জল-তরঙ্গ

Representative Image

শৈশব থেকে বৃষ্টির সঙ্গে আমার বেশ একটা সখ্য ছিল। শুনেছি যেদিন জন্মেছিলাম, সেদিন শহরে সাংঘাতিক বৃষ্টি হয়েছিল— শহর প্রায় ডুবে গিয়েছিল সেই রাতে (পরে বুঝেছি, আমার জন্মানোয় প্রকৃতি কেঁদেছিল)। বৃষ্টি এলে জানালায় বসে গরাদ দিয়ে পা আর হাত বাড়িয়ে দিতাম। জলের ছাট যত লাগত, ততই স্ফূর্তি। বৃষ্টি এলে মনে একটা ‘feel good factor’ ভেতর থেকে ঘাই মারত। কিন্তু ‘too much of too good is too bad’— এই আপ্তবাক্য নিয়ে আমার ব্যাপটিজম হয়, ১৯৭৮ সালে। আটাত্তরের বানভাসি শহরের বেশ কিছু দৃশ্য এখনও দিব্যি মনে আছে— ক্লাস থ্রি-তে পড়া ছোট ছেলেটা ওই প্রথম জল জমতে দেখল। 

দাদা, জলটা একটু গরম যেন!  

উত্তর কলকাতায় আমাদের বাড়ির সামনে কোনওদিন জল জমতে দেখিনি, আটাত্তরের আগেও না, পরেও না। ওই একবারই জল জমেছিল। চারদিক যখন জলমগ্ন, গলিতে জল ঢুকেছে, কিন্তু আমাদের বাড়ির একতলার মেঝে শুকনো। দাদাভাইয়ের আর আমার বেশ হীনমন্যতা তৈরি হয়েছিল সেদিন। শেষপর্যন্ত, রাতে একটা লরি যেতে তার ঢেউ গলি দিয়ে এসে যখন একতলার মেঝে ডোবাল, আনন্দে হাততালি দিয়েছিলাম। বাবা বুদিদের, মানে আমার সেজপিসিদের সবাইকে ওপরে ডেকে নিলেন আর বলে দিলেন, জল যতদিন না নামছে, সবাই ওপরেই থাকবে আর খাবে। পরেরদিন মেজপিসিদের গোয়াবাগানের বাড়িতে ঘরের মধ্যে জল যখন পায়ের পাতা বেয়ে হাঁটু পেরিয়ে গেল, আর ঝুঁকি না নিয়ে সবাই আমাদের বাড়িতে চলে এল। ডাফ হস্টেলের পাশে প্যারীমোহন সুর লেনের মুখে লোকে লাইন দিয়ে প্রস্রাব করত বলে ওই রাস্তাকে লোকে একটা অন্য নামে চিনত। গোয়াবাগান থেকে আমাদের বাড়ি আসার পথে জলমগ্ন প্যারীমোহন সুর লেন ক্রস করার সময় জনদির সেখানকার জলকে অপেক্ষাকৃত গরম লেগেছিল, আর দাদাকে সেটা জানাতে দাদা ভীষণ রেগে যায়। দিদিভাইদের বাদুড়বাগান থেকে রেস্কিউ করার প্রয়োজন হয়নি, কারণ ওদের বাড়ি দোতলা ছিল— বাবা জানতেন যে, সময়মতো দিদিভাই সবকিছু দোতলায় সরিয়ে ফেলবে। তবু নিশ্চিন্ত হতে বাবা আমাকে নিয়ে একটা রিকশায় চড়ে বিদ্যাসাগর স্ট্রিট দিয়ে দিদিভাইদের গলির মোড় অবধি যখন পৌঁছলেন, রিকশাওয়ালায় গলা অবধি জল। বাবা চিৎকার করে দিদিভাইকে ডাকতে, দিদিভাই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে গলির ভেতরে বাড়ির দোতলা থেকে সাড়া দিয়েছিল, আর জানিয়েছিল, চিন্তা না করতে, ওরা ভাল আছে। 

আরও পড়ুন : যে বাঙালি যুদ্ধবিরোধী মিছিলে রাজপথ দখল করত একদিন, সে কি আজ রাস্তায় নামবে যুদ্ধবাজির সমর্থনে?
লিখছেন অমিতাভ মালাকার…

আটাত্তরের বন্যার হিরো আমার কাছে দিদিভাইয়ের শ্বশুরমশাই, হিরোইন পুচকুদির ঠাকুরমা। জল বাড়ার সঙ্গে দিদিভাই প্রায় সবকিছুই ওপরে নিয়ে চলে গিয়েছিল, শুধু দিদিভাইয়ের ৭৩ বছরের শ্বশুরমশাই ঘরে জল ঢুকলে ওপরের তলায় যাবেন বলে বাদুড়বাগানের বাড়ির একতলায়, দরজার দিয়ে চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন। একসময় দিদিভাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখে দুটো সিঁড়ি ডুবে গিয়েছে। দিদিভাই আতঙ্কিত হয়ে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে ঢুকে দেখে, খাট অর্ধেক জলে ডুবে, শ্বশুরমশাই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে সিগারেট প্যাকেট, দেশলাই নিয়ে সদর দরজার দিকে ঠায় তাকিয়ে জল ঘরে ঢোকার অপেক্ষায়, আর এদিকে উঠোন থেকে জল উঠে ঘর ভাসিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে! পুচকুদির ৮২ বছরের ঠাকু’মা বালিগঞ্জের বাড়িতে শেমিজ পড়তেন, কিন্তু আটাত্তরে ঘরে জল ঢুকলে একটা সাদা শর্টস আর লাল গেঞ্জি পরে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, ভিজে শেমিজ পড়ে জমা জলের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোয় অসুবিধা হয় বলে।  

এ নদী কেমন নদী

নয়ের দশকের শেষ ভাগের এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছি, খুব বৃষ্টি পড়ছে। সেই রাতে শুরু হয়েছে, কিন্তু থামার কোনও লক্ষণ নেই। রাত থেকে একনাগাড়ে জোর বৃষ্টি। অফিসে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলাম রোজের মতো। কী খেয়াল হতে জিন্স পরে নিয়ে অফিসের পোশাক একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম— বৃষ্টিতে ভিজে গেলে হোটেলে গিয়ে পোশাক বদলে নেব। আমাদের পাড়ায় কোনও জল জমে না, তাই বৃষ্টির পরিমাপ নিয়ে সম্যক ধারণা তৈরি হল না। বাসস্ট্যান্ডে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু আমার চার্টার্ড বাসের কোনও দেখা নেই। শুধু আমার বাস কেন, রাস্তায় গাড়ি খুবই কম। একটাই ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল— আমি পৌঁছনোর আগেই এক ভদ্রলোক আর মহিলা বুক করে নিয়েছেন— তাঁরা যাবেন যাদবপুর। প্রায় কান্নাকাটি করে ওঁদের অনুরোধ করলাম যে, অফিসে যেতে ভীষণ দেরি হয়ে গিয়েছে। শেয়ার ট্যাক্সির ভাড়া নয়, আমি ভাড়ার এক তৃতীয়াংশ দিতে প্রস্তুত। ট্যাক্সি ড্রাইভার রাজি হয়ে আমাকে গাড়িতে তুলে নিল। বাইপাসের ওপর দিয়ে যখন  কাদাপাড়া, বেলেঘাটা মোড় ক্রস করছি, দেখি রাস্তায় জল জমে আছে। একটু অবাক হলাম, কারণ এইরকম আগে দেখিনি বলে। গাড়ি পরমা আইল্যান্ড থেকে পার্ক সার্কাসের দিকে বাঁক নিতে দেখি, দুইদিকেই জল জমে। ট্যাক্সি তপসিয়া মোড় পেরিয়ে চার নম্বর ব্রিজের কিছু দূরে এসে জ্যামে আটকে গেল। সামনের কী অবস্থা, সরেজমিনে দেখে এসে ঘোষণা করল আর আগে যাবে না। তর্কাতর্কি শুরু হতেই বলল, ‘দরকার হলে আমাকে এক টাকাও দেবেন না। কিন্তু আমি যাব না!’ সেইরকম আবার হয় নাকি!

যাই হোক, আমার অংশের টাকা দিয়ে নেমে পড়লাম আর হাঁটতে থাকলাম চার নম্বর ব্রিজের দিকে। ব্রিজের ওপরে উঠে পুরো ফ্রিজ করে গেলাম। সামনে একটা নদী বইছে। এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে বাড়ি পনেরো কিলোমিটার আর কর্মক্ষেত্র, মানে হোটেল দুই কিলোমিটার। কোনওদিকেই গাড়ি পাওয়া যাবে না, তাই ধীরে পার্ক স্ট্রিটের দিকে অগ্রসর হলাম। এক কোমর জল ঠেলে এগিয়ে চলেছি। কিছু জায়গায় ওভারহেড তার ছিঁড়ে গিয়েছে। পুলিশের তৎপরতা দেখে বুঝলাম, সেখানে সলিল-সমাধিও ঘটে গিয়েছে। কিন্তু এগনো ছাড়া কোনও উপায় নেই, তাই এগিয়ে চললাম। মল্লিকবাজারের সামনে দেখি হাতে টানা রিকশা আর সাইকেল রিকশা কয়েকটা দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ দিনে যারা পার্ক স্ট্রিট রাজপথে নিষিদ্ধ, সেদিন তারাই ত্রাণকর্তা। রুটের আবার তফাত আছে— সাইকেল রিকশা রফি আহমেদ কিডওয়াই রোড দিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে যাবে, আর টানা রিকশা মির্জা গালিব স্ট্রিট দিয়ে। একটা টানা রিকশা নিয়ে পার্ক হোটেল অভিমুখে চললাম।

মোড়ের চারদিকে জলে জল, ক্যামাক স্ট্রিটে নৌকো চলছে, দূর থেকে দেখলাম। অবশেষে হোটেল যখন পৌঁছলাম, দেখি রিসেপশন লবিতে একহাঁটু জল। হোটেলের সমস্ত কর্তারা তখন বেঙ্গালুরু, নতুন হোটেলের উদ্বোধন সেদিন। এটা প্রাক-মোবাইল জমানার ঘটনা— হোটেলের সমস্ত ফোনলাইন বিপর্যস্ত, শুধু একটা লাইন ঠিক আছে। আমি পৌঁছতেই সেই ফোন লাইন দিয়ে বেঙ্গালুরু খবর চলে গিয়েছে।

জামাকাপড় বদলে নিজের দপ্তরে আসতেই ফোন বেজে উঠল, একসারি নির্দেশ, কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দেওয়া হল, আর শেষে বড়কর্তা বলে দিলেন, অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া অবধি আমি যেন হোটেলের বাইরে পা না রাখি, হোটেল আমার জিম্মায়। গোদের ওপর বিষফোড়া, অপারেটরদের নির্দেশ দিয়ে ওই একমাত্র চালু লাইনকে ফ্যাক্সের সঙ্গে কানেক্ট করে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফ্যাক্সে আমার নামে অর্ডার এসে গিয়েছিল। ঈশ্বরের আশীর্বাদে সেদিন আর বৃষ্টি হয়নি, অবস্থা ক্রমে স্বাভাবিক হয়েছিল আর সেদিন মধ্যরাতে সব সামলে কীভাবে আমি বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম, কিন্তু সে এক অন্য কাহিনি!

আটাত্তরের বন্যার হিরো আমার কাছে দিদিভাইয়ের শ্বশুরমশাই, হিরোইন পুচকুদির ঠাকুরমা। জল বাড়ার সঙ্গে দিদিভাই প্রায় সবকিছুই ওপরে নিয়ে চলে গিয়েছিল, শুধু দিদিভাইয়ের ৭৩ বছরের শ্বশুরমশাই ঘরে জল ঢুকলে ওপরের তলায় যাবেন বলে বাদুড়বাগানের বাড়ির একতলায়, দরজার দিয়ে চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন। একসময় দিদিভাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখে দুটো সিঁড়ি ডুবে গিয়েছে।

মধ্যরাত্রে ক্যাটামারান

কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার স্বপ্নের চেয়েও কঠিন কাজ— ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন যখন দেখেছিলাম, ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছিল এক বৃষ্টির দিনে। মুম্বই থেকে দেবাশিস আসছে, তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরের দিনই সে ফেরত চলে যাবে, তার আগে কোম্পানি তৈরির যাবতীয় কথা আলোচনা করে নিতে হবে সেই রাতেই। এয়ারপোর্ট থেকে দক্ষিণ কলকাতায় একটা মিটিং করে বালিগঞ্জের এক ধাবায় বসে আমরা মিটিং সেরে নেব। বাড়ি থেকে যখন বেরচ্ছি, মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এই সময়ে অম্লানের ফোন এল— ওকে তুলে নিয়ে যেতে হবে। ট্যাক্সি পাওয়া এই বৃষ্টিতে দুস্কর, তাই গাড়ি নিয়ে বেরলাম। যখন ওই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরচ্ছি, বাবু বলল, ‘এই বৃষ্টিতে একা গাড়ি নিয়ে যাস না— আমি যাচ্ছি সঙ্গে’, বলে গাড়িতে উঠে পড়ল। অম্লানকে মানিকতলা থেকে নিয়ে যখন রাত দশটায় বালিগঞ্জ পৌঁছলাম, বৃষ্টি হয়েই চলেছে।

দেবাশিস অপেক্ষা করছিল, আলোচনা শুরু হল। রাতের খাবার এবং আলোচনা সারতে রাত একটা বেজে গিয়েছে। ধাবার মধ্যে বসে বাইরের বৃষ্টির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি অল্প কমেছে ইতিমধ্যে। দেবাশিস বলল, ওকে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ছেড়ে দিতে। যাওয়ার পথে জলের পরিমাণ দেখে বুঝলাম যে-সময় আমরা ধাবায় ছিলাম, ক্রমাগত বৃষ্টি হয়েছে। দেবাশিসকে ছেড়ে অম্লানকে নামিয়ে যখন বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছি, তখন রাত প্রায় দুটো। বৃষ্টির পরিমাপে বুঝে গিয়েছি, ততক্ষণে যে উল্টোডাঙা রেলব্রিজের তলায় জল জমেছে, ভিআইপি রোডে পৌঁছনো অসম্ভব। কাঁকুড়গাছির রেলব্রিজের তলায় সাবওয়েতেও জল জমে, জানি। হঠাৎই মনে পড়ল, কাঁকুড়গাছি রেলব্রিজের দুই পাশের রাস্তা বেশ উঁচু, কোনওদিন জল জমতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সেই রাস্তায় ঢুকে দেখি সেখানেও জল জমেছে। গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, জল বাড়ছে। এমন একটা পরিস্থিতি যে, গাড়ি ব্যাক করার চেষ্টা করলেই গাড়ি ফেঁসে যাবে। গাড়িতে জল ঢুকতে শুরু করেছে দেখে যা আছে কপালে ভেবে গাড়ি দ্বিতীয় গিয়ারে ফেলে রেস দিলাম। গাড়ি সাংঘাতিক আওয়াজ করে এগিয়ে চলল স্পিড বাড়িয়ে।

হঠাৎ দেখি, গাড়ি ক্যাটামারান হয়ে জলে ভাসছে, চাকা মাটিতে নেই। কিন্তু গাড়ি মোমেন্টামে ছিল বলে ভেসেই এগিয়ে চলেছে। দশ সেকেন্ড। কিন্তু সেই কয়েক সেকেন্ড শিরদাঁড়া দিয়ে বরফ জল নামছে। এর পরেই অনুভব করলাম, গাড়ি আর ভাসছে না, চাকা মাটি খুঁজে পেয়েছে। গাড়ি ব্রিজের ওপারে গিয়ে যখন পৌঁছল, বনেট থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে— এত তেতে গিয়েছে যে, যে-কোনও মুহূর্তে আগুন লেগে বার্স্ট করবে। সেখানে জমা জল অপেক্ষাকৃত কম। ভাগ্যক্রমে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে ভেতর থেকেই বনেটের মুখ ফাঁক করে দিতে হু-হু করে ধোঁয়া বেরতে লাগল, মিনিট পনেরো-কুড়ি চুপচাপ বসে রইলাম। ইতিমধ্যে বৃষ্টির জল কিছুটা ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গাড়ির তাপ কমিয়ে ফেলেছে। শুনশান রাস্তা দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে গাড়ি চালিয়ে যখন মাত্র চার মাইল দূরে বাড়িতে পৌঁছলাম রাত তিনটেতে। বাবু এই গাড়ি চালানোর গল্প পরে অনেককে বলেছে, কিন্তু আমি আজও মনে করি, সেদিন বৃষ্টি ফাঁসিয়েছিল, বৃষ্টি রক্ষা করেছিল। বাকিটা ইনটিউশন!

চলেছে চলছে চলবে

আটাত্তরে শহরবাসী প্রথম জল জমা দেখল। তার আগে কি জল জমত না? অবশ্যই জমত, আবার নেমেও যেত। আটাত্তরে প্রথম জমা জল দাঁড়িয়ে রইল। দিনের পর দিন। একই ঘটনা হল ১৯৮৪, ১৯৮৬, ১৯৯৪, ১৯৯৯, ২০০০। আটাত্তরে জলমগ্ন পাড়ায় একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। পাড়া থেকে একজন বাজারে গিয়ে সবার জন্য জিনিস নিয়ে আসা, একসঙ্গে রান্না, বৃষ্টির জলে প্লেট ধোয়ার মধ্যে যে কমিউন গোছের এক রোম্যান্টিক ব্যাপার ছিল, পরবর্তীকালের জমা জলে রোম্যান্টিসিজম ডুবে গিয়ে এক বিড়ম্বনার জন্ম দিয়েছে। দিদিভাইয়ের ছোট মেয়ে পটাই, ’৮৮-তে জন্ম, আর জন্ম-ইস্তক দেখছে বর্ষাকালে জল জমা, নাস্তানাবুদ হওয়া। টয়লেটের জল, খাওয়ার জল, চোখের জল, নাকের জল এক হয়ে যেতে দেখেছে ছোটবেলা থেকে, একবার জলে আটকে পরীক্ষা অবধি দিতে যেতে পারেনি।এখন সে মা-বাবাকে অন্য জায়গায় নিয়ে রেখেছে, কারণ অন্য রাজ্যে চাকরি করে তার বয়স্ক মা-বাবার ওই জলের মধ্যে আটকা পড়া নিয়ে আতঙ্কে থাকে। নবদ্বীপের গোঁসাইবাড়ির বউ, আমার মেজপিসি রান্না করতে করতে দেখেছে, বাথরুমের ময়লা পাশ দিয়ে ভেসে চলে যেতে। জনদি বলে, ‘মা মারা গিয়ে বেঁচে গেছেন।’ বর্ষার দিনে মেঘ দেখলে আর বাড়ির ময়ূরী নাচে না, কারণ বেশি বৃষ্টি তার কাছে আতঙ্কের। যে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে তার কলেজ, বর্ষার দিনে হয় সে রিকশায় করে কোনওমতে পৌঁছলেও ওর ছাত্রীরা পৌঁছতে পারে না, তাই বৃষ্টির নৃত্যের তালে তালে তার  মেজাজ চড়তে থাকে। 

এমনিতেই জন্মে অপরাধ করেছি, তার ওপর ভরা বর্ষায় জন্ম! তাই তাল-বেতাল দেখে বারান্দায় ঘাপটি মেরে বসে বৃষ্টি দেখি আর মনে মনে বলি, ‘এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে/ আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।’