কুব্রিক : বৈচিত্র ও দ্বন্দ্ব

Article on Stanley Kubrick on his death anniversary by Arup Ratan Samajdar.

বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় যেসব কন্সপিরেসি থিওরিগুলো আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল অ্যাপোলো ইলেভেন আদৌ চাঁদের মাটিতে পা রাখেনি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত গবেষণা ও প্রযুক্তিকে টেক্কা দেওয়ার জন্য পুরোটাই স্রেফ চক্রান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, হলিউডের এক স্টুডিওতে সেট, প্রপ, আলো, কস্টিউম, সবকিছু নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করে এই গোটা নাটক অভিনীত ও চিত্রায়িত হয়। এবং এহেন দুঃসাহসী প্রকল্পে ক্যামেরার পিছনে থাকার স্পর্ধা একজন পরিচালকেরই সম্ভব— স্ট্যানলি কুব্রিক।

কুব্রিককে নিয়ে এরকম নানা বিচিত্র গল্প চালু আছে, সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে। যেমন তিনি সত্যি সত্যিই তাঁর ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব্যারি লিন্ডন’-এর জন্য একটি বিশেষ লেন্সের দাবি করে বসেন। ছবির প্রেক্ষাপট অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটেন, শিল্পবিপ্লবের ঢের আগে। অতএব কুব্রিক ঠিক করেন ছবিতে কোনও বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার করবেন না। ক্যামেরায় ইমেজ ধরা দেবে মোমবাতির আলোয়। কিন্তু এই ইচ্ছে বাস্তবায়িত করতে হলে প্রয়োজন অন্তত ০.৭ এফ স্টপের লেন্স। সেই দুর্লভ বস্তু অবশেষে মিলল কার্ল জাইস কোম্পানির কাছে, যারা খুব সীমিত সংখ্যায় এই লেন্স প্রস্তুত করেছিল। এবং তাদের প্রথম খদ্দের কে? নাসা-র অ্যাপোলো প্রোজেক্ট! সমাপতন, না কি রহস্য আরও ঘনীভূত?

মোদ্দা কথা হল, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, রং চড়ানো গল্প, সত্যি ঘটনা ও কিংবদন্তি মিলিয়ে তৈরি হয়েছে কুব্রিক নামক এক অনন্য শিল্পীর ধারণা, যার ৪৭ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে ছবির সংখ্যা ১৩। শিল্পের চর্চায় বা সমালোচনায় এহেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাধন-ভজন বিশেষ ব্যতিক্রম কিছু নয়, সিনেমার ক্ষেত্রে তো নয়ই। মোটামুটি গত শতকের পাঁচের দশক থেকে, ফরাসি নবতরঙ্গের আশপাশ দিয়ে শুরু হয় ‘অতিউর’-এর চর্চা। অর্থাৎ, বাছাই করা কিছু পরিচালকের কাজ খুঁটিয়ে দেখে সেখান থেকে নান্দনিকতা ও বিন্যাসের কিছু কিছু পুনরাবৃত্তির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। তারপর সেসবের ভিত্তিতে পরিচালকের মতাদর্শ বা বোধজগৎ-এর একটি ধারণা বা কাঠামো তৈরি করে তার মাধ্যমে পুনরায় ছবিগুলিকে পাঠ করা। একসময় পত্রপত্রিকায় এবং শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্গত সিনেমা-চর্চাতেও এই তত্ত্বের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। তারপর ধীরে ধীরে তত্ত্বের অভিমুখ ও চর্চার গতিমুখ, দুই-ই পালটে গেছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সিনেফিলিয়ায় এর প্রায় স্থায়ী ছাপ রয়ে গেছে। আমরা এখনও যখন সিনেমা সংক্রান্ত কোনও তথাকথিত সিরিয়াস আলোচনার মধ্যে ঢুকি, সাধারণত পরিচালকের নাম ধরেই ছবি উল্লিখিত হয়; যেমন ঘটকের ছবি, ফেলিনির ছবি, বা হিচককের ছবি।

আরও পড়ুন : মানুষ-রোবট সম্পর্কে এক অন্য সমীকরণের আভাস দেয় ‘ফো’!
লিখছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য…

এত কথা বলছি, কারণ এই ছোট্ট প্রবন্ধের উদ্দেশ্য অনুধাবনের চেষ্টা করছি। এই একটি লেখায় স্ট্যানলি কুব্রিকের ছবির ওপর একটি সার্বিক মন্তব্য করা শুধু অসম্ভবই নয়, বরং এই মন্তব্যের প্রচেষ্টাই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। আসলে কোনও শিল্পী বা পরিচালকের সমস্ত কাজ একত্রিত করে একক অর্থনির্মাণ ও সার্বিক ব্যাখ্যা – চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া হিসেবে খুব একটা সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয় না। শিল্পসম্ভারের মধ্যে বৈচিত্র থাকে, থাকে দ্বন্দ্ব। সেইসব উপেক্ষা করে একটি নিটোল কাঠামো ও একরৈখিক সূত্রে সব শিল্পকর্ম বেঁধে ফেলতে চাইলে, সেই শিল্পীকে উপলব্ধি করার ব্যাপারে মস্ত ফাঁক রয়ে যাবে। কুব্রিকের প্রসঙ্গে এই কথার উত্থাপন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ তাঁর ছবির সমষ্টি এই সীমাবদ্ধ ধারণা থেকে বেরনোর দিশা দেখায়।

একজন নির্দিষ্ট পরিচালকের ছবির আলোচনায় সেই ‘অতিউর’ চর্চার ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে সাধারণত তাঁর কাজের ধারাবাহিকতা ও অভিন্নতার ওপরেই জোর দেওয়া হয়। বহু বই, প্রবন্ধ, ও ইদানীংকালে ইউটিউব ভিডিও আছে, যেখানে কুব্রিককে নিয়েও এই ধরনের আলোচনা আছে। সেখানে উল্লেখ পাওয়া যাবে পরিচালকের ট্র্যাকিং শট ব্যবহার বিষয়ক পক্ষপাতের। বিশদে বিশ্লেষণ করা আছে, বিভিন্ন ছবিতে বারবার ফিরে আসা পার্সপেক্টিভ পেইন্টিং-এর মতো নিখুঁত প্রতিসম বা সিমেট্রিকাল কম্পোজিশনের। মন্তব্য রয়েছে ‘কুব্রিক স্টেয়ার’ বিষয়েও— একাধিক ছবিতে ব্যবহৃত বিশেষ ক্লোজ আপ শট, যেখানে মূল চরিত্র একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে ক্যামেরার দিকে সটান চেয়ে থাকে। এরকম আরও নানা ধরনের নান্দনিক ও শৈল্পিক সিদ্ধান্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ও পাঠের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার কুব্রিককে নির্মাণের প্রচেষ্টায় যথারীতি প্রাধান্য পায় একক ব্যক্তিসত্তার অবিচ্ছিন্নতা। ব্যতিক্রম বা অসংগতি এরকম আলোচনায় ব্রাত্য।

আর্ট হাউজ ছবির স্বনামধন্য পরিচালকদের কাজ সাধারণত ইন্ডাস্ট্রির বিধি ও যুক্তির বাইরে। তাঁরা অনেকেই ছবি তৈরির গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে থাকেন। ফলে তাঁদের ছবির অর্থনির্মাণের চেষ্টা খুব সহজেই সেই ব্যক্তিমানুষ ও তাঁদের জীবনের দিকে ঠেলে দেয়। অমুক মানুষটি এমন, তাই তাঁর ছবিও তেমন। মূলধারাতেও অনেক পরিচালকের ক্ষেত্রে খুব সহজেই তাঁদের ছবির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কিছু মিল হয়তো পাওয়া যায়। যেমন ফোর্ডের ওয়েস্টার্ন, হিচককের সাসপেন্স, চ্যাপলিনের কমেডি, বা একদম জঁর হিসেবে না ভেবে যদি বিষয়ের দিক থেকে ভাবা যায়, সেই ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে কোয়েন ব্রাদার্সের মার্কিনি মফসসল বা তারান্তিনোর ছবিতে ভায়োলেন্স। আবারও ইঙ্গিত করছি সেই একই দিকে, যেভাবে হোক একটি নিটোল, অবিচ্ছিন্ন ধারণার দিকে যাওয়ার প্রবণতা।

তিনি সত্যি সত্যিই তাঁর ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব্যারি লিন্ডন’-এর জন্য একটি বিশেষ লেন্সের দাবি করে বসেন। ছবির প্রেক্ষাপট অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটেন, শিল্পবিপ্লবের ঢের আগে। অতএব কুব্রিক ঠিক করেন ছবিতে কোনও বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার করবেন না। ক্যামেরায় ইমেজ ধরা দেবে মোমবাতির আলোয়।

এখানেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রয়েছে কুব্রিকের কর্মজীবন। উপরোক্ত নান্দনিক সিদ্ধান্তের মিলগুলিও যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি, তাঁর ১৩টি ছবির সমষ্টির মধ্যে স্পষ্ট বৈচিত্র ও দ্বন্দ্বের উপস্থিতি। তাঁকে নিয়ে অধিকাংশ আলোচনা, অনুরাগীদের উন্মাদনা, ইত্যাদির সিংহভাগই শেষ ছ’টি ছবি নিয়ে। তিনি যে শুরুতে খানপাঁচেক ছবি একেবারেই স্টুডিও সিস্টেমের মধ্যে থেকে বানিয়েছেন, এ-কথা বিশেষ উল্লিখিত হয় না। নিঃসন্দেহে তার একটি কারণ হল, ওই প্রথম ও শেষ পর্বের ছবির শৈলী, বিন্যাস, চলন, ও কাঠামোর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত; তাদের কখনওই একটি নির্দিষ্ট ধারণার মধ্যে বাক্সবন্দি করে ফেলা সম্ভব নয়। আমি এই কথা দাবি করছি না যে, কুব্রিকই একমাত্র পরিচালক, যাঁর ফিল্মোগ্রাফি বৈচিত্রে ভরা। কিন্তু স্টুডিও যুগে এবং স্টুডিও-পরবর্তী যুগে আরও সচেতনভাবে তাঁর ছবিতে সাদৃশ্যের মতোই ভিন্নতাও উদাযাপিত হয়। আজকে দাঁড়িয়ে যদি স্ট্যানলি কুব্রিক নামক একটি ধারা বা ঘরানার কথা ভাবি, এবং সেখানে শুধুমাত্র পরিচিত কিছু নান্দনিকতা ও বিন্যাসের উপাদান উপস্থিত থাকে, তাহলে সেই ভাবনা স্পষ্টতই অসম্পূর্ণ। কুব্রিকের ছবি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পরিচালক/শিল্পীকেন্দ্রিক ভাবনাও যদি ভাবতে হয়, সেখানে অভিন্নতার সঙ্গে দ্বন্দ্বকেও একই স্থান দিতে হবে।

১৯৬১-তে যখন জেমস বন্ডের গল্পগুলি অবলম্বনে ছবি তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে, তখন সেই প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হয় হিচককের কাছে। তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন যে, গুপ্তচরবৃত্তি, অদ্ভুত যন্ত্রপাতি, পদে পদে বিপদ, ও লাস্যময়ী নারীর সাহচর্যে সমস্যার সমাধান— এই ছবিটি তিনি আগের বছরই বানিয়েছেন; আবার বানাতে আগ্রহী নন। হিচকক ইঙ্গিত করছিলেন ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট-এর প্রতি। একই যুক্তিতে বলা যায়, কন্সপিরেসি থিওরি হিসেবে যতই মুখরোচক হোক, কুব্রিক হয়তো সত্যিই অ্যাপোলো ইলেভেনের চন্দ্রাভিযানটি পরিচালনা করেননি। কারণ দু’বছর আগেই ‘২০০১: আ স্পেস ওডিসিবানানো হয়ে গিয়েছিল।