‘এবং ঋতুপর্ণ’ ‘টক শো’র জন্য ঋতুদার সঙ্গে আমার প্রফেশনাল আলাপ; অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার হত ইটিভি বাংলায়; সে-সময় আমরা বেশ কয়েকজন, ‘FTII’ থেকে পাশ করে এসে, ইটিভির কয়েকটা অনুষ্ঠান করেছিলাম; যার মধ্যে অন্যতম ‘এবং ঋতুপর্ণ’।
সালটা ২০০০, ঋতুদা আমায় ডাকলেন, ‘এবং ঋতুপর্ণ‘র ডিওপি হিসেবে কাজ করার জন্য; টক শো-টি পরিচালনা করেছিলেন, শৌভিক মিত্র, আবহ নির্মাণে দেবজ্যোতি মিশ্র। ক্যামেরার দায়িত্বে আমি;
আরও পড়ুন: নিল ডাউন করে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ!? লিখছেন, বিশ্বনাথ আচার্য
মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ— অনেক গুণীজন এসেছিলেন, শো-টির অতিথি হয়ে; ঋতুদা তাঁদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আড্ডা দিতেন সম্পূর্ণ ঘরোয়া ভঙ্গিমায়। কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ঋতুদার, কোন সংলাপের পর কোন প্রসঙ্গে কথা আসতে পারে অনায়াসে ধরে ফেলতেন। এই কারণেই ‘এবং ঋতুপর্ণ’ এত জনপ্রিয় শো হয়েছিল।



সেই প্রথম ঋতুদার বাড়িতে গেলাম। ‘১৮ A ইন্দ্রাণী পার্ক’। ঋতুদা একা ছিলেন বাড়িতে, আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বসার ঘরে। ঋতুদার বসার ঘর ঠিক যেভাবে সাজানো ছিল, সেটাই ‘এবং ঋতুপর্ণ’র সেট। ওঁর বসার ঘর যাঁরা দেখেছেন, খুব সহজেই রিলেট করতে পারবেন; অনুষ্ঠানটির সামগ্রিক পরিকল্পনাই ছিল, ‘Let Rituparno be at home’ সেইভাবে দেখতে গেলে, ‘এবং ঋতুপর্ণ’র জন্য আমারই প্রথম ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন ঋতুদা; কিন্তু সেটা কোথাও রেকর্ডেড নেই।
ওঁর বাড়িতে পৌঁছানোর পর, ঋতুদা বসতে বললেন, সে-সময় থেকেই ঋতুদার আশ্চর্য মনোমুগ্ধকর ব্যাক্তিত্ব ছিল। প্রসঙ্গত, আজ আর কারও জানতে বাকি নেই— ঋতুদা প্রথম আলাপ থেকেই প্রায় সকলকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন; একবার সুপ্রিয়া চৌধুরীকে ‘তুই’ বলার জন্য খুব বিতর্ক হয়; অনেকের খারাপ লাগলেও, ঋতুদার সকলকে, ‘তুই’ সম্বোধনটুকুর মধ্যে আপন করে নেওয়ার উষ্ণতা ছিল। ওটা যে ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম কোনও প্রফেশনাল আলাপ, সেই আপন করে নেওয়ার ভঙ্গিই আলাদা করে কিছু বুঝতে দেয়নি।
বসার পর, ঋতুদা ওঁর ঘরের সবটুকু খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে বললেন, দেখলাম। শো-এর সম্পর্কে ব্রিফিং— ইত্যাদির পর্ব চলল। তার পরের কথাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুদা বললেন, ‘অম্লান, দিজ ইজ দ্য ফার্স্ট টাইম, বেঙ্গলস অডিয়েন্স গোয়িং টু সি ঋতুপর্ণ ঘোষ অন স্ক্রিন।’ আশা করি বোঝাতে পারছি, সে-সময় ঋতুদা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে গেলেও, বাঙালি দর্শক কোনও মুভিং ইমেজে ঋতুদাকে দেখেননি, কেমন করে ঋতুদা হাঁটেন, বসেন, কথা বলেন— কেউই জানেন না।
ঋতুদা বললেন, ‘এই শো-তে, দ্য ফার্স্ট থিং, বেঙ্গলস অডিয়েন্স উইল নোটিশ ইজ মাই এফিমিনেসি, আই ওয়ান্ট ইউ টু হাইলাইট ইট!’ প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেল, ‘এবং ঋতুপর্ণ’ শ্যুট করেছি, অনেক স্মৃতিই ঝাপসা, কিন্তু ঋতুদার এই সংলাপটুকু আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে; আমার কাছে ‘এবং ঋতুপর্ণ’র জার্নিতে এই মুহূর্তটুকু খুব জরুরি মনে হয়। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ঋতুদা নিজের জেন্ডার আডেন্টিটি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, নিজের প্রথম পাবলিক এপিয়ারেন্সের শোতেই। কোনও লুকোচুরি নেই; আমি ওঁকে মজা করে বললাম, ঋতুদা, ‘FTII’ থেকে অনেককিছু শিখেছি, কিন্তু এফিমিনেসি কীভাবে হাইলাইট করতে হয়, তা তো জানিনা। ঋতুদা বললেন, ‘তুই আর্টিস্ট মানুষ, তোর এস্থেটিক ভাবনা আমার ভাল লেগেছে বলেই তোকে ডেকেছি; প্রতি শো-তে তুই আমার দোপাট্টা পছন্দ করে দিবি, যেভাবে সেটা হাইলাইটেড হয়, তার জন্য তুইই আলো নির্বাচন করবি’।
ঋতুদা বললেন, ‘অম্লান, দিজ ইজ দ্য ফার্স্ট টাইম, বেঙ্গলস অডিয়েন্স গোয়িং টু সি ঋতুপর্ণ ঘোষ অন স্ক্রিন।’ আশা করি বোঝাতে পারছি, সে-সময় ঋতুদা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে গেলেও, বাঙালি দর্শক কোনও মুভিং ইমেজে ঋতুদাকে দেখেননি, কেমন করে ঋতুদা হাঁটেন, বসেন, কথা বলেন— কেউই জানেন না।
তারাতলায়, ইটিভির বেস ব্রিজের ওখানে শুটিং হত; শ্যুটিং-এ ঋতুদার বাড়ি থেকে ট্রাঙ্ক-এ করে অনেক পোশাক আসত রোজ, শেষ দিন পর্যন্ত আলো কেমন হবে, তার সঙ্গে মাননসই পোশাক বেছে দিতাম ঋতুদার জন্য;


‘এবং ঋতুপর্ণ’র লাইট সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বিশেষ; একটা ঘরের অ্যাটমোস্ফিয়ার আনার জন্য— সেট-এ, বিশেষ ভাবে আলো সাজানোর মাধ্যমে ডার্ক একটা টোন ব্যবহার করা হত, ঠিক যেমন ওঁর বসার ঘরে ছিল। যেহেতু ডার্কটোন, আবার একই সঙ্গে ক্যামেরায় ঔজ্জ্বল্য আনার ব্যাপার ছিল, তাই সেট-এর নানা জায়গায় ছোট-ছোট লাইট বসিয়ে রাখা হত। এখনও মনে পড়ে, সামান্য আলোর ঔজ্জ্বল্যের অদল-বদলের জন্য কতবার সম্পূর্ণ আলোর সেট চেঞ্জ করিয়ছিলেন ঋতুদা। বারবার বলতেন, ‘আমার বাড়িতে যেরকম দেখে আসলি, ঠিক সে-রকম হবে’। কাজটা চ্যালেঞ্জিং হলেও সৃষ্টিশীল দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ।
একদিন প্রযোজনা সংস্থার তরফে টাকা মেটানোর সমস্যা তৈরি হয়, আমি ঠিক করি বকেয়া টাকা না পেলে কোনও ভাবেই যাব না; এদিকে ঋতুদার শ্যুটিং, প্রযোজনা সংস্থাও সে-সময়কার একজন স্বনামধন্য ডিওপিকে দিয়ে আলো করিয়ে রেখেছেন; আমি বাড়িতে বসে। হঠাৎ ফোন, ঋতুদা সেটে এসে আলো দেখেই চিনে ফেলেছেন, এ-আলো আমার করা নয়, ওমনি সোজা শ্যুট না করে বাড়ি। কোনও শিল্পীর নির্দিষ্ট কাজের ভঙ্গি চেনার নিজস্ব ক্ষমতা ছিল ওঁর, সে-কারণেই এত ভাল করে মানুষের মন পড়তে পারতেন, যা কোথাও গিয়ে ‘এবং ঋতুপর্ণ’তে স্বতঃস্ফূর্ত আড্ডার মেজাজটা ধরে রেখেছিল।