‘আওধ থেকে কলকাতায় নির্বাসিত হওয়ার পর নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ, আর্থিক সংকটের জন্যে বিরিয়ানিতে মাংসের পরিমাণ কমিয়ে আলু দেওয়া শুধু করেন। যে-আলু, ডিমের ভাগাভাগি নিয়ে তোরা এখন মারপিট করিস, সেই সব কিছু আসলে এসেছে শ্রেণিগত কারণে, তাই আমি সবসময়ে বলি, শ্রেণির কাছে ফিরতে হবে’— কলেজজীবনে এই সমস্ত তুরীয় বাণীর বলে বলিয়ান হয়ে আমাদের বিপ্লবের দিকে ঠেলে দিয়েছিল যে-দাদা, সে এখন নামজাদা প্রোমোটার! ‘শ্রেণির স্বার্থে’ ছোট-ছোট ফ্ল্যাট বানিয়ে নিজেই লোনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে! আর এভাবেই বাঙালির জীবনে বিরিয়ানির অবদান… না, বলে শেষ করা যাবে না।
ঠিক যেমন, কিছু বিরিয়ানি খাওয়ার পর মুখের ভেতরটা ওয়াটারপ্রুফ হয়ে যায়। পুরু ডালডার দুর্ভেদ্য লেয়ার ভেদ করে টাকরার চামড়া স্পর্শ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে কুলকুচির ধৈর্য্য!
সেইমতো, অবিচ্ছেদ্যভাবে বিরিয়ানি দম দিয়ে চলেছে বঙ্গ-সংস্কৃতির পরতে-পরতে। সে-জায়গা দখল করে নেবে, সেই সাধ্যি আছে কোনও হুজুগে মাস্তানির? চাইনিজ থেকে শুরু করে, শ্যোওয়ারমা হয়ে আজকের এই যে দক্ষিণ কোরিয়ার বিবিম্বাপি মাস্তানি, কেউ পেরেছে ও-হাঁড়ি টলাতে? আরে আমেরিকি চিকেনভাজার কোম্পানিও মায় মেনুতে বিরিয়ানি জুড়ে দিয়েছে আবার কথা! জোড়বার কারণ অবশ্যি দুটো।

প্রথমত, মাস কানেক্ট। বিরিয়ানি হল… বিরিয়ানির মতো। নিজেই নিজের উদাহরণ! সবাই চেনে। সবাই জানে। সবাই ভরসা করে। ‘বিরিয়ানিই তো, কতই-বা আর খারাপ করবে!’ অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ! তাছাড়া লেখা আছে ‘গৌরমিন্ট’ কিন্তু বলতে হচ্ছে ‘গ্যুঁরমে’; এই সমস্ত পেছনপাকামো থেকে দেড়শো মাইল দূরে হাঁটে বিরিয়ানি! যা লেখা আছে তাই! হাতরুটির পিসতুতো ভাইকে তরতিয়া বলে চালায় না! চাল মানে চাল। মাংস মানে মাংস।
আর সবচাইতে ভাল ব্যাপারটা হল, যে-সমস্ত দু’দিনের সাহেবরা চামচ ছাড়া খেতে পারে না তাদের একেবারে নড়া ধরে নলির হাড় পাতে ঠুকতে বাধ্য করে। শ্রেণি! দ্বিতীয়ত, বিরিয়ানির মধ্যে একটা নিশ্চিন্ত ব্যাপার আছে। অনুষ্ঠানবাড়ির মেনুতে বিরিয়ানি স্থির হয়ে গেল মানে এইবার শুধু সেটাকে জাস্টিফাই করার মতো আগু-পিছু পদাবলি রচনা করতে হবে! একেবারে অ্যানালগ শতকের মধ্যবিত্ত মা-বাবাদের মতো। ক্যালায় কিন্তু ভালওবাসে! অম্বলও হবে কিন্তু পেট-মন দুই’ই ভরবে! সেই সমস্ত মা-বাবারা যেমন খুব অল্পে খুশি হয়ে যেতেন, বিরিয়ানিও তেমন এক পদ নিলেই হয়ে যায়। সঙ্গে চাপ বা ফিরনি হল সে-শতকে এক মাসের খরচা থেকে খানিকটা বেঁচে যাওয়ার আহ্লাদ।
বিরিয়ানির কোটিখানেক অবদানের মধ্যে একটি হল, এই খাবার চটজলদি খ্যাতি এনে দেওয়ার এক অবিস্মরণীয় ক্ষমতা রাখে! আপনি সমুদ্রে নেমে, জীবন বাজি রেখে হাঙরের সঙ্গে সমঝোতা করে, একখানা পাখা চেয়ে এনে স্যুপ রেঁধে খাওয়াতে যান, দেখবেন এক্সট্রা নুন-গোলমরিচ চাইবে। কিন্তু তারপর একদিন বিরিয়ানি রেঁধে খাইয়ে দেখুন! যেমনই হোক-না কেন, গুণগান গাইতে ভুলবে না। কারণ সকলেই জানে বিরিয়ানি রান্নার সঙ্গে কী অপরিসীম খাটনি জুড়ে আছে। কৃতজ্ঞতার দায় খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তুলবে আপনমনেই। তবে, শুধু পাচক নয়, এক্সপ্লোরার হিসেবেও বিরিয়ানি আপনার খ্যাতিকে গগনচুম্বি অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। ‘ওই যে বান্টির বাড়ি, সেটাকে ডান হাতে রেখে এগিয়ে গেলে বাঁ-দিকে যে-গলিটা পড়ে, সেই গলি দিয়ে সোজা গিয়ে, ঈশান কোণ-বরাবর দেখবি একটা পায়রা উড়ছে, ওর নাম ডোনাল্ড, সারাক্ষণ উড়ে-উড়ে শান্তির বাণী দেয়, ওই পায়ারটার চঞ্চু-বরাবর এগিয়ে গেলে দেখবি, আরেকটা গলি আছে, ওটাতে কিন্তু সোজা ঢুকতে পারবি না, খুব সরু গলি তো, আড়াআড়ি করে কাত হয়ে ঢুকতে হবে, ওই গলিটা যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে, খুল জা সিম সিম বললেই দেখবি দেওয়াল সরে গিয়ে একটা ছোট্ট বিরিয়ানির দোকান বেরিয়ে আসবে! ওই টেস্ট, ওহো! কয়েকটা পাঁঠা তো জীবিত অবস্থায় নিজেরাই চেয়ে আদা-রসুন বাটা খেয়ে নেয়, যাতে ওদের রান্না করতে কোন অসুবিধা না হয়’… কিন্তু আজকাল এই এক্সপ্লোরারদের ক্ষমতা ও সংখ্যা কমে আসছে। ভ্লগার সভ্যতার আগ্রাসনের সঙ্গে পেরে উঠছেন না ঠিক।

এই সমস্ত ভ্লগার ভাই-বোনদের ভিডিয়ো দেখে আশ্চর্য হয়ে ভাবি, যেভাবে বিরিয়ানির দাম কমছে, তাতে বোধহয় কিছুদিন পর থেকে বিরিয়ানি খেলে দোকান থেকে হাতে কিছু টাকাও দেবে। তখন মনে পড়ে, বেচারা ওয়াজেদ আলি সাহেবের কথা। সঙ্গে আবার এটা ভেবেও ভাল লাগে যে, তখন যদি ফুড ভ্লগারদের দৌলতে নবাব সামান্য টাকায় মাটন বিরিয়ানির হদিশ পেতেন, তাহলে প্রথমত বিরিয়ানিতে আলু পড়ত না। দ্বিতীয়ত, কলকাতা বিরিয়ানির আলাদা পরিচয় তৈরি হত না। তৃতীয়ত, অনেক টি-শার্ট এবং মিম তৈরির কারখানা কনটেন্টের অভাবে বসে যেত, আর শেষ পর্যন্ত তোমাকেই চাই! কারণ কিছু জিনিস কখনও বদলায় না, ঠিক বিরিয়ানির প্রতি আমাদের নির্ভরতার মতো। কিন্তু চল বদলায়, চালও বদলায়, যখন দেখি হাঁড়ি ভাসান দিয়ে দেওয়ার মতো ঘি আর মাখন ছড়ানো হচ্ছে বিরিয়ানির ওপর। দেড় কিলো-দু’কিলো শুধু ঘি আর মাখন। চোখে জল আর গলায় টকজল উঠে আসছে কিন্তু বিরিয়ানির প্রজনন থামছে না। পাড়ার মোড়ে-মোড়ে শহরের কোনায়-কোনায়, একেবারে বড় রাস্তার উপর, ট্রামবাসের ধুলো খেয়ে ‘হিডেন জেম’ হয়ে জ্বলজ্বল করে অদম্য গতিতে দুদ্দাড় করে এগিয়ে চলেছে একের পর এক বিরিয়ানির দোকান! শুধু একটু অদ্ভুত কিছু করতে হবে, ব্যাস! তাহলেই কিছুদিনের মধ্যেই দোকান হিট আর দোকানদার সেলিব্রিটি৷ খ্যাতি একেবারে ঝরে-ঝরে পড়বে। বলেছিলাম না, চটজলদি খ্যাতি এনে দেওয়ার এক অবিস্মরণীয় ক্ষমতা! চতুর পাঠক হয়তো বলবেন, সে-ক্ষমতা তো আজকাল বিচিত্র পরোটাদেরও কিছু কম নেই হে! তার উত্তরে বলতে পারি না, অনুষ্ঠানবাড়ির মেনকোর্সে যেদিন বিরিয়ানির জায়গা ওই সমস্ত পরোটা নিতে পারবে, সেদিন হবে আলোচনা আর আবারও আমরা ফিরে আসব সেই শ্রেণির গল্পে! সবার কি আর ক্ষমতা আছে, অনুষ্ঠানবাড়িতে বিরিয়ানি করার? কিন্তু আলোচনাটা তো শুরু হয়েছিল তো নবাব বাদশাকে দিয়ে, তাই না! আর সেই কলেজের দাদা এখন ডুপ্লেতে থাকে! তাহলে পরিশেষে দাঁড়ালটা কী?
এই সমস্ত ভ্লগার ভাই-বোনদের ভিডিয়ো দেখে আশ্চর্য হয়ে ভাবি, যেভাবে বিরিয়ানির দাম কমছে, তাতে বোধহয় কিছুদিন পর থেকে বিরিয়ানি খেলে দোকান থেকে হাতে কিছু টাকাও দেবে। তখন মনে পড়ে, বেচারা ওয়াজেদ আলি সাহেবের কথা।
দাঁড়াল এই যে, এই সম্পূর্ণ অমূলক লেখাটির মতোই বিরিয়ানি খাওয়ার আগেও বিশেষ ভাবনাচিন্তা করার দরকার নেই। একটাই তো জীবন, অত ভেবে কী হবে! বিরিয়ানি খান, বিরিয়ানির আলুটা নিয়ে খুনসুটি করার মতো ব্যক্তিগত জুটুক, ফিরনির ভাঁড়টা চেঁছেপুঁছে সাফ করে দেওয়ার মতো সাহসিকতা জন্ম নিক আপনার অন্তরে— ব্যাস এইটুকু। ও হ্যাঁ, ভয়ংকর নাকউঁচু, পাকা, বিচ্ছিরি টাইপের কিছু লোকজন দেখবেন বলে বেড়ায়, বিরিয়ানি মানেই মাটন বিরিয়ানি, চিকেন বিরিয়ানি বলে কিছু হয় না, ওটা আসলে ভেজ বিরিয়ানির ছদ্মবেশ! হ্যাঁ, এই ধরনের কথাগুলো শুনলে না গা-পিত্তি জ্বলে যায়! আসলে সত্যি কথা সহ্য করার অভ্যাস আজকাল একদম কমে গেছে…