ভাঙনের জয়গান

Bob Dylan

১৯৯৬ সাল, পিট সিগার কলকাতায় এসেছেন। তারিখটা ছিল ১৬ নভেম্বর। কলকাতায় আশুতোষ জন্মশতবার্ষিকী প্রেক্ষাগৃহে একটি সংগীত-কর্মশালা আয়োজন করেছিলেন পিট। তাতে জনা কুড়ি মতন মিউজিশিয়ান ছিলেন, যাঁদের মধ্যে কবীর সুমন, প্রতুল মুখোপাধ্যায় ঊষা উত্থুপ অন্যতম। সেই কর্মশালায় ওঁর জীবন, গান, উডি গাথরির কথা, প্রোটেস্ট সংস এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।

কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন সেখানে। যদিও সেভাবে কর্মশালায় কোনওরকম প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল না, স্টেটসম্যান পত্রিকার একজন সাংবাদিক ওঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “১৯৬৫ সালে ‘নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভাল’-এর সময়ে যে বিতর্ক হয় এবং আপনার দিকে আঙুল তুলে বলা হয়, আপনি বব ডিলানের অনুষ্ঠান সাবোটাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। ঠিক কী হয়েছিল সেদিন?” পিট সিগার সে-প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘নিউপোর্ট ফোক-ফেস্টিভাল’ সার্বিকভাবে ফোক-ফেস্টিভাল, কিন্তু সেখানে ডিলান ইলেকট্রিক গিটার নিয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে একটা ব্যান্ড-ও ছিল; তাতে অ্যালিস কুপার, (বিখ্যাত অরগ্যান প্লেয়ার), মাইক ব্লুমফিল্ড (গিটারিস্ট) প্রমুখের মতো বেশ ভাল-ভাল মিউজিশিয়ান-রাও ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল, কিচ্ছু শোনা যাচ্ছিল না। তখন উনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়র-কে বলেন, মিউজিকের লেভেলটা কম করো। কারণ ডিলানের গানের মূল ভিত্তিই তার লিরিক্স, সেটাই কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। মিউজিকটা এত লাউড এবং হাউলিং ছিল, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়র নাকি সিগারের কথাও প্রথমে শুনতে পাচ্ছিলেন না। পাশাপাশি দর্শকের মধ্যে থেকেও মিশ্র, বিশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত সাউন্ড ইঞ্জিনিয়র সিগারের কথা বুঝতে পারলেও বলেছিলেন, মিউজিক লেভেল কমানো যাবে না, কারণ ডিলান এটাই চেয়েছেন। তখন সিগার বলেছিলেন, ‘If I had an axe, I would cut the cable’ পরেরদিন খবরের কাগজেও শিরোনাম হয়, ‘Pete Seeger tried to cut the cable during Bob Dylan’s show with an axe’ এই হল ইতিহাস।

আরও পড়ুন: কলকাতার মানুষ কি আদৌ যোগ্য সম্মান দিতে পারল বাঁশির ঈশ্বরকে? লিখছেন কবীর সুমন…

দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সকলেই যে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন এমন নয়। আসলে ১৯৬৫ সালে ডিলান এমন একটা জনপ্রিয়তার স্তরে পৌঁছে গেছেন, তখন সেটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল। অ্যালেন গিন্সবার্গ বলেছিলেন, ডিলান যে এমনকিছু গাইতে পারেন বা গিটার বাজাতে পারেন তা নয়, কিন্তু ওঁর যে সার্বিক প্রেজেন্টেশন ফরম্যাট, যেভাবে কথাগুলো ডেলিভার করছেন,  সুরগুলো যেভাবে বাঁধছেন, সর্বোপরি গিটার বাজানোর স্টাইল (ডিলানের গিটার বাজানোর স্টাইল অনেকটা উডি গাথরির থেকে অনুপ্রাণিত) আমেরিকার যাযাবর লোকসংগীত শিল্পীরা যেভাবে অ্যাকুস্টিক গিটার বাজাতেন। ফলে, শব্দের প্রডাকশনটাই অন্যরকম।

পিট সিগার-এর সঙ্গে এক ফ্রেমে লেখক, ঊষা উত্থুপ প্রমুখ

মানুষ ভাবতে পারেননি, অ্যাকুস্টিক গিটার এইভাবে বাজানোর রীতির সঙ্গে এমন পাওয়ার পাঞ্চড লিরিক্স থাকতে পারে। ডিলান যে তাঁর গানে দুর্বোধ্য কোনও শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করতেন তা নয়, দৈনন্দিন ব্যবহারের শব্দগুলো এমনভাবে উনি সাজাতেন, যে একেকটা লাইন যেন একেকটা মিসাইল কিংবা স্লোগান হয়ে যেত। যে-মানুষ এরকম একটা সাধারণ আঙ্গিকে সংগীতকে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে পারেন, তারউপরে ওঁর নেজাল টোনের ফলে অন্যরকম উচ্চারণ, সবমিলিয়ে ক্যাজুয়ালি একটা সাংঘাতিক কথাকে বলে দেওয়া— এগুলো কিন্তু আগে কেউ শোনেননি এবং এটাই ডিলানের উত্থানের কারণ।

সেই কর্মশালার আমন্ত্রণ পত্র…

ডিলান যে-সময়ে উদীয়মান, ১৯৬১-১৯৬২, তখন কিন্তু ব্রডওয়েসের সময়। লোকে ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, ন্যাট কিং কোল, প্যাট বুন শুনছে; অন্যদিকে কিন্তু রক অ্যান্ড রোল-রাও ঢুকছে; এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ডিলান কয়েকবছরের মধ্যেই নিজের সাংগীতিক স্বাতন্ত্র খুঁজে নিয়েছিলেন এবং একইসঙ্গে প্রথাগত ফোক মিউজিকের ব্যাকরণ ভেঙে বেরতে চেয়েছিলেন, কারণ ওঁর মনে হয়েছিল, কিছু ক্ষেত্রে ফোক মিউজিক ভীষণ রেসট্রিকটিভ ইন নেচার, যা কয়েকটা বেসিক মিউজিকাল কর্ড আর ফ্রেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। একটা গানের সঙ্গে আর-একটা গানের মিল অনেক। বৈচিত্র খুব কম। এখান থেকে উনি হয়তো বেরতে চাইছিলেন।

এই প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়, ডিলানের গানে কিন্তু মারাত্মক মেলোডিক কন্টেন্ট আছে; ওঁর সাংগীতিক স্বাতন্ত্র দিয়ে হয়তো সেই মেলডিক রিচনেসটাকে অনেক সময়ে ডেলিবারেটলি এবং ন্যাচেরালি অ্যানিহিলেট করতেন, পাশাপাশি অদ্ভুত-অদ্ভুত স্ক্যানে ডিলান গানগুলোকে বাঁধতেন যেমন তাল থেকে বেরিয়ে গিয়েই আবার তালে ফিরে আসা; এবারে ওঁর কেন মনে হল স্টাইলটা সীমাবদ্ধ যেখানে নিজেই ফোক স্টাইলের মধ্যে থেকেও সো কল্ড ট্র্যাডিশন ভেঙেছিলেন। যদি ভেঙে না ফেলতেন, তাহলে ওঁর গানের নতুনত্ব কেউ খুঁজে পেতেন না।

লোকটা আসলে ম্যাভেরিক ইন নেচার; যদি খুব সহজে সাফল্য এসে যায়, তখন বোধহয় ওখানে উনি ক্লান্ত বোধ করেন। এবং সেখানে থেমে থাকতে চান না। এধরনের মানুষরা নিজেই নিজেদের ক্রাইসিস তৈরি করেন এবং নিজেরাই সেগুলো সল্ভ করার চেষ্টা করেন। বেড়া ভেঙে একটা নতুন রীতি আনার চেষ্টা, নিজেরই তৈরি ব্যাকরণ ভেঙে নিজেকে নতুন করে আবিস্কারের প্রেরণাই বোধহয় নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভ্যালে ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহারের কারণ।

ডিলান-ও যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি ‘নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভাল’-এই অ্যাকুস্টিক থেকে ইলেকট্রিক গিটারে ব্রেক-অ্যাওয়ে করবেন, সেটা কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই ওঁর মাথায় ঘুরছিল। যে-গিটারটি উনি বাজিয়েছিলেন, (স্ট্রাটোকাস্টার গিটার) সেটা উনি হাতে পেয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। ডিলান কিন্তু বিশেষ কাউকে বলেনওনি যে, এটা উনি করতে চলেছেন। প্রসঙ্গত ডিলান নিউপোর্ট-এ প্রথম গেয়েছিলেন ১৯৬৩-তে; সেখানে তাঁকে ইন্ট্রোডিউস করে দিয়েছিলেন পিট সিগার। ডিলান গেয়েছিলেন ‘ট্যাম্বুরিন ম্যান’;  

অনেকে বলেন ১৯৬৪-তে ডিলানের সঙ্গে বিটলসের যোগাযোগ হয়েছিল, সেটাও নাকি ডিলানের ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহারের পেছনে অনুপ্রেরণার কারণ। ’৬৫-তে গাইতে ওঠার আগের মুহূর্তে ডিলান জানিয়েছিলেন, উনি ইলেকট্রিক ব্যান্ড ব্যবহার করছেন, সেখানে প্রথম আপত্তি জানিয়েছিলেন, অ্যালেন লোম্যাক্স। লোম্যাক্স বিশ্ববিখ্যাত ফোক-কিউরেটর; সে-সময়ে তিনি ঘুরে-ঘুরে যারা আমেরিকান ফোক সংস, প্রোটেস্ট সংস, পিট সিগার, উডি গাথরি বব ডিলান, জোন বায়াজ, বেলাফন্টে প্রমুখের অনুষ্ঠান রেকর্ড করতেন, এমন নয় যে তিনি বড়-বড় অনুষ্ঠানগুলিই রেকর্ড করতেন, ধরা যাক কোনও চার্চ, ছোট ফোক ক্লাব বা কোনও প্রাইমারি স্কুলের ব্যাকইয়ার্ড-এ অনুষ্ঠান হচ্ছে, উনি সেগুলোর অধিকাংশ রেকর্ড করে কিউরেট করতেন। উনিও বলেছিলেন, আমি বিদ্যুৎ সংযোগই রাখব না, খালি গলায় গাক! সেটা তো আর বাস্তবায়িত হয় না।

প্রতিটি মানুষেরই আলাদা-আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে; এই বদল ভাল হল না খারাপ, তা নির্ভর করে শ্রোতার উপরে। কিন্তু ডিলানের কালজয়ী সব গান কিন্তু তৈরি হয়েছিল তাঁর ৬৫ বছরের সাংগীতিক কেরিয়ারের প্রথম ২০ বছরে। ডিলানের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হয়েও একজন শ্রোতা হিসেবে আমার মনে হয়, ডিলানের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহারের এই প্ল্যাটফর্মটা ভুল ছিল। যে-জন্য এত বিতর্ক তৈরি হল। অনেকেই বলতে পারেন, ডিলান তো ফোক সিংগার, নিউপোর্ট ছাড়া আর কোন প্ল্যাটফর্ম তিনি বেছে নেবেন! আমার মনে হয় শ্রোতাদের কথা মাথায় রেখে, উনি যদি এটা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে করতেন তাহলে বিতর্ক অন্য প্রকৃতির হত। অনেকেই মনে করেছিলেন, এটা ফোক মিউজিককে অসম্মান করা হচ্ছে। ডিলান তো আর সেটা করেননি, উনি একজন শিল্পী হিসেবে নিজেকে ভাঙতে চেয়েছেন।

যে-কোনও শিল্পী যখন একটা মাধ্যম থেকে নিজেকে অন্য মাধ্যমে রূপান্তর করছেন, আমার মনে হয় যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই সেটা করা উচিত। তাড়াহুড়ো করে করলে সেটা শুনতে ভাল লাগছে কি না সেটাও মাথায় রাখা উচিত। যে-কোনও গানই যখন আমরা তৈরি করি, তার আরেঞ্জমেন্ট মাথায় রেখে কিন্তু গানটা তৈরি করা বাঞ্ছনীয়। এবারে ‘No Direction Home, Like a Rolling Stone’-এই গানটা যখন ডিলান বেঁধেছিলেন, তখন  কি ওরকম একটা ফরম্যাটে করবেন বলে ভেবেছিলেন? না কি জোর করে ইলেকট্রিক গিটার ঢুকিয়ে আরেঞ্জমেন্টটা করলেন? কোথাও কি মেলানোর জন্য একটা সমস্যা থেকে গেল? আর-একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, নিউপোর্ট-এর টেকনিশিয়ানরা নির্দিষ্ট ইনস্ট্রুমেন্টাল লাইন-আপে অভ্যস্ত। সেই অনুযায়ী তাঁরা মাইক, মিক্সার সব কিছু সেট করে থাকেন। সেখানে ডিলানের দো-আঁশলা মেলানো-মেশানো গান তাঁদের জন্যও অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল বলেই মনে হয়। ফলে সবমিলিয়ে গানটা সাধারণ শ্রোতা ও মিউজিশিয়ান হিসেবে শুনতে কিন্তু ভাল লাগেনি।

প্রখ্যাত রকস্টার ব্রুস স্প্রিংসটিন, মার্ক নফলার তাঁদের সংগীতে ডিলানের প্রভাব এবং অনুপ্রেরণার কথা বারবার সর্বসমক্ষে বলেছেন। এখানে মজার বিষয় এটাই, ডিলান অ্যাকুস্টিক থেকে ইলেকট্রিকে শিফট করছেন, কিন্তু বিখ্যাত গিটারিস্টরা অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন তাঁর প্রথম ২০ বছরের পর্ব থেকেই, যখন তিনি অ্যাকুস্টিক ব্যবহার করতেন। এই রুপান্তরের মধ্যে কিন্তু একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। সাধারণের মুখে-মুখে ফেরা ডিলানের গানও কিন্তু অ্যাকুস্টিক বেসড।

প্রতিটি মানুষেরই আলাদা-আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে; এই বদল ভাল হল না খারাপ, তা নির্ভর করে শ্রোতার উপরে। কিন্তু ডিলানের কালজয়ী সব গান কিন্তু তৈরি হয়েছিল তাঁর ৬৫ বছরের সাংগীতিক কেরিয়ারের প্রথম ২০ বছরে। ডিলানের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হয়েও একজন শ্রোতা হিসেবে আমার মনে হয়, ডিলানের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহারের এই প্ল্যাটফর্মটা ভুল ছিল।

পরের দিকে কিছু গান উনি করেছেন, যেগুলো অ্যাকুস্টিকে করলেও, যেমন ‘All along the watch tower’ গানটি, যেটা ‘জন ওয়েসলি হার্ডিং’ অ্যালবামে বেরিয়েছিল, প্রসঙ্গত এতে পূর্ণদাস বাউলও কোলাবরেট করেছিলেন। এটার আয়োজন কিন্তু একটা হারমোনিকা এবং অ্যাকুস্টিক গিটারের অনুষঙ্গে। গানটার ফরম্যাট এমনই, বেশ কিছু বছর পর পৃথিবী বিখ্যাত এক গিটারিস্ট গানাটার রক ভার্সন যা করেন, সেটাতে কিন্তু সারা পৃথিবী কেঁপে গেছিল, তাঁর নাম জিমি হেনড্রিক্স। তিনি এমন একটা ফরম্যাট আনলেন যা লোকে ভাবতেই পারেনি। সেটা কিন্তু বহু রক গিটারিস্টদের কাছে পাঠ্যর মতন। অথচ গানটার পূর্বসূত্র কিন্তু অ্যাকুস্টিক গিটারেই করা।  

আজ থেকে ১৫ বছর আগে ডিলান যখন হোয়াইট হাউসে পারফর্ম করেছিলেন,  ‘Times They Are A-Changin’ তখনও কিন্তু অ্যাকুস্টিকেই পারফর্ম করছিলেন। ডিলান সাম্প্রতিক সময়ে যত অনুষ্ঠান করেন, ইলেকট্রিক গিটার তো বাজান না, পিয়ানো কিংবা কী-বোর্ড বাজান। সেটাও তো আরেক ধরনের নতুন পন্থা! আমার মনে হয় যার শুরুই হয়েছিল সমস্ত পুরনো পন্থা ভেঙে লিরিকালি মিউজিকালি নিজের জিনিস করার, তাঁর এটাই ভবিতব্য… যতদিন উনি কাজ করবেন, নিজেকে ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিশীলতার মধ্যে থাকবেন। এটাই ওঁর শিল্পী সত্তা!