সাক্ষাৎকার: গোবিন্দ বসু

Representative Image

রাজসভার গায়ক ছিলেন। বাংলা গানের জগতে বিস্মৃতপ্রায় নাম, অনাথনাথ বসু। একইসঙ্গে মহিলা ও পুরুষকণ্ঠে গাইতে পারতেন ধ্রুপদী সংগীত। কেমন ছিল তাঁর গানজীবন? কেমনই-বা ছিল সে-সময়ের সংগীত-ইতিহাস? অনাথনাথ বসুর কনিষ্ঠ পুত্র পণ্ডিত গোবিন্দ বসুর সঙ্গে ডাকবাংলা.কম-এর পক্ষ থেকে কথা বললেন সর্বানন্দ চৌধুরী।

অনাথনাথ বসু আপনার বাবা, ছেলেবেলায় তাঁর সঙ্গ, তাঁর থেকে গান শেখার কথা সর্বোপরি অনাথনাথ বসুর জীবনের কিছু কথা যদি ভাগ করে নেন।
আমার বাবা অনাথনাথ বসু ছিলেন রাজসভার গায়ক। রায়গড় স্টেটের রাজা চক্রধর সিং-এর সভায় তিনি গান গাইতেন। সেই সভার অন্য গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজের বাবা ও কাকা— আচ্ছন মহারাজ ও শম্ভু মহারাজ। সেই সভায় তবলাবাদ্যের শিল্পী ছিলেন— পাঞ্জাব তথা ভারতশ্রেষ্ঠ ওস্তাদ ফিরোজ খান সাব। খান সাব-এর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে বাবা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। আমার বাবা তবলাও বাজাতেন। ওস্তাদ এনায়েৎ খাঁ, হাফেজ আলি খাঁর সঙ্গে বাবার সঙ্গত করা রেকর্ডও আছে। সে-সময়ে যাঁরা গান গাইতেন, তাঁরা আগে তবলা শিখতেন।

‘তবলা’ শেখা এত জরুরি কেন হয়ে উঠল?
কারণ তবলার বোল, ছন্দ শেখা ছিল একটা প্রস্তুতি-মঞ্চের মতো, যা শিল্পীকে তাল ও লয়ের সামগ্রিক ধারণা দিত। পণ্ডিত রবিশঙ্করও বলতেন, তালের জন্য আলাদা করে লয়-শিক্ষা খুবই জরুরি। রাজসভায় বাবা তবলা-গান উভয়ই পরিবেশন করতেন। এবং ছিলেন ওই রাজসভার একমাত্র বাঙালি গাইয়ে। বাবার বাংলা গানের গুরু ছিলেন নিকুঞ্জবিহারী দত্ত।

আরও পড়ুন: শৌখিন পান-জর্দার সুবাস ও সহজাত আভিজাত্যে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় যেন ছিলেন সুর-জগতের রাজপুত্র! লিখছেন ঋতচেতা গোস্বামী…

বাবার কাছে শেখার অভিজ্ঞতা কেমন?  
বাবা ছিলেন খুবই নিরীহ, ভাল প্রকৃতির মানুষ। খুব একটা কঠিন হাতে কখনওই কিছু শেখাননি। সে সংগীতই হোক কিংবা লেখাপড়া। মনের সঠিক বিকাশের জন্য একটা ‘ছাড়’ বা স্পেস লাগে সবসময়। সেটা বাবা খুব ভাল করে বুঝতেন। তখন আমার আট-ন’ বছর বয়স, সদ্য ‘ঝাঁপতাল’ আর ‘রূপক’ শিখেছি। রেওয়াজের সময়ে হঠাৎ গেল গুলিয়ে, তখন ভরদুপুর। বাবা ঘুমাচ্ছিলেন, ডেকে তুললাম। একটুও বিরক্ত না হয়ে, ছদ্মকঠিন স্বরে, ‘মাত্রা’ গুনে-গুনে দুই তালের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিলেন। বাবার শেখানোর ভঙ্গিমা কখনওই গুরুগম্ভীর ছিল না।

আপনার বাবার গুরু কারা ছিলেন? তাঁদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন…
আমার বাবার গুরু ছিলেন ওস্তাদ ছোটে খাঁ, তিনি ছিলেন আগেকার দিনের গুরুত্বপূর্ণ সারেঙ্গি-বাদক। সে-সময়ে তবলার পাশাপাশি সারেঙ্গি শেখাও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও বাবার অন্যতম গুরু ছিলেন বেনারসের এক ওস্তাদ লছমিপ্রসাদ মিশ্র। ছোটে খাঁর কাছে মূলত খেয়াল, ঠুমরি ইত্যাদির তালিম নিয়েছিলেন।

বহু স্বনামধন্য শিল্পী তো আপনার বাবার ছাত্র, অনেককেই আপনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁদের কথা কিছু যদি ভাগ করে নেন।
পণ্ডিত সত্যেন ঘোষাল, পণ্ডিত সুখেন্দু গোস্বামী, নচিকেতা ঘোষ, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, ডমরুপাণি ভট্টাচার্য, মানিক পাল, সুবোধ নন্দীর মতো গুণী মানুষ আমার বাবার ছাত্র। পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষও আমার বাবার অন্যতম ছাত্র। প্রায় আঠেরো বছর শিখেছেন। ওঁর নিজের দিদি (মীরা দেবী) আমার বাবার ছাত্রী ছিলেন। কে সি দাসের মালিকের মেয়েও ছিলেন আমার বাবার ছাত্রী। প্রসঙ্গত, আমার দুই দাদা। মেজদা কমল বোস ছিলেন আমির খাঁ-র ছাত্র। আর বড়দা শ্যামল বোস, আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ছাত্র।

আপনার বাবার সঙ্গে চলচ্চিত্র-জগতেরও যোগাযোগও ছিল বলে জানি। সেই ইতিহাসটা কী?  
কলকাতায় আসার পরে, বাবা রাধা ফিল্ম-এ চাকরি করতেন। সে-সময়ের অন্যতম নটশিল্পী ছিলেন তুলসী লাহিড়ী, ভবানী দাস প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গেও বাবা কাজ করেছেন। শুনেছি, একটি ছবিতে যাঁর মহিলাকণ্ঠে গাওয়ার কথা ছিল, তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর হয়ে বাবা স্বছন্দে গানটি গাইলেন এবং সেখান থেকেই ওঁর মহিলাকণ্ঠে গাওয়ার সূত্রপাত। ভারতের একমাত্র শিল্পী, যিনি একসঙ্গে দু’টি কণ্ঠে ধ্রুপদী সংগীত গাইতে পারতেন— তাঁর নাম অনাথনাথ বসু। মহিলাকণ্ঠে ঠুমরি গাইতেন, পুরুষকণ্ঠে গাইতেন খেয়াল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একবার গল্প করেছিলেন,  আকাশবাণীতে ঘোষক থাকাকালীন, একবার বাবার জন্য তাঁর চাকরি যেতে বসেছিল। ঘোষণা করা হল, এবার আপনাদের ঠুমরি গেয়ে শোনাবেন অনাথনাথ বসু। এবারে রেকর্ড যখন চালানো হল, শোনা যাচ্ছে মহিলাকণ্ঠের গান। বিভ্রান্ত শ্রোতাদের ফোনের পর ফোন আসতে শুরু করল দপ্তরে। এই নিয়ে বিরাট হইচই! তখন দেখা গেল অনাথ-ই মহিলাকণ্ঠে গাইছেন। এমনও হয়েছে, বাবার জন্য রায়গড়, লখনঔ, বেনারস থেকে উপঢৌকন হিসেবে শাড়ি-গয়না এসেছে।

অনাথনাথ বসু

আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষর মতো কিংবদন্তির সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের তাঁর সম্পর্কে কিছু যদি বলেন…
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-এর সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল বাবার। ওঁকে বাবা নিজের ভাইয়ের মতন স্নেহ করতেন। যেহেতু নিজের ব্যস্ততার জন্য বাবা আমাদের খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না, সে-কারণে বড়দাকে খুব অল্প বয়সেই জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-এর কাছে তালিমের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় সারারাত রেওয়াজ হত। প্রসঙ্গত, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-এর মতন মানুষ আবার ফিরোজ খান সাহেবের কাছে তবলা শিখেছিলেন। বাবাকে বলেছিলেন, ‘অনাথদা, এঁর কাছে তবলা না শিখলে জীবন বৃথা।’ এদিকে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ, মজিদ খান সাহেবের মতন মানুষের ছাত্র। তা সত্ত্বেও জ্ঞানলিপ্সার জন্য প্রায় পাঁচ বছর ফিরোজ খান সাহেবের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আমিও জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-এর কাছে তালিম নিয়েছি।

আচ্ছা অনাথনাথ বসু তো মূলত বেনারস ঘরানার শিল্পী ছিলেন, সেখানে আপনাদের গুরুর উৎস আলাদা। এক্ষেত্রে এই আলাদা-আলাদা ধারা নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়নি?
বিভিন্ন ঘরানার আঙ্গিক আলাদা, কিন্তু কোথাও গিয়ে সামগ্রিক সংগীত একই সুরে বাঁধা পড়ে যায়। আসলে এক-একটা ঘরানার শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সঙ্গে অন্য ঘরানার শ্রেষ্ঠ শিল্পীর কোথাও যেন মিল আছে। ধরা যাক, দিল্লিতে তবলার উৎস, আবার তবলার সঙ্গে রয়েছে পাখোয়াজের যোগসূত্র। এখন দিল্লির ওস্তাদের কাছে নানা জায়গা থেকে মানুষ এসে শিখছেন, তাঁদের সবার শেখার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অন্যদের ভাবনা ও প্রয়োগ। এভাবেই ঘরানা আলাদ হওয়া সত্ত্বেও সংগীত স্বতন্ত্রতা পায়। আমাদের তিন ভাইদের ক্ষেত্রে যেমন— বাবার বেনারস ঘরানার উত্তরাধিকারের সঙ্গে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-এর শিক্ষার সম্মিলন সমৃদ্ধ করেছে আমাদের সামগ্রিক সংগীত-ধারা।

আপনাদের পরিবারে হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সংগীতের পাশাপাশি বাংলা গানেরও সমান্তরাল চর্চা চলেছে। এ প্রসঙ্গে আপনার সহধর্মিণী শিপ্রা বসুর কথাও অনেকেই অবগত। একটা সময়ে ধ্রুপদী আর আধুনিক গান একইসঙ্গে চললেও, সময়ের নিরিখে দুই ধারার মধ্যে বিরোধ এসেছে, আবার সে বিরোধ মিটেও গেছে। এই বিষয়টিকে আপনার বাবা কীভাবে দেখতেন?  
আমার বাবা রাগপ্রধান গানের পাশাপাশি ‘পুরাতনী বাংলা গান’ও প্রচুর গেয়েছেন। আসলে একটা সময়ে ধ্রুপদী বা রাগপ্রধান সংগীতের সঙ্গে অন্য ধারার গানের বিভাজন করা হত না। এখন যেটা হয়েছে, গানের মধ্যে আলাদা করে ‘ঘরানা’র ছাপটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁর যেটা ভাল লাগছে, তিনি সেটাই গাইছেন। এটা একদিক থেকে ভাল। আমার বাবা বলতেন, সংগীতকে ভালবাসো, সংগীত নিয়ে যাঁরা চর্চা করছেন, তাঁদেরকে ভালবাসো, ওপর দিকে দেখো না, নীচের দিকে দেখো তাহলে মানুষের কথা বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে মানুষের সুর।