কিস্তিমাতের প্রান্তে

Representative Image

প্রান্তবাসী ততক্ষণই সহনীয়, যতক্ষণ সে প্রান্তবাসী। এলিট হর্ম্যে যখন সে প্রবেশাধিকার চায়, এবং সেটা সুকান্তর মোরগের কাহিনির বেচারা প্রাণীটির মতো করে নয়, বরং অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রখর দাবিতেই, তখনই ক্ষমতার দর্পিত মিনারের যাবতীয় প্রগতিশীলতা মুহূর্তে কোথায় যে মেলায়, কে জানে! ক্ষমতার সঙ্গে অবদমিতের এই স্বাভাবিক বিরোধের তাত্ত্বিক ও ফলিত আখ্যান আমাদের চিন্তাজগৎকে সমৃদ্ধ করছে বিগত বেশ কিছু দশক ধরে। উত্তর-উপনিবেশবাদ, মানবীবিদ্যা, বর্ণবাদ-বিরোধিতা বা লিঙ্গসাম্যচর্চার এই উজ্জ্বল ধারা মানবসভ্যতারই এক অর্জন। তবু কোথাও যেন অকাদেমিয় ও সংগঠিত রাজনীতির পরিসরের বাইরে এই দ্বন্দ্বের সম্প্রসারণ প্রতি সন্ধানে, প্রতি আবিষ্কারে আমাদের নতুন করে চমকে দেয়। প্রবুদ্ধ ঘোষের ‘স্পর্ধার ৬৪ খোপ: প্রান্তজনের দাবা’ এইরকমই একটি নির্মোহ সন্ধান, নিবিষ্ট আবিষ্কার।

ক্রীড়াজগতে বর্ণবিদ্বেষ ও লিঙ্গ-অসাম্য নিয়ে লেখা বিদেশি ভাষায় দুর্লভ নয়। হ্যারি এডওয়ার্ডস-এর ‘দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য ব্ল্যাক আথলিট’ বা লেসা ক্লাইন র‍্যানসমের ‘গেম চেঞ্জারস: দ্য স্টোরি অফ ভিনাস অ্যান্ড সেরেনা উইলিয়ামস’-এর মুগ্ধ পাঠকসংখ্যাও যথেষ্ট । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত জিম ক্রো জমানায় খেলাধুলোর জগতে তীব্র বর্ণবৈষম্য নিয়ে গবেষণা ও লেখালিখিও রয়েছে বিস্তর। আফ্রিকাতেও উদীয়মান ফুটবল প্রতিভাদের কীভাবে ইউরোপের ক্লাবে ট্রায়ালের লোভ দেখিয়ে অপরাধচক্র চালান করে দেয় পাচারের অন্ধকূপে, তা নিয়েও লেখালিখি হয়। বাংলা ভাষায় বিশ্ব-ক্রীড়াজগতের এই অন্ধকার নিয়ে লেখার খানিক অভাবই ছিল। ‘স্পর্ধার ৬৪ খোপ’ এই অভাব মেটানোর কাজটিই শুধু করেনি। যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে করেছে। তার কারণ, দাবা কত দূর ‘খেলা’, সেটা নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। বইটি তা নিয়েও খানিক আলোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন দাবা-কে খেলা হিসেবে মানলেও, তা যথেষ্ট শারীরিক খেলা ব’লে মনে না করায় অলিম্পিকের মঞ্চে দাবা কল্কে পায়নি এখন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দাবা খেলা হিসেবেই শুধু উদযাপিত হয়, তা-ই নয়, একান্তই মেধাকেন্দ্রিক, উচ্চকোটির খেলা হিসেবেই সম্ভ্রম পায় আপামরের। আর এইখানেই এলিট কেন্দ্রের উদ্ভাসিত প্রদীপের তলায় প্রান্তবর্গের প্রতি নির্মম বৈষম্যের জমাট অন্ধকার খুঁড়ে বের করে এই বই।

আরও পড়ুন : মশা কীভাবে জড়িয়ে বঙ্গ ইতিহাসের সঙ্গে? লিখছেন আশিস পাঠক…

তিনভাগে বিন্যস্ত এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে দাবার জগতে অপরায়ন, অবদমন ও নাছোড় প্রতিরোধের তিনটি সম্প্রসার। আফ্রিকান ও আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, লাতিন আমেরিকার দাবা এবং সবশেষে নারী দাবাড়ুদের সমানাধিকারের লড়াইয়ের বিশ্লেষণাত্মক বিবরণ মনোগ্রাহী নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই বিন্যাসটিও সূক্ষ্ম স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। কৃষ্ণাঙ্গ দাবাড়ুদের লড়াইয়ে নিপীড়িত ব্যক্তি ও কৌমের সংগ্রাম লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয় অবদমিত, শোষিত ভূখণ্ডে। নারী দাবাড়ুদের লড়াই সেই প্রতিরোধে রাঙিয়ে দেয় অর্ধেক আকাশ ও আমাদের নৈমিত্তিক যাপন।

অবশ্য এইসব অতিক্রম করে এই বই আসলে ধরতে চায় অপরায়নের জটিলতর নীল নকশাকে। সভ্যতার অতি-উদযাপিত অট্টালিকাদের ইঁদুরে কাটা ভিত্তিভূমের সন্ধান একটি পরিচিত প্রয়াস। কিন্তু সেগুলির পুনরুচ্চারণ ও ক্রম-আবিষ্কার একটি পুণ্যব্রত। লেখক সেই কাজটি তন্নিষ্ঠভাবে করেছেন। কিংবদন্তি ববি ফিশারের অন্তর্লীন নারীবিদ্বেষ, অ্যাপরথেইডের শেষবেলাতেও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ দাবাড়ুকে তারই দেশের লোকের দ্বারা পুলের জল থেকে উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার খ্যাতনামা পুরুষ দাবাড়ুর সুজান পোলগারকে তিন তলার বারান্দা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টার কথা পড়তে পড়তে পুরনো শিউরে ওঠাগুলো নতুনভাবে ফিরে আসে।

প্রায় এক বসাতেই পড়ে ফেলার মতো দৈর্ঘ্যের এই বইটির কাছে এইটুকু প্রাপ্তি হলেই প্রায় সব প্রত্যাশা মিটে যেত। যদিও স্বল্প পরিসরে এই বই আরও একটু দুরূহ কাজ প্রাঞ্জলভাবে সেরে ফেলে। প্রান্তিক করে দেওয়ার এই রাজনীতি কীভাবে বহুবিধ পরতে নির্মিত হয়, এই বই দাবার জগতে স্থিত থেকে তার সুচারু সন্ধান চালায়। ফলে সে আমাদের চেনায়, কীভাবে প্রতিবাদী সুজান পোলগার, ছকভাঙা সুজান পোলগার যখন তাঁর ‘আ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নস গাইড টু চেজ’ লেখেন, তখন তাঁর রচিত পাজলের আশি শতাংশে, অবচেতনে নিহিত বর্ণবাদ তাঁকে দিয়ে সাদা ঘুঁটির জয়জয়কার ঘোষণা করিয়ে নেয়। অথবা, বারাকা শাবাজের মতো প্রতিভাময়ী কৃষ্ণাঙ্গ দাবাড়ু, যিনি তাঁর পরিবার ও জনগোষ্ঠীর কাছে প্রতিস্পর্ধার আইকন হয়ে উঠছিলেন, সেই পরিজনের প্রত্যাশার ভার নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে তিনি দাবার প্রতি ভালবাসাটাই হারিয়ে ফেললেন।

একইভাবে দেশভাগ ও প্রান্তিক নারী-অস্তিত্বের জোড়া ফলায় কীভাবে রক্ষণশীল সমাজকে সম্ভাবনাময় বিরুদ্ধ স্বর শোনানো গুলাম ফাতিমারা হারিয়ে যান, বা হাল আমলের কোনেরু হাম্পি কীভাবে মাতৃত্বকালীন বিরতির কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চের কাম্যমান থেকে নেমে আসতে বাধ্য হন, এসবের বিবরণ পাঠককে ভাবনার পথে নামাবেই।

প্রতিরোধের আখ্যানেও এই বই সেই ভিন্নতার খোঁজ দেয়। ক্ষমতার অপরায়ন ও অবদমন কৌশলের বহুবিধ হাইড্রামুখের প্রতিরোধ-নির্মাণও হবে বহুমুখী, অনেক ক্ষেত্রে আপাত-স্ববিরোধী। ফলে গ্র‍্যান্ডমাস্টারের কাম্য রেটিং না ছুঁয়েও, কেনেথ টেরেন্স সলোমন যখন আফ্রিকার প্রথম গ্র‍্যান্ডমাস্টার হলেন আফ্রিকান চেস চ্যাম্পিয়নশিপ জেতায়, তাকেও কি আমাদের দেশের মতো, সংরক্ষণ-বিরোধী উন্নাসিকতার শিকার হতে হয়েছিল? জানা নেই। তবে কেনেথের আত্মপ্রত্যয় আমাদের অনেকটাই অজানাই থেকে যেত তিনি বিশ্বমঞ্চে অবদমিত মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ না পেলে। আবার অন্যদিকে বারবার পুরুষদের টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে, তাদের হারিয়ে পোলগার বোনেরা বা লাজলো-ক্লারা-রা বুঝিয়ে দিয়েছেন নারী ও পুরুষদের টুর্নামেন্টের পুরস্কারমূল্য কম-বেশি হওয়া কেন অর্থহীন এক বৈষম্যের গা-জোয়ারিমাত্র।

দেশভাগ ও প্রান্তিক নারী-অস্তিত্বের জোড়া ফলায় কীভাবে রক্ষণশীল সমাজকে সম্ভাবনাময় বিরুদ্ধ স্বর শোনানো গুলাম ফাতিমারা হারিয়ে যান, বা হাল আমলের কোনেরু হাম্পি কীভাবে মাতৃত্বকালীন বিরতির কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চের কাম্যমান থেকে নেমে আসতে বাধ্য হন, এসবের বিবরণ পাঠককে ভাবনার পথে নামাবেই।

তবে শুধু রম্য হয়ে বা সামাজিক, রাজনৈতিক ভাষ্যের মধ্যে এই বই আটকে থাকেনি। লেখক একজন আন্তর্জাতিক এলো-রেটিং পাওয়া দাবাড়ু, দাবা-প্রশিক্ষকও। ফলে আলোচনায় উঠে আসা বহু ম্যাচের সচিত্র, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণও রয়েছে পাতায় পাতায়; যা নিখাদ দাবাপ্রেমীদের কাছেও বইটিকে প্রিয় করে তুলবে। বইয়ের শেষে সংযোজিত ‘পাঠ ও তথ্যসূত্র’ অংশটি উৎসাহী পাঠককে বিষয়ের গভীরে যাওয়ার পথও দেখাবে।

বইয়ের নির্মাণ উল্লেখের দাবিদার। বইয়ের হালকা, বহনযোগ্য মাপটি ঝরঝরে লিখনশৈলীর পরিপূরক। অলংকরণও যথাযথ। একটিমাত্র মুদ্রণপ্রমাদ ব্যতিরেকে ছাপাতেও যত্ন ও পেশাদারিত্ব সুস্পষ্ট। 

স্বচ্ছ, সুবোধ্য গদ্যের এই বইটি শেষ করার পরে যদিও একটি না পাওয়া থেকেই যায়। অধুনা সময়ে প্রান্তবর্গের আলোচনায় প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের বিষয়ে নীরবতা খানিক পীড়া দেয়। বিশেষত, ট্রান্সজেন্ডার নারীদের ফিডে যখন মহিলাদের টুর্নামেন্টে অংশ নিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, তখন লেখকের কাছে প্রান্তজনের পরিসরকে বিস্তৃত করার দাবি থাকবেই। একইভাবে ভারতীয় দাবার বর্তমান সময়ের যে সুসময় চলছে, তার যে উজ্জ্বল মুখেরা, তাঁদের দিকে তাকালে, তাঁদের যাপন খানিক পর্যবেক্ষণ করলে বেশ বোঝা যায় যে ভারতীয় দাবা, অন্যবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিসরের মতোই— উচ্চবর্ণ নিয়ন্ত্রিত। কোথাও কি কোনও দলিত দাবাড়ু লড়ে যাচ্ছেন কেনেথ সলোমন, হোসে রাউল ক্যাপাব্লাংকা বা পোলগার বোনেদের লড়াই? পরবর্তী সংস্করণে এর সন্ধান পেলেও ভাল লাগবে।