বিশ্বভুবনের আলো

Representative image

‘বিষ্ণোঃ পদে পরমে মধ্ব উৎসঃ’ বা বিষ্ণুর পরমপদে মধুর উৎস। অশ্বিদ্বয়, উষা, সবিতা, ভগ, সূর্য, পূষা, বিষ্ণু— ঘন অন্ধকার থেকে মধ্যগগন পর্যন্ত সূর্যের এই সাতটি পদক্ষেপ, যে ভাবনার কঙ্কাল আজও টিকে আছে বিয়ের সপ্তপদী অনুষ্ঠানে। মধ্য-আকাশের সবচেয়ে আলোকিত সূর্যই বিষ্ণুর পরমপদ। বেদের মতানুযায়ী, এই পরমপদেই আছে মধুর উৎস। তাই আলো বেদে প্রত্যক্ষ দেবতা। শ্রুতি বলছেন, ‘আমি কিছুই জানতাম না; কিন্তু বিশ্বের অধিপতি, ভুবনের রাখাল সেই ধ্যানী, আমাতে আবিষ্ট হলেন। তখন আমি জানলাম।’ ঋগ্বেদের অনুক্রমণিকা-কার কাত্যায়নের  মতে ‘এক মহান্‌ আত্মাই দেবতা হয়েছেন। তাঁকে বলে সূর্য। তিনি সর্বভূতের আত্মা। অন্য দেবতারা তাঁর বিভূতি।’ আবার— ‘যোঽসাবসৌ পুরুষঃ সোঽহমস্মি’ (ঈশ-১৬) অর্থাৎ, ‘ওই ওই যে পুরুষ আমি হচ্ছি সেই।’ সুতরাং, যে পুরুষ (person) ওই সূর্যে সেই পুরুষই এইখানে, আমাতে। সুতরাং, বৈদিক ঋষির লক্ষ্য সূর্যের সঙ্গে বা আলোর সঙ্গে সাযুজ্যলাভ। আর এই সাযুজ্য-ভাবনা থেকেই বৈদিক যজ্ঞ উদ্ভূত হয়েছে। 

তাহলে সূর্যের প্রত্যক্ষ দেবতা হওয়ার দু’টি কারণ পাওয়া গেল— ১) সূর্যের আলোর আবেশেই আমাদের জ্ঞান ফুটছে, ২) এই জ্ঞান আমাকে যজ্ঞ কর্মে প্রচোদিত করছে। 

আরও পড়ুন : অন্ধকারকে কীভাবে চিনিয়েছিলেন বিবেকানন্দ তাঁর কালী-ভাবনায়? লিখছেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য…

আলোর আবেশ

বেদ অনুযায়ী, কোনও একটা বিষয়ের জ্ঞান তিনটি ভূমি থেকে নেমে আসতে পারে। প্রথম ভূমি হল, জড় ভূমি, বেদের ভাষায় অধিভূত (phenomenal বা material)। যেমন, চোখ মেলতেই আলো দেখছি। এটি হল আলোর ভূতগুণ। কিন্তু সেই আলোতে আমার চিত্তে যে স্বচ্ছতা বা প্রসন্নতার আবির্ভাব হল, এই যে অবাক হয়ে আমি ভাবলাম, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর’— তাও জ্ঞানের আরেকটা দিক। বলতে পারি, যেন বাইরের আলো ভেতরে ফুটল। এই যে ভেতরের আলোর জ্ঞান, একে বলা হয় অধ্যাত্ম (psychical) ভূমির জ্ঞান। বলাই বাহুল্য, অধিভূত ও অধ্যাত্ম-জ্ঞানের মধ্যে একটা সাযুজ্য আছে। বস্তুত, বাইরে-ভেতরে তত্ত্বের একতা না থাকলে কোনও জ্ঞানই সম্ভব হয় না। তাই বেদান্তী বলেন, বিষয়ী চৈতন্য আর বিষয়-চৈতন্যের একাত্মতাই জ্ঞান। এখন যদি এই অধ্যাত্ম জ্ঞানের দিকে জোর দেওয়া যায়, তবে স্বাভাবিকভাবেই বিষয়ের থেকে প্রাধান্য পাবে বিষয়ের সংযোগে উন্মেষিত চেতনা। অর্থাৎ, বাইরের অধিভূত আলো দেখে অন্তরে যে অধ্যাত্ম আলো ফুটল, চিত্তকে অন্তর্মুখ করে যদি তাতে নিবিষ্ট হওয়া যায়, তবে  বিষয়ী ও বিষয়— উভয়কে কুক্ষিগত করে এক ব্যাপ্তিচৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে। এই ব্যাপ্তিচৈতন্যই দেবতা আর এই ভূমির জ্ঞান অধিদৈবত (spiritual)। লক্ষ্যণীয়, ‘ব্রহ্ম’ শব্দের সহজ অর্থ, ‘যিনি বাড়ছেন’ অর্থাৎ, চিরবর্ধিষ্ণু চেতনা বা চৈতন্যের বিস্তার (expansion of consciousness)। তাই শ্রুতির দিক থেকে দেখলে আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য, নিজেকে বড় করে পাওয়া। ব্যাপারটা অত্যন্ত সাধারণ অভিজ্ঞতার বিষয়। বাহ্যপ্রকৃতির সংস্পর্শে প্রত্যেক কবিচিত্তেই এই ধরনের একটা উদ্দেপনা জাগে। রবীন্দ্রনাথে গানে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। বস্তুত ‘দেবতা’ শব্দটি ‘দিব্‌’ ধাতু থেকে উৎপন্ন যার অর্থ ‘দীপ্তি দেওয়া’ বা ‘ঝলমল করা’। যাস্কের নিরুক্তি অনুযায়ী, দিব্‌, দিবা, ও দেব— এই তিনটি শব্দেই একই ভাবনার প্রকাশ আর সে-ভাবনা হল আলোর ভাবনা। পরাক্‌ (objective) দৃষ্টিতে যা আলো, প্রত্যক্‌ (subjective) দৃষ্টিতে তাই বোধ। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয় দিয়ে যাকে বাইরে বস্তুরূপে অনুভব করছি, ভেতরে বোধি দিয়ে তাকেই অনুভব করছি চিদ্‌বৃত্তি রূপে।  ‘বোধ’ শব্দটি ঋগ্বেদে নেই, তার জায়গায় আছে ‘বুধ’, অর্থ ‘জেগে ওঠা’। অতএব দেবতার অর্থ যে, ‘সজাগ ঝলমলে চেতনা’— তা বেশ বোঝা যায়। অতএব, আলো-ঝলমলে চৈতন্যই দেব-চৈতন্য, তিনি আবার ‘বিশ্বভূ’। বিশ্বের রূপে রূপে তাঁর প্রতিরূপ। শ্রুতি বলছেন, ‘রূপং রূপং মঘবা বোভবতী মায়াঃ’ অর্থাৎ, ‘রূপে রূপে মঘবা নিজেকেই ফুটিয়ে তুলছেন— তাঁর আপন তনুর চারিদিকে বিচিত্র মায়ার জাল রচনা করে।’ এইভাবেই নিজেকে বড় করে পেয়ে ইতরার পুত্র মহিদাস ঐতরেয় তার রচিত আরণ্যকে বলেন, ‘আমি আমাকে জেনেছি দেবগণ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত আর দেবগণ-কে জেনেছি আমা পর্যন্ত অনুব্যাপ্ত।’ অর্থাৎ, নিখিল অস্তিত্বের কেন্দ্রে আমি আর পরিধি দেবগণ। আমিই দেবতা, দেবতা-ই আমি। ঋক বেদে আছে, ‘এবা মহান বৃহদ্দিবঃ অথর্বা বোচেৎ স্বাততন্বমি প্রমেব’ অর্থাৎ, ‘এমনি করে মহান অথর্বা বৃহদ্দিব নিজের তনুকেই ইন্দ্র তনু বলে ঘোষণা করলেন।’ অনুক্রমণিকা-কার বলেছেন, এই মন্ত্রগুলি দেবস্তুতি নয়, ‘আত্মস্তুতি’। আধুনিক পণ্ডিতরা একে বলেন, ‘mystic participation’ বা ‘অতীন্দ্রিয় সাযুজ্যবোধ’। ঐতরেয় আরণ্যকে আছে— ‘য়োঽহং সোঽসৌ য়োঽসৌ সোঽহম্’ অর্থাৎ, ‘এই যে আমি সে ওই আর ওই যে সে, সে আমি।’ সাদা বাংলায়, ‘তুমি আমার আমি তোমার’— এই হল ‘আত্মস্তুতি’ বা অতীন্দ্রিয় সাযুজ্যবোধের মর্মরহস্য। কিন্তু আমাদের দুর্দশাগ্রস্থ চিন্তা ‘আমি’ ও ‘আমার’ ছাড়া এগোতে পারে না। একে বলা যায়, ‘দুষ্টচক্র’ বা ‘vicious circle’। সবই আমি ও আমরা নই, তুমি ও তোমরাও আছে— এই চিন্তা করতে শিখতে হয়। তাই সরহ পাদ তাঁর একটি দোঁহায় বলেছেন, ‘এই হল আপন আর এই হল পর—যারা এইভাবে পরিভাবনা করে, তারা বিমুক্ত নিজেকে বিনা দড়িতে বেঁধে ফেলেন’ (এহু সো অপ্পা এহু পরু জো পরিভাবই কোবি।/ তেঁ বিনু বন্ধে বেট্‌ঠি কিউ অপ্প বিমুক্কউ তো বি।।)। সুতরাং, ধর্ম যখন ‘আমরা-ওরা’-র বিভেদ শেখায়, তখন বুঝতে হবে, ধর্মের নামে অধর্মের চাষ শুরু হয়েছে। 

আলোর আবেশে জ্ঞানের ফুটে ওঠার একটি চমৎকার মন্ত্র আছে ঋগ্বেদে, সেটি হল— ‘যত্রা সূপর্ণ অমৃতস্য ভাগমনিমেষৎ বিদথাভিস্বরন্তি।/ ইনো বিশ্বস্য ভূবনস্য গোপাঃ সম ধীরঃ পাকমত্রা বিবেশ।।’ অর্থাৎ, ‘যেখানে সুপর্ণ বৃহৎস্বরজ্যোতির সঙ্গে অমৃতের অংশভাক গ্রহণ করতে করতে অনবরতঃ গমন করছেন, ইনিই বিশ্বভুবনের গোপ বা রাখাল, তিনি ধীরভাবে পাকের মধ্যে আবিষ্ট হয়ে তার মনীষা জাগিয়ে তোলেন।’

বেদ অনুযায়ী, কোনও একটা বিষয়ের জ্ঞান তিনটি ভূমি থেকে নেমে আসতে পারে। প্রথম ভূমি হল, জড় ভূমি, বেদের ভাষায় অধিভূত (phenomenal বা material)। যেমন, চোখ মেলতেই আলো দেখছি। এটি হল আলোর ভূতগুণ। কিন্তু সেই আলোতে আমার চিত্তে যে স্বচ্ছতা বা প্রসন্নতার আবির্ভাব হল, এই যে অবাক হয়ে আমি ভাবলাম, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর’— তাও জ্ঞানের আরেকটা দিক। বলতে পারি, যেন বাইরের আলো ভেতরে ফুটল।

সূর্য একটি সুপর্ণ পাখি এই ভাবনাটি নানা বৈদিক ঋকে পাওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্যে পাখি, ‘উর্দ্ধাভিসারী চেতনার প্রতীক’। অগ্নি-চয়নের জন্য যজ্ঞের বেদির যে আকার দেওয়া হয়, তাও পাখির। অন্য ঋকে দেখি, এই সূর্য ‘হংসঃ শুচিষ্য’ (ঋক-৪/৪০/৫), তার কিরণ নেমে এসেছে জীবের মধ্যে, তাই জীবও হংস। ‘উর্দ্ধাভিসারী’ চেতনা যেন পাখির মতো উড়ছে বৃহৎস্বরজ্যোতির সঙ্গে। ‘স্বঃ’ শব্দটির প্রাচীন সংজ্ঞা, ‘জ্যোতির্ময় অনুভব’। বাইরে যা আদিত্যের জ্যোতি, ভেতরে তাই  বৃহৎস্বরজ্যোতি। প্রত্যক্‌দৃষ্টিতে যার অর্থ হয়, আত্মচেতনাকে (Individual Consciousness) এক অতীন্দ্রিয় অথচ বুদ্ধিগ্রাহ্য লোকোত্তর চিন্ময় (Cosmic Consciousness) ভূমিতে উত্তীর্ণ করা। ‘স্বর’ শব্দটির অর্থ, আলো ও সুর দুই-ই হয়। তাহলে বৃহৎস্বরজ্যোতির অর্থ করা যায় ‘সুরের আলো’। অর্থাৎ, এই বিশ্বভুবনের যিনি রাখাল, তিনি ‘ধীর’। বস্তুত, তিনি যেন ‘আলোর সুরের হানা’-য় ‘পাক’-এর মধ্যে আবিষ্ট হচ্ছেন। ‘ধীর’ বৈদিক পারিভাষিক শব্দ, যার অর্থ ‘চিকিত্বাণ’ বা বিদ্বান, ক্ষেত্রবিদ অথবা কবি। আর ‘পাক’ শব্দের অর্থ, ‘মনসা অবিজানন্‌’ অর্থাৎ, যার মনীষা বা বোধি জাগেনি, সে এখনও মুগ্ধ বা মূঢ়— জানে না। তাই এই কথা বলাই যায় যে, এই বিশ্বভুবনের রাখাল তাঁর কবিত্বশক্তির আবেশে অবোধকে সম্বুদ্ধ করে তুলছেন, সে বলে উঠছে, ‘ওরে আজ কি গান গেয়েছে পাখি এসেছে রবির কর।’

যজ্ঞের প্রচোদনা

ঋগ্বেদের পুরুষসুক্তে (১০/৯০) বলা হয়েছে, যজ্ঞ থেকেই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। সেই যজ্ঞ আদিম দেবযজ্ঞ। সে-যজ্ঞে দেবতারা পরমপুরুষকেই পশুরূপে যূপে বাঁধলেন, তিনি হলেন যজ্ঞের হবি। তাঁকে আহুতি দেওয়া হল যজ্ঞের আগুনে। এই আত্মোৎসর্গের ফলে তিনিই সহস্রশীর্ষ সহস্রাক্ষ সহস্রপাৎ বিরাটরূপে আবির্ভূত হয়ে এই ভূমিকে আবৃত করে দশ আঙুল ছাপিয়ে গেলেন। দেবযজ্ঞের অনুসরণেই মানুষ যজ্ঞ। দেবতা আত্মাহুতি দিয়ে নিচে নেমে আসেন, আর মানুষ আত্মাহুতি দিয়ে দেবতার দিকে বা সজাগ, ঝলমলে চেতনার দিকে উঠে যায়।

‘যজ্ঞ’ শব্দটি ‘যজ্‌’ ধাতু থেকে এসেছে। ‘যজ্‌’ ধাতুর দুটি অর্থ— একটি ত্যাগ, উৎসর্গ, সমর্পণ; আর একটি ভাবনা। মীমাংসক বলেন, দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্যত্যাগই যজ্ঞ। ‘দ্রব্য’ অর্থ আহুতির দ্রব্য। এই আহুতির দ্রব্যের স্বরূপ কী? ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, আহুতির দ্রব্য হল ‘নিষ্ক্রিয়’ বা প্রতিনিধি। কার প্রতিনিধি? যজমানের প্রতিনিধি। অর্থাৎ, নিজেকেই আহুতি দিতে হবে। কিন্তু বেঁচে থাকতে তো তা সম্ভব নয়, তাই মনন দিয়ে এই সমর্পণের সাধনা চলে। বাইরের আগুনে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে পুরোডাশ প্রভৃতি আহুতি দেওয়া হয়। সমর্পণের এই ভাবটি জাগিয়ে রাখার জন্য যজমান সারা জীবন এমনি করে আহুতি দিয়ে যায়, একে বলা হয় ইষ্টি যজ্ঞ। তার শেষ আহুতি হবে মরণের পর দেহটিকে চিতায় তুলে দিয়ে। সেই হবে অন্ত্যেষ্টি বা তার শেষ সমর্পণ। এই অবিরাম উৎসর্গের সাধনাই হল যজ্ঞের ক্রিয়ার দিক। 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এর সঙ্গে সূর্যের সম্পর্ক কী? সম্পর্ক অতি গভীর, এই সাদা চোখেই স্পষ্ট দেখা যায়, আমার দেবতা সূর্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নিজেকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে এই বিশ্ব-প্রাণ জাগিয়ে তুলছেন। তিনি নিজেকে দিয়েছেন বলেই প্রাণ জেগেছে। তাই আগুন জ্বালিয়ে রাখতে কিংবা প্রাণ টিকিয়ে রাখতেও কিছু দিতে হয়। কিছু না দিলে মহাবিশ্বে প্রাণ টেকে না। তিনি যা, আমাদেরও ঠিক তাই হতে হবে। হতে হবে পুরোপুরি কোনও দিককে ছেঁটে ফেলে বা এড়িয়ে গিয়ে নয়। দিতে দিতেই তাঁকে পেতে হবে— এই হল জীবের নিয়তি। তাঁকে পাওয়া আর নিজেকে বড় করে পাওয়া একই কথা— কারণ আমার মাঝে তো সেই সূর্যেরই প্রকাশ।  

এ তো গেল ক্রিয়ার দিক, তবে ভাবনার দিক থেকে যজ্ঞ কেন? বেদ বলছেন ‘দেবায় জন্মনে’ বা চিন্ময় হয়ে জন্মানোর জন্য। কীভাবে চিন্ময় বা দিব্য জন্ম হয়? যজুর্বেদকে কর্মবেদ বলা হয়, কারণ  যজ্ঞের যাবতীয় আহুতি-কর্ম এই বেদের মন্ত্রেই সম্পন্ন হয়। সেই যজুর্বেদের শুরুতেই বলা হয়েছে— ‘ইষে ত্বা ঊর্জে ত্বা’। ‘ইষ্‌’ অর্থ এষণা, আর ‘ঊর্জ’ অর্থ, মোড় ফেরানোর শক্তি। বলাই বাহুল্য, এর মধ্যে শক্তি-প্রয়োগের দ্বারা প্রবৃত্তির মোড় ফেরানো বা রূপান্তরের একটা ব্যঞ্জনা আছে। যেহেতু এখানে-ওখানে বা মানুষে-দেবতায় কোনও ভেদ নেই, ভেদ নেই স্বরূপ-সত্তায়, ভেদ নেই তাদের ধাতুপ্রকৃতিতে— তখন এই মর্ত্যজীবনের দিব্য রূপান্তর সম্ভব, সম্ভব এই জড়দেহেই পূর্ণ চৈতন্যের দীপ্তি। অতএব যজ্ঞ হল এমন এক আত্মসংস্কৃতি, যার মধ্য দিয়ে মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মোড় ফিরিয়ে, দিতে দিতে সবকিছু পায়। 

কিন্তু দিতে কে চায়? মানুষ তো চায় শুধু নিতে। বর্তমান সময়ের নরমেধ যজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে  মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যে স্বার্থপরতা, সাম্প্রদায়িকতা, আগ্রাসন, নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা— সে-কথা বোঝার জন্য এরিক ফ্রমের ‘The Anatomy of Human Destructiveness’ পড়ার কোনও দরকার নেই। সন্ধেবেলা বা প্রাইমটাইমে টিভি খুলে বসলেই জানা যায়। এরিক ফ্রম বলেন, প্রাকৃতিক ক্রমবিকাশজনিত কারণেই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে হিংসা, নৃশংসতা ইত্যাদি। তার এই বই-এর ভুমিকায় তিনি একটি সমীকরণের সাহায্যে দেখান, Destructiveness and cruelty is identical with biologically adaptive aggression therefor destructiveness and cruelty are innate to human nature. তবু ব্যাসদেব থেকে চণ্ডীদাস সকলেই বলেছেন— মানুষের থেকে শ্রেষ্ঠতর আর কিছুই হতে পারে না। শ্রীঅরবিন্দ তাঁর মহাকাব্য ‘সাবিত্রী’-তে অনুপম ভঙ্গিতে লিখেছেন— ‘He is the crown of all that has been done/ Thus is creation’s labour justified/This is the world’s result/Nature last poise.’ কারণ তারা প্রত্যেকেই বুঝেছিলেন, একমাত্র মানুষই পারে, তার সহজাত প্রবৃত্তির মোড় ফিরিয়ে স্রোতের বিপরীতে চলতে। এইখানেই সে সমস্ত পশুর চেয়ে আলাদা। সে হিংসার বদলে হিংসা না-ও করতে পারে, সন্ত্রাসে বদলে সে সন্ত্রাস নাও চাইতে পারে। প্রাকৃতিক ক্রমবিকাশ তত্ত্ব মেনেই বলা যায়, অন্ত্যত স্নায়ুগতভাবে তার এই স্বাধীনতা আছে। অর্থাৎ, সেই একমাত্র পারে তার পাশবিক জিঘাংসাকে দমন করে তাকে ‘উল্টা পথে’ বইয়ে দিতে। যদি মানুষ তা না করে সানন্দে পশুর জীবন মেনে নেয়, তবে তার একটাই পরিণতি হতে পারে তা হল— সমূলে বিনাশ। ঋষিরা ভেবেছিলেন, যেখানে ত্যাগ নেই, দেবতা নেই, মানুষের চেতনায় ঊর্ধ্বায়নের কোনও ইশারাই নেই সেই জীবন পশুর জীবন। তাই তারা মনে করতেন, গোটা জীবনটাই একটা যজ্ঞ বা যোগ। যার মূলে আছে উৎসর্গ-বুদ্ধি আর প্রবৃত্তির স্রোতের মোড় ঘুরিয়ে ‘উজান পথে’ চলা। তারা তাদের এই ভাবনাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শুধুমাত্র স্মৃতির সাহায্যে হাজার হাজার বছর টিকিয়ে রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন তা ভবিষ্যৎ মানুষের কাজে লাগবে। তাই বেদে একটা জাতির কয়েক হাজার বছরের অধ্যাত্ম-চিন্তার ধারাকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য তাদের সেই স্বপ্ন, অক্লান্ত পরিশ্রম, সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সমগ্র বেদ আমাদের কোনও কাজে লাগেনি।