ভূত পরিক্রমা

Representative Image

ছোট থেকেই বাঙালিদের মধ্যে ভূত এবং ভয়— এই দুই সত্ত্বাকে এমন ভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, যে ভূতের নাম শুনলেই রামরাম শুরু করতে হয়। একটা সময় এমন ছিল, ‘যেখানে ভূতের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়’ এই প্রবাদেই অভ্যস্ত ছিল বাঙালি। কিন্তু এখন সেই ভূতেদের-ই পণ্য করে চুটিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। প্রাচীন প্রবাদটি পালটে এমন হয়েছে, যেখানে ভূতের ভয়, সেখানেই ব্যবসা হয়!

তবে ভূতেদের নিয়ে ব্যবসা আজকের আমদানি নয়, এর ইতিহাস দীর্ঘ। উৎসও বিদেশের মাটিতে। বাংলা সাহিত্য এবং লোককথায় যে এত ভূতের ছড়াছড়ি, সেই ভূতের দল আজ কিন্তু বেশ লাভবান। তারা বেঁচে থাকলে রীতিমতো রয়্যালটি চেয়ে করে বসত। সিনেমা থেকে সাহিত্য, অডিও স্টোরি থেকে টিশার্ট— ভূতেদের পণ্য করে দিব্যি বিকিকিনি চলছে। সেই সঙ্গে জুড়েছে ঘোস্ট ট্যুরিজমের ব্যবসা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি স্থানে কোনও ভয়ের জায়গা আছে কি না, আর থাকলেও সেই স্থানের সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ঘুরে দেখানোর কাজ এখন রীতিমতো জনপ্রিয়।

আরও পড়ুন: হ্যারি পটারের গগনচুম্বী সাফল্যকে নিজেই কীভাবে নস্যাৎ করলেন জে. কে. রাউলিং? লিখছেন কৃষ্টি কর…

ঘোস্ট ট্যুরিজম হল এমন এক ধরণের ভ্রমণ, যেখানে মানুষ সচেতনভাবে এমন স্থানগুলিতে যান, যেগুলি ঘিরে রয়েছে ভৌতিক গল্প, অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা বা লোকবিশ্বাস। পরিত্যক্ত প্রাসাদ, শ্মশান লাগোয়া পুরনো হাভেলি, দুর্ঘটনাপ্রবণ রাস্তা কিংবা আত্মহত্যার ইতিহাস জড়ানো হোটেল— এই সব জায়গা যেন এক আশ্চর্য টানে ডাকে। যাঁরা সাহসিকতার রোমাঞ্চ খোঁজেন, যাঁদের মনে ভয়ও একধরনের আনন্দ দেয়, তাঁদের কাছেই এই ঘোস্ট ট্যুরিজমের টান সবচেয়ে বেশি। এই ভ্রমণ শুধুমাত্র দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময় পর্যটকেরা রাতে থেকে সেই স্থান বিশেষভাবে অনুভব করেন, শুনে নেন স্থানীয় মানুষদের মুখে গল্প, অংশ নেন গবেষণামূলক অভিযানেও। এই ট্যুরিজম আজ শুধুই কল্পনার খোরাক নয়, বরং ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা খুঁজে নেওয়ার এক সামাজিক ও মানসিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। মানুষের মৃত্যুভয়, অজানা জগতের প্রতি কৌতূহল এবং আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে হাজার-হাজার বছর ধরে এক অন্তর্লীন টান রয়েছে, ঠিক এই কৌতূহলের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে এক বিশেষ ধরনের পর্যটন—ঘোস্ট ট্যুরিজম, যাকে ভৌতিক ভ্রমণ, আতঙ্কভ্রমণ, বা ডার্ক ট্যুরিজম নামেও অভিহিত করা হয়।

এই পর্যটনের সূচনা আধুনিক অর্থে সাতের দশকে হলেও, মূল শিকড় ছড়িয়ে আছে অনেক আগেই। ইউরোপের ভিক্টোরিয়ান যুগে (১৮৩৭–১৯০১) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে প্রাচীন কেল্লা, কবরস্থান, এবং পরিত্যক্ত হাসপাতাল ঘিরে ভূতের গল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। স্পিরিচুয়ালিজম নামে একটি দর্শনের মাধ্যমে আত্মার অস্তিত্ব, মৃত্যুর পর জীবন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। এই সময়েই প্রথম ভূতুড়ে জায়গা ঘিরে মানুষ স্বেচ্ছায় ভ্রমণে যেতে শুরু করে, বিশেষত ব্রিটিশ সমাজে। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী মোড় আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে।

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে ‘ডার্ক ট্যুরিজম’ যার মধ্যে হলোকাস্ট ক্যাম্প, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল, কিংবা ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের স্থানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই ধারার ভেতর থেকেই একটি বিশেষ শাখা হিসেবে গড়ে ওঠে ‘ঘোস্ট ট্যুরিজম’, যেখানে অতীতের করুণ স্মৃতি, কল্পিত ভূত, আত্মা এবং স্থানবিশেষের অভিশাপ ঘিরে আগ্রহ তৈরি হয়। ২০০০ সালের পর থেকে, ইন্টারনেট ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির হাত ধরে ঘোস্ট ট্যুরিজম বৈশ্বিক মাত্রা পায়। ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো ‘মোস্ট হন্টেড প্লেসেস’ নামের টেলিভিশন সিরিজ এই আগ্রহকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর আমেরিকায় ‘ঘোস্ট অ্যাডভেঞ্চারস’(২০০৮) এবং  ‘প্যারানর্মাল স্টেটস’(২০০৭) নামক সিরিজ ঘোস্ট ট্যুরিজমকে মূলধারার বিনোদনের অংশ করে তোলে।

বর্তমানে যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া, রোমানিয়া, এবং ভারত সহ বহু দেশে এই ঘোস্ট ট্যুরিজম একটি প্রতিষ্ঠিত পর্যটনধারা। এটি শুধুমাত্র কল্পনার উপর নির্ভর করে না, বরং ঐতিহাসিক স্থান, লোকবিশ্বাস, এবং সংস্কৃতির এক জটিল মেলবন্ধন তৈরি করে।

ঘোস্ট ট্যুরিজম মানে কি শুধুই ভানগড়ের ধ্বংসস্তূপ ঘুরে বেড়ানো? কাশ্মীরের গুলমার্গের পরিত্যক্ত হোটেল কিংবা কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির ভূতুড়ে করিডোর? আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও তো প্রতিনিয়ত আমরা ‘ভয়ের সফর’-এর মধ্যে দিয়ে যাই। ছোটবেলায় রাতবিরেতে বিছানা ছেড়ে বাথরুম পর্যন্ত যাওয়াটা ছিল এক ধরনের সাহসিক অভিযান। করিডোরের প্রতিটি অন্ধকার কোণে মনে হত কেউ লুকিয়ে আছে। ঘরের জানালায় বাতাসের ধাক্কা যেন কারও নিঃশ্বাস। সে-ভয় কোনও পেইড ঘোস্ট ট্যুরিজমের থেকেও বেশি বাস্তব, বেশি প্রভাবশালী। স্কুলজীবনে হেডস্যারের ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানেই বুক ধড়ফড়। ‘যদি ডাকে!’, ‘যদি শাস্তি দেয়!’— এই সব আশঙ্কাই একধরনের অলৌকিক ভয়ের জন্ম দেয়। প্রিন্সিপালের চেয়ারে বসা মানুষটা যেন আধা-দৈত্য। পরে সেই ভয়ের রূপ বদলায়, কিন্তু আতঙ্ক যায় না। প্রেমজ জীবনে সেই ভয় আরও সূক্ষ্ম, আরও মারাত্মক। প্রিয় মানুষটি হঠাৎ ফোন ধরছে না, মেসেজ সিন হয়েছে কিন্তু রিপ্লাই আসেনি। মনে হয়—‘এই বুঝি সব শেষ!’ প্রেমের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে পরিত্যাগের এক অন্ধকার করিডোর, যার প্রতিধ্বনি সারারাত ঘুমোতে দেয় না। ব্রেকআপ শব্দটা একটা ভূতের মতো মনের কোণে ঘুরে বেড়ায়।

অফিসে ম্যানেজারের ঘর— আরেকটা ভূতুড়ে স্থান। বিশেষ করে সেলস টার্গেট পূরণ না হলে বা কাজে ভুল হলে যখন ডাকা হয়। দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার মুহূর্তটা যেন ঠিক কোনও হানাবাড়িতে প্রবেশ করার মতো, চোখে মুখে সৌজন্য, ভেতরে রক্তচাপ চরমে। কেউ-কেউ দিনরাত ভয় পায় হাউজিং লোনের ইএমআই-এর টাকা সময়মতো জোগাড় করতে না পারলে কী হবে সেই চিন্তায়। বাচ্চার স্কুল ফি, পরিবারের চিকিৎসা খরচ, বাজারদর— সবই যেন একেকটা অদৃশ্য ভূতের মতো আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। ভয়ের সঙ্গে বসবাস করতে-করতে মানুষ ভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েও পড়ে। তাই তো ঘোস্ট ট্যুরিজম নামের বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতা আমাদের এত টানে।

ভারতের বহু প্রাচীন স্থানেই লোককথা ও কিংবদন্তি জড়িয়ে রয়েছে যা ঘোস্ট ট্যুরিজ়মের অনুকূল ভূমি তৈরি করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ভারতের তরুণ প্রজন্ম এবং কনটেন্ট চালিত ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহে এই ধারাটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ইন্ডিয়া টুডে-র ২০২৫ সালের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কেরালার পাহাড়ঘেরা সড়ক থেকে রাজস্থানের ফাঁকা কেল্লা— সব জায়গাতেই ভূত-পেত্নীকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে ঘোস্ট ওয়াক, হন্টেড ট্রেইলস এবং মুভি-ইনস্পায়ার্ড সফর। এক সমীক্ষা বলছে, ১৮–৩৫ বছর বয়সি প্রায় ৬২% ভারতীয় শহুরে পর্যটক ভূতুড়ে জায়গা দেখতে আগ্রহী। সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারযোগ্য ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বা অদ্ভুত দৃশ্যই এই আগ্রহের পেছনে অন্যতম কারণ।

ভারতের ভূতুড়ে পর্যটনের মানচিত্রে কিছু নাম বহুল পরিচিত। রাজস্থানের ভানগড় ফোর্ট সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে কুখ্যাত ভূতুড়ে স্থান, যেখানে ভারত সরকারের পক্ষ থেকেই প্রবেশের উপর সূর্যাস্তের পর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই দুর্গকে ঘিরে বহু লোককাহিনি রয়েছে, যেখানে এক তান্ত্রিকের অভিশাপের কথা বলা হয়, যার জেরে গোটা নগরী ধ্বংস হয়ে যায়। কার্শিয়ংয়ের ডাউ হিল এলাকায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুলের কাছে এক শিক্ষিকা খুনের গল্প স্থানীয়দের মুখে-মুখে ফেরে, এবং আজও সেখানে নিঃসঙ্গ পায়ের শব্দ শোনা যায় বলে দাবি অনেকের। পুনের শানিবারওয়াড়া দুর্গে ১৭৪০ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি বহন করে কিশোর রাজকুমার নারায়ণ রাওয়ের আত্মার আর্তনাদ নাকি এখনও শোনা যায়। রাজস্থানের কুলধারা গ্রাম হল আরও একটি রহস্যময় স্থান ১৮২৫ সালে এই গ্রামটি রাতারাতি জনশূন্য হয়ে যায়, এবং লোককথা অনুযায়ী, গ্রামবাসীরা অভিশাপ দিয়ে চলে যায় যাতে আর কেউ এখানে বসবাস করতে না পারে।

২০১৯ সালে ইন্ডিয়া টুডে-র রিপোর্ট অনুসারে, প্রতি বছর প্রায় ৮-১০% ভৌতিক স্থানে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান, নিমতলা শ্মশান কিংবা কার্শিয়ংয়ের ডাউ হিল— এই জায়গাগুলোতে ভৌতিক পরিবেশে ঘোরার জন্য ট্যুর প্যাকেজ পর্যন্ত চালু হয়েছে। এই বাণিজ্যিকীকরণের নেপথ্যে রয়েছে মানুষের  উত্তেজনার চাহিদা এবং ডিজিটাল মিডিয়ার প্রচার। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এবং হরর ব্লগ বা পডকাস্টগুলো ভূতের প্রতি কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছে। পর্যটন মন্ত্রণালয় পর্যন্ত একে ‘থিম ভিত্তিক ট্যুরিজম’-এর মধ্যে রাখতে শুরু করেছে। ফোর্বস ইন্ডিয়ার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতে প্রচলিত ট্যুরিজমের বাইরে থাকা অভিজ্ঞতা নির্ভর ভ্রমণ বাজার বছরে প্রায় ২০% হারে বাড়ছে, যার মধ্যে ঘোস্ট ট্যুরিজম একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। কলকাতার একটি জনপ্রিয় ট্যুর কোম্পানি ‘অদ্ভুত অভিযান’ বছরে প্রায় ৪০-৫০টি ঘোস্ট ট্যুর পরিচালনা করে থাকে এবং প্রতি ট্যুরে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ২০-৩০ জনের বেশি হয়। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটনধারার নাম ‘ঘোস্ট ট্যুরিজম’ বা ‘ভূত পর্যটন’।

চেন্নাই ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস-এর ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে অন্তত ২ হাজারের বেশি পর্যটক ভারতের বিখ্যাত হন্টেড লোকেশনে ঘোরার প্যাকেজ নিচ্ছেন, যার মধ্যে ভাঙা দুর্গ, প্রাসাদ ও শ্মশানঘাট অন্যতম। দেরাদুনের স্যাভয় হোটেল, রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি কিংবা নিমতলা শ্মশান এই ঘোস্ট ট্যুর গন্তব্যগুলির মধ্যে অন্যতম।

অন্ধকার ইতিহাস, ভৌতিক কাহিনি ও ভীতিকর অভিজ্ঞতা পেতে উৎসাহী এক শ্রেণির মানুষ আজ এই পর্যটনের প্রতি আকৃষ্ট। বিশ্বজুড়ে এই ভূতভিত্তিক পর্যটনশিল্প বর্তমানে এক বিশাল অর্থনৈতিক পরিসরে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্ব পর্যায়ে ঘোস্ট ট্যুরিজমের বাজারমূল্য বর্তমানে প্রায় ৮.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বিশেষজ্ঞদের মতে এটি ২০২৮ সালের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের বহু ঐতিহাসিক দুর্গ, পুরনো হাসপাতাল, কবরস্থান ও পরিত্যক্ত খনি এখন পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য। শুধু আমেরিকার সালেম শহরে বছরে প্রায় ১ লক্ষের বেশি ঘোস্ট-ভিত্তিক পর্যটক আকর্ষণ করে, যার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যটন দপ্তর ৬ কোটি ডলার উপার্জন করে। ভারতের ক্ষেত্রেও এই ট্রেন্ড ধীরে- ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে ভারতীয় ঘোস্ট ট্যুরিজম খাতে আর্থিক প্রবাহ ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। চেন্নাই ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস-এর ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে অন্তত ২ হাজারের বেশি পর্যটক ভারতের বিখ্যাত হন্টেড লোকেশনে ঘোরার প্যাকেজ নিচ্ছেন, যার মধ্যে ভাঙা দুর্গ, প্রাসাদ ও শ্মশানঘাট অন্যতম। দেরাদুনের স্যাভয় হোটেল, রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি কিংবা নিমতলা শ্মশান এই ঘোস্ট ট্যুর গন্তব্যগুলির মধ্যে অন্যতম। ২০২৪ সালে কলকাতা পুরসভার পর্যটন দপ্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়, এই ধরনের ট্যুর থেকে বছরে প্রায় ৮৫ লক্ষ টাকার রাজস্ব আয় হচ্ছে, যা ক্রমবর্ধমান। ভূতের প্রতি মানুষের কৌতূহল, রহস্যের মোহ এবং সাহসিকতার পরীক্ষা— এই তিনটি মনস্তাত্ত্বিক উপাদানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে  ঘোস্ট ট্যুরিজম। আজ ভূতের ভয় শুধুই গল্পে সীমাবদ্ধ নয়, তা একটি লাভজনক শিল্প হয়ে উঠেছে। লোকবিশ্বাস, সাহিত্যের রস, ডিজিটাল দুনিয়ার কল্পনা এবং পর্যটননীতির চাতুরী মিশিয়ে ভয়ের বাজার এর অর্থনীতি আজ বাস্তবের মঞ্চে এক বিরাট রূপ নিয়েছে।

অনীক দত্তের দুটি আলোচিত বাংলা ছবি— ‘ভবিষ্যতের ভূত’ এবং ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’— ঘোস্ট ট্যুরিজম বা ভূতভিত্তিক পর্যটনের ধারণাকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছবিতে আমরা দেখি, একটি পরিত্যক্ত থিয়েটার হলে একদল ভূতের বাস, যারা তাদের হারানো শিল্প ও সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণে রত। এই থিয়েটার হলটি একসময়ে জমজমাট ছিল, কিন্তু আধুনিক সময়ের ব্যস্ততায় তা বিস্মৃতপ্রায়। ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে উঠে আসে এই ভূতদের থিয়েটার ভবনটিকে রক্ষা করার সংগ্রাম, যেখানে সেটিকে ভেঙে আধুনিক শপিং মল বানানোর ষড়যন্ত্র চলেছে। এই সিনেমা প্রশ্ন তোলে— ভূতেরা কেবল ভয় দেখানোর জন্য না কি তারা আমাদের স্মৃতি, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ধারকও হতে পারে? এই প্রেক্ষাপটে সিনেমাটি ভূতুড়ে জায়গা ঘিরে তৈরি পর্যটন, বা ‘ঘোস্ট ট্যুরিজম’-এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা হাজির করে। অন্যদিকে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছবিতে একটি পুরনো বনেদি বাড়িকে কেন্দ্র করে গল্প এগোয়, যেখানে একে-একে ভিন্ন-ভিন্ন সময়ের ভূতেরা বাস করে। এই বাড়ি যেন এক স্মৃতি-সংগ্রহশালা— যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর কৌতুক মিলেমিশে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করে। এই ছবিতেও পুরনো ভৌতিক বাড়ি ঘিরে কৌতূহল, মানবিকতা এবং দর্শনের যে বুনন, তা প্রকৃতপক্ষে ঘোস্ট ট্যুরিজমের একটি উপাদান হয়ে ওঠে— যেখানে দর্শক শুধু ভয় নয়, ইতিহাস ও স্মৃতির অভিজ্ঞতা নিতে চায়। এই দুই সিনেমাই বাংলা চলচ্চিত্রে ভূত বা অতিপ্রাকৃতকে ভয় ও হাসির বাইরেও, একটি ঐতিহাসিক, পর্যটন-উপযোগী এবং নস্ট্যালজিক আবহে উপস্থাপন করে।

যতই ঘটা করে ভৌতিক সফরের প্রতি আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি না কেন, দিনের শেষে আমাদের চলার পথটাও একটা ঘোস্ট ওয়াক। কখন যে কী হয়, কে জানে। প্রতিটা মুহূর্ত একটু-একটু করে এগিয়ে চলে। ট্রেন ছুটে যায় নিজের গতিতে, ফেরার চিন্তা কাঁধে নিয়ে কত কেউ ভীত থাকে দিনরাত। অথবা চিংড়িঘাটা ক্রসিং এলেই মনে হয় থেমে গেল জীবনের গতি। কতক্ষণ জ্যামে আটকে থাকতে হবে কে জানে। হয়ত ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে। প্রেমিকা অপেক্ষা করতে-করতে ফিরে যাবে। সিনেমাটা শুরু হয়ে যাবে। প্রথম দৃশ্যটা মিস হয়ে যাবে। ভয়, ভয়ের সফরের মধ্যে দিয়েই তো বেঁচে থাকা।