‘কলকাতা দখল’-পুরাণ

Article on history of Robert Clive ocuupying Kolkata and recent Occupy Kolkata slogan by Bangladesh by Amitabha Malakar. Site title Title Primary category Separator

নগদ মুনাফার গল্প না-থাকলে মশাই শহর, এলাকা, কন্টিনেন্ট দখলের গল্প দাঁড়ায় না। ক্লাইভ সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে পাণ্ডববর্জিত দেশে কুচকাওয়াজে মেতে উঠেছিল, কারণ, হাতি, ঘোড়া, কামান, বন্দুক, পাইক-বরকন্দাজ, জাঁদরেল সেনাপতিদের ঘুষ দেওয়ার মোহর, এবং মাথালো গোছের সমাজপতি-ব্যবসায়ীদের আবদার-আহ্লাদ সওয়ার ঠেকনা-বাবদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভূত লগ্নি ছিল। নিজেও হোনহার লোক– বুঝেছিলেন কচুকাটা পর্ব সেরে একবার মৌরসি পাট্টা গেঁড়ে বসতে পারলে রিমেইনিং নেমকহারাম-সহ বেবাক অনুচরবর্গ পাবে… ভালই পাবে— ওঁরও থাকবে টু-পাইস। তা পেয়েছিল। বাচ্যার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হৃষ্টপুষ্ট ইস্টো-খৃষ্টোটি ফুল মার্কস পেয়েই বিজয়কেতন ওড়ান— এদের ভাগ্যাকাশে একচেটিয়া ব্যবসার দিগন্ত উন্মোচিত হল।

অর্থাৎ, ত্রয়োদশ শতকে সমরখন্দ, বুখারায় চেঙ্গিজের অশ্বপুচ্ছশোভিত নিশান ওড়াতে রুশ, তুর্ক, চিনে, মোঙ্গল ছড়াও এদিকে লান্ডিকোটাল, জালালাবাদ থেকে নিপার তীরবর্তী কিইভের মুসাফিরখানাগুলোয় একত্রিত প্রায় সমস্ত জনগোষ্ঠীর ব্যবসায়ীরা যেমন জোট বেঁধেছিল, এখানেও তেমনই সিন্ডিকেট পত্তনি দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়।

রবার্ট ক্লাইভ

সম্প্রতি, বাংলাদেশ থেকে কলকাতা দখলের বজ্রনির্ঘোষ-বোস-মিত্তির শুনছি। আবক্ষ হেনারাঙানো দাড়ি-শোভিত আহ্লাদি-পেল্লাদি ইমাম-মুরুব্বিসহ কুঁচো, মাঝারি নুরবাহারি ল্যাংবোটদের সুরমা-টানা চোখ পাকানো, ‘ফান-সুফারি’-রাঙা দন্ত–কিড়মিড়ানো, মুষ্টিবইদ্দো হস্থ ফাকাইয়া ফাল পাড়া সহ ‘খইলখাতা’, অর্থাৎ কিনা, গুটা ‘বারইতবইশ্য’ দখলের হুমকিতে উফো, সরি উপমহাদ্যাশের আখাশ-বাথাশ প্রখম্ফিত!

আরও পড়ুন : মেট্রো স্টেশনে চুমুতে বাঙালির লজ্জা, কিন্তু অনেক প্রকাশ্য অশ্লীলতাতেই নির্লজ্জ…

এপারের তালেবররাও কম যান না। এক চাচা বর্ডার কাঁপিয়ে ক’দিন খুব তড়পালেন— ‘‘সব রপ্তানি বন্ধ করে দেব, না খাইয়ে মেরে দেব।’’ তারপর ব্যবসায়ী সমিতি ধমকাল, এবং বৃহৎ স্বার্থ প্রকট হলেন। পশ্চিম ভারতের মাফিয়ারা আড়মোড়া ভেঙে গরুর পিঠ থেকে নেমে ঠোঁট চাটতে চাটতে এদিক-সেদিক চাইছে— ‘‘কিছু ছেলে খালে-বিলে, কিছু গেল জেলে, গোটাকয় ভারি দুষ্টু আছে অন্য দলে…’’ তাদের কথা পরে হবেখ’ন। হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলতে লেগেছে বাংলাদেশি হিন্দুদের নিরাপত্তা চাই। এদেশের হিন্দুদের কথা আজকাল আর ভাবছে না। এটা খুবই স্বস্তিদায়ক। রাহুলবাবু অবশ্য বেশ কিছুদিন হল মন্দির পরিদর্শনে বেরচ্ছেন— এদের গুন্ডারা সফদর হাশমি থেকে সুতোকলের শ্রমিক— সকলকে খুন করে ইদানিং ‘সাধু’ সাজার গো অ্যাজ ইউ লাইকে নেমেছে। বোন স্বস্তি দিলে ভাই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কী জ্বালা মাইরি!

ক্লাইভ স্বয়ং আমদানির পথটি বেশ কয়েক শতাব্দী অবধি মসৃণ চলার ব্যবস্থা দেখে গিয়েছিলেন। পেটমোটা বাবুরা নাকে চশমা আর কানে কলম গুঁজে সেই যে কেরানিবৃত্তিতে নিযুক্ত হল, সেই পেশা আজও চলিতেছে।

ইতিহাসে শহর দখলের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। মোটামুটি আমাদের সময়েই অপারেশন বারবারোসার ধাক্কায় একের পর এক সোভিয়েত শহর দখল হয়েছে লেবেনস্ট্রাউমের দাবিতে। অবরুদ্ধ স্তালিনগ্রাদে ‘অপরাজেয়’ ফন পাউলাস-সহ সিক্সথ আর্মির পরাজয় আধুনিক ইতিহাসে গণসংগ্রামের পরিভাষা বদলে দেয়— তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নাগরিক গেরিলাবাহিনী গঠন থেকে হেঁসেল ছেড়ে বেড়িয়ে ‘‘হালার বোরখার মায়েরে বাপ’’ হেঁকে আড়ংধোলাই দিয়ে বিজয় হাসিলের অনুপ্রেরণাও বটে। ‘‘আর যদি একটাও গুলি চলে… আপনারা ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলুন’’, অ্যায়লান-এ-জঙ্গও অবরুদ্ধ জাতিকে খুঁচিয়ে মুক্তিসংগ্রামে নামানোর উদ্দেশ্যেই, এবং পিছনে সোভিয়েত সাহিত্য, ইতিহাস, গণবন্টন ব্যবস্থার উদাহরণ ছাড়াও সাবমেরিন এবং মিগের ঠেকনা ছিল– নয়তো ইন্দিরার অত দায় পড়েনি দু’টি ফ্রন্ট একসঙ্গে ওপেন করবে। রমনার সেই নেতাকে ‘ভারতের দালাল’ ঘোষণার পর এক বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতোর মালা পরিয়ে ঘোরাল ইউনুস-বাহিনী ও জামায়েত— নয়তো কলকাতা দখল ইত্যাদি বালখিল্যপনার আহ্বানে সমগ্র জাতির নজর-ফেরানোর অশ্লীলতা সম্ভব হত? তবু সবটা ফালতু বাখোয়াজি নয়। সাধারণ মানুষ খুন হচ্ছে।

এখানে কার পুছ, থুরি, ন্যাজ নাড়ানো চলছে— সেটাই পর্যালোচনার বিষয়— তবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্ব অশ্ব থেকে অশ্বেতর পুচ্ছে পর্যবসিত, নিঃসন্দেহেই। দুই দেশেরই ধর্মীয় মৌলবাদী ধাঁচা গণরোষের একইরকম প্রকাশভঙ্গিকে আশকারা দিয়ে ফ্যাসিজমের বীজ বুনেছে। হেথায় বাবরি মসজিদ ভাঙলে হোথায় শেখ মুজিবের মূর্তির মাথায় মুত্রত্যাগ চলে। তবে, এরা কখনও, এমনকী, দু-এক পেগ বাড়তি গোমুত্র পান করেও একে-অপরকে তাগ করে গুলি চালায়নি— স্ট্রেঞ্জ!

পিচ্চিরা কি নিয়ন্ত্রণ করেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন?

এমতাবস্থায় ইউনূস সাহেবের টার্গেট ঠিক কী, অর্থাৎ ন্যাজ কোনপ্রকার অঙ্গুলিহেলনে লড়তিছে-চড়তিছে সে-দিকদারির উত্তর প্রয়োজন। গোটা দেশবাসীকে সবরকম সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক  অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ইউনূসের লক্ষ্য? হাসাবেন না পিলিজ!

উপমহাদেশে অস্ত্রব্যবসা ভারত-পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদরা চালায়— চিন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্টদের আমরা সর্বসমক্ষে দেখি না কয়েকটা নেতা-মন্ত্রী ছাড়া। জুজু বলতে কী বুঝি, তা ওয়াঘা সীমান্তে সামরিক উর্দি চাপানো ক্লাউনদের হাত-পা ছোড়া থেকেই পরিষ্কার। নেপাল-ভুটান এই খেলায় নেই, আফগানিস্তান তালিবান শাসন-বাবদ নিজের ভাগ বুঝে নিয়েছে। বাংলাদেশকে ইউনূস এই তবিলদারির বখেরায় ঢোকাবে— পশ্চিম এশিয়ার পেট্রোডলারের বরাভয় থাকলে জিহাদি রোমান্টিসিজমের অমোঘ আকর্ষণে লুটোপুটি শহুরে জনতাকে টুপি দিয়ে তালিবানি রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্নপূরণ বাঁয়ে হাত কা খেল। এর চেয়ে লাভজনক ব্যবসা এই মুহূর্তে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদটির পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়। জামায়েতের তৈরি মৌলবাদী ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে, অতএব সমস্ত অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিন্দুদের, অর্থাৎ কিনা, ভারতের (প্রায় হিন্দু রাষ্ট্র) ঘাড়ে চাপানোর ছক খেটে গেলেই, কেল্লা ফতে! দৃষ্টান্ত ইজ়রাইল— ওইটুকু দেশ, একটু একটু করে গোটা গাজ়া, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, লেবাননকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে ইদানীং নবকলেবর–পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন ব্যবসার দারোয়ানি-বাবদ নির্বিচারে ফিলিস্তিনদের কোতলের ছাড়পত্র ছাড়াও পরের জমি দখলের সনদে ন্যাটো-ভুক্ত দেশগুলির পাঞ্জাছাপ, সামরিক সাহায্য, সমস্ত পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমে একচেটিয়া হামাস-বিরোধিতা এবং নেতানিয়াহুকে বাকায়দা জামাই আদর। বাংলাদেশি বাবুটির হাউস হবে না?

এই ব্যবস্থায় ভারতের সায় আছে বিলকুল। ‘‘ওই দেখো, ওরাও মারছে’’ বলে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের সমস্ত প্রশ্ন মন্দিরের ঘণ্টায় ঝুলিয়ে ধর্মযুদ্ধে গুটকাখোরদের উসকাও। ইসকনের একটা সাধুকে জেলে পুরলে যাদের ধর্ম ‘খতরে মেঁ’, তাদের ‘স্বচ্ছ ভারতীয়’ জেলখানায় ২০২২-এর হিসেব অনুযায়ী ৪,৩৪,৩০২ জন, অর্থাৎ মোট কয়েদির ছিয়াত্তর শতাংশ স্বাধীন নাগরিক বিনা বিচারে বন্দি! এরা হিন্দু-মুসলিম কোনওটাই নয়, স্রিফ গরিব। গৌরী লঙ্কেশদের সুপারি কিলার দিয়ে খুনের হিসেবটাও পাওয়া যাবে লিচ্চয়— তারাও হিন্দু-মুসলমানের খেলায় অংশগ্রহণের বদলে কেবল গরিব ভারতীয়দের হয়ে গলা ফাটিয়েছিল!

ক্রিসমাসে চার্চের বাইরে ইসকন রামনামের গাওনা চালায়, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে বজরং দলের সমাজ সংস্কারকরা মহিলাদের অন্তর্বাসের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কুমারীত্ব ইত্যাদি পরীক্ষা করে। জামায়েতের কলকাতা দখলের হুমকিতে যারা গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচায়, উত্তরপ্রদেশে বুলডোজারের তলায় একের পর এক জনপদ নির্মাণ সংস্থার লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হলে তারা বখরার রোকরা গুনতে বসে।

ইউনূস এবং তার পেটোয়া বাহিনী সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধর্মগুরুদের ডেকেছে— একজনও শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, সাধারণ গৃহবধুকে ডাকেনি। বাংলাদেশে ধর্মীয় বৈষম্য ছাড়া অন্য কোনও ধরনের নিপীড়নের সাম্প্রতিক ইতিহাস, নিদর্শন নেই? আছে? তাহলে সেসব ক্ষেত্র থেকে প্রতিনিধিরা ডাক পেলেন না কেন? সবাই পেট ভরে ভাত খেয়ে কাজে যায়? সকলে ঠিকঠাক বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের বকেয়া টাকা, পেনশন পেত? সকলের স্বাস্থ্য-শিক্ষার সুব্যবস্থা সরকার দেখেছিল, যেমনটা স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলিতে নিয়ম? মিলিটারি এবং পুলিশের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক লক্ষ গুম-খুন এবং রাস্তায় গুলি চালিয়ে নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যার নালিশ সত্তেও দেশের সংবিধানে জনগণের স্বার্থরক্ষার, প্রকারান্তরে সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের ক্ষমতা খর্ব-সংক্রান্ত কোনও আইন সংশোধন তো হল না— প্রশ্নটাই তুলল না কেউ। সময় পায়নি জামায়েতের মোল্লারা?

গাজা স্ট্রিপেও চলছে দখলদারির খেলা

কলকাতা দখলের জন্য কি নিকারাগুয়ায় যেমন মার্কিনরা কন্ট্রা লেলিয়ে দিয়েছিল, তেমনই ঢাকায় দক্ষিণপন্থী মিলিশিয়ায় রূপান্তরিত খুনি প্যারামিলিটারি ছেড়ে দেওয়াটা জরুরি? তার মানে কি আগে সমস্ত বিরুদ্ধ-স্বর গলা টিপে খতমের পর ঢাকা দখল করতে হবে অন্য এক বড় খেলার নিষ্ক্রিয় দর্শক তৈরির জন্য? অর্থাৎ, এমন এক সন্নাটা— যা গাজ়ায় শিশু হাসপাতালে বোমা ফেলার বিরোধিতা করে না, সিরিয়ায় সিআইএ-নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন দেখে না, কুর্দদের চারপাশ থেকে ঘিরে খতমের পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানায়, লিবিয়াকে দ্বিখণ্ডিত গৃহযুদ্ধের স্থায়ী ক্ষেত্র বানিয়ে তেল নিষ্কাশনকে আধুনিক বাণিজ্যের কোল্যাটেরাল ড্যামেজ মনে করে এবং সৌদি আরবে পরকীয়ার অভিযোগ প্রমাণ না হলেও মহিলাদের মুণ্ডচ্ছেদকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জরুরি সামাজিক অভ্যাস বলে মানে— এরাই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় পা মুছে জাতীয় সংগীত বদলানোর ছক কষে।

তাতেও ভারতের পূর্ণ সমর্থন মিলবে। এদেশের প্রধানমন্ত্রীও নেতানিয়াহুর গালে চুমু খেয়ে এসেছে। আরাফাত ইন্দিরাকে জাপটে ধরেছিল ঠিকই, তবে কাস্ত্রো কিসিকিসি খেয়েছিল যেকালে, সেকালে সোভিয়েত সাবমেরিন… মিগ…গম… ইত্যাদি প্রভৃতি…

ইতিহাসে শহর দখলের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। মোটামুটি আমাদের সময়েই অপারেশন বারবারোসার ধাক্কায় একের পর এক সোভিয়েত শহর দখল হয়েছে লেবেনস্ট্রাউমের দাবিতে। অবরুদ্ধ স্তালিনগ্রাদে ‘অপরাজেয়’ ফন পাউলাস-সহ সিক্সথ আর্মির পরাজয় আধুনিক ইতিহাসে গণসংগ্রামের পরিভাষা বদলে দেয়…

ভারতীয় এবং বাংলাদেশি দক্ষিণপন্থী মৌলবাদীরা একযোগে স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস এবং সে-লড়াইয়ের ইতিহাসকে অস্বীকার করে। আগেই বলেছি, উপমহাদেশে ধর্মান্ধদের বৈষম্য নির্মাণের একটাই ধাঁচা। এদেশে বলা হচ্ছে, ২০১৪-য় দেশ স্বাধীন হয়েছে, অর্থাৎ, মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার, বা গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য ১০০০ টাকা ছাড়ানোর পর— বাংলাদেশে মৌলবীরা জোর গলায় প্রচার চালাচ্ছে ২০২৪-এর জামায়েত পরিচালিত অভ্যুত্থানই স্বাধীনতার লড়াই, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় আদতে ভারতের গোলামে পরিণত হওয়ার দাস্তান। ক্লাইভের পার্ষদরাও বলেছিল, এবার নেটিভরা সভ্য হবে। তারা চাবুক চালাত, তালিবানরাও চালায়। বাংলাদেশেও একই দাবিতে শোরগোল, ঠিক যেমন এদেশে সম্মান-রক্ষার্থে ভাইগণ প্রায়ই অসবর্ণ বিবাহে ইচ্ছুক বোনেদের মাথা কেটে সম্পত্তি বাগানোর পথ নিষ্কণ্টক করছে।

অর্থাৎ, আবার সেই ইকনমিক্স! চাঙ্গা করতে মগরেবি তেল মাখান দু-বেলা, কাজ দেয়নি রোহিঙ্গাদের বেলায়, তবে এনগেজড্ থাকা গিয়েছিল।বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের দখল নিতে মরিয়া কিছু বাণিজ্যগোষ্ঠীর তমন্না-মোতাবেক নতুন রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ চলবে— তমন্না সরফরোশির নয়, পুঁটি মাছের লাফালাফি, তাই ‘ফরফরোশি’। তিড়িংবিড়িং চলছে।

ক্লাইভ স্বয়ং আমদানির পথটি বেশ কয়েক শতাব্দী অবধি মসৃণ চলার ব্যবস্থা দেখে গিয়েছিলেন। পেটমোটা বাবুরা নাকে চশমা আর কানে কলম গুঁজে সেই যে কেরানিবৃত্তিতে নিযুক্ত হল, সেই পেশা আজও চলিতেছে। দেশভাগের পর, তারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা চল্লিশ গুণ বৃদ্ধি পেল, আর যুবসমাজ ইসলামি রাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়ার আনন্দে আত্মহারা। লে, এবার ঠেলা সামলা! সামনে কইলকাত্তা দখল নামক মিথ্যে লড়াইয়ের গাজর ঝুলিয়ে ন্যাজে— সেই ন্যাজ! এমন মোচড় মেরেছে যে, মেয়েমদ্দ দিগবিদিকজ্ঞানশুন্যর ন্যায় যেদিকে পারছে দৌড়চ্ছে— চতুর্দিকেই এল ডোরাডো, যেদিকে যাও নিউ মার্কট, সব রাস্তার শেষেই ভেলোরের পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়। কেউ কেউ মুক্ত-যুক্ত বাংলার স্বপ্নে বিভোর হলেও, বেশিরভাগই আবার অখণ্ড পাকিস্তানের কল্পনায় বেপথু।

এই কেস সামলাতে ইউনূসকে বেগ পেতে হবে। তবে, ভারত-বাংলাদেশ পূর্ব সীমান্তে ‘পিওকে’-র মতোই একটি ‘বিওকে’ পেতে চলেছে— ‘বাঙালি অক্যুপাইড কলকাতা’… ইউনূস যা কিছু বাঙালির আদরের, তার সবটা ধ্বংস করতে মরিয়া। খেলা জমে গেছে।

একচেটিয়া ব্যবসার দখলই পারে এই জখমে পুলটিস মারতে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশিরা বেচবেটা কী! আফগানদের মতো পড়ে পাওয়া রাশিয়ান, মার্কিন অস্ত্র বা লুকিয়েচুরিয়ে দেদার ফলিয়ে চলা পপি নেই। ইজরাইলি উজি নেই। ইস্পাহানি বা বোগদাদি তেল নেই। আইসিসের মতো সিরিয়ার সুন্দরী নেই যে, কাতার আর সৌদি আরবের ক্রীতদাস বাজারে মার্কিন পিস কিপিং ফৌজের তত্ত্বাবধানে বেচা যাবে। তা, শহর দখলের বাজারহাট করার পুঁজি ক’নে ভাই? মানলাম, যুদ্ধ বাধলে বিমানসেবিকারা বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জানালা দিয়ে টিপ করে বোমা ছুড়বে— তা, ওদের তো মিনিমাম একটা টিপিন খরচাও আছে, সেটাও কি দিবিনি? বাবুজি কেক, কলা, ডিমসেদ্ধ কেনার পয়সাটুকু জোগাড় হয়েছে তো, না কি…?

এই আন্দোলনটিকে গোড়া থেকে দেখছিলাম বাকি সব বাঙালির মতোই খুঁটিয়ে। রাস্তা জুড়ে সরকারবিরোধী জনজোয়ার দেখে প্রথমেই খটকা লেগেছিল। কী যেন নেই মনে হল, কেমন যেন চিরপরিচিত ঢাকাইয়াদের মিছিল নয়… হঠাৎ মাথায় বিদ্দুচ্চমকের মতো খেলে গেল বহু পুরনো একটি পোস্টারের ছবি— মিছিলের একেবারে সামনে এক হাড্ডিসার পিচ্চি, বজ্রমুষ্ঠি তুলে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। ২০২৪-এর মিছিলে সামনের সারি থেকে রাস্তার এই পিচ্চিরা বেমালুম ভ্যানিশ, বা অতি অল্পসংখ্যক ছুটছাট ঘোরাফেরা করে। পিচ্চিরা মিলিটারির গুলির সামনে বুক পেতে যে মিছিলকে লিড করে না, সে-মিছিল বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাসের অংশ হতে পারে না। ভাষা আন্দোলন ইস্তক তেমনটাই চলে আসছে। যারা টিক্কা খান, নিয়াজি, ইয়াহিয়ার খানসেনাদের অ্যাসল্ট রাইফেল দেখে ডরায়নি, যারা ভুখা পেটে এরশাদের তানাশাহীর বিরুদ্ধে বাংলাবাজার, মীরপুর, বায়তুল চত্তর গরম করে তুলত, তারা কেন এই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নেই, সে-প্রশ্নের সদুত্তর না-মেলা অবধি আমার কাছে অন্তত কলকাতা দখলকারীদের ক্রোধের যুক্তি জায়েজ নয়। পিচ্চিদের অনুপস্থিতির ফলে আন্দোলনের আত্মাটিকে উধাও হতে দেখলাম, সেটি বেদনাদায়ক কারণ, আওয়ামী লীগের শাসনকালে সরকারি সহায়তায় খুনখারাপি কম হয়নি। তবু পিচ্চিরা সরে থাকল অন্তরালে…

অতএব, কলকাতা দখলের আস্ফালনও সাধারণ মানুষের নয়, এটা দুই পার্লামেন্টে উপবিষ্ট বড় বাণিজ্যগোষ্ঠীর দালালদের ঝগড়া— রিকশাওলা, ছোটখাট ব্যবসায়ী, ছাত্রদের বড় অংশ, চাষি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মেয়েরা স্বদেশেই উদ্বাস্তু, তারা কলকাতা নয়, নিজেদের হারানো অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে নামার রাজনৈতিক ক্ষমতা ফেরত চায়, যেটি জামায়েত দখল করেছে। গাজ়া ভূখণ্ডে জ়িওনিস্ট গণহত্যা বা ইজ়রাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন ইহুদিদের কোনও যোগ নেই, তেমনি জামায়েতও বজরং, কু ক্লুক্স ক্ল্যান এবং নাৎসিদের মতোই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ইউনূস এদের কোন পথে চালিত করে, সেটাই দেখার।

এমনিতে যশোর রোড গাছ কেটে নেওয়ার পরও বেশ মনোরম, সাঁ করে গাড়ি চালিয়ে আসতে পারবে দখলকারীগণ। তবে মনে রাখবেন, ‘‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’’ – ‘ঘটি’ নয়, মানে শুধু দুর্জয় ঘটিরাই আছে, তা নয়, এদেশে কিছু দুর্জয় বাঙালও আছে। বাংলাদেশিদের সঙ্গে তাদের তফাতটা জানা থাকলে সকলেরই কম-বেশি মঙ্গল। তাদের শহর দখল করার, এবং দখলীকৃত জমি রক্ষার ইতিহাসটি প্রাচীন। তাছাড়া যে-শহরের নাগরিকরা নিজেরাই নিজেদের শহরের রাত, রাজনীতি,  রাজপথ, দখল করে— তাদের একটু সমঝে চলাই ভালো। এই আরকি।