গব্বরের শিকার

Amjad Khan

আমজাদ খান ছিলেন বলিউডের প্রখ্যাত চরিত্রাভিনেতা জয়ন্তর ছেলে। প্রশ্ন উঠবে, জয়ন্তর ছেলে কী করে আমজাদ খান হয়? এখানে বলার, সেকালের অনেক মুসলিম অভিনেতাই হিন্দু নাম নিতেন, যেমন ইউসুফ খানের নাম দিলীপকুমার। সেভাবেই জয়ন্ত ছিল আমজাদ খানের বাবার স্ক্রিন নেম। আমজাদ সেসময় বম্বের থিয়েটার জগতের পরিশ্রমী ও উঠতি অভিনেতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন, যাঁর খোঁজ ছিল জাভেদ আখতারের কাছে।

‘শোলে’ যখন ঘোষণা হয়, তখন গব্বর সিং হিসেবে নাম ঘোষণা হয় ড্যানি ডেনজংপা-র, তিনি সেসময় যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত খলনায়ক। কিন্তু সেই একই সময় আরও একটি বড় বাজেটের ছবির শুটিং চলছে, ফিরোজ খানের ‘ধর্মাত্মা’, সেই ছবিতে ড্যানি অভিনয় করছেন। ‘ধর্মাত্মা’-র সঙ্গে ডেট ক্ল্যাশ করছিল ‘শোলে’-র। যে কোনও একটা ছবিতে ড্যানি অভিনয় করলে অন্যটার শুটিং পিছিয়ে যাবে, এই হচ্ছে অবস্থা, যেটা তখন সম্ভব ছিল না। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে রমেশ সিপ্পি সেসময় সবে ‘সীতা অউর গীতা’-র মতো হিট ছবি বানিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু তাও, ফিরোজ খানের মতো এতগুলো হিট তিনি পরপর দেননি। তার ওপর ‘ধর্মাত্মা’-র ক্যানভাস ছিল বিশাল বড়। তার ওপর ‘শোলে’-র শুটিংয়ের সময় অবধি ‘জঞ্জীর’ মুক্তি পায়নি। ফলে, অমিতাভ বচ্চন ঠিক কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন কালক্রমে, তাও তখন বোঝা যাচ্ছে না। ফলে, ড্যানির পক্ষে ‘ধর্মাত্মা’ বেছে নেওয়াই সহজ ছিল।

আমজাদ খান অচিরেই কাল্ট হয়ে উঠলেন গব্বরের মাধ্যমে

আরও পড়ুন: গীতা দত্তর গানকে পেরিয়ে গেল তাঁর জীবনের দুঃখ, এর চেয়ে বেদনার কিছু হয় না!
লিখছেন বৃন্দা দাশগুপ্ত…

এই সময় ‘শোলে’-র চিত্রনাট্যকার জুটি সেলিম-জাভেদ গব্বর হিসেবে আমজাদ খানের নাম প্রস্তাব করেন। শুটিংও হয়ে যায়। কিন্তু ডাবিংয়ের সময়, এই সেলিম-জাভেদ জুটিই, যাঁরা কিনা গব্বর হিসেবে আমজাদকে বেছে নিয়েছিল, সেই তাঁরাই আমজাদের পাতলা গলা শুনে ভয় পেয়ে যান। এরকম একটা ভিলেন, মিহি কণ্ঠস্বরে যে বলছে, ‘কিতনে আদমি থে’— তাকে কি আদৌ নেবে ভারতীয় দর্শক? সেলিম-জাভেদ তখন পরামর্শ দেন, গব্বরের চরিত্রে ডাবিংটা করুন অন্য কোনও অভিনেতা। এই কথা শুনে আমজাদ খানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমজাদ খান থিয়েটারের অভিনেতা, কণ্ঠস্বর তাঁর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তখন কান্নাকাটি, কাকুতিমিনতি কিছু করতে বাদ রাখেন না। মজার ব্যাপার, যে সেলিম-জাভেদের হাত ধরে গব্বর হয়ে ওঠা আমজাদের, সেই সেলিম-জাভেদ জুটির সঙ্গে আমজাদের সম্পর্ক খারাপ হল আজীবনের মতো।

যদিও গব্বরের ডাবিং শেষমেশ করেছিলেন আমজাদ-ই। ওই কণ্ঠস্বরই ইতিহাস তৈরি করে। ‘শোলে’-র আগে কিন্তু এই ছবির সব অভিনেতারই কমবেশি ইমেজ তৈরি হয়ে গিয়েছে। অমিতাভ প্রতিষ্ঠিত না হলেও, ততদিনে ‘জঞ্জীর’ মুক্তি পেয়ে গেছে, ‘দিওয়ার’-এর শুটিং চলছে, তাঁর অ্যাংরি ইয়ংম্যান ইমেজ ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। ধর্মেন্দ্র এবং সঞ্জীবকুমার প্রতিষ্ঠিত তো বটেই, দুই নায়িকা, হেমা মালিনী ও জয়া বচ্চনও প্রতিষ্ঠিত। একজন ভিলেন যে হিরোকে ছাপিয়েও এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে, সেই নজির না আগে তৈরি হয়েছে, না পরেও ঘটেছে তেমনভাবে। বিবিধ বিপণন, গ্লুকোজ ডি বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে গব্বরের ছবি— চারদিকে তখন আলোড়ন তাঁকে নিয়ে। বদলে গেল জীবন।

কিন্তু এসবের আড়ালে একটা অন্য সত্যি চাপা পড়ে গেল। সেটা বলতে গেলে একটি ব্যক্তিগত গল্পও বলতে হবে।

আমাদের ভাষায়, যাকে আমরা বলি ‘ঝাপসা’ ছবি, অর্থাৎ কিনা, যেসব ছবিতে টাকা ঠিকই পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলোর পোস্টার কেনই বা পড়ে, কেনই বা সেগুলো মুক্তি পায়, আমরা নিজেরাও জানি না— তেমন একটি ছবির শুটিংয়েই কথা হচ্ছিল সৌমিত্রজেঠুর (চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে। আমরা দু’জনেই একটি ভাল ছবিতে কাজ করেছি তার আগে, অতনু ঘোষের ‘রূপকথা নয়’। সৌমিত্রজেঠু সেই প্রসঙ্গেই বলছিলেন, ‘হ্যাঁ, ওই ছবিটাতে তো মন দিয়েই কাজ করেছিলাম’, একথা বলে একটু ভেবে বলেছিলেন, ‘আসলে কী জানো রাহুল, আমার অবস্থা এখন হয়েছে আমজাদ খানের মতো।’

আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কেন?’

সৌমিত্রজেঠু তখন বলেছিলেন, ‘কারণ, একটা সময় আমজাদ খান ফ্লোরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করতেন, কিস কুত্তে-কামিনে কা খুন পিনা হ্যায়?’

ডাবিংয়ের সময়, এই সেলিম-জাভেদ জুটিই, যাঁরা কিনা গব্বর হিসেবে আমজাদকে বেছে নিয়েছিল, সেই তাঁরাই আমজাদের পাতলা গলা শুনে ভয় পেয়ে যান। এরকম একটা ভিলেন, মিহি কণ্ঠস্বরে যে বলছে, ‘কিতনে আদমি থে’— তাকে কি আদৌ নেবে ভারতীয় দর্শক? সেলিম-জাভেদ তখন পরামর্শ দেন, গব্বরের চরিত্রে ডাবিংটা করুন অন্য কোনও অভিনেতা। এই কথা শুনে আমজাদ খানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমজাদ খান থিয়েটারের অভিনেতা, কণ্ঠস্বর তাঁর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তখন কান্নাকাটি, কাকুতিমিনতি কিছু করতে বাদ রাখেন না।

আসল কথাটা হল, এই একই সংলাপ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন আমজাদ। তখন খলনায়কের চরিত্রেও এখনকার মতো এত স্তর ছিল না। হয় সে লম্পট, ধর্ষক, নয় সে হিরোর পাঞ্চিং ব্যাগ। আমজাদ খান ছিলেন একজন অত্যন্ত শিক্ষিত, গুণী থিয়েটার অভিনেতা। তাঁর যে সাক্ষাৎকারগুলো এখনও ইউটিউবে দেখা যায়, সেগুলো দেখলেই বোঝা যাবে, তাঁর অভিনয়ের বোধ কতটা গভীর ছিল। একজন খলনায়ক, যে কিনা মাঝেমধ্যে কমিক্যালও মনে হবে, এই ধরনের অভিনয় আমরা দেখেছি বোমান ইরানির, ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ ছবিতে। কিন্তু সেই ধরনের অভিনয় অনেক আগেই করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন আমজাদ খান। আমজাদের কমিক টাইমিং এতই সূক্ষ্ম ছিল, যে ওই তুখড় ভিলেনির মধ্যেও মাঝে মাঝে তা হাসির উদ্রেক ঘটাত। কিন্তু এই যে একধারসে ভিলেন বানিয়ে রাখা আমজাদকে, এটা ছিল একেবারেই বলিউডের ছক।

যখন সৌমিত্রজেঠু এই কথা আমাকে বলেছিলেন, তখন তিনি অশীতিপর। কিন্তু তখনও ঠিক সিনেমাটা, ঠিক চরিত্রটা পেলে সৌমিত্রজেঠু জাত চেনাতেন। কিন্তু আমজাদ খান মারা গেছেন ১৯৯২-এর ২৭ জুলাই। অর্থাৎ, সেই ১৯৭৫-এ ‘শোলে’-তে ওঁর গব্বরের ইমেজ তৈরি হওয়ার পর, কমবেশি ষোলো থেকে সতেরো বছর কাজ করেছিলেন আমজাদ। কিন্তু তার মধ্যেই এই তিক্ততা ওঁকে পেয়ে বসেছিল, যে, গব্বরের পর যে কাজই তিনি করেছেন, তাতেই দর্শক বলেছে, ‘গব্বর তো হল না!’ এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু হয় না একজন অভিনেতার কাছে!

একজন অভিনেতা কেবলই তাঁর অভিনয় দিয়ে তৈরি হন না। তাঁর নেপথ্যে থাকে চিত্রনাট্য, তাঁর নেপথ্যে থাকে সম্পাদনা। ধরা যাক, ‘শোলে’-তে যখন গব্বর বলছে, ‘ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর’, তারপর তরোয়ালটা তুলছে, কাট টু, সঞ্জীব কুমারের চাদর সরে যাচ্ছে, হাওয়ায় পতপত করছে তার কুর্তার হাতা, যেখানে হাতটা দেখা যাচ্ছে না আর— এই যে সরাসরি ভায়োলেন্স না দেখানোর সম্পাদনার চাতুর্য, এটাও তো একজন অভিনেতাকে, তাঁর অভিনীত চরিত্রকে একটা উত্তরণ দেয়। এইটাও বলে দেয়, একজন খলনায়ক কতটা রোমহর্ষক। একা অভিনেতা তাই চাইলেও আর-একটা গব্বর করতে পারবেন না, যদি না বাদবাকি সবকিছু তাঁকে সমর্থন করে।

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-র সেটে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে

আমজাদ খানের খুব দুর্ভাগ্যজনক একটি দুর্ঘটনা হয়। ওঁর শারীরিক কসরতের ক্ষমতা চলে যায়, যা একজন অভিনেতার অ্যাসেট। ওজন ক্রমশ ওঁর হাতের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। অথচ, এই ভদ্রলোক কিন্তু অল্প সময় কাজ করেই যা যা অর্জন করেছেন, তা অনস্বীকার্য। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করলেন আমজাদ খান, যে সত্যজিৎ রায় বলিউড অভিনেতাদের বিষয়ে, বলা যেতে পারে, খানিকটা উন্নাসিকই ছিলেন। সঞ্জীব কুমার একজায়গায় খানিকটা দুঃখই করেছেন, বলেছেন, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-র শুটিংয়ের সময় সৈয়দ জাফ্রি ও আমজাদ খানকে যে স্বাধীনতা দিচ্ছেন সত্যজিৎ, সেই তুলনায় প্রায় কোনও স্বাধীনতাই তিনি দিচ্ছেন না সঞ্জীব কুমারকে, তিনি দুঃখ করছেন, যে প্রায় ‘পাপেট’ হয়ে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। সেখানে তো আমজাদ খানকে স্বাধীনতা দিচ্ছেন সত্যজিৎ, এখানেই তাঁর অভিনয়ক্ষমতার প্রকাশ।

শেষে একেবারে নিজের কথা বলব। আমি কী করে চিনলাম আমজাদ খানকে? এখনও যখন গ্রামেগঞ্জে ফাংশন করতে যাই, এবং লোকে বলে, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’-এর পর তো আর কিছু দেখলাম না, তখন আমার আমজাদ খানের কথাই মনে পড়ে। আমার লেখালিখি, পডকাস্ট করা, নিউজ চ্যানেলে আলোচনায় যোগ দেওয়া— এই সবকিছুর মধ্যেই আদতে সূক্ষ্মভাবে রয়েছে এটুকু প্রমাণ করার চেষ্টা যে, আমি আদতে ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার নই। ‘চিরদিনই…’-র পর পেরিয়ে গিয়েছে আঠারোটা বছর, ‘শোলে’-র পর আমজাদ কিন্তু এতদিন বাঁচেনওনি। তাও, যতবার কেউ সেই ঘুরেফিরে ‘চিরদিনই…’-র কথা বলে, আমার মনে পড়ে, ‘শোলে’ আর ‘চিরদিনই…’— দুটোরই রিলিজ ডেট ১৫ অগাস্ট। আমি তাকাই আমজাদ খানের ছবির দিকে, আমজাদ জিজ্ঞেস করেন, ‘কিতনে আদমি থে?’, আমি বলি, ‘দো, সর্দার!’ এই দু’জন— আমি আর আমজাদ খান।