জাদু থেকে বাস্তব

Harry Potter in Movies

গল্পটা আমাদের সকলেরই জানা। এগারো বছর আগে চার নম্বর প্রাইভেট ড্রাইভে কারা যেন রেখে যায় এতটুকু এক বাপ-মা হারা ছোট্ট প্রাণকে। তারপর সে বেড়ে ওঠে, কিছু অযত্নে, কিছু অপ্রাপ্তিতে। কিন্তু তার এগারো বছরের জন্মদিনেই যেন এক নিমেষে বদলে যায় তার পৃথিবী— উড়ো চিঠিতে তার ডাক আসে হগওয়ার্টস জাদুকরি বিদ্যালয়ে, যেখানে নাকি পড়েছেন তার মা-বাবাও। এতটুকু বিস্ময়-বালকের চোখ ধাঁধায় কিছু— এই নতুন দুনিয়ায় ঢের বেশি মানুষ তাকে চেনে, তার থেকে প্রত্যাশাও তাদের আকাশচুম্বী। অথচ, সে তো জানতই না যে, সে-ই বিশেষ। আমরা তো কেউ-ই জানতাম না যে, আমরা বিশেষ। এই দুনিয়ার এত প্রত্যাশা আমাদের থেকেও। সাত খণ্ড মহাকাব্যোপম উপন্যাসে তা আমরা জানলাম কি? হ্যাঁ। জানালেন, জোনাথন ক্যাথেলিন রাউলিং। হ্যারি যেন অনায়াসেই হয়ে উঠল আমাদের মুখপাত্র— মুখপাত্র সেই যুদ্ধে, যেখানে আমরা এসেছি একেবারে প্রস্তুতিহীন; আমাদের বেড়ে ওঠার বয়সে, হ্যারির শৈশবকালীন বঞ্চনা, নতুন স্কুলের আদবকায়দার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়াস, এবং সর্বোপরি বন্ধুত্ব গড়ে তোলার যে কাহিনি, তা যেন আমাদের দেখাল এক আয়না— এই কি তবে আমাদের ‘মিরর অফ এরিসেদ’? যা আমাদের এই অদম্য ‘আইডেন্টিফিকেশন’-এর, নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার তাগিদকে রূপকথার স্বর্ণাক্ষরে ফিরিয়ে দেয় আমাদেরই কাছে?

তা হবেই বইকি, রাউলিং যে সময়ে হ্যারি পটার লিখতে শুরু করেন, তখন তিনি এডিনবার্গ শহরের এক এক-কামরার ফ্ল্যাটে একাই বড় করছেন তাঁর কোলের সন্তান জেসিকাকে। মাতৃত্বের ক্লান্তি এবং একা নারীর সংগ্রামের কিসসার মধ্যে, তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল এক রূপকথা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে অপত্য স্নেহ। রাউলিং স্মৃতিচারণ করেছেন, লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টার যাওয়ার পথে তাঁর মাথায় এমনিই ভেসে আসে এলোমেলো চুলের এক মায়াবালকের মুখ. এই মুখ পরবর্তীতে হয়ে ওঠে পৃথিবীর আপামর খুদের মুখ— গোল চশমা আর কপালে বজ্রপাতের নিশান-সহ হ্যারি পটার। অক্লান্ত পরিশ্রম ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে রাউলিং লিখে চলেন হ্যারির বেড়ে ওঠার গল্প— তাঁর ছোট্ট শিশু যখন ঘুমোয়, তিনি তখন লেখেন। তিনি লেখেন তাঁর বিছানার পাশটিতে, তিনি লেখেন ক্যাফেটেরিয়ার ন্যাপকিনের ওপর, তাঁর ঘুম হয় না, নাওয়া-খাওয়ার ঠিক থাকে না– তবু তিনি লেখেন, প্রতি সন্ধেয়। তবে কেন লিখতেন রাউলিং? অনিশ্চয়তা এবং সংগ্রামের জীবনের ক্ষেত্রে রূপকথার যে দুয়ার তিনি বেছে নিয়েছিলেন, তা কি একধরনের উপশম হয়ে উঠেছিল তার জন্য? 

সিনেমার হ্যারি, হারমাইনি ও রন

আরও পড়ুন: ‘ইন্টারস্টেলার’-এর সঙ্গে কি কোথাও মিলে গেল ভারতীয় পুরাণের অনুষঙ্গ?
লিখছেন সৌকর্য ঘোষাল…

হ্যারি পটার সিরিজ শুরু করার কিছু আগেই রাউলিং হারান তাঁর মাকে। তিনি নিজে বলেছেন যে, উপন্যাসগুলোর বিষয়বস্তু অনেকাংশেই মৃত্যু— আবার তিনি এ-ও বলেন যে, হ্যারির আখ্যান তাঁর কাছে সম্পূর্ণ রূপে আসে— চার ঘণ্টার সেই ট্রেনযাত্রায় তিনি সম্পূর্ণ গল্পের পরিকাঠামো পেয়ে গেছিলেন। এই গল্প বলতে বলতে তাঁর মনে হয়েছিল যে, তিনি এক নতুন করে বাঁচার উপলক্ষ খুঁজে পেয়েছেন। সাধারণত, আমরা বই পড়ি, তার কারণ আমরা কাহিনির মুখ্য চরিত্রে খুঁজে পেতে চাই নিজেদের অবয়ব। মনঃস্তত্ত্বের ভাষায় আমরা একে ‘আইডেন্টিফিকেশন’ বলে আখ্যায়িত করি; কিন্তু রাউলিং যা করলেন, বাস্তবতা থেকে নিজেকে আড়াল করতে, তা একধরনের ‘ডিপার্সোনালাইজেশন’, সম্ভবত রুক্ষ, কঠিন বাস্তবতার থেকে মুখ ফিরিয়ে এক জাদুবাস্তবের মধ্যে নিজেকে ন্যস্ত করার এই যে অভ্যাস, তা তাকে অব্যহতি দিল— হলেই বা সাময়িক, তা তাকে বিশ্বাস করতে শেখাল যে, চারপাশের দুনিয়া ছাড়াও, এই ভেতরে, মনের মধ্যেও বসবাস করা সম্ভব। আমরা হয়তো সকলেই পড়লাম জাদুকরের অদ্ভুত দাস্তান, কিন্তু লেখিকা এবং তাঁর লিখনের মধ্যে অতর্কিতে যে জাদুবাস্তবতা তৈরি হল, তা একেবারে তাদের নিজস্ব। এই দুনিয়া রাউলিংকে করে তুলল আত্মবিশ্বাসী এবং দিল একধরনের স্বীকৃতি— ভবিষ্যতে যা আঁকড়াতে গিয়েই তিনি পড়বেন অসংখ্য বিতর্কের মুখোমুখি।

হ্যারির দুনিয়া অতিবাস্তবতার— কিন্তু তা যেন বাস্তবের খুব কাছাকাছি। চলতি রূপকথার চেয়ে তার ফারাক এখানেই, যে হ্যারিও প্রতি বছরের শুরুতে ব্যাগ-বই কাঁধে নিয়ে যায় স্কুলে। সেখানে আছে তার কাছের বন্ধু রন-হারমাইনি, আবার সেখানে আছে পাতাল কুঠুরি থেকে বেরিয়ে পড়া কালনাগিনী ও দৈত্য-দানব। আমরা যখন ফুটবল-মাঠে লেঙ্গি মেরে ফেলে দিচ্ছি বন্ধুকে, তখন হ্যারিকে কুইড্ডিচ ম্যাচে ঝাঁটা থেকে ফেলার উপক্রম করছে তারই সহপাঠীরা। এই গল্পের সূত্রগুলো যেখানে এসে মিলে যায়, তার নাম হল শৈশব, তার নাম হল কৈশোর।

জে. কে. রাউলিং

তবে এই নিজেকে মিলিয়ে দেখা ছাড়াও হ্যারি পটারের আখ্যানে রাউলিং যা নিয়ে এলেন, তা হল সাদা-কালোর এক চিরাচরিত লড়াই। হ্যারিকে হত্যা করবে বলে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মাতৃ-পিতৃ হন্তারক এক বেজায় দুষ্টু জাদুকর— ভোল্ডেমর্ট। সাত খণ্ডে (যা আবার হ্যারির সত্ত্বার সাতভাগকেও বোঝায়) আমরা দেখি এই সাদা-কালোর অমোঘ ঘাত-প্রতিঘাত, যা কৈশোর পেরিয়ে বড় হয়ে উঠলে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। রূপকথাকে বিশেষ করে তোলে তার চিরাচরিত স্বভাব— তার প্রতীকী উপস্থিতি, যাকে সাদা বাংলায় আমরা বলি আর্কেটাইপ। কাজেই রাউলিং-এর কাহিনি যুগোপযোগী মোড়কে এই আর্কেটাইপ তুলে আনার প্রয়াসে হয়ে উঠল এক সফল, নব্য-রূপকথা। 

এই অবধি ঠিকই ছিল। কিন্তু রাউলিং-এর গল্পে গরমিল শুরু হল আরও পরে. যখন হ্যারির কথাটি ফুরল, নটে গাছটি মুড়োল। রাউলিং যখন হ্যারি পটার লিখছেন, তখনও সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্ব কার্যত নেই বললেই চলে। অস্তিত্ববাদী রাজনীতির যে অধ্যায় শুরু হল একুশ শতকের প্রথম দশক থেকে, হ্যারির কাহিনি লেখা হয়ে গেছে তার বহু আগে। ‘ওক’ কালচারের লেশমাত্র হ্যারি পটারের মধ্যে ঠাঁই নিতে পারেনি, কারণ সম্ভবত সেই ধরনের রাজনৈতিক লেন্স মিডিয়ায় তখন প্রবেশই করেনি। এই মুহূর্তে যেভাবে নেটফ্লিক্স-এর যে-কোনও প্রোডাকশনে ইনক্লুসিভিটির স্বার্থে, এবং সমর্থিত স্বার্থেই, রেস, লিঙ্গ, এবং যৌন পরিচয়মূলক রূপায়ণ করা হয়, তেমন চল সত্যিই ছিল না হ্যারি পটারের যুগে। কিন্তু রাউলিং-এর পাঠককূল বড় হয়ে গেছেন, তাকে এবার জায়গা করে নিতে হবে সেইসব শিশুদের মনে যারা বেড়ে উঠেছে এই ‘ওক’ সমাজের বুকেই। এছাড়াও তিনি প্রাসঙ্গিকতা হারাতে চাইলেন না সমালোচক-মহলে। একে একে তিনি বলতে শুরু করলেন আগে কখনও না-বলা সব তথ্য— তিনি বললেন ডাম্বলডোর আসলে সমকামী ছিলেন, তিনি বললেন আমি কখনও এমন বলিইনি যে হারমোইনি কালো চামড়ার না. তিনি বললেন কালনাগিনী আসলে একজন এশিয়ান নারী ছিলেন। নিঃসন্দেহে ঘটনাটি অভূতপূর্ব— আমরা শেক্সপিয়রের নাটককে এখনো লিঙ্গ, রূপভেদে নতুন করে পাঠ করে চলেছি; সেখানে একজন প্রবাদপ্রতিম লেখিকা তাঁর নিজের লেখাকেই পুনর্ব্যাখ্যা ও কিয়দংশে পুনর্লিখন করে চলেছেন, তা হয়তো কালক্রমে ‘কাল্ট ক্লাসিক’-এর আখ্যা পেলেও পেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে লেখিকার এই জারিজুরি খাটল না। পাঠকরা বললেন এই সমর্থন মেকি, সমালোচকেরা ঠারে-ঠোরে বলে দিলেন, মার্জিনের পাশের নোট হিসেবেও জায়গা হবে না এই পুনর্ব্যাখ্যার।

কেন প্রত্যাখ্যাত হলেন রাউলিং? তার দু’টি প্রধান কারণ আছে।

প্রথম কারণটি হল— লেখকের মৃত্যু, অথবা ‘ডেথ অফ দ্য অথর’ তত্ত্ব, যার বিপ্রতীপে দাঁড়ালেন রাউলিং। চিন্তক রোলা বার্থ এই তত্ত্বে বলছেন, প্রকাশ-পরবর্তী ক্ষেত্রে একটি লেখা হয়ে দাঁড়ায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। লেখকের এই লেখার প্রতি আর কোনও স্বত্ব থাকে না; লেখার নিরিখে তিনি কার্যত মৃত। লেখকের অস্তিত্বের এই মৃত্যক্ষণ থেকেই জন্ম হয় পাঠকের। পাঠক যতবার টেক্সটি পড়েন, ততরকমভাবেই তার মননে পুনর্লিখিত হতে থাকে লিখিতবস্তুটি। হয়তো রাউলিং এর মাঝখানে না এলে সত্যি সত্যিই কোনও পাঠক এমন একটি অ্যাডাপ্টেশন বানাতেন, যাতে হারমাইনি এশিয়ান, হ্যারি একজন নাইজেরিয়ান বালক। কিন্তু রাউলিং প্রাসঙ্গিকতার মোহে পাঠককে এই স্থানটি ছেড়ে দিতে পারলেন না; অপত্য স্নেহে অন্ধ মায়ের মতো তিনি বলে যেতেই থাকলেন তাঁর সন্তানের প্রিয় রং কী, ঘুমের সময় কখন, কেমন বন্ধু সে পছন্দ করে। ফলত, যে ইমাজিনেশনকে তিনি পুঁজি করে এগিয়েছিলেন এতদূর, তার চারপাশে এত বিধিনিষেধের বেড়াজাল দেখতে পেয়ে পাঠক হল মনমরা। তার ভাবের ঘরে চুরি করছেন স্বয়ং লেখিকা! সব যদি লেখকই বলে দেন, তবে পাঠক ভাববে কী?

রাউলিং-এর গল্পে গরমিল শুরু হল আরও পরে. যখন হ্যারির কথাটি ফুরল, নটে গাছটি মুড়োল। রাউলিং যখন হ্যারি পটার লিখছেন, তখনও সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্ব কার্যত নেই বললেই চলে। অস্তিত্ববাদী রাজনীতির যে অধ্যায় শুরু হল একুশ শতকের প্রথম দশক থেকে, হ্যারির কাহিনি লেখা হয়ে গেছে তার বহু আগে। ‘ওক’ কালচারের লেশমাত্র হ্যারি পটারের মধ্যে ঠাঁই নিতে পারেনি, কারণ সম্ভবত সেই ধরনের রাজনৈতিক লেন্স মিডিয়ায় তখন প্রবেশই করেনি। এই মুহূর্তে যেভাবে নেটফ্লিক্স-এর যে-কোনও প্রোডাকশনে ইনক্লুসিভিটির স্বার্থে, এবং সমর্থিত স্বার্থেই, রেস, লিঙ্গ, এবং যৌন পরিচয়মূলক রূপায়ণ করা হয়, তেমন চল সত্যিই ছিল না হ্যারি পটারের যুগে।

দ্বিতীয় কারণটি হল, রূপকথার স্বকীয়তা। দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকা যে রূপকথার কাহিনি আমরা পড়ি, শুনি, এবং বেড়ে উঠি, সেই সাহিত্যের ব্যবচ্ছেদ করলে মূল উপজীব্য হিসেবে পাওয়া যায় চিরাচরিত কিছু কনসেপ্ট— যেমন রাজপুত্র ও দৈত্যের মধ্যে চলা সাদা-কালোর লড়াই। যেমন লিটল রেড রাইডিং হুডের আধারে ছোট্ট মেয়ের কৈশোরে পদার্পণের গল্প।  প্রতিটি রূপকথাই আসলে একটি কম্প্যাক্ট, এবং কমপ্লেক্স রূপকের কারখানা। সেই রূপকের যৌগিকত্ব আমরা সারাজীবনের শ্রম দিয়ে অল্প অল্প করে ব্যাখ্যা করি। ছোটবেলায় আধো ঘুম-আধো জাগরণে দৈত্য বশ করার কাহিনি আমাদের রসদ জোগায় কাল সকালে উঠে কর্মক্ষেত্রে ব্যাজারমুখ বসের কেবিনে ছোট্ট বিপ্লব করার, ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা রাজকুমারীকে টুক করে পক্ষীরাজ বাইকে করে তুলে এনে দেঁতো হাসি হাসার। রূপকথা তার নিজ গুণেই প্রাসঙ্গিক, তা মোটেই হারাত না প্রাসঙ্গিকতা, কিন্তু বিশ্বাস হারালেন লেখিকা স্বয়ং। যে কাহিনির এমনিই এলেম ছিল টিকে থাকার; তার ক্ষেত্রে অতি-সাবধানী হতে গিয়ে তিনি কুড়ুল হানলেন নিজেরই পায়ে। 

সম্ভবত, হ্যারি পটারের গগনচুম্বী সাফল্যের পরে রাউলিং-এর লেখিকা সত্তা পড়ে এক ক্রাইসিসের মধ্যে। পটার-পরবর্তী সময়ে তিনি নিজের নামে এবং ‘রবার্ট গলব্রেথ’ ছদ্মনামে বেশ কিছু বই লেখেন। বড়দের জন্য লেখা তাঁর বইগুলির অধিকাংশই থ্রিলার-ধর্মী, অথবা ডিটেকটিভ কাহিনি। এর মধ্যে পড়ে ‘ক্যাজুয়াল ভেকেন্সি’, এবং ‘কর্মোরান স্ট্রাইক’ সিরিজ। হ্যারি পটার-সুলভ প্রত্যাশার জাল থেকে বাঁচতে তিনি বেছে নেন এই ছদ্মনাম— কিন্তু এই বইয়ের কাটতি থাকে পড়তির দিকেই। কখনও তাঁর লিখনকে মনে হয় আড়ষ্ট, আবার কখনও ট্রান্স-অস্তিত্বের রাজনীতিকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি আঘাত করে বসেন ট্রান্স পাঠকদের (‘ট্রাবলড ব্লাড’ গ্রন্থে তার নায়ক একজন সিস্ পুরুষ যিনি নারীবেশে হত্যা করেন, কিন্তু রাউলিং তাকে ‘ট্রান্স’ বলতে নারাজ)। তুলনামূলকভাবে, হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজ-ভিত্তিক যে মেটা ফিকশনগুলি তিনি লেখেন— যেমন ‘ব্লু বেয়ার্ডস টেল’, অথবা ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস’ সিরিজ— তা পুরনো পুঁজিকে ভিত্তি করে তবুও কিছু গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু হ্যারি পটারের দুনিয়ার বাইরে লেখিকা হিসেবে রাউলিং এখনও অবধি সেই সফলতার মুখ না দেখেছেন পাঠকের কাছে, না সমালোচক-মহলে। তবে কি রাউলিং ‘ওয়ান ওয়ার্ক ওয়ান্ডার’? সম্ভবত এই প্রশ্ন এড়াতেই তিনি বেছে নেন তাঁর পুরনো টোটকা— হ্যারি পটার, যা তাঁকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল তাঁর একেবারে প্রান্তিক সময়ে। 

এছাড়াও অনবরত, বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্য তিনি করেন, যা তার ‘ওক’ পটার পুনর্ব্যাখ্যার সরাসরি বিপ্রতীপ। একাধিকবার বিভিন্ন টুইটে তিনি মশকরা করেন ট্রান্স মানুষদের নিয়ে, তিনি বলেন যে নারীর নিরাপত্তা শুধু নারীবহুল স্পেসেই সুনিশ্চিত করা সম্ভব— রূপান্তরকামীদের মাঝে নয়, এবং এর পাল্টা যে-কোনও মতামত এলেই তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের উপর্যুপরি ব্লক করতে শুরু করেন। তার কলম যে জাদুবাস্তবতার মাঝে আমাদের নিয়ে গেছিল, তার বাইরের জগতের রাউলিং হয়ে ওঠেন কট্টরপন্থী সমাজের দুঃখজনক এক পরিণতি। অথচ পুঁজিগতভাবে এর দরকার ছিল কি? বই লিখে এবং তার স্বত্ব থেকে বিলিওনেয়র হওয়া প্রথম লেখিকা জে. কে. রাউলিং। বই এবং ছবি ছাড়াও বিপণনের বাজারে হ্যারি পটারের অজস্র মার্চেন্ডাইজ রমরমিয়ে ব্যবসা করছে। তবে শূন্যতা অর্থাভাব বা যশের নয়, এই শূন্যতা মুছে যাওয়ার ভয়ের। এই ভয় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার। 

সাতটি বই এবং নয়টি মূল ছবির পরে, বর্তমানে হ্যারি পটারের নতুন সিরিজ আসছে। পটারপন্থী হিসেবে প্রথমে ঈষৎ ভ্রু তুললেও, খুদে হ্যারি, হারমাইনি এবং রনকে দেখে প্রশ্রয়ের হাসি হেসেই ফেললাম। ভারি মিষ্টিই তো লাগছে! এ-যুগের খুদেরা ‘মাগল’ দুনিয়া থেকে ৯ ৩/৪-এর দেওয়াল পেরিয়ে হগওয়ার্টস-এর দুনিয়ায় প্রবেশের ক্ষেত্রে খামকা বঞ্চিত থাকবে কেন? লেখিকার মান হয়েছে বলে? আদপেই না! রোলাঁ বার্থে তো কবেই বলে গেছেন যা বলার! এবার আমাদের পড়ার অপেক্ষা।