ইডেনে ক্রিকেটপুজো

কলকাতার দুয়ারে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ৫ই অক্টোবর আসর শুরু হয়ে গেলেও, ইডেন গার্ডেন্সে প্রথম ম্যাচ ২৮ তারিখ। গাঙ্গেয় বাংলায় বর্ষা দেরিতে শেষ বলে, মাঠ এবং পিচ তৈরি করতে সময় লাগে। সেই কারণে ঢাকে কাঠি বাজতে বাজতে বিসর্জন পার। তবে দুর্গাপুজোর ঠিক পরেই ঘরে ক্রিকেটের উৎসব, শেষ হতে হতে কালীপুজো সারা। এমন মোচ্ছব বারবার আসে না। এতসব হজম করতে পারলে হয়!  

কলকাতায় প্রথম ম্যাচ বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস। পঞ্চম ও শেষ খেলা নভেম্বর ১৬য় দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। চোখ থাকবে ৫ই নভেম্বর সাউথ আফ্রিকা-ভারতের দিকে। মাঠে সাড়াজাগানো শুরুর শেষ কী রকম হয়, জানতে উৎসাহ তুঙ্গে ওঠার কথা। দেশে বিশ্বকাপের সমস্ত ম্যাচ আগে হয়নি। তা সত্ত্বেও, প্রথম দিকে নেহাতই নিস্তেজ ছিল আইপিএল-এ বুঁদ জনতা। এখন ছুটছে ভারতের ঘোড়া। ব্যাটিং-বোলিং দুইয়েই বাজিমাত করছে রোহিত শর্মার দল। পাঁজি বলছে, অশ্বমেধের পালা ইডেন পৌঁছতে পৌঁছতে সরগরম হয়ে উঠবে বাজার।   

দেশবিদেশে খ্যাতি। আভিজাত্যে, কৌলীন্যে, নান্দনিকতায়, ইতিহাসে, নজিরবিহীন কিছু ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ইডেনের জুড়ি মেলা ভার। ক্রিকেটরসে সমৃদ্ধির এক মহা পীঠস্থান বলা যেতে পারে। বহু তাবড় ক্রিকেটতারকার কথায়, এইখানে পা না রাখলে খেলোয়াড় জীবন অসম্পূর্ণ। এমন বলার কারণ যথেষ্ট। ইতিহাস ১৫৯ বছরের। প্রথম টেস্ট প্রায় ৯০ বছর আগে। সবুজ মখমলের মতো মাঠ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার কয়েক দশক আগেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ইডেনের গালিচা। ব্যাটসম্যান বা বোলার, পিচ সবাইকে কোনও একটা সময়ে সাহায্য করবে। বল শুধু ঘুরবে আর ধুলো ওড়াবে, এমন নয়। প্যাভিলিয়নের বারান্দায় সাদা বেতের চেয়ার। বিলিতি আদবকায়দায় ভরপুর। গ্যালারিঠাসা দর্শকের আকাশকাঁপানো চিৎকার। পরে ফ্লাডলাইটের আলোয় মোহময়ী রূপ। এই পরিবেশে মজেছেন নামী-অনামী সবাই। ক্রিকেটের জন্য বাংলার আতিথেয়তা, আদিখ্যেতা ইত্যাদি তো আছেই।

এহেন ইডেনের সঙ্গে বিশ্বকাপে ভারতের খেলার সম্পর্ক আদৌ সুবিধের নয়। স্বপ্নের মাঠে ঘরের দলের ম্যাচের সংখ্যা সাকুল্যে এক। বিভিন্ন দশকে, ভারতের খেলা নিয়ে আশায় বুক বেঁধে, শেষমেশ নানা কারণে কপাল চাপড়াতে হয়েছে কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমীদের। ১৯৮৭তে, দল ফাইনালে উঠছে ধরে মুখিয়ে ছিল শহর। প্রথম সেমিফাইনালে পাকিস্তানের হার উস্কে দিয়েছিল পরপর দু’বার কাপ জয়ের জল্পনা। মুম্বইয়ের ওয়াঙ্খেড়ে স্টেডিয়ামে গ্রাহাম গুচের ব্যাটের দাপট বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দেয়। কলকাতায় ভারতের বদলে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ফাইনাল দেখতে গ্যালারি ভরেছিল বটে। তবে সাধ মিটেছিল বললে, ইডেনের লাগোয়া হাইকোর্টের অবমাননা হবে।   

ইনিংস ঝুরঝুর করে ধসে পড়তেই গ্যালারিতে সমবেত পাগলামির বিস্ফোরণ। মাঠে দর্শকদের ছোঁড়া অগুনতি জলের বোতলের মধ্যে দু-একটা মদের বোতল। ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড বাধ্য হন খেলা বন্ধ করে শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করতে। টিভির দৌলতে, রূপকথার মাঠে কলঙ্কের সন্ধ্যার সাক্ষী ক্রিকেটদুনিয়া।

এর পরের দুর্ভোগ অন্য স্বাদের। ১৯৯৬-এর সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টস জিতে দুর্বোধ্য কারণে ফিল্ডিং নিয়েও প্রথম ওভারে দু-উইকেট। অরবিন্দ ডি’সিলভার প্রতিআক্রমণ সামলে সামনে গোটা ২৫০ রানের টার্গেট। সচিন তেন্ডুলকরের ব্যাটের শাসনে যখন রীতিমতো চালকের আসনে মহম্মদ আজহারউদ্দিনের দল, নামে বিপর্যয়। ইনিংস ঝুরঝুর করে ধসে পড়তেই গ্যালারিতে সমবেত পাগলামির বিস্ফোরণ। মাঠে দর্শকদের ছোঁড়া অগুনতি জলের বোতলের মধ্যে দু-একটা মদের বোতল। ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড বাধ্য হন খেলা বন্ধ করে শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করতে। টিভির দৌলতে, রূপকথার মাঠে কলঙ্কের সন্ধ্যার সাক্ষী ক্রিকেটদুনিয়া।

বছর পনেরো পর খেলা মাঠের বাইরে। ফাইনাল, সেমিফাইনালের ইডেনে ২০১১য় নেই কোনও নক-আউট ম্যাচ। সবেধন নীলমণি গ্রুপ লিগে ভারত বনাম ইংল্যান্ড। বাকি তিনটে খেলা সাউথ আফ্রিকা, জিম্বাবোয়ে, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও কেনিয়ার মধ্যে। কিন্তু, প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে পুরনো বিবাদের শোধ তুলতে তখনকার আইসিসি প্রেসিডেন্ট শরদ পওয়ার চালেন অভাবনীয় চাল। ভিআইপি-দের খানাপিনার জায়গা প্রশস্ত নয়, এই অজুহাতে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ সরিয়ে নেওয়া হয় বেঙ্গালুরুতে। ১৯৯৬য়ে লজ্জার পর অপমান! খেলার ধর্তাকর্তাদের বালখিল্যসুলভ অভব্যতায়, দুঃখে চুপ করে থাকা ছাড়া শহরবাসীর কিছু করার ছিল না।

বারো বছরে, ইডেনের ঢিলছোড়া দূরত্বে হুগলি দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। বদলেছে অনেক কিছু। ২০১৬য় হয়েছে টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল। প্রশাসকদের মধ্যে ফের বেড়েছে কলকাতা, ইডেনের কদর। পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপে প্রথম তিনবার মিলিয়ে ছটার পর, এইবার ম্যাচের সংখ্যা পাঁচ। গোটা টুর্নামেন্ট ভারতে হওয়া এর একটা কারণ। প্রায় সবকটাই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-সাউথ আফ্রিকা ও সেমিফাইনাল ছাড়া, পাকিস্তান-ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান-বাংলাদেশ লিগে শেষ দিকের ম্যাচ। অনেক কিছু এই দিনগুলোয় নির্ভর করবে। প্রায় প্রত্যেক খেলাই কোনও না কোনও ভাবে, কারও না কারও ভাগ্যে প্রভাব ফেলবে। সামান্য এদিকওদিক হলেই, পাল্টে যাবে অঙ্ক।     

৫ই নভেম্বর বড় ম্যাচ। এর পর, ভারত ও সাউথ আফ্রিকার একটা করে খেলা বাকি থাকবে। অন্যান্য দেশগুলোরও মোটামুটি তাই। লিগ টেবিলে কোন দল কোথায় শেষ করবে, কারা সেমিফাইনালে উঠবে, কাদের নিয়তি রান-রেট ঠিক করে দেবে— ফয়সালা হবে এই সময় নাগাদ। রোহিতদের পালে লাগা হাওয়া কতদূর নিয়ে যেতে পারে, মিলবে তার আভাস। অনুমান করা যায়, ভারত ভাল জায়গায় থাকবে। উন্মাদনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ‘দাদা, টিকিট হবে’ মেসেজ। অন্যান্য মাঠে যাই হোক, ইডেনে সব দলের ম্যাচে আসবেন দর্শকরা। এঁদের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশের। কলকাতায় দুর্গাপুজোর রেশ কাটার আগেই তাঁদের দলের দু-দুটো ম্যাচ। উৎসবের আবহে দুই বাংলার মিলন সংস্কৃতির বাজারেও ক্রিকেটের দাঁত ফোটানোর সুযোগ।

সুযোগ আমাদেরও। দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, চোদ্দ পিদিম, আলোর রোশনাই, লুকিয়েচুরিয়ে কেনা ও প্রকাশ্যে ফাটানো বোমার শব্দ, ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে রিভার্স সুইপ, স্লোয়ার বাউন্সার, চায়নাম্যান, থার্ড আম্পায়ার, হেভি রোলার, ডাকওয়ার্থ-লুইস মেশানো বিচিত্র ককটেল উপভোগ করার। হাতছাড়া করবেন না। তবে, হজমের গুলি অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। নিয়ে ঢুকতে হয়তো পারবেন না, কারণ পুলিশ বলবে এগুলো সব মাঠে ছোঁড়ার ক্ষেপণাস্ত্র। বাড়ি ফিরে দরকার মনে হলে, ‘হাউজ দ্যাট’ বলে টুক করে মেরে দেবেন।