উত্তরবঙ্গ ডায়রি: পর্ব ৯


নভেম্বরের হাওয়া 

যেভাবে লিটমাস কাগজে অম্লতা মাপা হয়, বাতাসের স্বাদ যদি কোনওদিন সেভাবে মাপা যেত, দেখতেন, উত্তরবঙ্গের বাতাস যেন একটা রামধনু বা জলরঙের বাক্সের মতো দেখাত। আমি ‘বাতাসের স্বাদ’ কথাটায় তাপমাত্রার কথাও বোঝাতে চাইছি। তর্কের খাতিরে, যদি এই বাতাস-কাগজটাকে সত্যিই কখনও কাজে লাগানো যায়, তবে আমি চাই সেটা এই সময়ে ব্যবহার করা হোক। এই নভেম্বর মাসে। 

অক্টোবরের পালা-পার্বণ ঢাক-ঢোল ধূমধাম আর কাঁপা উত্তেজনার আর ছুটির আমেজের, মরশুমি শুভেচ্ছার ডিসেম্বরের ঠিক মাঝখানে নভেম্বর যেন একটা গোপন কথা। উত্তরবঙ্গে নভেম্বর বয়ে নিয়ে আসে বাতাস। শরীর হয়ে ওঠে একটা থার্মোমিটার; প্রতি সকালে আগের দিনের থেকে একটা করে বেশি গরম জামা চড়াতে হয়। 

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মনে পড়ে যায় একটা না একটা সুতির চাদরের কথা, সেটা বাটিক হোক বা সম্বলপুরি কিংবা পুরী বা শান্তিনিকেতনে কেনা। সকাল-সন্ধ্যার ঠান্ডার পক্ষে যথেষ্ট। ঠিক শীত আটকাতে তো নয়, এ-চাদর গায়ে জড়ানো হবে শীতকে আহ্বান জানাতে। শীত এখনও এসে পৌঁছয়নি, পাঠিয়েছে শুধু প্রথম বার্তাবাহকদের। ঘাসে-পাতায় জমা রাতের আর ভোরের শিশির তার মধ্যে প্রথম। ভাইফোঁটার সকালে ঘাস-পাতার ওপর থেকে শিশির সংগ্রহ করে ভাইয়েদের কপাল সেই শিশির দিয়ে  মুছিয়ে দেওয়া যেন এই আগমনের স্বীকৃতি, যে শীতকাল পরের কয়েক মাস জাঁকিয়ে বসবাস করবে এই অঞ্চলে।

দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে বাতাসের গন্ধ বদলে যায়। রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, জমায়েতে খড়কুটো-পচা পাতা— আর এখন প্লাস্টিক— পোড়ানো শুরু হয়ে যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিকালবেলা ছাদ থেকে দেখা যায় যে সেই ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে মিলিয়ে গেল। মাত্র এক মাসের মধ্যেই, এই একই ধোঁয়া আরও একটু হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠবে, যেন ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে থাকা অনমনীয় শিরদাঁড়া।  

শুধু গন্ধ নয়। বাতাসে ঠান্ডার আমেজ লাগতে শুরু করে এই সময়ে, সূক্ষ্ম, অবিচল। মাঝ-নভেম্বরের কোনও এক সকালে হঠাৎ বাড়িময় ন্যাপথালিনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে— গরমে মাসের পর মাস ঝিমিয়ে থাকা লেপ-কম্বল থেকে সেই গন্ধ সরাতে এবং আসন্ন শীতের উপযোগী করে তুলতে তাদের বার করে রোদে দেওয়া হবে বারান্দায়। হঠাৎ, শীত এসে যাবে। কেউ-কেউ সারাদিনে দু-একবার কথাটা বলে উঠবেন, যেন সেটা সত্যবাদ, সংবাদ-বিশেষ, বা কোনও কাছের মানুষের জন্মদিন। 

এর পরেই ডুয়ার্সে বাতাস যেন মোটাসোটা হয়ে ওঠে। ছোট দিনের এই মরশুমে, দুপুরের প্রথম দিকটাতেই এই বাতাস ক্ষেতে বেড়ে ওঠা ফসলের উপর কুম্ভকর্ণের মতো এলিয়ে যায়। কাকতাড়ুয়ার মাফলার ঠান্ডা হাওয়ায় নড়ে চলে, এক বুড়ি ঠাকুমা অক্লান্তভাবে নিজের মাথার শাল টেনে অবাধ্য বাতাসের মোকাবিলা করে চলেন, শীতের পড়ন্ত রোদে পাতার দুর্বল ছায়া দেখে-দেখে একটা ছাগল ভাবে সেটা খাওয়ার চেষ্টা করবে কি না।   

বাতাসের স্বাদ পরখের যে লিটমাস কাগজের কথা আমি কল্পনা করে নিয়েছি, সেটা উত্তরবঙ্গবাসীদের মনে গেঁথেই থাকে। গ্রীষ্মকালে সুক্‌নার ইলা পাল চৌধুরী মেমোরিয়াল (ট্রাইবাল) হিন্দি হাই স্কুলের পাশ দিয়ে গাড়িতে বা সাইকেলে গেলে আমরা জিভ বার করে রাখতাম, যেন ক্রমশ-নিকটবর্তী পাহাড়ের ঠান্ডা বাতাস একটা বরফের ললিপপের মতো চেখে দেখতে পারি। এখন মুখ বন্ধ করে রাখি, আর এই বাতাস আমাদের গাল আর কপালে থাপ্পড় মেরে যায়। প্রায় পেশাদার মালিশকারীর হাতে দেহে রক্তসঞ্চালন ফিরিয়ে আনার অভিজ্ঞতার সমান।   

তিনধারিয়া পৌঁছে বাতাসকে কোনওমতেই আর বন্ধু বলা যায় না। সে হয়ে ওঠে ছিঁচকে চোর, যেটুকু জায়গা পাওয়া যায় তা দিয়েই গলে পড়তে চায়, বিশেষত কান, চোখ আর মুখ। আরও উপরে উঠলে বাতাস ব্যক্তিবিশেষে বদলে যায়—এমন একজন অতিথি যার সঙ্গে দেখা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু নভেম্বরের মাধুর্য এমনই যে এই মাঝের-মাসে সবাই, সবকিছু, এমনকি এই শীতল মানুষটাও ভালবাসতে চায়।     

এর পরেই ডুয়ার্সে বাতাস যেন মোটাসোটা হয়ে ওঠে। ছোট দিনের এই মরশুমে, দুপুরের প্রথম দিকটাতেই এই বাতাস ক্ষেতে বেড়ে ওঠা ফসলের উপর কুম্ভকর্ণের মতো এলিয়ে যায়। কাকতাড়ুয়ার মাফলার ঠান্ডা হাওয়ায় নড়ে চলে, এক বুড়ি ঠাকুমা অক্লান্তভাবে নিজের মাথার শাল টেনে অবাধ্য বাতাসের মোকাবিলা করে চলেন, শীতের পড়ন্ত রোদে পাতার দুর্বল ছায়া দেখে-দেখে একটা ছাগল ভাবে সেটা খাওয়ার চেষ্টা করবে কি না।        

শীতকাল ঠান্ডা হবেই, এবং ঠান্ডা হবে শীতের বাতাস। কিন্তু আসন্ন শীতের নাটকটা একটু আলাদা— যখন না-পৌঁছনো শীতের ভূমিকা যেন শীতের চেয়ে লম্বা, এবং মধুর। ‘আদুরে ঠান্ডা’, ‘মিষ্টি ঠান্ডা’— এই শব্দগুলো কথোপকথনে, বাড়ির খাবারের সিদ্ধান্ত আর পিকনিকের খাদ্যচয়নে, পোশাক-আশাকের কথাবার্তায় বার-বার উঠে আসবে। এই সবই নভেম্বরকে নিজস্ব একটা মরশুম বলে চিহ্নিত করে তুলবে— আসল মরশুমের প্রতীক্ষার মরশুম। ওই লিটমাস কাগজের রং প্রতিদিন অল্প-অল্প করে বদলাবে। কিন্তু এই রং কখনই প্রত্যাশিত হয়ে উঠবে না, কেননা হঠাৎ কোনও অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দিন আমাদের পুর্ববর্তী, মোলায়েম ঠান্ডার দিনের কথা ভুলিয়ে দেবে। অন্যান্য মহাদেশে গাছের পাতার রং বদলায়, খসে পড়া পাতার নামে মরশুমের নাম হয়ে ওঠে ‘ফল’ (Fall)। আমাদের দেশে এই মরশুমের নাম বোধহয় হওয়া উচিৎ ‘হাওয়া’— যে শব্দ উত্তরবঙ্গের বহু ভাষার, বহুভাষী মানুষের কাছে সর্বজনীন।         

ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

Read in English