ফিল্মফিরিস্তি : ১

Representative Image

কী দেখবেন, কেন দেখবেন

আজ থেকে শুরু হল ৩১ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। উদ্বোধনী ছবি হিসেবে প্রদর্শিত হল অজয় করের ‘সপ্তপদী’। মূল উৎসবের শুরু ৭ নভেম্বর, চলবে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত। কলকাতা শহরের মোট ২০টি ভেন্যুতে ছবি দেখানো হবে এই এক সপ্তাহ জুড়ে। ৩৯টি দেশের ২১৫টি চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে এবার, যার মধ্যে ১৮৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের এবং ৩০টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের।

দেশ-বিদেশের এত চলচ্চিত্র, কিন্তু সব ছবিই কি সমানভাবে দেখা গুরুত্বপূর্ণ? কী দেখব, কেন দেখব, কী না দেখলেও চলে, পাশাপাশি এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে একান্তই যেগুলো দেখা প্রয়োজন, তা নিয়েই এই আলোচনা।

দেখুন প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ‘নধরের ভেলা’। আমরা এর আগে তাঁর পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ (২০১৩) ও ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ (২০১৯) দেখেছি। প্রথম ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের মাইলফলক বলা চলে। তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-ও সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়াও তিনি বানিয়েছেন একাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্র ও টিভি ফিল্ম যেমন ‘ঢেউ’, ‘শিকড়’, ‘পিঙ্কি আই লাভ ইউ’, ‘কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল’, ‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’, ‘পরশুরাম’ প্রভৃতি।

আরও পড়ুন: শিশুকন্যার নিগ্রহ নিয়ে আমরা আদৌ সচেতন? প্রশ্ন তুলে দেয় এই ছবি!
লিখছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য…

‘নধরের ভেলা’, বছরের শুরুতে আয়োজিত রটারডাম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম দেখানো হয়। ছবিটি একটি গ্রামাঞ্চল, একটি সার্কাস, নিরন্তর ছুটে চলা একদল মানুষ এবং এই ছুটন্ত পৃথিবীতে পিছিয়ে পড়া একজন ধীরগতির লোককে নিয়ে। ছবিটি নিয়ে অনেকেরই প্রত্যাশা তুঙ্গে।

দেখে নিন গুয়াতেমালার চিত্রপরিচালক হায়রো বুস্তামান্তের নতুন ছবি, ‘মাউন্টেনস অফ ফায়ার’। হায়রো বুস্তামান্তে গুয়াতেমালায় স্বাধীনভাবে নির্মিত ছবির জগতে প্রথম সারির নাম। তাঁর ছবির কেন্দ্রে থাকে মূলত গুয়াতেমালার মায়া জনজাতির মানুষজন, তাদের জীবনযুদ্ধ, দেশের ইতিহাস ও কঠোর রাজনীতি। তাঁর বানানো ‘ইশকানুল’ (২০১৫), ‘ট্রেমরস’ (২০১৯), ‘লা ইয়োরোনা’ (২০১৯) ও ‘রিটা’ (২০২৪) ছবিগুলিতে তিনি মিশিয়েছেন একাধিক ঘরানা, মুখোমুখি হয়েছেন সংবেদনশীল একাধিক বিষয়ের। ‘লা ইয়োরোনা’ ছবিটিতে হররের মোড়কে কথা বলা হয়েছে আদিবাসী মায়া জনজাতির গণহত্যা ও গুয়াতেমালার গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে। ‘ট্রেমরস’ ছবিটি একজন সমকামী পুরুষকে নিয়ে। গুয়াতেমালায় ফিল্ম কালচার ও তথাকথিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার পিছনে বুস্তামান্তের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর নতুন ছবিটি শীঘ্রই বিস্ফোরণ ঘটতে চলা এক আগ্নেয়গিরি, নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী সম্প্রদায়, দুই শহুরে আগ্নেয়গিরিবিদ, তাদের আশঙ্কা এবং সরকারি দুর্নীতি ও অবহেলার গোপন খতিয়ান নিয়ে।

দেখতে পারেন সার্বিয়ার চিত্রপরিচালক নিকোলা লেজাইচের ‘হাউ কাম ইট’স অল গ্রিন আউট হিয়ার?’ ছবিটি। এ’টি তাঁর দ্বিতীয় ছবি। প্রথম ছবি ‘টিলভা রোশ’ (২০১০)-এ আমরা দেখতে পাই তাঁর ছোটবেলার শহর বোর, দুই কিশোর বন্ধু, যারা স্কেটবোর্ড চালাতে ভালবাসে, এক নির্ঘুম গ্রীষ্মকাল, খনি বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে ইউনিউনের প্রতিবাদ এবং তা কীভাবে এই দুই বন্ধুর জীবনে প্রভাব ফেলে, তার বর্ণনামালা। দীর্ঘ ১৫ বছর পরে আবার নতুন ছবি বানিয়েছেন। নতুন ছবিটি এক বাবা ও তার ছেলেকে নিয়ে, যা দেখাবে কীভাবে এক আপাত-সরল সড়কযাত্রা হয়ে ওঠে পরিবার, স্মৃতি, পিতৃত্ব, আত্মপরিচয় এবং সময়ের অন্তর্মুখী অনুসন্ধান।

ইতালির দক্ষিণ টিরোল অঞ্চলে বড় হওয়া মিখায়েল কোফলারের প্রথম ছবি ‘জু়ইটল্যান্ড’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছবিটির পটভূমিতে রয়েছে ১৯৬১ সালের দক্ষিণ টিরোল, সেখানকার বাসিন্দা দুই ভাই, যাদের একজন আর্ট নিয়ে পড়তে আগ্রহী, কিন্তু অন্যজন ক্রমশ জড়িয়ে পড়ে চরমপন্থায়। আল্পস পর্বতমালার কোনাকাঞ্চিতে লুকিয়ে থাকা স্থানীয় ইতিহাসের অজানা স্পর্শ তাঁর এই ছবি থেকে পাওয়া যাবে বলেই বিশ্বাস।

দেখে নিতে পারেন, স্পেনীয় ফিল্মমেকার ডেভিড বেলত্রান ই মারির কিউবা ও স্পেনের যৌথ প্রযোজনায় বানানো তথ্যচিত্র ‘টু দ্য ওয়েস্ট, ইন শাপাতা’। ছবির কেন্দ্রে কিউবার শাপাতা জলাভূমিতে বসবাসকারী একটি পরিবার, তাদের কঠোর জীবনযাপন, সামাজিক অস্থিরতা, বিশ্বব্যাপী অতিমারি এবং এর মাঝেও তাদের বুকভরা আশা। প্রায় ৮-৯ বছর ধরে পরিচালক বানিয়েছেন ছবিটি।

তুরস্কের পরিচালক এরকান ইয়াযুজুহ্‌-র ছবিতে মূলত সামাজিক সচেতনতা-ভিত্তিক বিষয় ঘুরেফিরে আসে। তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র ‘ডিসট্যান্ট ল্যান্ড’ (২০২০)-এও যেমন, তেমনই নতুন যে-ছবিটি এবারের KIFF-এ প্রদর্শিত হতে চলেছে, সেই ‘ফ্র্যাগমেন্টস ফ্রম দ্য ইস্ট’-এও পরিচয় অনুসন্ধান, অনিশ্চয়তা ও স্থানচ্যুতির মতো বিষয়গুলির মুখোমুখি হতে হবে দর্শককে। দেখার আগে প্রেক্ষাপট হিসাবে একটু পড়াশোনা করে নিতেই পারেন ১৯১৬-তে তুরস্কের উত্তর-পূর্বে ট্রাবজোনে সোভিয়েত আক্রমণের ইতিহাস সম্পর্কে।

দেখুন ক্রোয়েশিয়ার (এবং আংশিকভাবে মন্টিনিগ্রোর) পরিচালক ইভোনা ইউকার নতুন ছবি ‘বিউটিফুল ইভিনিং, বিউটিফুল ডে’। তিনি এর আগে বানিয়েছেন ‘ফেসিং দ্য ডে’ (২০০৬)-এর মতো তথ্যচিত্র, যাতে দেখানো হয়েছে কীভাবে এক সংশোধনাগারের কয়েকজন বন্দী মিলে শেক্সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ করে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। এছাড়াও তিনি বানিয়েছেন বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র এবং ‘ইউ ক্যারি মি’ (২০১৫) নামের পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র। এবছরের নতুন ছবিটি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করা চার বন্ধুকে নিয়ে, যারা পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মাণকে জীবিকা হিসাবে বেছে নেন। কিন্তু ১৯৫৭-তে যখন তাদের যৌন পরিচয় জানাজানি হয়ে যায়, তখন প্রশ্ন ওঠে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাদের আনুগত্যে এবং তারপর থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নানাবিধ টানাপোড়েন। যুদ্ধপরবর্তী যুগোস্লাভিয়ায় আত্মপরিচয়, আনুগত্য, শিল্পচর্চা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে পরখ করতে চাওয়া এই ছবিটিও দেখা উচিত।

দেখে নিন আর্মেনিয়ার পরিচালক মারিয়া রিগেলের ছবি ‘দাস স্পোক দ্য উইন্ড’। আর্মেনিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক মহিলার দীর্ঘদিন বাদে ফেরত আসার পরে, সাবেক পিতৃতন্ত্রে লাগা শুরু হয় একের পর এক আঘাত।

এবারে আসা যাক, বলিভিয়ার পরিচালক আলভারো অলমোস টোরিকোর ছবি ‘দ্য কন্ডোর ডটার’-এর প্রসঙ্গে। কেচুয়া সম্প্রদায়ের এক মহিলা স্বপ্ন দেখে শহরে গিয়ে গায়িকা হওয়ার। পরিচালক মূলত তাঁর নতুন এই কাজে এবং আগের কাজগুলিতে বলিভিয়ার আদিবাসী মানুষদের কথা বলে চলেছেন যা জরুরি এক সময়-পর্বের ভাষ্য।

দেখুন কাজাখস্তানের ফারখাত শরিপভের ‘ইভ্যাকুয়েশন’। তাঁর চলচ্চিত্রগুলো প্রায়ই যুবসমাজ, সোভিয়েত রাশিয়ায় পরিবর্তিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে হওয়া সামাজিক পটপরিবর্তন এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর আগের ছবি ‘স্কিম’ (২০২২) সে-বছরের বার্লিনে জেনারেশন ১৪প্লাস বিভাগে ‘গ্রাঁ পি’ জিতেছিল। নতুন ছবিটি আবর্তিত হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার তৎকালীন সোভিয়েতে জার্মান ফ্যাসিজম এবং বিপদাপন্ন একদল সোভিয়েত নাগরিককে ঘিরে। এক মা উদ্বাস্তুদের ভিড়ে নিজের মেয়েকে হারিয়ে ফেলে। তাঁর অনুসন্ধান নিয়ে এই ছবি।

এরপর দেখতে পারেন মরোক্কোর পরিচালক আজলারাবি আলাউইয়ের নতুন ছবি ‘আফ্রিকা ব্লাঙ্কা’। এক সেনেগালি অ্যালবিনো মহিলা ও তার সন্তানের মরুভূমি পেরিয়ে, ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা নিয়ে এই ছবি। আলাউই ছবি পরিচালনার পাশাপাশি একজন চলচ্চিত্র গবেষকও। তাঁর ছবিগুলিতে প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে মরক্কোর ইতিহাস, গ্রামাঞ্চল, বঞ্চনা, ভেদাভেদ ও দলিত মানুষদের অনর্গল ব্যথামালা।

শ্রীলঙ্কার ললিত রত্নায়েকে তাঁর দ্বিতীয় ছবি নিয়ে এসেছেন এ-বছর; নাম ‘রিভারস্টোন’। এক বন্দিকে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দু’জন পুলিশ, উদ্দেশ্য সম্ভবত অলিখিত এনকাউন্টার। সেই যাত্রাপথের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে এই ছবি। এবারের সাংহাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ‘এশিয়ান নিউ ট্যালেন্ট’ বিভাগে এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য ও শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফির পুরস্কার জিতেছে। দেখতে পারেন।

সিকিমের বাসিন্দা নেপালিভাষী ত্রিবেণী রাইয়ের প্রথম ছবি ‘শেপ অফ মোমো’ দেখে ফেলুন। ত্রিবেণীর সিনেমায় হাতেখড়ি কলকাতার SRFTI-তে পড়তে এসে। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত ও পুরস্কৃত এই ছবিটি দেখা দরকার হালফিলের সিকিমের চলচ্চিত্র সম্পর্কে জানতে-বুঝতে হলে।

এবারে দেখে নিন আসামের চলচ্চিত্রকার খঞ্জন কিশোর নাথের নতুন ছবি ‘কাংবো আলোতি’ বা ‘দ্য লস্ট পাথ’। ছবিটির ভাষা কার্বি। এর আগেও খঞ্জন কার্বি ভাষায় একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি করেছিলেন, নাম ‘দ্য বয় উইথ এ গান’ (২০১৯)। এই ছবিটি ৬৮তম জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র বিভাগের শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেয়েছিল। অতি অবশ্যই দেখুন।

প্রবীণ মোরচালের ছবি ‘হোয়াইট স্নো’ও দেখে নিন। প্রবীণের ছবিগুলো আগাগোড়াই লাদাখ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ২০১৭ সালে লাদাখি ভাষায় নির্মিত ‘ওয়াকিং উইথ দ্য উইন্ড’ ছবিটি শ্রেষ্ঠ লাদাখি ছবি, শ্রেষ্ঠ সাউন্ড ডিজাইন ও শ্রেষ্ঠ রি-রেকর্ডিং এই তিনটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতে। নতুন ছবিটির বিষয়বস্তু চমৎকার— প্রত্যন্ত হিমালয়ের একটি ছেলে একটি শর্ট ফিল্ম বানায়, কিন্তু তা সমাজের উঁচুতলার মুরুব্বিদের চক্করে ব্যান করে দেওয়া হয় এবং ছেলেটিকে করে দেওয়া হয় একঘরে। কিন্তু ছেলেটির বুড়ি মা নাছোড়বান্দা, তিনি টাট্টু ঘোড়ার পিঠে একটি টিভি ও ডিভিডি প্লেয়ার চাপিয়ে যাত্রা শুরু করেন আশেপাশের গ্রামের উদ্দেশ্যে, নিজের ছেলের ছবি দেখাবেন বলে। অতি অবশ্যই দেখুন।

শতবর্ষের কারণে ঋত্বিক ঘটকের ছ’টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে বড় পর্দায়। ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। দেখে নিন, কারণ এমন সুযোগ পাওয়া যায় না। সলিল চৌধুরীর শতবর্ষে দেখানো হবে বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩)। সদ্য রেস্টোর হওয়া প্রিন্টটিই সম্ভবত দেখানো হবে।

মেঘালয়ের পরিচালক প্রদীপ কুরবাহ-র খাসি-ভাষী ছবি ‘দ্য এলাইসিয়ান ফিল্ড’ ছবিটিও অবশ্যই দেখুন। এতে এবং তাঁর আগেকার সমস্ত ছবিতেই তিনি নিজের অঞ্চল, সেখানকার মানুষজনের ছোটছোট সুখ-দুঃখকে দেখিয়ে আসছেন। তাঁর প্রতিটি ছবিই দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত এবং এই নতুন ছবিটিও সাম্প্রতিক মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবি ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার জিতে নিয়েছে।

দেখতে পারেন মণিপুরের পরিচালক রাকেশ মৈরাংতেমের প্রথম ছবি ‘ফুওইবি’, যার ভাষা মণিপুরি মেইতেই। একইসঙ্গে অসমের নবীন চিত্রপরিচালক পঙ্কজ বোরার প্রথম ছবি ‘নৈ কথা’ও দেখে নিতে পারেন।

এছাড়া দেখতে পারেন রাজস্থানের জিগর নাগড়ার ছবি ‘হুইস্পারস অফ দ্য মাউন্টেনস’। ইনি নিজের ছবি পরিচালনার আগে অনুরাগ কাশ্যপ, ওনির ও মনীষ গুপ্তর মতো পরিচালকদের ছবিতে সহযোগী পরিচালক হিসাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

আর চাইলে দেখতে পারেন একটি বাংলা ছবি, ‘পরবাসী’। মনেট রায় সাহা ছবিটির পরিচালক।

অতি অবশ্যই দেখুন শিবরঞ্জিনী কে-এর মলয়ালম ছবি ‘ভিক্টোরিয়া’। ছবিটি গত বছর কেরালা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নবাগত পরিচালকের শ্রেষ্ঠ মলয়ালম ফিল্মের জন্য ফিপ্রেস্কি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল।

তাইওয়ানের চু চুং তেং-এর প্রথম ছবি ‘ইল’বা ‘হি ম্যান’ ছবিটি দেখতে পারেন। এই ফিল্মমেকার প্রথাগত ফিল্মমেকিংয়ের পাশাপাশি ভিডিও ইনস্টলেশন ও সমসাময়িক আর্টের আরও অন্যান্য আঙ্গিককেও সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আলোচ্য ছবিটি এক রহস্যময়ী নারী ও এক পথভ্রষ্ট পুরুষকে নিয়ে।

মানব অধিকার নিয়ে কাজ করা সিঙ্গাপুরের চলচ্চিত্রকার জেসন সু-এর তথ্যচিত্র ‘আল আওদা’ দেখুন। ২০১৮-তে প্রায় ১৫টি দেশের ২২জন কর্মী গাজা উপত্যকার উপর আরোপিত ইজরায়েলি অবরোধ ভাঙতে এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন। তথ্যচিত্রটি তার শ্বাসরুদ্ধ খতিয়ান।

জাপানের ইয়াসুতোমো চিকুমার নতুন ছবি ‘দ্য ডিপেস্ট স্পেস বিটুইন আস’ দেখে নিতে পারেন।

এবারের ‘বেঙ্গলি প্যানোরামা’-র ছবিগুলির মধ্যে যা-যা দেখতে পারেন:

‘আমি ও মনোহর’ ছবির পরিচালক অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘৮’। ‘নিরন্তর’ ছবির পরিচালক চন্দ্রাশিস রায়ের ‘পরশী’। রুদ্রজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পিঞ্জর’। এবং শিশিরকুমার ভাদুড়ীর জীবন নিয়ে বানানো ছবি ‘বড়বাবু’। এই ছবিগুলির সবই যে সমানভাবে ভাল হবে, এমন নিশ্চয়তা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।

অবশ্যই দেখুন চীনের পরিচালক বি গান-এর ‘রেজারেকশন’। এর আগে বি গান ‘কৈলি ব্লুজ’ (২০১৫) ও ‘লং ডে’জ জার্ন ইনটু নাইট’ (২০১৮)-এর মতো পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র এবং ‘ডায়ামন্ড সুত্র’ (২০১২) ও ‘আ শর্ট স্টোরি’ (২০২২)-এর মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়েছেন এবং ইতিমধ্যেই তাঁকে বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচিত্রকার হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। স্বপ্ন, অন্তহীন সময়কাল এবং চলচ্চিত্রের আদিগন্তব্যাপী ইতিহাস নিয়ে ‘রেজারেকশন’।

টনি গ্যাটলিফের নতুন ছবি আছে এবারে, নাম ‘অ্যাঞ্জ’ বা ‘আঁজ’। দেখুন অবশ্যই, কারণ রোমানি তথা জিপসি সংস্কৃতি, তাদের আত্মপরিচয়, সংগীত, যাযাবরী জীবনযাপন ও সান্ধভাষা নিয়ে টনি গ্যাটলিফ আজীবন কাজ করে গেছেন এবং একদা যিনি বানিয়েছিলেন ‘লাচো ড্রম’ (১৯৯৩), ‘গাজো ডিলো’ (১৯৯৭), ‘এক্সিলস’ (২০০৪), ‘জ্যাম’ (২০১৭)-এর মতো ছবি, তাঁর নতুন কাজ তো দেখতেই হয়। নতুন ছবিটিতে আমরা পাব এক বয়স্ক ব্যক্তিকে, যিনি অতীতের সন্ধানে বের হন এবং তাঁর সঙ্গী হয় তাঁরই যুবতী মেয়ে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি এই কিছুদিন আগেও জানতেন না। পথেপ্রান্তরে আমরা পরিচিত হতে থাকি দক্ষিণ ফ্রান্সের যাযাবর সংস্কৃতির।

ব্রাজিলের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ক্লেবেহ মেন্দোসা ফিলিউ-র নতুন ছবি ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’ অবশ্যই দেখুন। ফিলিউর প্রতিটি ছবিই তাঁর জন্মস্থান হেসিফির (Recife) কথা শোনা যায়, তা সে তার ‘নেউবারিং সাউন্ডস’ (২০১২) হোক, ‘অ্যাকোয়ারিয়াস’ (২০১৬) হোক কি একদম হালফিলের তথ্যচিত্র ‘পিকচার অফ ঘোস্টস’ (২০২৩) হোক। নতুন ছবিটি মার্সেলো নামের একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তথা শিক্ষাবিদকে নিয়ে, যার পিছনে তৎকালীন মিলিটারি লেগেছে কোনও এক কারণে। তিনি হেসিফিতে আসেন নিজের ছেলের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু এসে বুঝতে পারেন এই শহরাঞ্চলে স্বস্তি কম, শাস্তি বেশি। ফিলিউর এই ছবিটির প্রেক্ষাপট ১৯৭৭-এর ব্রাজিল, যখন সেদেশে রাজ করছে মিলিটারির একনায়কতন্ত্র।

তিউনিশিয়ার চলচ্চিত্রকার এরিজ সেহিরির দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম ‘প্রমিসড স্কাই’ অতি অবশ্যই দেখুন। তাঁর ছবিগুলি, বিশেষ করে এই নতুন ছবিটি এবং এর আগেকার ‘রেলওয়ে মেন’ (২০১৯, তথ্যচিত্র) ও ‘আন্ডার দ্য ফিগ ট্রিজ’ (২০২২, প্রথম ফিচার ফিল্ম) অস্বীকৃত শ্রম, প্রান্তিক সম্প্রদায় এবং লিঙ্গ ও অভিবাসন সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে আলোকপাত করে থাকে। মূলত ফ্রান্সে জন্মানো এই তিউনিশিয়ান ফিল্মমেকার তিউনিশিয়ার মহিলা চিত্রপরিচালকদের মধ্যে অন্যতম। তার কথাগুলো শোনা দরকার।

স্পেনের কার্লা সিমনের তৃতীয় ছবি ‘রোমেরিয়া’ দেখা অতি অবশ্যই দরকার। যারা এর আগে সিমনের ‘সামার ১৯৯৩’ (২০১৭) ও ‘আলকারাস’ (২০২২) দেখেছেন, তারা জানেন, কাতালোনিয়ার ছোট্ট এক গ্রামাঞ্চলে বড় হওয়া কার্লার অনেক কম বয়সে বাবা-মার মৃত্যু হয় এইডস রোগে। তাই তার ছবিতে ঘুরেফিরে আসে নিজের মা-বাবার কথা, নয়ের দশক, এইড মহামারির প্রসঙ্গ এবং একাকী শিশুরা। সহজ-সরল এই ছবিগুলিতে এমন-এমন উপলব্ধি থাকে, যার জুরি মেলা ভার।

‘৮ ফেমস’ (২০০২), ‘সুইমিং পুল’ (২০০৩) ইত্যাদি ছবির পরিচালক ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ওজোঁ এবারে আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ চলচ্চিত্রে অ্যাডাপ্ট করেছেন। কাজটি অত্যন্ত জটিল, তাতে সন্দেহ নেই। দেখতেই পারেন।

রোমানিয়ার রাডু ইয়ুডে-র নতুন ছবি ‘ড্রাকুলা’ দেখে নিন, যেখানে আমরা পাব এক চলচ্চিত্র পরিচালককে, যিনি ড্রাকুলা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে সাহায্য নিতে AI-এর শরণাপন্ন হন। এর ফলস্বরূপ জন্ম নেয় একাধিক দৃশ্যাংশ, যেখানে মিশে যায় লোককথা, হরর, সায়েন্স ফিকশন, এক্সপ্লয়টেশন, শ্রমসংক্রান্ত সমস্যা এবং ভ্যাম্পায়ার পুরাণ। বরাবরই ব্যাকরণ-ভাঙা ছবি করেন রাডু ইয়ুডে, যার প্রমাণ তাঁর আগেকার ‘দ্য হ্যাপিয়েস্ট গার্ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ (২০০৯), ‘আফেরিম!’ (২০১৫), ‘আই ডু নট কেয়ার ইফ উই গো ডাউন ইন হিস্ট্রি অ্যাজ বারবারিয়ানস’ (২০১৮), ‘ব্যাড লাক ব্যাঙ্গিং অর লুনি পর্ন’ (২০২১) ও ‘ডু নট এক্সপেক্ট টু মাচ ফ্রম দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (২০২৩)-এর মতো ছবিতে ছড়িয়ে রয়েছে।

ইতালির পাওলো সোরেন্তিনো এবারেও আছেন, তার নতুন ছবি ‘লা গ্রাৎসিয়া’ নিয়ে। সোরেন্তিনোর ছবি ইদানীং বেশ এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে, তবে ‘লা গ্রাৎসিয়া’-তে তিনি ফিরেছেন তার পুরনো স্বকীয়তায়, ফলে এই ছবিটিও দেখে নিতে পারেন।

মেসিডোনিয়ার ফিল্মমেকার টোয়েনা স্ট্রুগার মিতেভস্কা এর আগে নিজের ভাষায় কয়েকটি ছবি বানিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গড একজিস্ট, হার নেম ইজ পেট্রুনিয়া’ (২০১৯) ছবিটি। তিনি এবারে ইংরেজি ভাষায় একটি ছবি করেছেন, মাদার টেরেজাকে নিয়ে। এই ‘মাদার’ ছবিটি প্রয়োজন হলে দেখে নিতে পারেন।

অতি অবশ্যই দেখুন প্যালেস্তাইনের রশিদ মাশারাউইয়ের ‘পাসিং ড্রিমস’ (ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা একটি বাচ্চা ছেলের হারানো পাখি খোঁজা নিয়ে), ইরাকের মুহাম্মদ আল দারাজির ‘ইরকালা: গিলগামেশ’স ড্রিম’ (যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কীভাবে একটি মা-বাপ হারা বাচ্চা ছেলে সার্ভাইভ করে, তা নিয়ে), সৌদি আরবের শাহাদ আমীনের ‘হিজরা’ (মক্কায় হজ করতে যাওয়া একটি বাচ্চা মেয়ের হারিয়ে যাওয়া এবং তাঁর সন্ধান করতে থাকা থুথুথুড়ে ঠাকুমাকে নিয়ে), তিউনিশিয়ার কাওতর বেন হানিয়ার ‘দ্য ভয়েস অফ হিন্দ রজব’ (গাজায় গোলাবর্ষণের মধ্যে একটি ছয় বছরের মেয়ে একটি গাড়িতে আটকা পড়ে যাওয়া এবং রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের তাকে উদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টা নিয়ে), মিশরের নাদা রিয়াধ ও আয়মান আল আমিরের যৌথ পরিচালনায় ‘দ্য ব্রিংক অফ ড্রিমস’ (এক দল প্রাণবন্ত মিশরীয় মেয়ের শহরের রাস্তাকে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে একটি নাট্যদল গঠন করা নিয়ে), প্যালেস্তাইনের আরেক পরিচালক অ্যানেমারি জাকিরের ‘প্যালেস্তাইন ৩৬’ (১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা প্যালেস্তিনীয়দের ক্লান্ত-বিক্ষুব্ধ জীবনযাপন নিয়ে), সুদানের মুহাম্মদ সুবাহীর ‘মাদানিয়া’ (সুদানের তিন যুবকের বিপ্লবে অংশ নেওয়া এবং নাগরিক সরকার গঠন করার লক্ষ নিয়ে), মিশরের আরেক পরিচালক মোরাদ মোস্তাফার ‘আয়শা কান্ট ফ্লাই অ্যাওয়ে’ (সুদানী তরুণী আয়শা এবং মিশরে তার কেয়ারগিভারের কাজ করতে গিয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া নিয়ে) এবং ইরাকের আব্বাস ফাহদেলের ‘টেলস অফ দ্য উন্ডেড ল্যান্ড’ (২০২৩-এ ইজরায়েলের লেবাননে আক্রমণ এবং পরবর্তী পনেরো মাস জুড়ে সেখানকার মানুষজনের জীবনযাপনের অকল্পনীয় ব্যথাবেদনা নিয়ে) ছবিগুলি। এগুলি প্রত্যেকটিই ভাল ছবি এবং বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কোনওটি তথ্যচিত্র, কোনওটি কাহিনিচিত্র, আবার কোনওটি দুইয়ের মিশেল, কিন্তু প্রতিটি স্বরই স্বতন্ত্র এবং শোনা আবশ্যক।

শতবর্ষের কারণে ঋত্বিক ঘটকের ছ’টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে বড় পর্দায়। ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। দেখে নিন, কারণ এমন সুযোগ পাওয়া যায় না।

সলিল চৌধুরীর শতবর্ষে দেখানো হবে বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩)। সদ্য রেস্টোর হওয়া প্রিন্টটিই সম্ভবত দেখানো হবে।

এছাড়াও শতবর্ষে স্যাম পেকিনপা-র ‘দ্য ওয়াইল্ড বাঞ্চ’ (১৯৬৯) ও ‘প্যাট গায়রেট অ্যান্ড বিলি দ্য কিড’ (১৯৭৩), রিচার্ড বার্টন অভিনীত ‘হু’জ অ্যাফ্রেইড অফ ভার্জিনিয়া উলফ’ (১৯৬৬), সন্তোষ দত্ত অভিনীত ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ও রাজ খোসলা পরিচালিত ‘বোম্বাই কা বাবু’ (১৯৬৬) দেখানো হবে। এগুলিও চাইলে দেখে নিতে পারেন।

বড় পর্দায় দেখানো হচ্ছে শ্যাম বেনেগালের ‘ভূমিকা’ (১৯৭৭)। প্রত্যক্ষ করুন অবশ্যই। রাজা মিত্রের ‘নয়নতারা’ দেখানো হবে, যদিও আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘একটি জীবন’। তিনি ৩০টিরও বেশি তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র বানিয়েছেন, এবং সেগুলির প্রায় প্রতিটিই যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যে-কথা আমরা আজকাল আর মনে রাখি না বড় একটা। দেখে নিন শশী আনন্দের তথ্যচিত্র ‘ম্যান ভার্সেস ম্যান’ (১৯৮১), যা তৎকালীন কলকাতার হাতে টানা রিক্সা চালকদের প্রতিকূলতা নিয়ে। এছাড়া দেখতে পারেন ক্লাউদিয়া কারদিনালে অভিনীত সার্জিও লিয়নের ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’ (১৯৬৮), ডেভিড লিঞ্চের অত্যন্ত দেখা-আবশ্যক ছবি ‘ব্লু ভেলভেট’ (১৯৮৬) ও রবার্ট রেডফোর্ড অভিনীতি সিডনি পোলাকের ‘দ্য ওয়ে উই ওয়্যার’ (১৯৭৩) ছবি দুটি।

সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০), সুমিত্রা পিরিয়েসের ‘গেহেনু লামাই’ (১৯৭৮) ও প্রেম কাপুরের ‘বদনাম বস্তি’ এই তিনটি ছবির রেস্টোর্ড প্রিন্ট দেখানো হচ্ছে, অবশ্যই বড় পর্দায় দেখুন। বিশেষ করে শেষ দু’টি ছবি। বলা হয় শ্রীলঙ্কার প্রথম নারী চিত্রপরিচালক ছিলেন সুমিত্রা পিরিয়েস। সিনহালা সমাজে মহিলাদের অবস্থান নিয়ে ‘গেহেনু লামাই’ দেখা যেমন অতি অবশ্যই দরকার, তেমনই ‘বদনাম বস্তি’তে আভাস দেওয়া হয়েছিল দুই পুরুষের শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কের ব্যাপারে, যা তথাকথিতভাবে ভারতের প্রথম কুইয়ার চলচ্চিত্র হিসাবে ফিল্ম গবেষকরা বলে থাকেন। দীর্ঘদিন ছবিটির প্রিন্ট পাওয়া যেত না, শেষে বার্লিনের আর্সেনালে একটি প্রিন্ট পাওয়া যায় এই ২০১৯ নাগাদ।

এছাড়া দেখুন হিমাংশু রাই ও ফ্রান্‌ৎস অস্টেনের ‘প্রেম সন্যাস (দ্য লাইট অফ এশিয়া)’ (১৯২৫) নামের সায়লেন্ট ফিল্মটি। ভারত ও জার্মানের সায়লেন্ট ফিল্মের ইতিহাসে এই ল্যান্ডমার্ক ছবিটি বড়পর্দায় প্রত্যক্ষ করা অতি আবশ্যক।এই ছবিটিতে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার, লং প্যানোরামিক শট ও প্রচুর কলাকুশলী নিয়ে জনবহুল দৃশ্যায়নের কারণে অনেকে ছবিটিকে গ্রিফিতের ‘ইনটলারেন্স’ ও মুর্নাউয়ের ‘ফাউস্ট’-এর সমকক্ষ হিসাবে ধরে থাকেন।

এবারে ফিলিপিনো অটর ফিল্মমেকার ব্রিলান্তে মেন্দোজার মোট পাঁচটি ছবি নিয়ে রেট্রোস্পেক্টিভের আয়োজন করা হয়েছে এবং তিনি মাস্টারক্লাস নেওয়ার জন্য উপস্থিতও থাকছেন। ‘সার্বিস’ (২০০৮), ‘কিনাটায়’ (২০০৯), ‘লোলা’ (২০০৯), ‘সিনাপুপুনান’ (২০১২) ও ‘মা’ রোসা’ (২০১৬) ছবিগুলি দেখে নিন বড় পর্দায়, কারণ এইসব ছবিগুলোর সবগুলোর ভাল প্রিন্ট কিন্তু এখনও সুলভ নয়।

এবারের ফোকাস কান্ট্রি পোল্যান্ড। দেখতে পারেন ‘ইউরোপা ইউরোপা’ (১৯৯০), ‘ইন ডার্কনেস’ (২০১১), ‘দ্য গ্রিন বর্ডার’ (২০২৩)-এর মতো ছবির নির্মাতা আগ্নিয়েশকা হল্যান্ডের ‘ফ্রানজ’, যা মূলত ফ্রাৎস কাফকার উপরে ভিত্তি করে নির্মিত। পোলিশ নিউ ওয়েভের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার ইয়েজি স্কোইমফ্‌স্কির ‘ইও’ দেখে নিন বড় পর্দায়। ক্রিস্তভ কিয়েশলভস্কির ‘দ্য ডাবল লাইফ অফ ভেরোনিক’ (১৯৯১) বড় পর্দায় না দেখলে জীবন বৃথা বলে ধরে নেবেন। অন্যদিকে আছে আন্দ্রে জুভাফস্কির ‘অন দ্য সিলভার গ্লোব’ (১৯৮৮), যা না দেখলেই নয়। এছাড়া রয়েছে ইয়েজি কাভালেরোভিচের ‘ফারাও’ ও ভয়চেখ ইয়েজি হাস-এর তিনটি ছবি যথাক্রমে ‘দ্য সারাগোসা ম্যানুস্ক্রিপ্ট’ (১৯৬৫), ‘দ্য ডল’ (১৯৬৮) ও ‘দ্য আওয়ারগ্লাস স্যানাটোরিয়াম’ (১৯৭৩), যেগুলি অতি অবশ্যই দেখা দরকার।

এবারে দেখার সুযোগ রয়েছে রূপকলা কেন্দ্রের একগুচ্ছ স্টুডেন্ট ফিল্ম, যেগুলো আমাদের সরাসরি গিয়ে দেখা খুবই প্রয়োজন। এই রূপকলা থেকেই অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মমেকার বা সিনেমা জগতের আরও অনেককে আমরা পেয়েছি। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কী ভাবছে, কীভাবে ছবির ভাষা অন্বেষণ করছে, কী বলতে চাইছে, তা আমরা সাধারণ দর্শক ও চলচ্চিত্রপ্রেমীরা যদি না দেখি, তো কারা দেখবে? সেভাবেই বলব এবারের উৎসবে যে-যে তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিগুলি দেখানো হচ্ছে, সেগুলি সম্ভব হলে দেখার চেষ্টা করুন। নানা রকম বিষয়ের অনেক তথ্যচিত্র আমরা দেখার সুযোগ পাচ্ছি এবার।

বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, চলচ্চিত্র পরিচালক দেবলীনা মজুমদার-এর কথা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা বিষয়ে তথ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র ইত্যাদি বানিয়েছেন, যেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘এবং বেওয়ারিশ’ (২০১৩), ‘আবার যদি ইচ্ছে করো…’ (২০১৭), ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ (২০১৯)। তাঁর নতুন ছবি ‘জিলিপিবালার বন্ধুরা’ অতি অবশ্যই দেখে নিন এবারের KIFF-এ। ছবির কেন্দ্রে স্বাধীনতা সংগ্রামী পারুল মুখোপাধ্যায়ের নিজের হাতে পোঁতা প্রায় ৮০ বছরের পুরনো একটি তেঁতুলগাছের অস্তিত্ব বনাম আধুনিক সমাজের উচ্চাশা। এছাড়াও দেখে নিতে পারেন অসমের পরিচালক ‘ক্রিপাল কালিটার ‘দ্য এলিফেন্ট হেভেন’, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘পেইন্টেড মেমরিজ ক্যালকাটা কানেক্ট রাজ কাপুর’ ও বিজয়ী যাপনের পটকথা’ ইত্যাদির মতো তথ্যচিত্র।

ভারতে বিরল হতে থাকা একাধিক ভাষায় বানানো ছবির সুলুকসন্ধানও এবারে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেগুলির অধিকাংশই দেখা দরকার বলেই মনে হয়। ভারতে বসবাসকারী সিদ্দি সম্প্রদায়কে নিয়ে ছবি জয়ন চেরিয়ানের ‘রিদম অফ দাম্মাম’, ত্রিপুরার আদিবাসীদের কেন্দ্রে রেখে বানানো ছবি প্লোটো দেববর্মার ‘খানি (বিলাভেড)’ ইত্যাদি ছবি চাইলে দেখে নিতে পারেন।

এছাড়াও দেখা যেতে পারে ‘চিটাগং’ (২০১২)-এর মতো ছবির নির্মাতা দেবব্রত পাইনের নতুন ছবি ‘দেজা ভু’, বিষয় মার্কিন কৃষকদের গত চার দশকের জীবনসংগ্রাম। দেখে নিন অস্ট্রেলিয়ার রলফ দ্য হারের ‘দ্য ট্র্যাকার’ (২০০২)। এছাড়া ‘রাশিয়ান আর্ক’ (২০০২)-এর মতো চমৎকার ছবির পরিচালক আলেকজান্দার শোকুরভের ৫ ঘণ্টাব্যাপী পরীক্ষামূলক ‘ডিরেক্টর’স ডায়েরি’।

দেখে নিন ওয়ার্নার হার্ৎসগ্‌-এর ‘ঘোস্ট এলিফেন্টস’। বিস্ময় নিয়ে বের হবেন সিনেমা হল থেকে।