সাক্ষাৎকার: অভিজিৎ গুপ্ত

Abhijit Gupta

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অভিজিৎ গুপ্ত বর্তমানে ‘স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস’-এর ডিরেক্টর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজ এবং আর্কাইভিংয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর তত্ত্বাবধানে এই প্রতিষ্ঠান করে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রকল্প। সদ্য পেরিয়ে গেল, ‘আন্তর্জাতিক আর্কাইভ দিবস’। তাঁর কাজের সূচনা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসের পাশাপাশি আর্কাইভিংয়ের নানান দিক নিয়ে কথা বললেন অভিজিৎ গুপ্ত। ডাকবাংলা.কম পত্রিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজান মুখোপাধ্যায়

আর্কাইভের সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপ কবে হল? সাহিত্যের ছাত্র, সেখান থেকে বুক হিস্ট্রি-র ট্রেনিং— সেই সূত্রে কি আর্কাইভ সংক্রান্ত কাজ করতে হয়েছিল? এ-কারণে সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনওরকম বদল হয়েছিল?

দ্বিতীয় প্রশ্নর উত্তরটা আগে দিই। ’৮০-র দশকের শেষদিকে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে সাহিত্য পড়ার দরুণ, সেখান থেকেই সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বদল হতে শুরু করেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, টেক্সটের প্রতি নিবিড় মনোযোগ, যাকে আমরা ‘টেক্সচুয়াল হারমেনিউটিক্স’ বলি। একটি পাঠকে কীভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, তার উপর ঝোঁক ছিল, কিন্তু তার মধ্যেই এই অবস্থাকে যিনি নাড়া দেন, তিনি অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী।

আমরা যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম, তিনি অক্সফোর্ড চলে যান, নাট্যকার টমাস মিডলটনের (১৫৮০-১৬২৭) উপর গবেষণা করতে। আমরা যখন স্নাতকোত্তর বর্ষে, তখন তিনি ফিরেও আসেন। এবং তখন সবে ‘নিউ হিস্টোরিসিজম’ কথাটি লব্জ হচ্ছে যা স্বপন চক্রবর্তীর মুখেই আমরা প্রথম শুনি।

পাশাপাশি, ওঁর মুখেই প্রথম শোনা যায়, নিউজিল্যান্ডের গ্রন্থ ঐতিহাসিক বা বুক হিস্টোরিয়ান ডন ম্যাকেনজির কথা, যিনি তখন অক্সফোর্ডেই বিবলিওগ্রাফি বিভাগে অধ্যাপনা করতেন— এক নতুন ধরনের গবেষণার ধারা তিনি উন্মোচিত করেছিলেন বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না। কিন্তু সেগুলো যে তখন খুব একটা রেখাপাত করেছিল মনে, তা নয়। স্বপনদা যখন পড়াতেন, তখন এই প্রসঙ্গগুলো আসত, কিন্তু অনেকটাই নিউ হিস্টোরিসিজমের আদলে।

তারপর আমি বছরদু’একের জন্য ‘স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্রে চাকরি করতে যাই, তখন কিন্তু অন্য একটা দৃষ্টিভঙ্গি কাজের সূত্রেই জন্মায়; বিশেষত মুদ্রিত সংবাদপত্রের নেপথ্যে অলক্ষ যে-যে পক্রিয়া, সেগুলো সম্পর্কে বেশকিছুটা ধারণা হয়। আমি বুঝতে পারি, খবরের কাগজে যা পড়ছি তা আদপে অনেকগুলি প্রক্রিয়ার ফল, যা অলক্ষ হলেও অপরিহার্য। পক্রিয়াগুলোর প্রতি তখনই আমার আগ্রহ জন্মায়। এ-বিষয় সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আবার, মূল সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করার জন্য যা-যা উপকরণ প্রয়োজন, তার পর্যাপ্ত আর্কাইভড মেটিরিয়াল সব ক্ষেত্রে থাকে না। এটাই সাহিত্যপাঠ ও আর্কাইভের সম্পর্ক নির্ধারণ করে; কিন্তু শুধু যে সাহিত্যপাঠের জন্যই আর্কাইভের প্রয়োজন তা তো নয়।

রাখালচন্দ্র পালের ছেলে নারায়ণ রুদ্র পাল আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার দোকানে রেডিও সবসময় ভর্তি থাকে কেন?’ আমি ওঁকে বলেছিলাম, ‘আপনাদের স্টুডিওতে ঠাকুর পড়ে থাকলে বোঝা যায়, সেটা বিক্রি হয়নি, সেটা ভাল দেখায় না। কিন্তু আমার ঠিক উল্টো।
পড়ুন: অমিতরঞ্জন কর্মকারের সাক্ষাৎকার

বিদেশে যখন গবেষণা করেতে যাই, তখন ঘটনাচক্রে যে-বিষয়ের উপর আগ্রহী হয়ে পড়েছিলাম, তা মুদ্রণ ও প্রকাশনার ইতিহাস। এই আগ্রহটা কিন্তু জন্মেছিল, খবরের কাগজে কাজ করে। মুদ্রণের পক্রিয়াগুলো আমার কাছে খুব চিত্তাকর্ষক মনে হত।

উনিশ শতকের ভিক্টরিয় প্রকাশকদের নিয়ে কাজ করতে গেছিলাম, বিশেষ করে মহিলা সাহিত্যিকদের প্রেক্ষিতে। কিছু ঔপন্যাসিকদের কথা জানা ছিল, যারা নিজেদের সময়ে হয়তো খুব বিখ্যাত ছিলেন, কিন্তু পরে হারিয়ে যান। আমার প্রশ্ন ছিল, এঁরা যে একসময়ে জনপ্রিয় ছিলনে, তারপর সেই জনপ্রিয়তা হ্রাস পেল, তার কারণ কী? সে-উত্তর কি শুধুই সাহিত্যপাঠের প্রকরণে পাওয়া যাবে? আমি কি শুধুই একটা টেক্সটের ভিত্তিতে বুঝতে পারব সে-কারণ না, অন্য কোনও প্রক্রিয়া তার পেছনে কাজ করে থাকবে? সেটা করতে গিয়ে, পাবলিশার্স আর্কাইভ অর্থাৎ প্রকাশকদের কাগজপত্র ঘাঁটতে হয়— চিঠিপত্র, চুক্তিপত্র, লাভ-ক্ষতির খতিয়ান এগুলোই দেখতাম।

এক্ষেত্রে আমি সৌভাগ্যবান, যাঁদের নিয়ে আমি কাজ করছিলাম সে-সংক্রান্ত অনেক কাগজপত্রই আমি পেয়ে যাই। তাঁদের কয়েকজন রোডা ব্রোটন (১৮৪০-১৯২০), মারি কোরেলি (১৮৫৫-১৯২৪), উইডা (১৮৩৯-১৯০৮) প্রমুখ; তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রকাশনা সংক্রান্ত আর্কাইভস পাওয়া যেত। যেমন ব্রেন্টলি ছাপতেন, রোডা ব্রোটন, মারি কোরেলি। আবার ম্যাকমিলান বা ব্ল্যাকউডের কথা যদি ভাবি, তাঁদের কাগজপত্র ব্রিটিশ লাইব্রেরি বা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তখন পাওয়া যেত। সময়টা নয়ের দশকের শেষ, প্রায় অধিকাংশ কাগজপত্রই ছিল ফোটোকপি এবং মাইক্রোফিল্ম আকারে। চ্যাটওয়েন উইনডার্স নামে আরেকজন প্রকাশকের আর্কাইভ ছিল রিডিং ইউনিভার্সিটি-তে; আমার গবেষণা সংক্রান্ত একজন ঔপন্যাসিক, উইডার কাগজপত্র ছিল সেখানে, সেখান থেকে একজন গবেষক অনেকগুলির ফোটোকপি (একেকটা বাক্সের ওজন প্রায় ১০/১২ কেজি) পৌঁছে দিয়েছিলেন আমার কাছে। সেগুলো পড়ে একটা ধারণা হয়।

অভিজিৎ গুপ্ত

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের আর্কাইভ ওঁদের ওয়ালটন স্ট্রিটের মহাফেজখানায় গিয়ে দেখতে হয়েছিল, সেখানে সে-সময়ে কাজ করছিলেন, রিমি চ্যাটার্জি, যিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ইতিহাস রচনা করেছিলেন। অনেককিছু জানতে পারলাম ওখানে গিয়ে। একদা ওঁদেরই সংগ্রহে ছিল, এমন অনেক জিনিসই আবার পাওয়া যায় না, ফেলে দিতে হয়েছিল যুদ্ধের সময়ে, অনেককিছু খোয়াও গেছিল। আমাদের শুনে খুব আক্ষেপ হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বেশকিছু চিঠিপত্র (ইনকামিং করেস্পডেন্স, ওঁরা ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন) এ-রকম অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো বেশ মজারও। যেমন, জিম করবেটের রাইফেল ওঁদের মহাফেজখানায় ছিল; স্থানীয় পুলিশ কৈফিয়ত তলব করে— আর্কাইভে আগ্নেয়াস্ত্র কী করছে!

কেন্দ্রীয় ভাবনাটা ছিল এই— যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তখনও একটি নবীন প্রতিষ্ঠান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা উনিশ শতকে গঠিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় তা স্পষ্ট। যাদবপুরের নিজস্ব কোনও আর্কাইভ তখন ছিল না, এবং এই নিয়ে বিশেষ কোনো চর্চাও গড়ে ওঠেনি। যদিও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পাঠদান হচ্ছিল, গবেষণার জন্য ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব বেশি সহায়তা মিলত না। তাদের বেশিরভাগকেই নির্ভর করতে হত বিদেশি আর্কাইভের ওপর। এই অভাববোধ থেকেই জন্ম নেয় ‘স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস’।

তখন অনেক বড়-বড় কোম্পানিই— অক্সফোর্ড ও আরও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আর্কাইভ মাইক্রোফিল্ম করতে চাইছিলেন, তবে তাঁরা যে পুরোটা করতে চাইতেন, এমনটাও নয়। অক্সফোর্ডের ক্ষেত্রেই, একটি কোম্পানি বলেছিল, সবই করব, কিন্তু ‘বাইবেল ট্রেড’ করব না। এদিকে বাইবেল ট্রেডের উপরেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রতিপত্তি দাঁড়িয়ে আছে, এটা ছাড়া ওঁদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। দীর্ঘদিন এগুলোর মধ্যে থেকে, জেনে— একটা ধারণা মোটামুটি তৈরি হয়েছিল।

যে-সময়ে আপনি কাজটা করেছিলেন, তার প্রেক্ষিতে বর্তমানে ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন নানা জায়গায় আর্কাইভাল মেটিরিয়াল পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে, আবার কোনও-কোনও দিক থেকে জটিলও হয়ে গেছে। আজ কি আমাদের দেশের আর্কাইভের পরিকাঠামোর কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়?

একটা আর্কাইভ কেবলমাত্র কিছু কাগজপত্রের সমষ্টি নয়, সেখানে এসে যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই কাগজপত্রগুলি নিয়ে কেউ গবেষণা করছেন, ততক্ষণ সেই আর্কাইভ মৃতবৎ। প্রকাশক ছাড়াও, ভারতবর্ষের কয়েকটি সংগঠন— তাঁদের নিজেদের কাগজপত্র থাকলেও, সেগুলি নিয়ে কেউ কখনও নাড়াচাড়া করেনি, অবশ্যই আমি ঐতিহাসিকদের কথা বলছি না, বলছি সাহিত্য-শাস্ত্রীদের কথা। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের তো অনেকটা কাজই এ-নিয়ে। ধরা যাক, অমিয় বাগচি যখন ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’র ইতিহাস রচনা করছেন, তখন তিনি পর্যাপ্ত গবেষণা করেছিলেন, সংশ্লিষ্ট আর্কাইভস ব্যাবহার করে। আবার সাবলটার্ন ইতিহাসের চর্চা যারা করছেন, তাঁরাও সে-অনুযায়ী কাজ করছেন। ফলে, সে-সচেতনতা ইতিহাসে ছিল, কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের আর্কাইভ সংক্রান্ত এই যোগ বা কথোপকথন হয়েছে কি না আমার জানা নেই।

আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, আমার নিজের যে গবেষণার বিষয়, এবং আমার ভবিষ্যতে চর্চার বিষয় যা হবে, সে-সংক্রান্ত কাজ এখানে করা সম্ভব নয়।

সাবেকি পাঠাভ্যাসে আমার সে-সময়ে হয়তো ততটা রুচি ছিল না, স্বপন চক্রবর্তী তখন যাদবপুরে পড়াচ্ছেন, ততদিনে সেই প্রথম, যাদবপুরে বুক হিস্ট্রির একটা কোর্সও শুরু হয়েছে…

সেটা কবে নাগাদ? আর সেখান থেকে স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস-এর প্রতিষ্ঠা—এই যাত্রাটা সম্পর্কে জানতে চাইব।

এই ’৯৮/’৯৯ হবে, আমার সঠিক স্মরণে নেই নির্দিষ্ট বছরটা। পঞ্চাশ নম্বরের অর্ধপত্র চালু হয় সেই কোর্সে।

সে-সময়ে যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভবত ২০০৩ সালে, আমরা যাদবপুরে একটি কনফারেন্স করেছিলাম, ‘টুয়ার্ডস বুক হিস্ট্রি ইন ইন্ডিয়া’, যেখানে প্রথম গন্থের ইতিহাস নিয়ে একটি আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গ্রাহাম শ, যতীন নায়েক, অরুণ সেন প্রমুখরা এসেছিলেন এবং সিদ্ধার্থ ঘোষ সেখানে তাঁর শেষ বক্তৃতা দেন। ওঁরও তো এই ক্ষেত্রে অবদান অনস্বীকার্য, বিশেষত, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং চর্চা, সে-সূত্রে সুকুমার রায়ের বইতে ব্যবহৃত ছবি— এ-নিয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। মূল বিষয় ছিল, ‘আবোল-তাবোল’-এ ব্যবহৃত ছবি। সে-পাণ্ডুলিপির ডামি কপি ওঁর কাছে ছিল, উনি বুঝিয়েছিলেন কীভাবে সুকুমার মৃত্যুশয্যায় ডামি দেখেছিলেন, যে কোনও-কোনও পাতায়, একটা লাইন তলার দিকে ফাঁকা পড়ে যাচ্ছে, যার জন্য তিনি রচনা করেছিলেন চার লাইনের টেলপিস। ডামি হাতের কাছে না থাকলে— এগুলো বোঝা একেবারে অসম্ভব। এই কনফারেন্সের পরে, নতুন করে, বুক হিস্ট্রি নিয়ে কাজ করার একটা উদ্যম আমরা পাই।

কাজ চলছে এসসিটিআরে

স্বপন বাবু আরও একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন, বাংলা মুদ্রণের ২২৫ বছর উপলক্ষে— কয়েকটি প্রবন্ধর সংকলন। ‘অবভাস’ প্রকাশ করেছিল। সেটার প্রথম লেখায় আমি বুক হিস্ট্রি সংক্রান্ত একটা প্রাথমিক সূত্র বা মৌলিক সূত্রের কথা বলেছিলাম। এবং স্বপনদাও ভূমিকায় একটা কথা বলেছিলেন যে, এটার জন্য হাহাকার করে বসে থাকলে হবে না যে, কবে মৌলিক সূত্র বা আর্কাইভস হাতে আসবে। এই চিন্তাগুলো তখন থেকে মনে দানা বাঁধতে থাকে। ঘটনাচক্রে ২০০৩ সালে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস এন্ড রেকর্ডসের প্রতিষ্ঠা। এই উদ্যগের পেছনে ছিলেন, অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী, স্বপন মজুমদার, স্বপন চক্রবর্তী।       

কেন্দ্রীয় ভাবনাটা ছিল এই— যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তখনও একটি নবীন প্রতিষ্ঠান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা উনিশ শতকে গঠিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় তা স্পষ্ট। যাদবপুরের নিজস্ব কোনও আর্কাইভ তখন ছিল না, এবং এই নিয়ে বিশেষ কোনো চর্চাও গড়ে ওঠেনি। যদিও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পাঠদান হচ্ছিল, গবেষণার জন্য ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব বেশি সহায়তা মিলত না। তাদের বেশিরভাগকেই নির্ভর করতে হত বিদেশি আর্কাইভের ওপর। এই অভাববোধ থেকেই জন্ম নেয় ‘স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস’। অনুঘটক হিসেবে যুক্ত হয়েছিল, ডিজিটাইজেশনের চিন্তা-ভাবনা। পাশাপাশি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংগ্রহেই কিছু আর্কাইভস ছিল, যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, রাজ্যেশ্বরী দত্ত প্রমুখর সংগ্রহ। এ-সব নিয়ে কাজ করার জন্য কয়েকটা ধাপ আমাদের পেরতে হবে। সেগুলো গোছাতে হবে, ক্যাটলগিং করতে হবে, মেটাডেটা তৈরি করতে হবে সর্বোপরি সম্ভব হলে ডিজিটাইজ করতে হবে। ডিজিটাল কপিগুলি যাতে সর্বসাধারণের কাছে লভ্য হয়— এসবই কিন্তু যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। তখন ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ থেকে ‘ইউনিভার্সিটি উইথ পোটেনশিয়াল এক্সেলেন্স’— এই প্রকল্পে টাকাও পাওয়া গেছিল। তারপরেই ব্রিটিশ লাইব্রেরির এন্ডেজার্ড আর্কাইভস প্রোগ্রামের সঙ্গে কাজ শুরু হয়। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে আর্কেডিয়া ট্রাস্টের বদান্যতায় আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।

বলা যেতে পারে, ২০০৩/২০০৪ সালের পরে, এখানকার পরিস্থিতির মোড় অনেকটা ঘুরে যায়। এখন অনেকগুলো জিনিস একসঙ্গে এসে যাওয়ার ফলে, ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করার একটা হিড়িক শুরু হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গের যে পাবলিক লাইব্রেরি নেটওয়ার্ক তারা প্রচুর বই ডিজিটাইজ করেছিল। সেখানে একটি মজার ব্যাপার ছিল, প্রত্যেকটি বইকেই তারা অনেক ভাগ করে আপলোড করতেন, কেননা ফোনে ব্যান্ডউইথ তখন কম ছিল। সেগুলো দৃষ্টিনন্দন না হলেও কাজ চালানোর মতো হত। সেটাও গবেষকদের খুব কাজে লেগেছিল বলে আমার মনে হয়।

এসসিটিআরের সঙ্গে আপনি কবে থেকে যুক্ত?

আমি এসসিটিআরের কাজের সঙ্গে প্রথমদিকে যুক্ত ছিলাম না, এখানকার যে মুদ্রণ-প্রশিক্ষণ, এডিট পাবলিশিংয়ের কাজ তার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিছুটা ধারণা ছিল, যে কোন কাজগুলো হচ্ছে এসসিটিআরে, বিশেষ করে শুধু যে পাণ্ডুলিপি, কাগজপত্র তা নয়, গান বা শব্দ— হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি বিরাট আর্কাইভ এখানে নির্মিত হয়েছিল। সেটার অনেকটা অংশই হয়তো অপ্রকাশিত। এরকম অনেক জিনিস গবেষকদের গোচরে আসতে শুরু করে। এগুলো হয়তো তখনও কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির কার্যক্রমে ঢোকেনি, কিন্তু এরকম যে একটা কাজ আমরা করতে পারছিলাম সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পরের প্রশ্নে আসি, বিএ (সাহিত্য) পাঠ্যক্রমে আর্কাইভ-ভাবনা সে-ভাবে প্রবেশ করেনি ঠিকই, তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে অধ্যাপক সুপ্রিয়া চৌধুরীর ‘লিটারেচার অ্যান্ড কালচার অফ স্পোর্ট’ কোর্সে আপনি বাংলার শরীরচর্চার ইতিহাসের ওপর কিছু অবিস্মরণীয় ক্লাস নিয়েছিলেন। সেই থেকে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ জন্মায় আর্কাইভ-ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা করার। এই ধরনের কাজ যে আদৌ সম্ভব, এর আগে আমার সেই ধারণাই ছিল না।

তার কিছুদিন পরেই আমরা জানতে পারি, শরীর চর্চার আর্কাইভ শুরু হচ্ছে এসসিটিআর-এ। ‘সাংস্কৃতিক’ বলতে যা সাধারণত বোঝানো হয়, তা বাদেও এই ধরনের নানা বিষয়ে আর্কাইভ তৈরি করেছেন আপনারা। এ-সমস্ত ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা বা প্রেরণা আসে কোথা থেকে?

সেটা ঠিকই, এসসিটিআরে সেই পরিসরটা ছিল। সাবেকি বিভাগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পাঠক্রম তৈরির একটা তাগিদ থাকে। অন্যদিকে এসসিটিআরে আমরা যে-ভাবে কাজ করেছি, আমাদের ব্যক্তিগত আগ্রহে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করার স্বাধীনতা ও সুযোগ অনেক বেশি ছিল। শরীরচর্চা, যেখানে কুস্তির মতো দেশজ নানা কসরত ছিল, যেটা আমরা জানি— উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে স্বদেশি কার্যক্রমের অংশ ছিল লাঠি খেলা, ছুরি খেলা— তার সঙ্গে-সঙ্গে আবার সার্কাস বা ভারোত্তলন —এগুলোর বহুল প্রচলন এবং সামাজিক দিক থেকে সে-সময়ে এগুলোর গুরুত্ব দেখা হয়নি। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সারস্বত গবেষণা পদ্ধতির অংশ নয় বলেই এগুলোকে সে-ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আবার জনপ্রিয় বা পপুলার কালচার আমরা যাকে বলি, সেখানে এগুলোর একটা স্থান ছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ যেমন সুরেশ বিশ্বাসের উল্লেখ আছে, সার্কাস প্রসঙ্গে। তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে খেলা দেখাতেন, কিন্তু তার বেশি কেউ কিছু জানা যায় না সহজে। এমন নানা প্রবাদপ্রতিম চরিত্র, তাঁরা একেবারেই ব্রাত্য হয়ে রয়েছেন। তার জন্য আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা থেকে সুরেশ বিশ্বাসের উপরে একটা বই বের করেছিলাম, আমরা ‘অস্ত্র শিক্ষা’ বলে একটা বই প্রকাশ করেছিলাম যার জন্য দীপ্তনীল রায় এবং নিখিলেশ ভট্টাচার্য একসঙ্গে কাজ করে, পুলিনবিহারি দাসের প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করেছিল। এসসিটিআরে, এধরনের কাজ করার ক্ষেত্র পাওয়া গেছিল। রায়বেঁশে নিয়ে তোমরা যে কাজটা করেছিলে, এখনও তাঁদের সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ রয়েছে এবং এটা যে শুধু আর্কাইভ বা ঐতিহাসিক কাজ তা নয়; ওঁদের অন্তত দু’বার যাদবপুরে এনে আমরা অনুষ্ঠান করিয়েছিলাম। এখানে বর্তমান ও অতীতের মধ্যে একটা সংলাপ তৈরি হয়েছিল। ফিজিক্যাল কালচারের আর্কাইভের ক্ষেত্রটা অনেক জীবন্ত। আমরা যখন গোবর বাবুর শিষ্য বিশ্বনাথ বাবুর বাড়িতে গেছি, বা মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে গোবর বাবুর আখড়ায়— তোমার নিশ্চয় মনে আছে, বিশ্বনাথ বাবু তখনও নিয়মিত আখড়ায় নামতেন। ফলে এই প্রজেক্টে কিন্তু আমরা অতীত এবং বর্তমান জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, সেটার সমস্ত সম্ভবনা কিন্তু এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এধরনের ‘প্র্যাকটিস বেসড আর্কাইভ’ কিন্তু একটা অন্য ধরনের আবেদন রাখে।

কাজ চলছে এসসিটিআরে

আর্কাইভে সংরক্ষিত জিনিস মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে না পারলে, বাইরের জগতের পক্ষে আর্কাইভের গুরুত্ব উপলব্ধি করা সহজ নাও হতে পারে। বিগত কিছু বছরে শুধু ‘এসসিটিআর’ নয়, আরও নানা আর্কাইভের দিক থেকে আমরা এই ধরণের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। এই পরিবর্তনের কারণ কী হতে পারে? আর এরকম প্রচেষ্টার কোনও উদাহরণ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন…

এটা খুবই ঠিক কথা যে, এসসিটিআরের ব্যাপারে আমরা কিছুটা পিছিয়েই ছিলাম। আমরা আর্কাইভ তৈরি করেছিলাম খুব সযত্নে কিন্তু সেগুলোকে সাধারণের কাছে লভ্য করা আমাদের উচিত ছিল। যেমন হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতের আর্কাইভ, সেগুলো কপিরাইটের কারণে অনলাইন করা যেত না। অন্যান্য উদাহরণ যেমন, এন্ডেঞ্জারর্ড আর্কাইভ প্রোগ্রামের মূল শর্তই হল সেটিকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হতে হবে এবং তা ডাউনলোডসাধ্য হবে। এছাড়া রতন টাটা ফাউন্ডেশনের আওতায় আমরা দু’টি কাজ করেছিলাম, ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা, ‘কবিতা’ পত্রিকা, বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের কিছু মাসিক বিবরণী। সেগুলো সবই আমাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। তবুও, এটা ঠিকই যে শুধুমাত্র গবেষণার পরিসর পেরিয়ে বাইরে আসতে, যেগুলোকে আমরা পাবলিক হিউম্যানিটিস বলি সেগুলিতে আমাদের আসতে একটু সময়ই লেগেছিল।

এসসিটিআরে জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতার পাণ্ডুলিপির প্রদর্শনী

কোভিড পরবর্তী সময়ে, আমরা চেষ্টা করেছি আর্কাইভগুলো সাধারণের কাছে যথাসাধ্য ছড়িয়ে দেওয়ার। আর্কাইভ যে শুধুমাত্র কোনও প্রতিষ্ঠানের বা কোনও সংগঠনের তা নয়, হ্যাঁ, ব্যক্তিগত আর্কাইভও হতে পারে, এবং সেটা আমরা নিজেদের অজান্তে বানিয়ে চলেছি। ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম তো একপ্রকার সেল্ফ-আর্কাইভিং-ই। সবসময়ে যে আমরা সেটা খুব সচেতন ভাবে করছি তা নয়, সেটার উপর অনেকক্ষেত্রেই আমাদের নিয়ন্ত্রণও থাকে না। তবে হ্যাঁ, আর্কাইভ করার প্রবণতা—বলা ভালো সচেতনতা—কিন্তু বাড়ছে। এমনকী অনেক বড়-বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও নিজেদের ইতিহাস সংরক্ষণ করার জন্য আর্কাইভিংয়ের কথা ভাবছেন। আরেকটা দিক হচ্ছে, পাঠক্রমে এর সংযোজন। এনইপি-র অনেক ভাল-খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে, ভাল দিক ডিজিটাল হিউম্যানিটিস বা আর্কাইভিং সংক্রান্ত নানা ভ্যালু অ্যাডেড কোর্স যুক্ত করা। অল্প বয়সের পড়ুয়ারা যেহেতু প্রযুক্তি-স্বচ্ছন্দ, তারা অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজগুলো শিখতে পারছে।

এর পাশাপাশি একটা আর্কাইভ যে গল্পগুলি বলতে পারে কিউরেশনের মাধ্যমে, সেই কাজও তো চলছে। দুই শতকের বাংলার মুদ্রন বা অন্য দিকে রাহি সোরেনের সাঁওতাল হুলের ১৭০ বছর উপলক্ষে প্রদর্শনী…

টু সেঞ্চুরির কথাটা বলে ভাল করলে, অনেকে হয়তো জানেন না, ‘টু সেঞ্চুরিস অফ ইন্ডিয়ান প্রিন্ট’ বলে ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে খুবই ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প ২০১৫/১৬ সালে শুরু করেছিলেন, সেখানে তাঁদের মূল সহযোগী ছিলেন, স্কুল অফ কালচারাল টেক্সট অ্যান্ড রেকর্ডস। এটার উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ লাইব্রেরির সংগ্রহে উনিশ শতকের যত বাংলা বই আছে, যেগুলির কপি শুধু ব্রিটিশ লাইব্রেরিতেই লভ্য, সেগুলি ডিজিটাইজড করা। পাশাপাশি অন্য নানা লাইব্রেরিতে যে-সব দুস্প্রাপ্য বই রয়েছে, সে-রকম অনেক বই ডিজিটাইজ করে আপলোড করা হয়েছিল। সে-কাজটা এখনও চলছে। এ-কাজটা করতে গিয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরি চেষ্টা করেছিলেন, নানা ধরনের পাবলিক আউটরিচকে প্রাধান্য দিতে। ফলে আর্কাইভটা তৈরি হয়ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা বর্তমানে লভ্য নয় কারণ ২০২৩ সালে লাইব্রেরির সাইটে সাইবার অ্যাটাক হয়, সেখান থেকে এখনও তারা রিকভার করতে পারেনি। এ-কারণেই উদাহরণটা দিলাম, ফিজিক্যাল আর্কাইভই যে বিপদাপন্ন তা নয়, ডিজিটাল আর্কাইভও বিপদে পড়তে পারে এবং এখানে এটা ব্রিটিশ লাইব্রেরির মতো এত বড় প্রতিষ্ঠানকে ফেস করতে হচ্ছে। তারা যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে কে নিরাপদ! এই কথাটা অম্লান দাশগুপ্ত অনেক দিন আগে থেকে বলতেন। ডিজিটাল আর্কাইভ কখনও ফিজিক্যাল আর্কাইভের পরিপূরক হতে পারে না। দুটোকেই একসঙ্গে থাকতে হবে।

সাধারণের কাছে আর্কাইভকে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, তখন এই প্রযুক্তিগত বা কৌশলগত দিকগুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে যেমন প্রোজেক্টটার চরিত্র নিজেই বলে দেয়, যে কোনটা এক্সিবিট করা প্রয়োজন। যেমন রাহির ক্ষেত্রে এই প্রজেক্টটা স্কুলে বা অন্যান্য জায়গায় আমাদের নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। অনেকক্ষেত্রে এক্সিবিশন ব্যাপারটা অনেকের নাগালের বাইরে থেকে যায়। কিন্তু ওগুলো যতক্ষণ না আমরা স্কুল বা কলেজের পরিসরে নিয়ে যাব ততক্ষণ সার্বিক সার্থকতা আসবে না।

তবে এখন এ-বিষয়ক নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, পাঠক্রমের অংশও হয়ে উঠছে। পাশাপাশি ইন্টার্নশিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা উঠে আসছে। যা আরও অল্প বয়সে যদি শুরু হয়, মিউজিয়াম বা আর্কাইভ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে। অনেকক্ষেত্রে এখন আর আমরা সরকারের কাছ থেকে ফান্ডিং পাচ্ছি না, সেটা একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে আমরা যে-টাকা পেতাম সে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে রুসা-র মতো প্রকল্পগুলো শুরু হয়, কিন্তু সেগুলো যে খুব সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়, তাও নয়। এমন নানা সমস্যায় অনেক প্রকল্পই মাঝপথে শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে, এসসিটিআরের তিনটি পর্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথমে রাষ্ট্রের অনুদান, তারপরে, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা এবং বর্তমানে অবস্থা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, রীতিমতো ক্রাউডফান্ডিং করতে হয় বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য। যেমন শব্দ-কল্প প্রজেক্টটা সম্পূর্ণ ক্রাউডফান্ড থেকে, বা নিখিলেশ ভট্টাচার্য্যর উদ্যোগে ভারতীয় হকির যে আর্কাইভিং-এর কাজ চলছে, সেটাও।

এই পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় কারণ, এর মধ্যে আমরা হয়তো দেখছে পাচ্ছি আর্কাইভ, নলেজ ও পাবলিকের এক নতুন সম্পর্ক, যেখানে সাধারণ মানুষ—হয়তো কিছুটা এই আউটরিচের ফলে— এই জ্ঞানচর্চাভিত্তিক উদ্যোগের অংশীদার হিসেবে নিজেদের দেখছেন। তার পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি, নানা ধরনের আর্কাইভ তৈরি হচ্ছে, যেগুলিকে পরিচয়ভিত্তিক বলা যেতে পারে— যেমন কুইয়ার আর্কাইভ বা দলিত আর্কাইভ—যা একধরনের সলিড্যারিটির জায়গা হিসেবেও কাজ করছে।

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। যে-মুহূর্তে সাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছি, তারাও প্রকল্পের অংশীদার হয়ে পড়ছেন, আরও একটা দিক, রাষ্ট্রমুখাপেক্ষী যে ভাবনা সেটায় অনেক বদল আসছে, সাধারণের অংশগ্রহণে। এরমধ্যে অনেক ভাল দিক রয়েছে, ফলে নানা নতুন সম্ভবনার দিকও খুলে যাচ্ছে। এমনকী সংজ্ঞাও, কাকে আমরা ‘আর্কাইভ’ বলব এবং সেগুলোকে কীভাবে আমরা ব্যবহার করব— সামগ্রিকভাবে একটা নতুন চিন্তাভাবনা উঠে আসছে। সব ক্ষেত্রেই যে রাষ্ট্রীয় তহবিল বা পরিকাঠামো কাম্য, তাও নয়, কারণ তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের একটা সম্ভাবনাও চলে আসে।

পাশাপাশি, সৃষ্টির সঙ্গে এর যে সম্পর্ক, যেখানে নাটকের মতো আর্টফর্মগুলোরও যে একটা আরকাইভিং ভ্যালু থাকতে পারে, সেই সম্ভবনার বিষয়ে কিন্তু আমাদের সজাগ থাকা উচিত। আবার আর্কাইভ করা বস্তু থেকে যে নতুন সৃষ্টি করা যায়, সেগুলোও দেখা দরকার, যেমন কয়েকদিন আগেই একজন শিল্পীর সঙ্গে কথা হল, যিনি উনিশ শতকের ব্লক প্রিন্টিংগুলো ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস তৈরি করছেন, সেই প্রক্রিয়াগুলোকে নতুনভাবে তাঁর শিল্পের মধ্যে নিয়ে আসছেন।

আশার কথা এই, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে, আর্কাইভ যে সমষ্টিগত ভাবে হতে পারে, পাশপাশি অনেক দৃষ্টিকোণ উঠে আসছে। এর অন্যতম সহায়ক হিসেবে উঠে আসছে প্রযুক্তি। সবচেয়ে বড় কথা, আর্কাইভের ক্ষেত্রে, প্রযুক্তিকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব সেটা সম্পর্কে অবগত হওয়া। আবার, একইসঙ্গে পাঠের যে পক্রিয়া সেটা কীভাবে এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে, সে-বিষয়ে অবগত হওয়াও খুব জরুরি।

ছবি সৌজন্যে: কৌশিক আকী, অমৃতেশ বিশ্বাস, ‘স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস’।