ব্রায়ান ট্যালবটের বিকল্প জগৎ

Keep clear of the badger, for he bites.’
Sir Arthur Conan Doyle, The Sign of Four.

বাষ্পাকুল শহর। এক দিকে দেওয়াল বেয়ে বেয়ে অসংখ্য পাইপের ঘিঞ্জি। অন্যদিকে একটা রেলগাড়ি ধোঁয়া উগড়াতে উগড়াতে নিজ গন্তব্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে। অনেক অনেক দূরে আইফেল টাওয়ারের সিল্যুট দেখা যাচ্ছে। পাথর-বসানো রাস্তায় জল জমে। সেই জলে দূরের আইফেল টাওয়ার প্রতিফলিত হচ্ছে।

ছবি ১ : সর্বপ্রথম ফ্রেম (ভলিউম ১)

হঠাৎই একটা অদ্ভুত দর্শন ক্যারিজ জল ছিটিয়ে আইফেল টাওয়ারের দিকে ঝড়ের মতো এগোতে লাগল। সেই গাড়ির পেছনে ধাওয়া করে আসছে আরও কিম্ভূত রকমের দেখতে অনেকগুলো তিন চাকার বাইক।

যানবাহন যত না অদ্ভুত, তার থেকেও বেশি অদ্ভুত তাদের চালক আর আরোহীরা। একদম সামনের ক্যারিজে বসে চেক-কাটা কোট প্যান্ট আর টপ হ্যাট পরা এক ভোঁদড়। আর তাকে ধাওয়া করতে করতে এগিয়ে আসছে কালো ইউনিফর্ম পরা শেয়াল, কুকুর, গিরগিটি, বন্য শূকর, ইত্যাদি।

যখনই ব্যাপারটা ‘টম অ্যান্ড জেরি’ হতে যাবে যাবে করছে, তখনই সেই শেয়াল দাঁত খিঁচিয়ে একটা রিভলভার তাক করে গুলি ছুড়তে শুরু করল। ভোঁদড়ও কোটের পকেট থেকে একটা বন্দুক বার করে প্রত্যুত্তর জানাল। তারপর যা হয়, তা হলিউড থ্রিলার বা অ্যাকশন সিনেমাতে আমরা অনেকবার দেখেছি। রক্তের ফোয়ারা, সংঘর্ষ, আগুন, মৃত্যু… হাই-স্পিড চেজ যাকে বলে, শুধু মানুষের স্থান অন্য প্রাণীরা দখল করে নিয়েছে।

ব্রায়ান ট্যালবটের অভূতপূর্ব এই দুনিয়াটাকে আসলে ওইভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব। আমাদের দুনিয়ার মতোই ভৌগোলিক বিভেদ, সামাজিক খুঁটিনাটি; ইতিহাসের স্রোতও প্রায় এক (যা কিছু আলাদা সেটা একটু পরে বলছি)। শুধু মানুষের জায়গাটা প্রাণীরা দখল করে নিয়েছে। টপ অফ দ্য ফুড চেইনে শুধু একটা প্রজাতি নেই, আছে পুরো প্রাণীজগৎ। অবিশ্যি এদের দেখতে ঠিক আমাদের দুনিয়ার পশু-পাখির মতো নয়। সেই মিকি মাউস বা ল্যুনি টিউনসের মত অ্যানথ্রপোমর্ফিক। হাতি, ঘোড়া, শেয়াল, ছুঁচো, পায়রা, চিংড়ি, ইঁদুর… ‘গ্র্যান্ডভিল’ (Grandville) গ্রাফিক উপন্যাসের দুনিয়াটা ওর নায়কের মতই খ্যাপাটে।

প্রথমেই গ্র্যান্ডভিলের জঁর (genre) নিয়ে আলোচনা করতে চাই। কারণ পশু-প্রাণী নিয়ে গল্পের কথা উঠলেই আমাদের মাথার সার্কিটে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গিয়ে ছোটবেলার কিছু স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে— পঞ্চতন্ত্র, ঈশপের গল্প, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর টুনটুনি, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড থেকে শুরু করে মিকি মাউস আর টম অ্যান্ড জেরি। অর্থাৎ, পশু-প্রাণী নিয়ে গল্পের কথা ভাবলেই আমাদের প্রথম মনোভাব হয়ে যায়, ‘ওহ্‌, তার মানে বাচ্চাদের গল্প।’ জর্জ অরওয়েলের লেখা ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ অথবা রিচার্ড অ্যাডামসের ‘ওয়াটারশিপ ডাউন’-এর কথা একদম প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে না। অন্যদিকে টুনটুনি বা অ্যালিসের গল্পকে শিশু-সাহিত্য বলে অনেকে বাতিল করে দিলেও, সেগুলোর মধ্যে গভীরতা কিন্তু কম নয়। এত কিছু বলছি, কারণ ‘গ্র্যান্ডভিল’ যেহেতু অ্যানথ্রপোমর্ফিক প্রাণীদের নিয়ে, তাই অনেকেই হয়তো এতক্ষণে ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছেন। তাদেরকে বলি, একটু দাঁড়িয়ে যান! এখনই বাতিল করে দেবেন না।

‘গ্র্যান্ডভিল’ কিন্তু একটা আদ্যপ্রান্ত হার্ডবয়েলড ডিটেকটিভ সিরিজ। হ্যাঁ, সিরিজের প্রতিটা খণ্ডে স্টিমপাঙ্ক আর ফ্যান্টাসির এলিমেন্ট বর্তমান ঠিকই, কিন্তু আসল প্লটের কেন্দ্রে রয়েছে গূঢ় রহস্য, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, অন্ধকার দুনিয়ার কার্যকলাপ, আর (অবশ্যই) ফেম ফ্যাটাল। এক কথায়, গ্র্যান্ডভিলকে ক্লাসিক ডিটেকটিভ উপন্যাস (এরকিউল, শার্লক), আমেরিকান হার্ডবয়েলড জঁর আর হলিউড অ্যাকশন সিনেমার (ডার্টি হ্যারি) প্যাস্টিশ (pastiche) বললে, ভুল কিছু বলা হবে না।

এখানেই বলে রাখি, প্যাস্টিশ বলতে কিন্তু শুধু অনুকরণই নয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনও আর্টস্টাইল, কোনও বা কারুর লেখনী পদ্ধতি, বিশেষ কোনও যুগের সংস্কৃতি… সমস্ত কিছুকে উদ্‌যাপন করা সম্ভব, এবং তাতে আধুনিকতার রেশ ঢোকানোও সম্ভব। প্যাস্টিশের কাজ গুরুগম্ভীর হতে পারে (‘ম্যাসন ট্রিলজি’, কৌশিক মজুমদার), আবার ক্যাম্পিও হতে পারে (‘কিল বিল’ ডুয়োলজি-ট্যারেন্টিনো)।

গ্র্যান্ডভিলের অনুপ্রেরণা নিয়ে এত কিছু বললাম কারণ নানা ঘরানার আর্ট নিজের বুকে জমিয়ে রেখে এই সিরিজটা সামান্য অ্যাকশন কমিক্সের থেকেও বেশি কিছু একটা হয়ে গেছে। রোবিডা আর জে জে গ্র্যান্ডভিলের প্রভাব সবথেকে বেশি প্রকট হলেও, ব্রায়ান ট্যালবট অসংখ্য ইস্টার-এগ প্রায় প্রতিটা পাতায় লুকিয়ে রেখেছেন।

মোদ্দা কথা প্যাস্টিশ পুরোপুরি প্যারোডি (parody) নয়। প্যারোডিতে আর্ট, সাহিত্যকে ব্যাঙ্গাত্মক আলোতে দেখানো হয়। এই যেমন ধরুন অস্টিন পাওয়ার্সের মাধ্যমে জেমস বন্ডের ট্রোপগুলোকে প্যারোডি করা হয়েছে; আবার বোরড অফ দ্য রিংসে টলকিনের বিভিন্ন ন্যারেটিভ এলিমেন্টগুলোকে (ম্যাপ, অত্যন্ত জটিল ইতিহাস, উদ্ভট নাম) ব্যঙ্গ করা হয়েছে।

এক কথায়, প্যারোডিতে রগড় করা হয়, আর প্যাস্টিশে ভালবাসা। ‘গ্র্যান্ডভিল’ সিরিজে প্যারোডির কিছু অসাধারণ উদাহরণ থাকলেও, গল্পগুলো ভালবাসার জায়গা থেকেই উঠে এসেছে বলে আমার বিশ্বাস।

গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে একটা ব্যাজার। না, মুখ ব্যাজার জাতীয় কিছু নয়, আমি badger প্রাণীটার কথা বলছি। সেই লোমশ সাদা-কালো নিশাচর সর্বভূক প্রাণী। সাধারণত হিংস্র নয়, কিন্তু কোণঠাসা হলে নিজেদের ধারালো নখ আর দাঁত ব্যবহার করতে পিছপা হয় না, সেই ব্যাজার। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর আর্চিবাল্ড ‘আর্চি’ ল্যেব্রক সেই জাতেরই প্রাণী। সুঠাম মাংসল দেহটা (‘ঢাই কিলো কা হাথ’ সহ) প্রায় সর্বদাই ওভারকোটে লুকানো থাকে। ইন্সপেক্টর লেব্রকের চরিত্রকে বর্ণনা দেওয়া যায় অনেকভাবেই। সে শার্লক হোমসের কায়দায় হাতে কালির ছোপ, আসবাবপত্রে ধুলোর স্তর, ইত্যাদি দেখে ‘ডিডাকশন’ করে সত্য অন্বেষণ করে। আবার অন্যদিকে, গল্পের ক্লাইম্যাক্সে, আর্নল্ড স্যোয়াজেনেগারের মত পেশি ফুলিয়ে, বোমা মেরে, মেশিন গান চালিয়ে শত্রু নিধন করে। আবার, একই সাথে ফেম ফ্যাটালদের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায়। স্ব-বিরোধী এই নায়কের অজিত হল ডিটেকটিভ রডরিক র‍্যাটজি (বলাই বাহুল্য, ইনি একজন ইঁদুর)। তার বিশেষ কোনও ভূমিকা আসলে নেই। ওই গতে বাঁধা গোয়েন্দা-গল্পের চ্যালাদের মতো সে মূলত ল্যেব্রকের foil হিসাবে কাজ করে।

ছবি ২ : র‍্যাটজি এবং ল্যেব্রক (ভলিউম ১)

ল্যেব্রকের জীবনটা খুব একটা সুখকর নয়। কারণ সে ন্যায়পরায়ণ পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও কাজ করে অনৈতিক সরকারের হয়ে। তাছাড়া ওর দুনিয়ায় ইংলিশম্যান হওয়ার মধ্যে তেমন আহামরি কিছু ব্যাপার নেই, কারণ এই দুনিয়াতে ৩০০ বছর পূর্বে নেপোলিয়নিক যুদ্ধে ফ্রান্স জয়ী হয়, আর ব্রিটেনের রাজপরিবারের কপাকপ করে মুণ্ডপাত করা হয়। গ্র‍্যান্ডভিলের প্রথম গল্প যখন শুরু হচ্ছে, তার মাত্র তেইশ বছর আগে ব্রিটেন স্বাধীনতা লাভ করে; নিজেদের গাল ভরা একটা নাম রাখে: দ্য সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অফ ব্রিটেন।

কিন্তু ততদিনে এই দুনিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। সারা বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতাকার বদলে ফ্রান্সের পতাকা ওড়ে। এমনকী জানা যায় যে ভারত আর চীন, দুই দেশই এখনও ফ্রান্সের অধীনে রয়েছে। ফলস্বরূপ, ইংল্যান্ডের কয়েকটা গ্রাম্য এলাকা ছাড়া (যেখানে এখনও কক্‌নি উচ্চারণের ইংরেজি অল্প শোনা যায়), প্রায় সব জায়গায় ফরাসি ভাষার চলন।

এতটা জানার পর যদি এই সমান্তরাল বাস্তবতার প্রতি সামান্যতম কৌতূহল জন্মিয়ে থাকে, তো বলব এই নিবন্ধ পড়ার আগে ‘গ্র‍্যান্ডভিল’ সিরিজটা না হয় পড়েই ফেলেন ৷ হতাশ হবেন না। ব্রায়ান ট্যালবট খুব সুনিপুণ ভাবে এই দুনিয়াটাকে সাজিয়েছেন, একবার পড়লে ভাল না বেসে পারা যায় না।

আরও কিছু বলার আগে আমি সিরিজটার নাম নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। ল্যেব্রকের দুনিয়াতে প্যারিস পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শহর। আশ্চর্যের কিছুই নয়, কারণ ফরাসি সরকার যে সকলের হর্তাকর্তা!

ছবি ৩ : র‍্যাটজি এবং ল্যেব্রক প্যারিস বা গ্র্যান্ডভিলে (ভল্যিউম ১)

এই প্যারিস শহরকেই সবাই ডাকে ‘গ্র্যান্ডভিল’ বলে। বেশ নবাবী নাম বটে, কিন্তু এর পেছনে একটু ইতিহাস রয়েছে।

জ্যঁ ইগনেস ইসিডোর জেরার্ড (আমি নিশ্চিত ফরাসি উচ্চারণে একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণ উহ্য থাকে, অতএব আমার বঙ্গীকরণ মার্জনা করবেন) ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ছিলেন। তাঁকে মূলত মনে রাখা হয় ফরাসি ক্যারিকেচারিস্ট হিসাবে যিনি মূলত জে জে গ্র্যান্ডভিল ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। কিন্তু শুধুমাত্র ক্যারিকেচার বললেও তাঁর আঁকাগুলো সঠিক বর্ণনা দেওয়া হবে না। একটু পরাবাস্তবতার ছোঁয়া রয়েছে তাঁর ছবিগুলোতে। যেন এক স্বপ্নালু দুনিয়ার কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য তাঁর তুলিতে ধরা পরত। তাঁর Les métamorphoses du jour  এবং Un autre monde,  বই দুটো মূলত অ্যানথ্রপোমর্ফিক প্রাণী আর জড়বস্তুদের নিয়ে। দুটো উদাহরণ নীচে দিচ্ছি।

ছবি ৪ : ‘Battle of the Playing Cards’
Un autre monde বই থেকে


ছবি ৫ : ‘Misery – Hypocrisy – Covetousness’
Les métamorphoses du jour বই থেকে

ছবি ৪, দেখলেই ঝট করে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের কথা মনে পড়ে যায়। আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ অ্যালিস সিরিজের চিত্রশিল্পী জন টেনিয়েল জেরার্ডের ভক্ত ছিলেন, এবং টেনিয়েলের অসংখ্য ছবি জেরার্ডের মূল কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আঁকা।

অন্যদিকে ছবি ৫-এ আমরা দেখতে পাই একটা ইঁদুর মৃত্যুশয্যায় শুয়ে। আর তার এই অবস্থা দেখে না কি একটা বিড়ালের চোখের জল আর থামছে না। তীব্র ব্যাঙ্গাত্মক ছবি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু লক্ষ্য করুন কত নিঁখুত ভাবে প্রাণীগুলো আমাদের হাবভাবকে অনুকরণ করছে। যে-পাখিদুটো সামরিক সজ্জায় রয়েছে, তারা বড় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে এসে তারা বড়ই বিব্রত। অন্যদিকে বিড়াল চোখ মুছছে বটে, কিন্তু তার চেহারায় শোকের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, বরং সে আড়চোখে তিনটে পাখির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

এইভাবেই জেরার্ডের ছবিতে সমসাময়িক ফরাসি সমাজের একটা প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। জেরার্ডের দুনিয়ায় তাই এক ত্রস্ত মেয়ে কুকুরের পেছনে নানা জাতের ‘ড্যান্ডি’ ছেলে কুকুর ছোঁক-ছোঁক করতে থাকে। অথবা, একটা শতছিন্ন কাপড় পরা বাচ্চা বিড়াল লুকিয়ে লুকিয়ে দুধ খায় আর গরু পরিচারিকার সেটা চোখে পড়লে, সে একটা ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে আসে।

জেরার্ডের আঁকা স্বপ্নালু আর উদ্ভট হলেও, সেগুলোর মধ্যে জমে থাকা আবেগগুলো বড্ড সত্যি, বড্ড বাস্তব। ব্রায়ান ট্যালবট তাই হয়তো তাঁর কমিক্সের প্রতিটা পাতায় জেরার্ডকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন নানা ভাবে। প্যারিসের আরেকটা নাম তাই হয়ে গেছে গ্র্যান্ডভিল, আর সেই গ্র্যান্ডভিলের নামই আমরা গ্রাফিক সিরিজের টাইটেলে দেখতে পাই।

জেরার্ড ছাড়া আরেকজন যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন অ্যালবার্ট রোবিডা। আর এক বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও চিত্রশিল্পী যাঁর কাজে ভবিষ্যতের নানা স্বপ্ন ফুটে উঠত বারংবার। অদ্ভুতদর্শন বিমান, জেপ্পেলিন, জাহাজ… কখনও বা ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি (তাও ১৮৮৩ সালে!), রোবিডার কল্পনাশক্তির প্রশংসা করার ক্ষমতা আমার মতো লিখিয়েদের মধ্যে নেই।

ছবি ৬ : রোবিডার টেলিফোনোগ্রাফ,
Le Vingtième siècle: la vie électrique বই থেকে

‘গ্র্যান্ডভিল’ সিরিজে রোবিডার ছোঁয়া দেখা যায় মূলত প্রযুক্তিগত বিবরণে। রোবিডার কল্পনায় প্যারিসের আকাশে অসংখ্য উড়োজাহাজের ভিড়। সেই উড়োজাহাজে চেপে প্যারিসবাসীরা সান্ধ্য আড্ডা দিতে বেরোয়, নইলে হোটেলের কনসিয়ার্জের সঙ্গে কথা বলে, নইলে রেস্তোরাঁ থেকে ঢুঁ মেরে আসে।

ছবি ৭ : Le Vingtième siècle: la vie électrique বই থেকে

ব্রায়ান ট্যালবটের সিরিজে রোবিডার প্রভাব নিম্নের ছবিটা দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেই একই রকমের মাছের মত চোখ আর পাখনা। বিজ্ঞানসম্মত না হলেও পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য রয়েছে।

ছবি ৮ : সামরিক উড়োজাহাজ, গ্র্যান্ডভিল (ভলিউম ১)

গ্র্যান্ডভিলের অনুপ্রেরণা নিয়ে এত কিছু বললাম কারণ নানা ঘরানার আর্ট নিজের বুকে জমিয়ে রেখে এই সিরিজটা সামান্য অ্যাকশন কমিক্সের থেকেও বেশি কিছু একটা হয়ে গেছে। রোবিডা আর জে জে গ্র্যান্ডভিলের প্রভাব সবথেকে বেশি প্রকট হলেও, ব্রায়ান ট্যালবট অসংখ্য ইস্টার-এগ প্রায় প্রতিটা পাতায় লুকিয়ে রেখেছেন। আমার সবথেকে প্রিয় ইস্টার এগ রয়েছে প্রথম ভল্যিউমে। তদন্তের স্বার্থে ল্যেব্রক আর র‍্যাটজি স্নোয়ি মিল্যু বলে এক কুকুরের খোঁজ করছিল। অনেক কাঠগড় পুড়িয়ে অবশেষে এক ‘poppy joint’-এ স্নোয়িকে তারা খুঁজে পায়। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা স্নোয়ি নিজের মনে কীসব বিড়বিড় করতে থাকে। সে নাকি স্বপ্নে দেখেছে এক ‘ময়দামুখোর’ সাথে চাঁদে গিয়েছে। সে নাকি সেই লোকটার সাথেই আবার কঙ্গোতেও গেছে। স্নোয়ি আরও কিছু শব্দ আওড়াতে থাকে : ‘নীলকমল’, ‘সোনার কাঁকড়া’…

এতক্ষণে হয়তো সকলে বুঝে গেছেন, স্নোয়ি আসলে টিনটিনের নানা অভিযানের স্বপ্ন দেখছে। বাংলায় যাকে আমরা কুট্টুস নামে চিনি, তার ফরাসি নাম মিল্যু আর ইংরেজি নাম স্নোয়ি, আর সেই দুটো নাম মিলিয়ে মিশিয়ে এই চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন ট্যালবট।

ছবি ৯ : স্নোয়ির স্বপ্ন, গ্র্যান্ডভিল (ভলিউম ১)

এছাড়াও অসংখ্য ক্লাসিক পেইন্টিং-এর ‘প্যারোডি’ কমিক্সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, অগাস্টাস লিওপল্ড এগ-এর The Travelling Companions.

ছবি ১০ : The Travelling Companions
ছবি ১১ : The Travelling Companions-এর প্যারোডি, গ্র্যান্ডভিল (ভলিউম ১)

পরিশেষ

সত্যি বলতে কী, আমি ইচ্ছে করে গ্র্যান্ডভিলের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিশদে আলোচনা করা থেকে বিরত থেকেছি। আমি চাই না এই সামান্য নিবন্ধে সমস্ত রহস্য, সমস্ত ইস্টার এগের কথা লিখে বইটা পড়ার আনন্দ মাটি করে দিই। আমি হয়তো অনেক ফরাসি চিত্রশিল্পী আর লেখক কপচালাম, তবে ব্রায়ান ট্যালবট কিন্তু ‘গ্র্যান্ডভিল’ লিখেছেন মূলত বিনোদনের জন্যেই। সেই যে হলিউডি সুপারকপ সিনেমা দেখার একটা আলাদা আনন্দ রয়েছে, যেখানে সময় এলে নিজের ব্রেইন সার্কিটের ‘যুক্তির’ সুইচটা বন্ধ করে দিতে হয়, সেইরকম আনন্দ পেয়েছি এই সিরিজটা পড়ে। এর মধ্যে ইন্টেলেকচুয়ালিটির কোনও মেকি-মোড়ক নেই, কোনও দেখনদারি নেই। ট্যালবট শুধু লিখেছেন— জাস্ট ফর দ্য হেক অফ ইট! জাস্ট ফর ফান।


ঋণ :
১.  https://www.bryan-talbot.com/grandvilledirectorscut/
২.  Wikimedia
৩. https://en.lesvilainescuriosites.fr/blogs/le-petit-echo-du-domaine-public- et-de-la-creation/jj-grandville-lewis-carroll-et-disney
৪.  https://publicdomainreview.org/collection/albert-robida-la-vie-electrique/
৫.  https://www.theguardian.com/books/2015/jan/29/sp-bryan-talbot-grandville-father-of-british-graphic-novel