সেই ছাত্রীটির ডেইলি রুটিন শুনে আপনারা খুব হেসেছিলেন। ‘ঘুম ভাঙলেই তার খিদে পেত,/আর খিদে মিটলেই তার ঘুম পেত,/ঘুম-খিদে-ঘুম-খিদে-ঘুম-খিদে-ঘুমঘুম-খিদেখিদে।’ অথচ ভেবে দেখেননি যে, আমাদের সকলের দৈনিক চক্রই কার্যত একই ঘটনার একঘেয়ে পুনরাবর্তন। বিজ্ঞান যাকে বলছে, ‘সারকাডিয়ান রিদম’। মোটামুটি চব্বিশ ঘণ্টা সময়ের এই চক্র অবশ্য একাধিক শর্তের ভিত্তিতে আবর্তিত হতে পারে। এর অন্যতম যেমন খাদ্য। বলা যেতে পারে, ওই ছাত্রীটির প্রাত্যহিক চক্র ছিল খাদ্য-ভিত্তিক সারকাডিয়ান রিদমের একটি নিদর্শনমাত্র। আবার, খাদ্যের বদলে কখনও শর্ত হয় আলোক। তখন আলোর ভিত্তিতে আবর্তন করে দৈনিক চক্র। যেমন আমরা দেখি, দিনের আলো ফুটলে কেউ বিছানা ছাড়েন, কেউ আবার কাজে বেরোন। একইভাবে আলো মুছে অন্ধকার গাঢ় হলে কেউ ঘুমোতে যান, হয়তো-বা কারও মাথায় চাগাড় মারে রতিক্রীড়ায় মেতে ওঠার গভীর ইচ্ছা।
আরও পড়ুন: বাইরের নয়, অন্তরের আলো থেকেই আমরা চিনি পৃথিবীকে? লিখছেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য…
সারকাডিয়ান রিদমের বিষয়টি হুবহু এতটা সরলরৈখিক নয় বটে, তবে সহজ করে দেখলে খানিক এইরকমই। নিয়মের এই চক্রবৎ নিগড়েই আমাদের জীবন অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর অন্যথা হলে দেখা দেয় বিবিধ গোলমাল। আলো আর আলোহীনতার ধারণার সঙ্গেও এভাবেই জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবন, সমাজ। জীবনের অপ্রকাশ্য, গোপন ক্রিয়াকলাপগুলি সমাজের লিখিত ও অলিখিত নিয়মে ক্রমে অন্ধকারের সঙ্গে সমাপতিত হয়ে যায়। তাই কলেজ-পড়ুয়া ছেলেটিকেও রাতে বন্ধুর বাড়ি থাকতে হলে অভিভাবকের বাড়তি অনুমতি নিতে হয়, গৃহবধূটি বাইরে ‘রাত কাটালে’ পড়শিরা বাঁকা চোখে তাকায়। অর্থাৎ, রাতের বেলায় এমনসব ‘গর্হিত’ কাজে আমরা রত হতে পারি, যা নাকি দিনের আলোয় অসম্ভব! এই কোট-আনকোট ‘গর্হিত’ কাজটি অধিকাংশক্ষেত্রে মুখ্যত যৌনতার ইঙ্গিতবাহী— গোদা বাংলায় যার এক কথায় প্রকাশ: ‘শোয়া’।
আদর্শ সমাজ আমাদের সর্বদা অসত্য থেকে সত্যের দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে যাত্রার কথা বলে— তমসো মা জ্যোতির্গময়। কারণ আলোহীনতার সঙ্গে বস্তুত নানাবিধ অপরাধমূলক কাজকর্মের ধারণা সম্পৃক্ত। সে-কারণেই আমাদের চেনা বুলি হয়ে ওঠে ‘অন্ধকার জগৎ’, ‘ডার্ক ওয়েব’। শুধু কি অপরাধ, পাপের ভাবনার সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে অন্ধকার। সেই আদিপাপ। মানুষ যেখানে চেয়েছে ‘অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে’। যতই ভুবনভরা আলো আপনার হৃদয় হরণ করুক, এই এত আলো-এত আকাশ দেখে যতই আপনার মন কাউকে আপন করে নিক— দু’চার সিনের পর আবহ ঘন হলে ঠিক ভিতর থেকে পর্দা টেনে দেওয়া হবে, ঘরের আলো নিভে যাবে!
এখন প্রশ্ন হল, এই যে আমাদের যৌনতার বোধ কিংবা শরীরী ক্রিয়াকলাপ, তার জন্য অন্ধকার কি আদপেই প্রয়োজনীয় কিংবা আলো-অন্ধকারের সমীকরণের উপরে তা কতটা নির্ভরশীল? মানুষের কামোত্তেজনার জন্য শারীরিক ও মানসিক ক্ষেত্রে যে আলোর ভূমিকা রয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। কামসূত্রেই যেমন বলা হচ্ছে, ‘কন্যাবিস্রম্ভন’ বা কন্যার মনে নায়কের যোগ্যতা সম্বন্ধে বিশ্বাস উৎপন্ন করায় আলোর গুরুত্বের কথা। ‘পূর্বে যে নারী রতিতৃপ্তি লাভ করেছে, যার যৌবন গাঢ়তা প্রাপ্ত হয়েছে এবং যে আলিঙ্গনের মর্ম জেনেছে, সেই নারীকে দীপালোকে আলিঙ্গন করা যেতে পারে’ (অনু. সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ)। এর বিপরীতে উল্লেখ করা হচ্ছে— ‘যে অপ্রাপ্তালিঙ্গনা অর্থাৎ পূর্বে কারো দ্বারা আলিঙ্গিত হয়নি, তাকে অন্ধকারেই আলিঙ্গন করা কর্তব্য।’
শালীনতারক্ষা, রহস্যে ঘেরা বাতাবরণ সৃষ্টি, নান্দনিক পরিবেশ রচনা, আবেগঘন মুহূর্ত উদ্যাপন করা— এমন কয়েকটি কারণে ‘আধো আলো-ছায়াতে কিছু ভালোবাসাতে’ মন ভোলানোর কথা বলেছেন স্বয়ং বাৎস্যায়ন। ঈষৎ অন্ধকারে মৃদু আলোকবর্তিকার ব্যবহার সেখানে যথার্থ। কিন্তু দৃশ্যসুখের জন্য যে কয়েক পরত বেশি আলোর প্রয়োজন, তা অভিজ্ঞ যুগলমাত্রেই জানবেন।
শালীনতারক্ষা, রহস্যে ঘেরা বাতাবরণ সৃষ্টি, নান্দনিক পরিবেশ রচনা, আবেগঘন মুহূর্ত উদ্যাপন করা— এমন কয়েকটি কারণে ‘আধো আলো-ছায়াতে কিছু ভালোবাসাতে’ মন ভোলানোর কথা বলেছেন স্বয়ং বাৎস্যায়ন। ঈষৎ অন্ধকারে মৃদু আলোকবর্তিকার ব্যবহার সেখানে যথার্থ। কিন্তু দৃশ্যসুখের জন্য যে কয়েক পরত বেশি আলোর প্রয়োজন, তা অভিজ্ঞ যুগলমাত্রেই জানবেন।
কিন্তু নিকষ অন্ধকার? চড়া আলোর মতোই এ-ও যৌন ক্রিয়াকলাপের জন্য মোটে তেমন সুবিধেজনক নয়। কিছু গবেষণা বলছে, আলোর পরিমিত ও সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ বরং যৌন উত্তেজনার মাত্রা বৃদ্ধিতে সক্ষম। হরমোন ক্ষরণের উপরেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাৎস্যায়নের দীপালোক থেকে আজকের ক্যান্ডল লাইট— মানুষের আদিম প্রবৃত্তির মূলগত আচরণে যে এতদিনেও বিশেষ পরিবর্তন আসেনি, এসব মায়াবী আবহে হাজিরা দেওয়ার সৌভাগ্য হলে তা দিব্য টের পাওয়া যায়!
যৌনক্রিয়ায় আলোর আরেকটি বড় ভূমিকার নেপথ্যে রয়েছে কুণ্ঠা। গেরস্ত দম্পতি হোক কিংবা বাবু ও বারবণিতা— আলো জ্বেলে ‘ওসব’ করায় অনেকেই অস্বস্তি অনুভব করেন। লজ্জা পান। বন্ধ ঘরে, যার সামনে মানুষ নিজেকে উন্মুক্ত করে দিতে দ্বিধা বোধ করছে না, সেখানেও অন্তত অন্ধকারের আগলটুকু বজায় রাখায় তার স্বস্তি। এই ঘটনার গভীরে অন্বেষণ করলে বোধ করি দেখা যাবে নিজের শরীরের প্রতি, নিজের রূপের প্রতি ক্রিয়াশীল একপ্রকার হীনম্মন্যতা। অতি-আত্মবিশ্বাসীকেও ভিতর থেকে কুরে-কুরে খাওয়া আত্মবিশ্বাসের অভাব।
অথচ যখন শোনা গিয়েছিল, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’— শুরু হয়েছিল সৃষ্টির কাজ। জগতের সৃষ্টি। মানুষের সৃষ্টি। আজও তা সর্বোৎকৃষ্ট ক্রয়েটিভিটির নিদর্শন। সঙ্গমরত দু’টি মানুষ যেমন শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল। প্রেম ও যৌনতাও পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পতঙ্গের দু’টি ডানার নাম। সে তো অন্ধকার থেকেই উড়ে যাবে। আলোর দিকে। আগুনের দিকে।