এই বছর পঁচিশ কি সাতাশ আগেও, টিভি আর বাড়ির ছেলে দুটোরই কান মোলা যেত। সর্বসাকুল্যে দুটো চ্যানেল, ডিডি সেভেন আর ডিডি ন্যাশনাল। তখনও কেবিল বা বাংলায় কেবল চ্যানেল, আসলে ‘কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে’। ফলে কৈবল্যপ্রাপ্তিও হয়নি, দেদার ক্রিকেট বিকেলে, দু’দিন অন্তর বন্ধুবান্ধবে চুলোচুলি, আবার যে কে সেই! কে বলে তখন সবে-সবে ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এর গান দিচ্ছে, ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে খেলতে গেলে ইএসপিএন-এ দেখায় স্টার স্পোর্টস-এ দেখাচ্ছে, ফলে ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। এপারেতে কী রইল তা’লে? রইল ‘চিত্রহার’, রোববার ‘রঙ্গোলি’, ‘মহাভারত’-‘রামায়ণ’, সর্বোপরি ‘শক্তিমান’, আর সপ্তাহান্তে উত্তমকুমারের বেশিরভাগ বাংলা সিনেমা। এখানেই পাখির পায়ে ঘুড়ির সুতো আটকাল।

‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমাতে একটা গান শুনলাম, ‘জীবন নদীর জোয়ার ভাটায় কত ঢেউ এসে পড়ে’। স্কুলে পাঠাচ্ছে বাবা-মা, ফলে রিডিং পড়তে পারছি, মোটামুটি পয়সা উসুল; দেখলাম, সংগীত পরিচালক হিসেবে নাম লেখা অনুপম ঘটক। আর সতীনাথ মুখার্জির গলা এর আগেও শুনেছি, ওই গলা কেউ ভোলে! গানটা ভাল লাগার বিশেষ কোনও কারণ ছিল না অন্তত ওই বয়সে, তবু লেগে গেল। পরে দেখতে গিয়ে দেখেছি, গানটাকে কেটে দিয়ে অনেকবার টেলিকাস্ট হয়েছে সিনেমাটা। ‘ইন্দ্রাণী’ সিনেমায় নচিকেতা ঘোষের সুরে মহম্মদ রফির হিন্দি গানটাও তাই হয়েছে, কেটে দিয়ে সিনেমা চলেছে। সাধে কি আর নষ্ট আত্মার টেলিভিশন বলে!
আরও পড়ুন: কপালকুণ্ডলা ছবির গানেই ক্যান্টরের যথাযথ প্রয়োগ করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। লিখছেন কবীর সুমন
সতীনাথ মুখোপাধ্যায় যে-দুটো গানের জন্য সব থেকে বেশি বিখ্যাত, ‘পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ আর ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’— এই দুটো গানের থেকে বরাবর বেশি ভাল লাগত ‘এখনও আকাশে চাঁদ ওই জেগে আছে’ বা ‘আজ মনে হয় এই নিরালায় সারাদিন ছন্দের গান শুনি’, ‘আকাশ এত মেঘলা, যেয়ো না তো একলা’ এই গানগুলো। যাঁদের ছোট থেকে ক্লাসিক্যাল মিউজিকে শিক্ষা আছে, তাঁরা ছোট থেকে বৃষ্টি বললেই মেঘ, মেঘমল্লার এসবের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করেন; আমাদের বর্ষা বলতেই, ‘এল বরষা যে সহসা মনে তাই’ বা ‘রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি’।

সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান যখন হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-মানবেন্দ্র এঁদের পাশে শুনি, সতীনাথ আলাদা হন; যেন একই সময়ে রাজেশ খান্না-অমিতাভ বচ্চন-ধর্মেন্দ্রদের পাশে বাসু ভট্টাচার্যের সিনেমায় একজন সঞ্জীব কুমার। একই সময়ে সুনীল-শক্তিদের পাশে যেমন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, তেমন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় যত অসামান্যই গান ‘এল বরষা যে সহসা মনে তাই’, কোথাও যেন মনে হয় ওঁর ঝোঁক বেশি ‘রাধিকা বিহনে কাঁদে রাধিকা রমণ’ গাওয়ার। সুর করার ক্ষেত্রেও বোধহয়, কথাটা পুরোটা না হলেও অনেকটা খাটে। মজার ঘটনাও আছে যে, ১৯৫৭ সালে শ্যামল মিত্র আর সতীনাথ মুখোপাধ্যায় পরস্পরের সুরে গান গাইবেন, যাঁর সুর হিট হবে তিনি উৎপলা সেনের কাছ থেকে এক কার্টন সিগারেট পাবেন। সতীনাথ সিগারেট পেলেন, ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর হাসি আর গানে ভরে তুলব’ সুর করে। শ্যামল মিত্রর সুরে সতীনাথের গানটাও অনবদ্য, ‘রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে’।
নিজের আরামের অঞ্চল ছেড়ে তিনি তেমন কিছু গান গেয়ে আমাদের চমকেও দেননি। কিন্তু সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গলায় এবং সুরে ছিল একটা ধারাবাহিক অন্তর্লীন বিরহবোধ, যে-বিরহের রুচির সঙ্গে অন্য প্রদেশের বিরহের রুচির মিল হবে না;
একটা প্রচলিত তথ্য তো হাতের কাছেই আছে যে, লতা মঙ্গেশকরের প্রথম বাংলা গান সতীনাথের সুরে, ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’, আরেকটা গান ‘কত নিশি গেছে নিঁদ হারা ওগো কত ফুল গেছে ঝরে’। এই গানদুটো গাইবার কথা ছিল পান্নালাল ভট্টাচার্যর। একটু আগে-পরে পান্নালাল গেয়েওছেন অসামান্য একটা গান সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে, ‘তোমার মতো আমিও তো কত সয়েছি’। ‘কত নিশি গেছে নিঁদ হারা’য় শুধু একটা সারেঙ্গির সঙ্গে গানটা গাওয়া। গানটার প্রতি একটা পক্ষপাতও আছে। অনেক পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়াবেন, ‘চঞ্চল ময়ূরী এ রাত বঁধু যেতে দিয়ো না’; ওখানেও একটা অনবদ্য সারেঙ্গি বাজানো ছিল। দুঃখের বিষয়, আমরা জানতে চেষ্টা করিনি, ৬০ বছর আগে, যখন নাকি সত্যিই চাইলেই জানা যেত এত অনবদ্য বাদ্যযন্ত্র কারা পেছনে বাজাতেন! আজকে আর সেই উপায় নেই। এই তথ্যসমৃদ্ধির যুগেও নেই…

সতীনাথের গলা ‘শেষের কবিতা’র শোভনলালের মতো; বিশেষত যখন, ‘ওই দূর আলেয়ার একটু আলো’ গানটা শুনতে পাই, এই মনে হওয়াটা দৃঢ় হয়। সমসাময়িক বন্ধুদের মতো ওঁর সুর বিশাল কিছু বাঁকবদল করে আমাদের কাছে আসেনি। যাকে বেশি কথায় পেরে না উঠে এক কথায় বলি ‘বিপ্লব’, সেসব কিছু হয়নি। আচমকা নিজের আরামের অঞ্চল ছেড়ে তিনি তেমন কিছু গান গেয়ে আমাদের চমকেও দেননি। কিন্তু সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গলায় এবং সুরে ছিল একটা ধারাবাহিক অন্তর্লীন বিরহবোধ, যে-বিরহের রুচির সঙ্গে অন্য প্রদেশের বিরহের রুচির মিল হবে না; যা একান্তই বাঙালির, ভাল-মন্দ মিলিয়েই। উদাহরণ হিসেবে শুনলেই বোঝা যায়, ‘রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে’।
চারদিকে যে-সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাই প্রতিদিন, তাতে সতীনাথের গান বেমানান। যাঁদের সতীনাথ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই, তাঁরা এক অর্থে বেঁচে গেছেন। সিগনাল খুললেই দৌড় ছাড়া তাঁদের কোনও লক্ষ্যই নেই, তাঁরা অর্জুনের একাগ্রতায় মাছের চোখ দেখেন। সমস্যা হল তাঁদের নিয়ে, যাঁরা সিগনাল খুললেও তিরিশ সেকেন্ড ট্রাফিকে দাঁড়িয়ে যান, প্রিয় গানের সঞ্চারীটা শুনবেন বলে! সতীনাথ, সতীনাথের মতো দিকপালেরা তাঁদের মারেন আবার বাঁচানও!