উত্তরের ধ্বংসকাণ্ড

শেষ সাত-আট দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে প্রায় প্রতি বছর ঘটে চলা প্রাকৃতিক বিপর্যয় একটি উত্তরবঙ্গীয় স্বাভাবিক ঘটনা। এতটাই স্বাভাবিক যে, দার্জিলিং পরিসরের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ইন্দ্রবাহাদুর রাই-এর ‘আজ রমিতা ছ’ শুরুই হচ্ছে পাহাড় কেটে করা হিলকার্ট রোডকে প্রাণধমনি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার ঠিক পরের লাইনেই এই ধমনিকে ঘিরে ধ্বসের বছরকার ভোগান্তির কথা বলে। এই ঔপনিবেশিক ধারা মেনেই রাষ্ট্র এখানে আরও চওড়া রাস্তা বানানোর ইচ্ছে ছাড়ে না, নদীকে আরও ড্যাম দিয়ে বেঁধে রাখার ইচ্ছে বাদ দেয় না, রেললাইন বসানোর জন্য ভঙ্গুর পাহাড়ে টানেলের পর টানেল করতে দু’বার ভাবে না। রাষ্ট্র শুরুর দিন থেকে এখানে নিজের মুনাফালোভী চেহারা স্পষ্ট করে রেখেছে। তবে আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বাংলার উত্তরবঙ্গ তৈরি হওয়াটাই একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সূচনা-পর্ব।

উত্তরবঙ্গ বলতে এখানে আমি দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারকেই বলছি, কারণ দুই দিনাজপুর ও মালদা প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মূলত বঙ্গীয় ও খানিক সুরজাপুরি (অহমিয়া-বাংলা উপগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত) পরিসরের থেকে যতটা মধ্যবর্তী ও  নিকটবর্তী, ততটা কাছের এরা কখনওই ভুটান, সিকিম, কামতাপুর, কোচবিহার ও নেপালের ছিল না। অপর পক্ষে দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এই অংশকে বাংলার অংশ করে তোলার প্রথম চেষ্টাটি করেন বখতিয়ার খলজি। বখতিয়ার সফল হননি রাজনৈতিকভাবে দখল করতে, কিন্তু প্রথম বঙ্গীয় প্রভাব, যা এই অঞ্চলে বখতিয়ার খুব অল্প পরিসরে রেখে যান, তা হল ইসলাম। হোসেন শাহের সময়েও এই অংশকে গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলে, কিন্তু হোসেন শাহও মূলত ব্যর্থই হন তরাই, ডুয়ার্স ও কোচ সমভূমিকে বাংলার অংশ করে তুলতে। হোসেন শাহের সময়ও একটি বঙ্গীয় সংস্কৃতি খুব সুস্পষ্টভাবে এই অঞ্চলকে দিয়ে যায় : মাজার ও পীর সংস্কৃতি। দিল্লির মোগলরা ও পরবর্তীতে মুর্শেদকুলি খাঁ-র সাম্রাজ্যও এই অঞ্চলকে অনেক চেষ্টা করেও বাংলা সুবার অংশ করতে পারেনি। তাই ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ বঙ্গের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর হলেও এই অংশে সালটি প্রাথমিকভাবে একটি গুরুত্বহীন বছর। তবে এই আপাত গুরুত্বহীন বছরটিই এই অংশকে বেঙ্গল প্রভিন্সে অন্তর্ভুক্ত করার প্রথম ধাপ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই বছর থেকে ঠিক ১০৮ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে এই অঞ্চল বেঙ্গল প্রভিন্সের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং নর্দার্ন ফ্রন্টিয়ার পার্ট অফ বেঙ্গল প্রভিন্স, নর্দার্ন পার্ট অফ বেঙ্গল, নর্থবেঙ্গল হয়ে জন্ম নেয় আজকের উত্তরবঙ্গ। এই অংশের ক্ষেত্রে অনেকটা গুরুত্ববহ বছর ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ, যা দার্জিলিং এবং ডুয়ার্সকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এই উত্তরবঙ্গে কোচবিহার শুধুমাত্র অফিসিয়ালি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ওই অফিসিয়াল পরিসরটুকু বাদ দিলে কোচবিহারও শাসনতন্ত্র, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের দিক দিয়ে নর্থবেঙ্গলই হয়ে উঠেছিল। তাই নর্থবেঙ্গল তার গড়ে ওঠার সূচনা থেকেই একটি ঔপনিবেশিক পরিসর। এই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার নিয়েই পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ জন্মায়। তাই বেঙ্গল এবং বঙ্গ যে প্রেক্ষিত থেকেই উত্তরবঙ্গকে দেখা হোক না কেন, একটি কটূ সত্যি স্বীকার করে নিয়ে আমাদের এগতে হবে। উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক বিপর্যয় লুকিয়ে রয়েছে রাজনৈতিকভাবে এই পরিসরের বঙ্গের অংশ হয়ে ওঠার বাধ্যতার ভেতর।

আরও পড়ুন : মেঘভাঙা বৃষ্টি উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ের চিরকালীন অজুহাত!
লিখছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য…

বাধ্যতা খুবই সমস্যাজনক একটা ব্যাপার। বাধ্যতা ও লোভ এতটা কাছাকাছি দেখতে যে নিরপেক্ষভাবে দুটোকে আলাদা করা খুব মুশকিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক লোভ  দার্জিলিং পাহাড়ের মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়া বেড়ে ওঠা গাছদের জঙ্গল সরিয়ে চা-শিল্প ও জাপানি পাইনের ফরেস্ট বানাল। ডুয়ার্সের জঙ্গলকে বার্মা থেকে আনা সেগুনের ফরেস্টে রূপান্তরিত করল। ডুয়ার্সে মানুষের তত্ত্বাবধানে থাকা ভেরেন্ডা ঝোপ ও তার থেকে পাওয়া রেশমের চেয়ে ঔপনিবেশিক কাঠামো নির্মাণে সেগুন অনেক জরুরি হওয়ায় ভেরেন্ডা ঝোপদের সরতে হল। গোটা অঞ্চল জুড়ে নেপাল ও ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে মানুষদের ছিঁচড়ে টেনে এনে জোর করে জুড়ে দেওয়া হল নতুন এই প্রকৃতির সঙ্গে, যেখানে টি-গার্ডেন ও ফরেস্টই ভিত্তি। এই গোটা স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি এত সুচারু ও সুগভীরভাবে হয়েছিল যে, এই অঞ্চল জুড়ে এখন একটি মানুষও খুঁজে পাওয়া মুশকিল যে ১৮৩৫ ও ১৮৬৫-এর আগের সময়ের স্মৃতি পূর্বজের কাছ থেকে শোনা গল্পের আকারেও বলতে পারবে। এই ঔপনিবেশিক প্রকৃতিকে এখন নিজের বলেই মনে করে এই অঞ্চল। রাজবংশী ভাষার সাহিত্যিক গণেশচন্দ্র রায় তার গল্পগ্রন্থের ‘আশা-নিরাশার আলো’ গল্পে তাই  নির্ভার হয়ে লেখেন, “চা’বাগানের সরু গলি দিয়া যাইতে যাইতে একসমায় ঘেসঘেসিয়া ফারাসের ভিতি ঢুকি পড়ে। পিকিনিক স্পটৎ নেপালী চেংড়ীলা সোন্তরার দোকান ধরি বসি আছে। সোন্তরা খাইতে খাইতে উমুরা আরো হাটির নাগে গহীনের পিকে। শাল-শিরিষের পাতে পাতে ভাটিবেলার সোনালী ওদ কুহার জাঙালিয়া জাগার ঝিল। কু-ঝিক কু-ঝিক করি টয়-ট্রেন ছুটি যাছে বনুয়া ফারাসের আলো-আন্দার ভাঙি ভাঙি।… প্রকৃতির রূপের ভিড়ৎ মাজি যায়া কাজল দুই লাইন কবিতা আবৃতি করে।” [ গণেশচন্দ্র রায়, ‘হেউতি ধানের জোনাক’]। এই মেনে নেওয়াকে, এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে তাই অ্যাকাডেমিক কাজ, সাহিত্য এবং দেশীয় আচার ও উৎসবের মধ্য দিয়েই শুধু চিহ্নিত করা সম্ভব। ওরাল ন্যারেটরের কাছ থেকে আসলে এখানে কেমন ছিল শোনা আর তিস্তা আসলে কোন খাত দিয়ে বইত, তা চিহ্নিত করতে যাওয়া খুব ফলপ্রসূ কাজ নয়। তার চেয়ে অনেক ফলপ্রসূ কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যর ‘সাইলেন্ট ডিপার্চার : আ স্টাডি অফ কনটেম্পোরারি ট্রাইবাল প্রেডিকামেন্ট ইন বেঙ্গল ডুয়ার্স’ পড়া বঙ্গীয় অবস্থান থেকে এই নীরব স্থানান্তরকে বোঝার জন্য। এই নীরব স্থানান্তরের ফলেই নেপাল আর ছোটনাগপুর থেকে আসতে বাধ্য হওয়া মানুষটি এক সময়ের পর চা-বাগানকে তার প্রাকৃতিক অবিচ্ছেদ্যতা হিসেবে দেখেছে। যে প্রকৃতির জন্ম হয়েছিল লোভের কারণে, যে ঔপনিবেশিক প্রকৃতি ‘বিজ্ঞানসম্মত’-ভাবে অবশ্যই এই ভূগোলের মাটি, পাথর, জলস্তর, নদী, ফরেস্ট, ফরেস্টের প্রাণী— সবকিছুর ক্ষতি করে চলে তাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের রোজকার জীবনকে টিকিয়ে রাখতে রাস্তায় নেমে তীব্র আন্দোলন করতে, এমনকী, মানুষ খুন করতেও পিছপা হয়নি স্থানান্তরিত হয়ে আসা মানুষ। একে লোভ হিসেবে চিহ্নিত করব, না কি বাধ্যতা?

উত্তরবঙ্গে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরের ছবি

যে বাধ্যতায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৫৫-পরবর্তী আসাম, ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ থেকে মাটিহীন হয়ে আসা বাঙালি চাষের পদ্ধতি আর চাষ জমির সংজ্ঞাই পালটে দিল এখানে। উদ্বাস্তু হয়ে আসা মূলত নমঃশূদ্র বাঙালির হাতেই চাষজমির বিস্তার ঘটেছিল। এরা বসবাসের জন্য বাস্তু জমি পায়নি। পেয়েছিল ‘দহলা’ ও ‘ডাঙা’-জাতীয় জমি, যা আজও অধিকাংশ ভাটিয়া রিফিউজি গ্রামগুলির বাড়িঘরের জমির পর্চায় বিদ্যমান। এরা এদেশি (রাজবংশী ও নস্যশেখ) নয়, রাভা নয়, টোটো নয়, মদেশিয়া (ছোটনাগপুর থেকে দাস হিসেবে নিয়ে আসা বিবিধ জনজাতি) নয়, ভুটিয়া নয়— ফরেস্ট এদের কাছের ছিল না কখনওই। তাই চাষকেই যে-কোনওভাবে কাজে লাগাতে হত নতুন ভাবে দেশের মাটি তৈরি করতে। দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপুরাণ’-এ ‘ভাটিয়া চাষ’ বলে একটি পর্বই রাখা হয়েছে ভাটিয়াদের দ্বারা পাল্টাতে থাকা চাষের চরিত্র নিয়ে। এদেশি (রাজবংশী ও নস্যশেখ) জোতদারদের কাছ থেকে এরা জল আসত একসময়, কিন্তু এখন আর আসে না, কিন্তু আসতেও পারে এমন সব ‘দহলা’ জমি চেয়ে নিতে থাকে। ‘দহলা’ জমিতে এত পরিমাণে ধান চাষ হতে পারে, এইটা ভাবনারও বাইরে ছিল এখানকার মানুষের। নিম্নবঙ্গের বাদাজমিকে পোষ মানানো নমঃশূদ্র তার দক্ষতা দিয়ে জানতো কী করে জলের জমিকে চাষের জমি বানিয়ে ফেলতে হয়। একইসঙ্গে ‘ডাঙা’ জমিকে ফেলে না রেখে চাষের পক্ষপাতী সে। তাই সে এদেশি জোতদারকে বলে বসে, “‘বাবু, আপনার এই জমিটা তো পইড়্যা আছে’। জোতদার বলল, ‘পতিত জমি পড়ি থাকিবে না তো ঐঠে কি পাটাক্ষেত হবা ধরিবে? তারা বলল, ‘পাটা না-হয় সরিষা তো হইবার পারে। সরিষা না হয় মটর গাছ তো হইবার পারে। মটর না হয় ধইনচ্যা গাছ তো হইবার পারে’। তারা এমন সব চাষের কথা বলে ও বলে চলে যায় যে-সব চাষের কথা এদিককার চাষী কোনোদিন শোনেই নি।” [ দেবেশ রায়, ‘তিস্তাপুরাণ’]।

ধান পাকার সময় তার দায় থাকে না এদেশীয় রীতি মেনে ‘গণশার ভোগ’ হিসাবে জমির একাংশ ধান হাতির জন্য তুলে রাখার। সে হাতির পথ আটকাতে জমিকে দুর্গের মতো করে তোলে প্রায়। জলের স্বাভাবিক পথকে জমি-দুর্গের পরিখা করে তোলে কেটে কেটে অন্তত এক দশকের শ্রমে ও পরিকল্পনায়। হাতির সঙ্গে বাঙালি ভাটিয়া যত হিংস্র হয়েছে, তত হিংস্র কখনোই এদেশীয়রা হয়নি।  কৌম-অবচেতনে হাতির উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির জন্যই কি এই আচরণগত পার্থক্য? নিষ্ঠুরতা কি অনুপস্থিতির জন্য এমন ভাবে উপস্থিত হয়?  হাতির উপস্থিতি তো রয়েছে দুইবারের রিফিউজি হয়ে আসা এখানকার ভাটিয়াদের জীবনে। অসমে প্রায় এক দশক ধরে গড়ে তোলা চাষের ক্ষেত, গ্রাম, গৃহস্থালি যখন ‘বঙ্গালি খ্যাদাও’-এর সামনে দুরমুশ হচ্ছিল, তখন হাতি ব্যবহৃত হত জমির ধান ধ্বংস করতে, বাড়ি ভাঙতে, এবং পুকুরে লুকিয়ে রাখা গৃহস্থালি ও বাক্সে রাখা টাকাপয়সা ও গয়না তুলে এনে লুঠ করতে। এখানে এসে হাতিকে রোখার জন্য নিজের মতো করে প্রকৃতিকে বানিয়ে নেওয়াকে শুধুই একমাত্রিক নিষ্ঠুরতা বলে চিহ্নিত করার প্রিভিলেজ কি দুইবারের রিফিউজি ভাটিয়াদের কখনওই আছে? এইভাবে আস্তে আস্তে সেটল করতে থাকা রিফিউজি জলের জমি নিতে থাকল। ‘দহলা’ ছাড়িয়েও ঢুকে পড়তে থাকলো  ‘ডারা’, ‘কুড়া’, ‘দোলা’ নামে পরিচিত এদেশীয় জলজ জগৎদের ওপর। তার এই দখল দেখে এদেশীয় মানুষ প্রথমে খানিক থমকেছিল। তারপর নিজের দেশ, নিজের জল হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এই উদ্বেগ থেকেই জমি করে ফেলল জলের মাটিকে। এই লোভের চূড়ান্ত পর্যায় হল শেষ দশকের প্রায় পুরোটা জুড়ে নদী গর্ভ থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালি তোলা।

ঔপনিবেশিক প্রকৃতির নির্মাণকেই নিজেদের বলে মনে করল উত্তরবঙ্গ…

এই বিবিধ অসহায়তা ও বাধ্যতা ধীরে ধীরে লোভ হয়ে মুনাফার সীমানায় ঢুকে পড়েছে রাজনৈতিক নিয়মেই। দার্জিলিং পাহাড়ের রাজনৈতিক স্বাধিকার পাওয়ার লড়াই এমনই একটা প্যারাডক্স। বাইরে থেকে যাকে হয় রাজনৈতিক অধিকারের লড়াই, নইলে বাঙালি এবং এলিট-বিদ্বেষ হিসেবেই শুধু চিহ্নিত করার চল রয়েছে, ভেতরের চোখের মারফতে দেখলে তা বহুস্তরীয় জটিল হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক লোভের ফলাফল হিসেবে গড়ে ওঠা ধূপি বন, জাপানি পাইনের সারি থেকে গাছ কেটে বন দপ্তর ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার  যে টাকা করেছে, তার একাংশও পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে ব্যয় করা হয়নি, যতক্ষণ না অবধি আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছে। মজার ব্যাপার হল, এই আন্দোলনের ফান্ডিং জোগাড় করতে এবং নিজের ব্যক্তিগত মুনাফার জন্যও ঔপনিবেশিক ফরেস্ট থেকে গাছ নির্বিচারে কেটেছে আন্দোলনকারীরা। তাই নিয়ে আন্দোলনকারীদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দন্দ্ব বেধেছে। কালিম্পং-এর প্রেক্ষিতে লেখা ছুদেন কাবিমোর ‘ফাৎসুঙ’ উপন্যাসে খুব স্পষ্ট ভাবে এর উল্লেখ রয়েছে : ‘ওরা জিভিসির নাম করে গাছ কেটে-কেটে বিক্রি করছে… গাছ কাটার পারমিশন নাকি উপর থেকেই নিয়ে এসেছে বলছে। কী করব আমরা, চিফ?’ [ অনুবাদঃ শমীক চক্রবর্তী] । এইখানে এসে সবকিছু গুলোতে থাকে। একটি ঔপনিবেশিক প্রকৃতি, যাকে মুনাফার জায়গা ছাড়া কিছু ভাবে না ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বওয়া একটি রাজ্য সরকার, প্রতিরোধের সময় সেটাকেই আবার মুনাফার পরিসর হিসাবে ব্যবহার করছে একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক আন্দোলন। এই ঘোলাটে হওয়া পরিসর আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনেস্ট্রেশন দার্জিলিং পাহাড়ের ট্যুরিজমের কেন্দ্র ঔপনিবেশিক একটি শহর থেকে সরিয়ে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে চায়। হোমস্টে হওয়ার অর্থনৈতিক লাভ দার্জিলিং ও কালিম্পং-এর গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে, যা আগে কখনওই হয়নি। মজার ব্যাপার এই বিকেন্দ্রীকরণের পথ ধরেই আবার লোভ এসেছে। যে লোভে একের পর এক বাড়ি অ-পাহাড়িদের লিজ দিয়ে দেওয়া হয়। বাইরের লোকের কাছে পাহাড়ের বাড়ি কখনওই বাড়ি নয়, তা হয় তার টাকা রোজগারের পথ, নয়তো তার খানিক হাঁফ ছেড়ে বাঁচার কয়েকদিন। বিকেন্দ্রীকরণকে কাজে লাগিয়ে পুঁজি কীভাবে মুনাফা-কেন্দ্র তৈরির ক্ষমতা রাখে, তার আদর্শ উদাহারণ দার্জিলিং ও কালিম্পং পাহাড়ের হোমস্টে-ভিত্তিক ট্যুরিজম। 

বিবিধ অসহায়তা ও বাধ্যতা ধীরে ধীরে লোভ হয়ে মুনাফার সীমানায় ঢুকে পড়েছে রাজনৈতিক নিয়মেই। দার্জিলিং পাহাড়ের রাজনৈতিক স্বাধিকার পাওয়ার লড়াই এমনই একটা প্যারাডক্স। বাইরে থেকে যাকে হয় রাজনৈতিক অধিকারের লড়াই, নইলে বাঙালি এবং এলিট-বিদ্বেষ হিসেবেই শুধু চিহ্নিত করার চল রয়েছে, ভেতরের চোখের মারফতে দেখলে তা বহুস্তরীয় জটিল হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক লোভের ফলাফল হিসেবে গড়ে ওঠা ধূপি বন, জাপানি পাইনের সারি থেকে গাছ কেটে বন দপ্তর ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার  যে টাকা করেছে, তার একাংশও পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে ব্যয় করা হয়নি, যতক্ষণ না অবধি আন্দোলনের আগুন
জ্বলে উঠেছে।

এত এত সমস্ত কথা শরীর দিয়ে মনে রেখে হাতি তার চেনা পথ ছেড়ে বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে। ড্যামে আটকানো নদী ভাদ্রে তেমন কাদা তৈরি করতে না পারায়, গণ্ডার নদীর ধারে এসে কাদা মাখার অভ্যাস ছাড়ে। পরিযায়ী পাখির দল পিছতে থাকে ও কমাতে থাকে নিজেদের আসা। এমনকী, লতাপাতা আর গাছপালাও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকেই নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এত সবকিছু শুধু বোঝে না যে, পরিসর তার নাম জলঃ “ জল, জল, জল । জল থেকে জলকণা, জল থেকে সিক্ততা। জলের কোনও ভূগোল নেই, জলের শুধু বিজ্ঞান। উঁচু থেকে নিচুতে, উচ্চতা থেকে নাবালে, আকাশে থেকে মাটিতে। জলের শুধু অধঃপতন। চতুর্দিকে গড়িয়ে যেতে লাগল জল। জলরেখা থেকে জলস্রোত, জলস্রোত থেকে জলপ্রবাহ থেকে শাখানদী, শাখানদী থেকে নদী। জলের বিজ্ঞান ভূগোল আর ইতিহাস জানে না। জল শুধু নামতে জানে। তিব্বত থেকে, ভুটান পাহাড় থেকে, সিকিম থেকে জল নামতে থাকল।… নদী ছোটো হোক, আর বড়, তার পথ চাই। গ্রামের ছোটোপথ বা রাজপথের মতো বড়ো। নদীর কোনো স্থানিক আনুগত্য থাকে না…” [ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বর্ষাদুয়ার’] । জলকে স্থানিকভাবে অনুগত করে তোলার জন্য যা যা হচ্ছে এবং হবে, জল তা স্থানীয়ভাবেই ফিরিয়ে দিচ্ছে এবং দেবেও। ফলে উত্তরবঙ্গ জুড়ে বিগত সাত-আট দশক ধরে যে বিপর্যয় ঘটে চলেছে, তা একটি ‘স্বাভাবিক’ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলেই এখানে ‘দায়ী’ খুঁজে বের করার খেলা চলবে। সস্তার ট্যুরিস্টকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা চলবে। কয়টা চিপসের প্যাকেট আর কয়টা মদের বোতল পাওয়া গেল বনের ধারে, তার খতিয়ান দেওয়া চলবে। শুধু ভুলে যেতে হবে ‘উত্তরবঙ্গ’ তৈরিই করা হয়েছিল এমনভাবে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যাতে তাকে ধ্বংস করে মুনাফা করতে পারে।