সম্প্রতি ওটিটি-তে এসেছে বহুকাঙ্ক্ষিত সিরিজ ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর সিজন তিন। এই সিরিজেরই প্রথম সিজনের প্রথম এপিসোডের একটি সংলাপ এই নিবন্ধের শুরুতেই স্মর্তব্য, ‘Privacy is a myth, just like democracy!’ ভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় এই মুহূর্তে এই সংলাপ প্রবল প্রাসঙ্গিক।
রয়টার্স সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যে প্রতিবেদন-মারফত কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সঞ্চার সাথী’ নামক অ্যাপটির গোপন আগমনবার্তা দেশবাসীর বৈঠকখানায় পৌঁছে গেছে। সরকার বাধ্যতামূলকভাবে সমস্ত স্মার্টফোন-প্রস্তুতকারী সংস্থাকে তাদের পণ্যে এই অ্যাপটি ইন্সটল করতে বাধ্য করছে। অর্থাৎ, মোবাইল ক্রয় করার সময় প্রি-ইন্সটলড অ্যাপ হিসেবে অপারেটিং সিস্টেমে এটি উপস্থিত থাকবে। কোনওভাবেই ক্রেতা এটি আনইন্সটল করতে বা এই অ্যাপের গতিবিধি রোধ করতে পারবে না। এমনকী, যে স্মার্টফোনগুলি ইতিমধ্যেই সাপ্লাই চেইনে রয়েছে, সেগুলিতেও সফ্টওয়্যার আপডেট মারফত এই অ্যাপ ইন্সটল হবে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করার মেয়াদ মাত্র ৯০ দিন।
গোটা পদ্ধতিতে যা চূড়ান্ত আশঙ্কার, কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণটিই সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিল সন্তর্পণে, লোকচক্ষুর অন্তরালে ও অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে। বিষয়টি রয়টার্স-কর্তৃক সামনে আসার পরে, অপ্রস্তুত হয়ে পড়া কেন্দ্রীয় শাসক দলের বয়ানেও বিভিন্ন সময়ে পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। পিআইবি বা প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো-র বিবৃতিতে, অ্যাপটি আনইন্সটল বা অক্ষম করা যাবে না, এটি স্পষ্টত লেখা থাকলেও— কমিউনিকেশন মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য মাধবরাও সিন্ধিয়ার বক্তব্য ভিন্ন। তিনি বলছেন, ব্যবহারকারী চাইলেই এটি আনইন্সটল করতে পারবেন। অদ্ভুতভাবে লক্ষ করা গেছে, সেই পিআইবি-ই পরবর্তীতে আবার জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার এক্স পোস্ট ভাগ করে নিয়েছে, তাদের পুরনো বিবৃতি প্রত্যাহার না করেই।
আরও পড়ুন: মানুষের লোভের দরুন বিরল প্রাণীরা ক্রমশ বিপন্ন!
লিখছেন জয়দীপ ঘোষ…
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের গোটা পদ্ধতিটিতে এত গোপনীয়তা ও তৎপরতা কীসের? আদতে বিজেপি সরকার এই বিষয়ে যে-কোনওরকম শোরগোল থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিল। পুরো কাজটি স্মার্টফোন-প্রস্তুতকারী সংস্থা মারফত ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল প্রাথমিক উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে অ্যাপটি ইন্সটল হয়ে গেলে, ঘটনাটি সামনে এলেও বিরোধী শিবির বা দেশবাসীর বিশেষ কিছুই করার থাকত না। কিন্তু সাংবাদিকতার এহেন আচম্বিৎ কলমবাণে বিদ্ধ রাষ্ট্র বাধ্য হয়ে পিছু হটছে। এছাড়া তাদের বাস্তবায়ন পরিকল্পনার মানচিত্রও ছিল ত্রুটিপূর্ণ, যাতে প্রাথমিকভাবেই খানিক পিছু হঠতে হয়েছে সরকারকে। পাল্টা হরেক দুর্বল যুক্তির সম্ভার সাজিয়ে বাজার কাঁপাচ্ছে শাসক শিবির। এই অ্যাপ নাকি একবিংশ শতাব্দীর এক বৈপ্লবিক নিদর্শন। দেশের ১.২ বিলিয়ন ব্যবহারকারীর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ৭ লক্ষেরও বেশি হ্যান্ডসেট নাকি এই সঞ্চারসাথী অ্যাপ মারফত উদ্ধার হয়েছে। কোনও জায়গায় এই তথ্যটা তিন লক্ষ দেখানো হচ্ছে, কোথাও আবার সংখ্যা আড়াই লক্ষর ঘরে।
আদতে এই মিথ্যা পরিসংখ্যানে তথ্যের চেয়েও ভক্তির পরিমান বেশি। বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। ‘ডিওটি’ বা ‘ডিপার্টমেন্ট অফ টেলিকমিউনিকেশন’-এর পরিসংখ্যান বলছে, হারিয়ে যাওয়া ৮.৯ লক্ষ ফোনের মধ্যে পুনরায় খুঁজে পাওয়া ফোনের পরিমাণ ১৫ শতাংশেরও নিচে। এহেন পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও সরকার হঠাৎই এমন ভয়ংকর মানবদরদী হয়ে উঠল কেন, তার কারণই উদ্বেগের উদ্রেক করে। পাশাপাশি সরকারের জানানো তথ্য অনুসারে, ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ এই অ্যাপ ডাউনলোড করেছে। শুধুমাত্র অক্টোবরেই নাকি ৫০,০০০-এরও বেশি হারিয়ে যাওয়া ফোন উদ্ধার হয়েছে। এই তথ্য যদি সত্যি হয়, তাহলে তো খুশি হওয়ার কথা সরকার বাহাদুরের। এত ভাল সার্ভিস যে অ্যাপের, তা তো এমনিই বহু মানুষ ডাউনলোড করবে। তাহলে এই বলপ্রয়োগ কীসের?
সরকার ও বিজেপি মুখপাত্ররা আসরে নেমে বুঝিয়েছেন, এতে যাবতীয় স্ক্যাম, ফ্রড, ডিজিটাল দুর্নীতি থেকে মুক্তি মিলবে। অর্থাৎ, দেশে ঘটে চলা অসংখ্য সাইবার হানার নিস্পত্তি ঘটবে একটি অ্যাপ ব্যবহার করলেই। নিন্দুকেরা বলছে, সাইবার ক্রাইমের অফিসগুলোয় তালা ঝোলা নাকি সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু যেখানে সংসদে শীতকালীন অধিবেশন সবে শুরু হয়েছে, সেখানে তো বিতর্ক এত সহজে থামার নয়। বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছে, পেগাসাস বিতর্কের কথা। ইজরায়েলের থেকে লুকিয়ে ক্রয় করা ম্যালওয়্যারের মূল টার্গেট ছিল বিরোধী শিবির, সমাজকর্মী ও তাবড় সাংবাদিকরা। ‘দ্য ওয়্যার’ নামক স্বাধীন সংবাদমাধ্যমেও আঘাত নেমে এসেছিল। সুপ্রিম কোর্টে মামলা হলেও, ‘সরকার কোর্টের সঙ্গে সহায়তা করছে না’ বলে হাত তুলে দেয় দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়। বাম নেতা ও সাংসদ জন ব্রিটাস তাই কটাক্ষ করে বলেছেন, হয়তো পরবর্তীতে পায়ে-গলায় কলার লাগানোরও বন্দোবস্ত করবে মোদি সরকার। শাসক দলের স্তাবককুল যথারীতি ঢাল-তরোয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদের বয়ান, সরকারের থেকে যারা গোপনীয়তা রাখে, নির্ঘাৎ তারা দেশদ্রোহী।
কিন্তু বিষয়টা দেশদ্রোহিতার নয়, নিরাপত্তার। সরকার কি কখনও মিডিয়া ফাইলস, ছবি-ভিডিও, কল লগস, মেমরি কার্ড, মেসেজ, ডকুমেন্টস ইত্যাদি সবকিছু অ্যাক্সেস করার দাবি করতে পারে? বা কোনও সিকিউরিটি প্রোভাইডিং অ্যাপ আপনার স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশলাইট অ্যাক্সেস চায়? অর্থাৎ, অন্ধকার বেডরুমেও সরকার আপনাকে ‘সুরক্ষা’ দিতে চায়!
স্বাভাবিকভাবেই গন্ধটা সন্দেহজনক! গণতন্ত্রের এহেন সংকটে প্রাথমিকভাবে বিরোধী দলগুলি অজ্ঞ থাকলেও, বিরোধিতা করেছে অ্যাপেলের মতো বহুজাগতিক সংস্থা। তারা কাস্টমারের সাইবার সেফটি ইস্যুতে কোনওরকম সমঝোতা করতে রাজি নয়। এর আগেও সরকারি তরফে অ্যান্টি-স্প্যাম অ্যাপের ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটির প্রস্তাবেও এই সংস্থা সম্মতি দেয়নি। এছাড়াও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সিকিউরিটি থ্রেট। অ্যাপটির ব্যাকএন্ড ইমেলে জ্বলজ্বল করছে জিমেলের সাধারণ একটি আইডি। অ্যাপের ডেটা কোথায় স্টোর হবে বা সেগুলি সুরক্ষিত থাকবে কি না, সেই সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা নেই। অন্যান্য অ্যাপের মতো পারমিশন অক্ষম করার অপশনটিই যেখানে নেই, সেখানে ডেটা ব্যক্তিগত না থাকার অবশ্যম্ভাবী আশঙ্কা কোনও সংস্থাই এড়াতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে অ্যাপেল ছাড়াও স্যামসাং বা অন্যান্য স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিও মুখ খুলেছে। অন্যান্য দেশের সরকারি নজরদারির জ্বলন্ত উদাহরণও সামনে আসছে ভরপুর।
এই বছরই বিবিসি-র একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, উত্তর কোরিয়া থেকে চোরাবাজার মারফত আসা একটি ফোনের বিষয়ে। যে স্মার্টফোনটি পরীক্ষা করলে দেখা যায়, সার্চ ইঞ্জিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘পাপেট স্টেট্’ দেখানো হচ্ছে। এছাড়াও কিম জং উনের দেশের ফোন প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর নিজে থেকেই স্ক্রিনশট নিতে সক্ষম। যাবতীয় স্ক্রিনশটের তথ্য জমা হয় এমন একটি ফোল্ডারে, যেখানে ব্যবহারকারীর নিজস্ব কোনও অ্যাক্সেস নেই। এই সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্যের তত্ত্বাবধানে থাকে দেশের সরকার। এছাড়াও হাতের কাছেই রয়েছে রাশিয়ার উদাহরণ। এই বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ পুতিনের দেশ বাজারে আনে ম্যাক্স মেসেঞ্জার নামক একটি নতুন অ্যাপ। সূচনা পর্বে হোয়াটস্যাপের প্রতিদ্বন্দী বলা হলেও, এও আদতে সরকারের নজরদারিরই একটি উৎকৃষ্ট ফসল। এই অ্যাপ-ব্যবহারকারীর যাবতীয় তথ্য, এমনকী, কথোপকথন, চ্যাট সবই পড়তে পারে সরকার।
সাম্প্রতিক সময়ে ভীমা-কোরেগাঁও কেসে আন্দোলনকারীদের ল্যাপটপে বাইরে থেকে অ্যাক্সেস করা হয়। বিভিন্ন ফাইল ডাউনলোড করা হয় ও চক্রান্ত করে ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠে। তাই পেগাসাস হোক বা সঞ্চার সাথী, বারবারই রাষ্ট্রের তরফে চেষ্টা চলেছে ডিজিটাল নজরদারির। কিন্তু এই মুহূর্তে চাপে পড়ে খানিক ইতিউতি বৈচিত্র্যময় বিবৃতির প্রহর পেরিয়ে জানানো হয়েছে, এই অ্যাপের ব্যবহার সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক। তাতেও মনে পড়ে যায় আধারের আলো-আঁধারি ইতিবৃত্ত।
আমাদের দেশেও ডিজিটাল নজরদারির অভিযোগ কম নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ভীমা-কোরেগাঁও কেসে আন্দোলনকারীদের ল্যাপটপে বাইরে থেকে অ্যাক্সেস করা হয়। বিভিন্ন ফাইল ডাউনলোড করা হয় ও চক্রান্ত করে ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠে। তাই পেগাসাস হোক বা সঞ্চার সাথী, বারবারই রাষ্ট্রের তরফে চেষ্টা চলেছে ডিজিটাল নজরদারির। কিন্তু এই মুহূর্তে চাপে পড়ে খানিক ইতিউতি বৈচিত্র্যময় বিবৃতির প্রহর পেরিয়ে জানানো হয়েছে, এই অ্যাপের ব্যবহার সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক। তাতেও মনে পড়ে যায় আধারের আলো-আঁধারি ইতিবৃত্ত। শুরুতে আধারও যে ঐচ্ছিক বলেই চালু হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাঙ্ক-বিমার চৌকাঠ পেরিয়ে, যাবতীয় বিতর্ককে বুড়ো আঙুলের নিশানায় উড়িয়ে আধার এখন নিত্যসঙ্গী। বিচ্যুতও হয়েছে আধারের তথ্য, এই সত্য রাষ্ট্র স্বীকারও করেছে। সরকার সদিচ্ছার দোহাই দিয়ে কুম্ভীরাশ্রু ফেললে জনগণ আবারও লাইনে দাঁড়ায়। কখনও প্রমাণ হাতে এসআইআর-এর জন্য, কখনও মোবাইল লিঙ্কের দোহাই দিয়ে আধারের জন্য। কখনও আবার অ্যাপ ইন্সটল করে প্রশ্ন না করেই। চলে জনগণের সঙ্গে আত্যন্তিক লুকোচুরি খেলা।
আবারও কাল্পনিক সংলাপেই ফিরে যাওয়া যাক। প্রথমে উল্লিখিত ওই ওটিটি-রই অন্য একটি বহু-প্রতীক্ষিত থ্রিলার সিরিজ শোরগোল ফেলেছিল নেট-দুনিয়ায়। ‘পাতাল লোক’ সিজন দুই। এই সিজনের অন্তিম ‘সিস্টেম’ একটি ডুবন্ত নৌকার প্রতিচ্ছবি, সবাই জানে, এটি ডুবতে চলেছে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে কেউ কেউ শুধু নিজেকে বাঁচাতে চাইছে, কেউ ব্যর্থ অভিপ্রায়ে গোটা সিস্টেমকে!


