করব। ছাত্রদেরও তাই বোঝাতাম; তুমি কোথায় আছ সেই অবস্থিতিটা আগে ঠিক করা দরকার, তবেই বিস্তার লাভ করতে পারবে। কেন বা কীভাবে, তা নির্ভর করবে তোমার ক্ষমতা এবং পরিশ্রমের উপর।     

আপনাদের প্রজন্ম দেশভাগের ইতিহাসের সাক্ষী। ২০২১-এ দেশ, এবং পশ্চিমবঙ্গ, আরও একটি যুগ পরিবর্তনের অভিমুখে। এই সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পরিবেশের প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া কী? 

আমি ১৯৩৮-এ কলকাতায় এসেছি। অনেক কিছু দেখেছি, যা আগে ভাবতে পারিনি। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে যদি সরকার বদলায়, এমন কিছু ঘটবে যা আমরা এখন ভাবতেই পারি না। পশ্চিমবঙ্গ চাই, কেননা / মেজরিটি হলেই পার্লামেন্টে অ্যাবসলিউট মেজরিটি পাওয়া যাবে। তখন সংবিধান বদলে দেওয়া যেতে পারে এবং দেশটাকে একটা হিন্দু রাষ্ট্র করে দিলেও আমরা কিছু করতে পারব না। আমরা বাকস্বাধীনতা হারাব। একটা দেশের কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের দেশের রাজধানীতে ঢুকতে দেবে না, তাই ব্যারিকেড বানাচ্ছে, রাস্তায় গজাল পুঁতছে: এটা কি ভাবা যায়? এখানে একমাত্র বাদ সাধতে পারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।   

পশ্চিমবঙ্গে নবীন শিল্পীদের ভবিষ্যৎ কী?  

আমি মনে করি পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর প্রতিভা আছে। প্রতিভা জিনিসটা আপাতদৃষ্টিতে চিত্তাকর্ষক। তবে ইমেজ তৈরি হওয়া, আর ভাল শিল্পী হওয়া দুটো আলাদা জিনিস। একজন সিরিয়াস আর্টিস্ট কোথা থেকে উঠে আসবে, বলা সম্ভব নয়। চারুকলা কেন্দ্রে গত চার-পাঁচ বছর ধরে আমরা নতুন শিল্পীদের প্রদর্শনী করে আসছি। এখানে প্রচুর প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছে, গ্রামের দিকেও রয়েছে, কিন্তু তারা উঠে আসতে পারছে না, সামাজিক এবং আর্থিক ভাবে ইন্সটিটিউশনাল সাপোর্ট-এর অভাবে। পশ্চিমবঙ্গের চারুকলার কোনও মিউজিয়াম নেই। আমি কেমোমা-র সঙ্গে যুক্ত আছি, কিন্তু সেই পরিকল্পনাও সম্পূর্ণ হতে যে ফান্ডিং লাগবে, তা এই মুহূর্তে আমাদের নেই। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সব সময়েই পিছিয়ে।    

ডাকবাংলার লোগো তৈরি করতে কেমন লেগেছে?  

মজা হয়েছে। এক সিটিং-এ বসে করেছি। আমি তো খুব অল্প বয়স থেকেই দেওয়াল-পত্রিকা করতাম; লোগো, বইয়ের প্রচ্ছদ, এগুলো করতে আমার ভালই লাগে। ১৯৬৪-এ আমি আর শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে, শেক্সপিয়রের ৪০০-তম বর্ষ উপলক্ষে কাজ করেছিলাম। 

তার থেকে বড় কথা, ডাকবাংলা শুরু হচ্ছে, বাংলা ভাষা নিয়ে আরও কাজ হবে, এটা আমার ভাল লেগেছে। এটা একটা পজিটিভ কাজ, এবং আমি সব সময় পজিটিভ কাজ সমর্থন করি। 

আলোকচিত্র সৌজন্য: নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধায়