ব্যান্ডপার্টির রবীন্দ্রগান

Band Party

তালবাদ্যের ‘তাসা পার্টি’কে বাদ দিলে, চার রকমের ব্যান্ড পার্টি দেখতে পাওয়া যায় এখন। তাসার সঙ্গে ব্যাঞ্জো, বা সস্তার সিন্থেসাইজারের মিশেলে ব্যাঞ্জো ব্যান্ড, ব্যাঞ্জো অথবা সিন্থেসাইজারের সঙ্গে ড্রামের যুগলবন্দিতে— মূলত শহরতলিতে অবস্থিত একধরনের ব্যান্ড, বিশেষ ধরনের সানাই (চলতি নাম টোটা), ব্যাগপাইপ ও ড্রামের মিশেলে তুলনামূলক এলিট ব্যাগপাইপ ব্যান্ড এবং ইংলিশ ব্যান্ড।

‘ইংলিশ ব্যান্ড’ অদ্ভুত এক পারফর্মেটিভ মিডিয়াম। সানাই, ক্ল্যারিয়নেট, স্যাক্সোফোন, ট্রাম্পেট, কেট্ল ড্রামস, বিগ ড্রাম, বিশেষ ধরনের শেকার, করতাল সহযোগে গড়ে ওঠে ইংলিশ ব্যান্ড।

আরও পড়ুন: সুরের মধ্যে একটা পুনরাবৃত্তি আছে, যেমন মনখারাপের বাতাসে থাকে। সে বারে বারে একই পথে ফিরে এসে হানা দেয়, এ-গানের সুরও তাই লিখছেন শ্রীজাত

কলেজ স্ট্রিট থেকে এমজি রোড ক্রসিংয়ের দিকে যেতেই, বাঁহাতে চোখে পড়বে, একের পর এক ইংলিশ ব্যান্ডের অফিস কাম দোকান। এখন সকালবেলায়, পুরোনো জামাকাপড় রাস্তার ধারে নীল-সাদা রেলিংয়ে, রোদ্দুরে দিয়ে, আর সন্ধ্যায় অপটু হাতে রেওয়াজ করেই টিকে আছে, ‘ক্যালক্যাটা ব্যান্ড’, ‘শ্যাম ব্যান্ড’, ‘বোম্বে ব্যান্ড’, ‘পাঞ্জাব ব্যান্ড’ অথবা ‘ম্যাহবুব ব্যান্ড’-রা।

আমরা একটা প্রশ্ন নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম ওঁদের কাছে।
— ‘আচ্ছা, আপনারা কিছু কমার্সিয়াল বাংলা গান এবং মূলত হিন্দি গান আর ভোজপুরি গান বাজান, রবীন্দ্রসংগীত একদমই বাজান না কেন?’

জানি, এই প্রশ্ন অনেক ভাবনাই নিয়ে আসছে আপনাদের মনে। প্রথমত আপনারা ভাবছেন, ‘ইংলিশ ব্যান্ড’কে এ-রকম প্রশ্ন করার অর্থ কী? আপনারা হয়তো ভাবছেন, ইংলিশ ব্যান্ডের সঙ্গে তো রবীন্দ্রসংগীত কোনও অর্থেই মেলানো যায় না।

তাহলে হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করে ওঁদের বিব্রত করার কারণ কী? কারণ আছে। ইংলিশ ব্যান্ড আজ বা কাল, কিংবা বিগত দশ কুড়ি বছরের কোনও বিষয় নয়, স্বাধীনতার আগে থেকেই, কলকাতা তথা বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে, ইংলিশ ব্যান্ড। একসময়ে রবীন্দ্রসংগীত তো বটেই, হেমন্ত-মান্নাদের আধুনিক বাংলা গানও, নিয়মিত বাজাত, এইসব ব্যান্ডরা। কিন্তু হঠাৎ কী হল? এর পিছনেও কি আছে উদারনৈতিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, বাজারের পরিবর্তন? না কি আছে অন্য কোনও বিষয়?

একদিন নয়, পরপর দু’দিন গেলাম এমজি রোড পাড়ায়। বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওরা প্রায় কেউই কথা বলতে রাজি নয়। প্রথমত বাজারে মন্দা, দ্বিতীয়ত বেশ অনেক বছর ধরে বিভিন্ন খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেল বা পোর্টাল ওদেরকে ইন্টারভিউয়ের নামে এতবার বিব্রত করেছে, আর কেউই নতুনভাবে কিছু বলতে রাজি নয়। তাহলে রবীন্দ্রনাথ? এই প্রশ্নটা করার অবস্থাই খুব একটা ছিল না হয়তো। আজকের দিনে যাঁরা, এই ইংলিশ ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা সকলেই মূলত, নিম্নবিত্ত অর্থনৈতিক শ্রেণির মুসলমান। তাঁদের লেখাপড়া খুব বেশি নয়, বাংলা বলতেও বেগ পেতে হচ্ছে যথেষ্ট। এরকম অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের কথা বলা বিলাসিতা।

কিন্তু হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ, এমনকী প্রায় পুরো বাংলা ভাষার গানগুলোই হারিয়ে গেল কেন ইংলিশ ব্যান্ডের থেকে? এই উত্তরটা খুঁজতে-খুঁজতেই আমরা চলে গিয়েছিলাম, অধ্যাপক নীলাদ্রি রায়ের কাছে। অধ্যাপক রায়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফরমিং আর্টস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। পাশের পাড়ার ব্যান্ড পার্টিকে নিয়ে প্রশ্ন রাখলাম ওঁর কাছে।

নীলাদ্রিবাবু এর উত্তরে জানান, ‘ইংলিশ ব্যান্ডের যারা পুরোনো লোক ছিল, তারা মূলত বাংলার, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সাংস্কৃতিক পীঠস্থান কলকাতার মানুষ ছিল। সাংস্কৃতিক পরিসর সে-সময়ে একভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তার মধ্যে স্থান পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। পরবর্তীতে যদি রাজনৈতিক পালা বদলের কথা বলি, অথবা মডার্ন মিডিয়ার এক্সপোজারের কথা বলি, রবীন্দ্রনাথের গানকে মানুষ অন্যভাবে দেখা শুরু করল, কোথাও একটা কমার্শিয়ালাইজেশনের জায়গা তৈরি হল।

যদিও প্রথম থেকে ধরলে, এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গানই সবথেকে বেশি বিক্রি হয়। কিন্তু আমি যে শিফ্টটার কথা বলছি, সেটা দেখা দিতে থাকল, ২০০০ সালের পর থেকে। একটা সম্প্রদায় রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে যেতে শুরু করল। কেন ২০০০ সালের পর? ওই সময় থেকে একটি বড় অংশের মানুষের মাইগ্রেশন শুরু হল। ব্যান্ডের ক্ষেত্রে যে-সমস্ত বয়স্ক বাঙালি লোকজন ছিল, তারা কেউ মারা গেল, অথবা তারা কাজ ছেড়ে দিল, তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে হয়তো পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে, বা অন্য কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, বাংলার বাইরে চলে যেতে হল।

তার ফলে, ব্যান্ডের পরিসরে একটি বড় শূন্যস্থান তৈরি হল। এই শূন্যস্থান পূরণ করতে যে নতুন মানুষরা এসে যোগ দিল ব্যান্ডে, তারা সম্পূর্ণ অন্য সাংস্কৃতিক বলয় থেকে আগত। ফলত, এখন যারা ব্যান্ড পার্টিতে কাজ করে, তারা রবীন্দ্রনাথকে সেভাবে চেনে না। উত্তর এবং মধ্য ভারতীয় বলয়ের সংস্কৃতি— চাপ ফেলতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতিদের উপর। যেহেতু ব্যান্ডে কাজ করা বেশিরভাগ মানুষ, ওই বিশেষ বলয় থেকে আগত, স্বভাবতই তারা রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারছে না। হয়তো কিছু সংখ্যক, কারও মুখে রবীন্দ্রনাথের কথা শুনছে, বাজানোর চেষ্টাও করেছে হয়তো।

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, ইংলিশ ব্যান্ডের শ্রোতা এবং ভোক্তা কারা? তারাও কি রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত? একটাও বাঙালি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠানে কি এখন ইংলিশ ব্যান্ডকে ডাকা হয়? না।

যারা এই ইংলিশ ব্যান্ডকে ভাড়া করে, তারাও মূলত কলকাতায় বসবাসকারী ওই বিশেষ সাংস্কৃতিক বলয়ের অবাঙালি মানুষ, সুতরাং ইংলিশ ব্যান্ডও সেই বিশেষ রুচির গান বাজাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয়, এই গোটা পরিমণ্ডলের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কোথাও নেই।’

কোনও বিশেষ ‘পক্ষ’র হয়ে কথা না বললেও, এটা ঠিক, কলকাতায়, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মূলত উত্তর কলকাতায় বাঙালি সংস্কৃতি দিন-দিন হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতির কাছে কোণঠাসা হয়েছে, হয়ে চলেছে। ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথও, আমাদের আলোচনায় উঠে আসা— এই ‘ইংলিশ ব্যান্ড’ পাড়ার ঢিল ছোড়া দূরত্বে জন্মালেও, উত্তর কলকাতার সংস্কৃতি— বর্তমান ‘পপ’ সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথই যেন বহিরাগত হয়ে পড়েছেন।

একথা বলা যায় না যে, আজ, ২০২৫ এ দাঁড়িয়ে, ‘ইংলিশ ব্যান্ড’ খুব ভাল জায়গায় আছে। বরং ডিজে বক্সের সংস্কৃতিতে ইংলিশ ব্যান্ড সংখ্যালঘু। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি আজ তার থেকেও বেশি সংখ্যালঘু নন? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা…