আলো ক্রমে আসিতেছে

Horse

উত্তর কলকাতার একটা গলি সামান্য বাঁক খেয়ে মিশে যাচ্ছে আরও একটা গলিতে। সেই সংযোগস্থলে ভাঙা ইটের দেওয়ালের পাশে রংচটা দেওয়ালটির রং কোনও এক কালে হলুদ ছিল। এই দুই দেওয়ালের উপরের গাছের ছায়া এসে পড়ছে, আবার সরে যাচ্ছে। লাল গামছা কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ক্লান্ত দু’টি পা। গোটা পাড়ার চিত্তচাঞ্চল্য পার করে এই অংশটুকুর নিবিড় শান্তি একটি ছবির জন্ম দিচ্ছে অনায়াসে।

এইসব অকিঞ্চিৎকর দৃশ্যের ডাকে ছবি সংগ্রহের নেশা তৈরি হয় অজান্তে। আলোর মৌতাতে কেটে যায় বাকি জীবন। প্রাথমিক দেখার চোখ ধীরে-ধীরে খুঁজতে চায় আরও জটিল বিষয়। পিকটোরিয়াল দৃশ্যপট ভেঙে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক টানা-পোড়েন লেন্সে স্থির হয়। সামগ্রিক ভাঙা গড়ার মধ্যে অসংখ্য ছবি জন্মায়, মারাও যায়। এই জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যে স্থিতাবস্থায় অবিচলিত থেকে নতুন দৃশ্যের যাত্রাপথ খুঁজে নেয় একজন ফোটোগ্রাফার।

আরও পড়ুন: বাঙালির জীবনে ফোটোগ্রাফির আদৌ কি কোনও প্রয়োজন আছে? লিখছেন রনি সেন…

আমার ছবি তোলার শুরু স্কুলজীবনে। বাবা একটা কোডাক ক্রোমা ক্যামেরা কিনে দিয়েছিল। পয়েন্ট অ্যান্ড শুট। সেই ক্যামেরা নিয়ে পারিবারিক মুহূর্ত বা ভ্রমণের স্মৃতি ফিল্মে তুলে রাখার শখ ছিল সেই সময়ে। বাবা ব্যবহার করতেন আসাহি পেন্টেক্স। পরবর্তীকালে সেই ক্যামেরাতে হাত পাকানো কিছুটা। বাঁধ ভাঙল মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আসার পর। খুবই সাধারণ মানের ক্যামেরা কিন্তু ফিল্মের মতো কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আমার কাছে তখন খুবই নতুন সম্ভাবনার শুরু।

কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম আগে থেকেই। কলেজজীবনের শুরুতে এই মোবাইল ফোনের ক্যামেরা হাতে আসার পর লেখার ইমেজারিগুলো ধরার চেষ্টা শুরু হল ছবিতে। শহুরে অনুষঙ্গ এবং জ্যামিতিক বিন্যাসের প্রতি আগ্রহ ছিল বিশেষভাবে। পরে একটি ডিজিটাল ক্যামেরা হাতে আসার ফলে শহরের রাস্তাঘাট, মানুষজন, গঙ্গার ঘাটের নানার গল্প এবং মুহূর্ত হয়ে ওঠে ছবির বিষয়। কবিতা আর ছবির মধ্যে চলতে থাকে পারস্পরিক আদান-প্রদান। ছবির কম্পোজিশনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই কবিতার ছন্দের। দুই ক্ষেত্রেই মাত্রাবোধ অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার ছন্দ শিখে তারপর তাকে ভাঙতে শেখার মতোই কম্পোজিশনের নিয়ম ভাঙার মধ্যে দিয়েই কখনও তৈরি হয় সার্থক ছবি।

ছবি তোলার নেশাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা স্থির করি ২০২১ সালে। সেইমতো কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার পর শুরু হয় অন্য এক যাত্রা। পেশাদার জগতের নিয়ম এবং রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে পরিচয় শুরু হয়। আমি যেহেতু ফ্যাশন এবং বিজ্ঞাপনের কাজ করা শুরু করি, তাই স্টুডিয়ো হয়ে ওঠে আমার দিনযাপনের বন্ধু। নিজের হাতে আলো করার আনন্দ, একটা ছবিকে প্রাণ দেওয়ার ইচ্ছে— সব মিলিয়ে সে এক অসামান্য অনুভূতি। কৃ্ত্রিম আলো নিয়ে কাজ করা শুরু করার পর থেকে এখনও অবধি ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’। প্রতিদিন। নতুন করে।

আলোকচিত্র: দেবর্ষি সরকার