আমার প্রফুল্লদা…

Prafulla Ray

অনেক মহান মানুষ বলেন, লেখক সারা জীবন ধরে একটা লেখাই লিখে যান। হয়তো তাই, হয়তো-বা নয়। কিন্তু এই কথাটি প্রফুল্ল রায়ের ক্ষেত্রে একদমই খাটে না। উনি প্রথম জীবনে লেখালিখির শুরু করলেন নাগা হিলসের কথকতা, ‘পূর্বপার্বতী’ দিয়ে। তারপর, পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা মানুষের, আন্দামানে বসত তৈরির কাহিনি লিখলেন। পাশাপাশি চরম কর্মাশিয়াল থ্রিলার ‘চরিত্র’ লিখছেন, তার পরেই লিখে ফেললেন ‘রামচরিত’, ‘আকাশের নীচে মানুষ’, মানুষের যুদ্ধ। গোটা একটা বিহার। যা অচ্ছুত দলিত মানুষের শুধু দারিদ্রকথা নয়, লড়াইয়ের কথা। তাঁদের ভাত-মাড়ের লড়াইয়ের কথা, তাদের অধিকারের বুঝে নেওয়া। যা উনি তেরোটি উপন্যাস, কুড়িটি গল্পে রেখে গেছেন। মাঝে-মাঝে ফেসবুক দেখে মনে হয়, বাংলা সাহিত্য কী পড়ে, কে পড়ে, কী মনে রাখে, কী মনে রাখবে? আমি জানি না, বুঝিও না। কিন্তু ভারতবর্যের বিহারকে চিনতে হলে প্রফুল্ল রায়কে স্মরণ করতেই হবে। তাঁকে স্মরণ করতেই হবে ‘নোনাজল মিঠে মাটি’তে।

আরও পড়ুন: এই যে দু-দশক বাদে নিজের লেখা সংশোধন করা তা বোধহয় অনেক লেখক ভাবতেও পারেন না। এখানেই মতি নন্দী অনন্য। নিজের লেখার সুপার এডিটর। লিখছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

লেখক তাঁর লিখন শৈলী, কাহিনিতে বাঁচেন যেমন, তেমনই বাঁচেন, চিরন্তন হয়ে ওঠেন জীবনদর্শনে, সাহিত্য দর্শনে। প্রফুল্ল রায়ের জীবন দর্শন ছিল, যে লেখায়, ‘মানুষ-মাটি-সময়’ থাকে না, সে-লেখা আর যাই হোক, সাহিত্য নয়। সে-লেখাও থাকবে না। এটা উনি শুধু বলতেন না, নিজের লেখায় তা পালন করতেন। যাকে জীবনদর্শন বলুন, সাহিত্য দর্শনই বলুন, প্রফুল্লদা এই মন্ত্রকেই ছুঁয়ে থেকেছেন আজীবন।

প্রফুল্ল রায়, প্রফুল্লদা আমার অত্যন্ত প্রিয় শ্রদ্ধেয় লেখক ছিলেন। ছিলেন আমার খুব কাছের একজন, মনের মানুষ। সম্পাদনার কাজ করতে এসেই, তাঁর সঙ্গে পরিচয় জমেছিল। একইসঙ্গে আমরা যেন তিন রাস্তার মোড়ে বসবাস করতাম। একটা সম্পর্ক লেখক এবং সম্পাদক। আর একদিকে লেখক এবং লেখক। অন্য দিকে দাদা এবং ভাই। পরের দু’টির আসন উনিই আমাকে দিয়েছিলেন।

প্রফুল্ল রায়

উনি ক্ষমতাশালী লেখক ছিলেন। কিন্তু কোনও পুরস্কার কমিটির ক্ষমতায় ছিলেন না। রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকতেন। নিজেকে একটু নিভৃতে রাখতেই পছন্দ করতেন। প্রায় কোনও সাহিত্যসভায় যেতেন না। শরীর খারাপের বাহানা ছিল প্রচণ্ড। উনি শরীর খারাপ বললেই— তাই বলতে পারতাম, ওটাই তো আপনাকে বাঁচিয়ে দিল। কতবার আমাদের দু’জনের দীঘা যাওয়ার প্ল্যান হয়েছে। ভেস্তে গেছে, শরীরটা খারাপ। এই কটা দিন বাদ দাও—দু’দিন পরেই যাব বুঝলে, সুধাংশুকে বলছি। ত্রিদিবদার মতো নাছোড় মানুষও ওঁকে দু’তিনদিনের বেশি বইমেলায় টেনে নিয়ে যেতে পারতেন না। যদিবা যেতেন, সে-দিন আমার বইমেলার আনন্দের বারোটা বাজিয়ে দিতেন। কিছুক্ষণ পরেই ফোন করে বলতেন— তুমি আর কতক্ষণ থাকবে? এবার চলো। ভুল না করলে, উনি শেষবার বইমেলায় গিয়েছিলেন, গৌতম ঘোষের তথ্যচিত্রের প্রয়োজনে।

একবার বইমেলায় করুণার স্টলে উনি বসে। আমরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরব। কয়েকজন সুবর্ণকঙ্কণ পরা, ফর্সা রমণী এসে আমাকেই জিজ্ঞেস করে বসলেন— ‘উনি কে বসে আছেন?’ আমি বলতে যাচ্ছিলাম— আমার আগে প্রফুল্লদা তাঁদের বললেন— ওই যে দেখুন সিনেমার… হেঁটে যাচ্ছেন।

তাঁরা শুনে, লাফিয়ে সিনেমার লোকজন দেখতে চলে গেলেন। আমরা হাসতে শুরু করলাম। অসাধারণ ধুতি পরতেন। বইমেলায় আমার সঙ্গী এক মহিলা  হাঁ করে প্রফুল্লদাকে দেখছেন। আমি বললাম, কী দেখছ? সে বললে, কী সুন্দর ধুতি পরেন! সেদিন শববাহী গাড়ি যখন ওঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন এক মহিলাও আর একজনকে বলছিলেন, ওই যে যিনি খুব সুন্দর করে ধুতি পরতেন, তিনিই…

কেমন ছিল আমার সঙ্গে প্রফুল্লদার সম্পর্ক? করোনার মহোৎসবের দ্বিতীয়দিন। লকডাউন। সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ, বাইক নিয়ে ওঁর বাড়ি গিয়েছি, কী অবস্থা জানতে। তার কিছুক্ষণ আগেও ওঁকে পুলিশে ধরেছিল। রাস্তায় বেরিয়েছিলেন ওষুধ কিনতে। শেষে প্রেসক্রিপশনে, পুলিশ সার্জেন দেখেন নাম লেখা— প্রফুল্ল রায়। তবে এ-পুলিশ সে-পুলিশ নয়, সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা হোক না কেন— তিনি প্রফুল্লদাকে বলেন— আপনি প্রফুল্ল রায়? লেখক প্রফুল্ল রায়? প্রফুল্লদার জবাব ছিল— হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। তিনিই ওষুধ কিনে বাড়ি দিয়ে যান।

ওঁর একটা ছোট্ট এবং গোপন মোবাইল ফোন ছিল। সেটি বন্ধই পড়ে থাকত। সেটা তখন বাজত, যখন ওঁর বাড়ির ল্যান্ড লাইন খারাপ হত। আর আমার কাজ ছিল, সেই ল্যান্ডলাইনটিকে জরুরিভিত্তিতে জীবন্ত করে দেওয়া। প্রচণ্ড ঘরকুনো ছিলেন। কিছুতেই ঘর থেকে বের করা যেত না। নিজে দেখেশুনে বাজার করতেন। কোনও এটিএম কার্ড মনে হয় ছিল না। ব্যাঙ্কে চেক জমা দিতেন। চেক কেটে টাকা তুলতেন। বাড়ির ট্যাক্স জমা দিতে নিজেই যেতেন। আগে-আগে মাঝেসাঝে, কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় দেখা গেলেও, পরের দিকে একদম না। অথচ এই মানুষটাই একসময় সারা ভারতবর্ষ চরকিবাজি করেছেন। নাগাল্যান্ড থেকে আন্দামান। দণ্ডকারণ্য থেকে বম্বে। বিহার চষে ফেলেছেন। ওঁর চোখ দিয়েই বিহার চিনেছি, দেশভাগ দাঙ্গা জেনেছি।

আপাত সরল মনে হলেও, তিনি ছিলেন খুব জেদি। জীবনের অনেকটা সময় চারতলাতেই থেকে গেলেন। অতগুলো সিঁড়িভাঙা যে কী কঠিন, যাঁরা যেতেন তাঁরা জানতেন। কিন্তু উনি দিব্যি টং টং করে নেমে জেরক্স করতে চলে যেতেন, বাজার-ব্যাঙ্ক করে আসতেন। আমি যাচ্ছি শুনলে, কচুরি আনতে নেমেছেন।

প্রফুল্লদার স্নেহ পেয়েছি যেমন বউদিরও স্নেহ পেয়েছি অগাধ। আমার সঙ্গে খুব ভাব ছিল বউদির। বউদির একটা খুব সুন্দর ডাক নাম ছিল, বাদল। বউদি চলে যেতে, খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন প্রফুল্লদা । যদিও ছোট মেয়ে সর্বদা সঙ্গেই থাকতেন। বড় মেয়ে, নাতি প্রায় রোজই সন্ধেবেলা আসা যাওয়া করতেন। নিজে মিষ্টি খেতেন না, কিন্তু কেউ গেলে, মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়তেন না।

বাংলা সাহিত্য কী পড়ে, কে পড়ে, কী মনে রাখে, কী মনে রাখবে? আমি জানি না, বুঝিও না। কিন্তু ভারতবর্যের বিহারকে চিনতে হলে প্রফুল্ল রায়কে স্মরণ করতেই হবে। তাঁকে স্মরণ করতেই হবে ‘নোনাজল মিঠে মাটি’তে।

উনি অজস্র লেখা আমাকে দিয়েছেন। যখনই হাত পেতেছি, ফেরাননি। লেখার ভেতর দিয়ে কখন যেন আমাদের বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে বন্ধন ভালবাসার এবং তর্কের। আমার মনখারাপ হলেই, ওঁর বাড়ি চলে যেতাম। আর উনি নানা দরকারে এবং অ-দরকারে আমাকে ডাকতেন। কিন্তু সেখানে গেলেই আড্ডায় কেটে যেত দু’তিন ঘণ্টা। আর এই যাওয়া ছিল প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’তিনদিন। কোনওদিন, কোনও আড্ডায় উনি কারও নামে নিন্দে করতেন না। একবার এক লেখক এসেছিলেন, একজনের নামে ওঁর কাছে কান ভাঙাতে। উনি তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে মুখের ওপর বলে দিলেন, এসব কথা আমাকে বলো না। ওঁর কাছে গেলেই কথা শুরু হতো— কী পড়ছি, আর কী লিখছি? দুর্দান্ত পড়ুয়া ছিলেন।

আমি সেই বিরল সৌভাগ্যবান মানুষ, উনি আমাকে দু’টি বই উৎসর্গ করেছিলেন। ‘মহাযুদ্ধের ঘোড়া’র তৃতীয় পর্ব এবং গল্প সমগ্র-১। কত তরুণ লেখককে যে ওঁর বাড়ি নিয়ে গিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। দুর্দান্ত জ্যোতিষ জানতেন। যেটা ফাঁস করতেন না। হাত নয়, ছক দেখতেন। ওঁর দু’টি বলা কথা, আমার অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। এই জ্যোতিষচর্চার গল্পে খুব শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প করতেন। কার না কার গল্প শুনেছি প্রফুল্লদার মুখে। তারাশংকর থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র, শ্যামল, সুনীল। রসিক ছিলেন।

প্রফুল্লদা দীর্ঘদিন বম্বে ছিলেন, হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গে গভীর যোগ ছিল, দিলীপকুমার থেকে ধর্মেন্দ্র, কত গল্প শুনেছি। উত্তমকুমার ভোরবেলা বাড়ি চলে এলে, উনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন— আপনি আসবেন না, এলে বড্ড ভিড় হয়। আমাকে ডাকবেন, আমি যাব। বাড়িতে সিনেমার লোকজন আসত খুব। সন্ধেবেলার দিকে নিত্য সঙ্গী ছিলেন অভিনেতা অরুণদা। আমি দীর্ঘদিন ধরে বলতাম, বম্বের সিনেমা জগতের কথাগুলো লিখে ফেলতে।  কিছুতেই লিখতে চাইতেন না। এক প্রকার জোর করে, হ্যাঁ আমার জেদে, উনি ‘সাক্ষী আরব সাগর’ ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক বর্তমানের পাতায় লিখতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু বয়েস এবং শরীর বড় বালাই। গৌতম ঘোষ ওঁকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি ছবি তৈরি করেছেন। যা এখনও দেখানো হয়নি। সেখানে যে দু’একজন লেখক তাঁর কথা বলেছেন আমি তাদের মধ্যে একজন।

শুধু বলি, মানুষটা শান্তিতে থাকতে চাইতেন। কখনও, কোনও বিতর্কে জড়াতে চাইতেন না। কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন, উপন্যাসটি বর্তমান শারদীয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। বই হয়েছে কিনা জানি না। ওই লেখার শেষে পর্বে কাশ্মীরে একটা বিরাট পট পরিবর্তন হয়। উনি আরও খান তিরিশ পাতা, সে বিষয়ে লিখেছিলেন। আমি সে লেখা ছাপিনি। বলেছিলাম— আপনার এই লেখা ছাপলে আপনাকে বিস্তর হেনস্থা হতে হবে। সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দেবে। আপনি ভাবুন। বলেছিলাম— এটা বাক্সবন্দি করে রেখে যান। আপনি মারা যাওয়ার পর,  প্রকাশক জুড়ে দেবেন, গালাগালি খেলে জানতে পারবেন না।

উনি অবাক হয়ে বলেছিলেন— গালাগালি দেবে? হ্যাঁ আমি ভয় দেখিয়েছিলাম। ওঁকে এবং নিজেকে বাঁচাতে। একথা অনেকেই জানেন। মৃত্যুর পর মৃতমানুষের গপ্পো নয়। উনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন, কিন্তু দেশ এবং বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও উত্তেজিত তর্ক করতেন।

খুব সুন্দরভাবে মিশতে পারতেন। সকলের সঙ্গে সবধরনের মানুষের সঙ্গে। একবার আমার এক সহকর্মীর বছর দশেকের ছেলে গিয়েছিল ওঁর বাড়িতে। সে সন্ধেবেলা বস্তুত আমাদের সঙ্গে নয়, প্রফুল্লদা ওই বাচ্চার সঙ্গেই দিব্য ঘণ্টা দেড়েক গল্প করে গেলেন। গল্পের বিষয়, বাংলাদেশে বন্যা হলে, বাড়ির সামনে দিয়ে কেমন করে কিলবিল করে মাছ চলাচল করত। গল্পের বিষয়, বিহারে টিয়া পাখির ঝাঁক দেখে ভুখা নিরন্ন মানুষ কীভাবে রাস্তা চিনে চাষের কাজে মাঠে যেত। কী মজা করে সেসব কথা বলা। আমার স্ত্রীর সঙ্গে উনি সারা সন্ধে রান্নার গল্প করে গেলেন।

একবার আমার সঙ্গে এক বন্ধু গিয়েছিল। আসলে আমি আড্ডা মারছিলাম রাণীকুঠীর একটু আগে চালিয়ার দিকে। ওঁর ফোন পেয়ে বললাম— আমি আপনার বাড়ির কাছেই আছি। উনি বললেন, তাহলে কি এখনই আসতে পারবে, একটু দরকার ছিল? আমি এক বন্ধুর বাইকে করেই ওঁর বাড়ি গেলাম। তখন সাড়ে তিনটে হবে। উনি বললেন— বন্ধুকে ওপরে নিয়ে এসো। বন্ধুটি যেতে চাইছিল না। লেখক-টেখক কী যাব, তোদের আঁতলেমি কথাবার্তা! কিন্তু আমি বললাম— ওনার অনেক গল্প সিনেমা হয়েছে। বাঘবন্দির খেলা, এখানে পিঞ্জর— শুনে বলল— চ তাহলে।

প্রফুল্লদা তার সঙ্গে সাড়ে পাঁচটা ছটা পর্যন্ত গল্প করেছিলেন। গল্পের বিষয়, কলকাতার মস্তানির আধুনিকতা। আমার বন্ধুটির কাজ ছিল বিবাদমান দুই মস্তানকে এক টেবিলে বসানো। বা কোনও প্রোমোটার আর মস্তানের মধ্যে গোলমাল হলে সেটা মেটানো। বাংলা কথায় মধ্যস্থতাকারী। সেদিন শেষে আমার বন্ধুটি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে প্যান্টের পিছন থেকে একটা রিভলবার প্রফুল্লদাকে দেখাল। প্রফুল্লদার কথা ছিল— এটার কি লাইসেন্স আছে? বন্ধুটি বলল—না। প্রফুল্লদা বললেন— তাহলে এটা পকেটে ঢুকিয়ে নাও। আমি খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম। সেদিন যার জন্য ডাকা, সেই কাজটি আর হল না। পরের দিন গেলাম। যতদূর মনে হয়, নতুন জটিল একটা টেলিফোন সেট এসেছিল। সেটা ফিক্স করতে হবে। কথায় কথায় বললাম— ওর কাছে যে মেশিন ছিল আমি জানতাম না দাদা। তাহলে কিছুতেই আমি ওকে নিয়ে আসতাম না। কিন্তু উনি আমার কথার ধারকাছ দিয়ে হাঁটলেন না। বললেন— কলকাতা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। পটভূমি হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই সময়, এই সময়ের কলকাতা। তোমার এই বন্ধুটি হবে শেষ চরিত্র। আমি বললাম, এটা কিন্তু আমার বিষয়। উনি আমাকে পালটা একটা বিষয় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন— এটা লিখো। কীভাবে লিখতে হবে তারও একটা পরামর্শ দিয়েছেন পরে-পরে। ওই বিষয়ে আমাকে কিছু বইপত্রও দিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরেই আমার সেই বন্ধুটি মার্ডার হয়ে যায়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার পাওয়ার সময়ে রাজভবনে, ডানদিক থেকে ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশুশেখর দে এবং জয়ন্ত দে

সে-সময়ে, আমরা একটা অপ্রচলিত ভ্রমণ পত্রিকা শুরু করেছিলাম। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘দ্রাঘিমা’। আমরা যাঁরা একসঙ্গে ট্রেকিং করতাম তাদের লেখা থাকত। আমিই সম্পাদক। সেই পত্রিকায় আমার খুন হয়ে যাওয়া বন্ধুটির ছবি খুলে, উনি চুপ করে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। বলেছিলেন— আমি এমনই একটা সমাপ্তির কথাই ভেবেছিলাম। দীর্ঘ কুড়ি বছরেও তাঁর সেই লেখা অসমাপ্ত থেকে গেল। নিশ্চয়ই লিখবেন কখনও।    

শেষের কথা বলি। আবারও বলি, লেখক বড় একা। অনেক ভিড় সামলাতেন, অনেক দর্শনার্থীকে সময় দিয়ে কথাও বলতেন। কিন্তু তারপর? অতীনদা, সমরেশদার সময়ে যা দেখেছিলাম, সুব্রতদার সময়ে যা উপলব্ধি করেছিলাম, বুদ্ধদেব গুহের সময়ে যা শুনেছিলাম। এঁদের আমরা বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করি। কিন্তু শেষযাত্রায়, তাঁদের আগুন পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই থাকেন, শুধু লেখক থাকেন না। লেখক বড় লেখায় ব্যস্ত!