নীলা-নীলাব্জ: পর্ব ২১

WFH

বিকেলে গোলপার্ক মোড়ের একটা কফির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নীলা কফির কাপটা দু’হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল। বৃষ্টি হবে-হবে ভাব, হালকা হাওয়া দিচ্ছে। ঠিক তখন, পাশ থেকে পরিচিত গলার স্বর—

নীলাব্জ: মেঘে-মেঘে কেটেছে বেলা, গোলপার্কের মোড়ে দাঁড়িয়ে নীলা…

নীলা চোখ না তুলেই বলে, ‘মিলল না।’

নীলাব্জ: মানে? লা-এ লা-এ মিলল না?

নীলা: একে তো ছন্দ মেলেনি, তার উপর রাইমটাও করতে পারোনি। সস্তার মিল। বেলার সঙ্গে খেলা মিলবে, ন্যালা মিলবে কিন্তু নীলা মেলে না। যারা কবিতা লিখতে পারে না, তারা এইসব মিল দিয়ে ভাবে ভীষণ মিলল বুঝি-বা।

নীলাব্জ: আচ্ছা বাবা, মিলল না কিন্তু লাগল তো?

নীলা: লাগল মানে?

নীলাব্জ: মানে এই যে তুমি এক পলকে চটে গেলে…

আরও পড়ুন: কর্পোরেটে কাজ করলে, চাপ নিতেই হবে? নীলাকে যা বলল নীলাব্জ! লিখছেন অনুপম রায়…

নীলা: আমি মোটেও চটিনি। তোমার দুর্বল রাইম… যাক গে, বাদ দাও। তোমার সঙ্গে কথা বলাও সময় নষ্ট। আমার উইকেন্ড আমি এভাবে নষ্ট করতে চাই না। 

নীলাব্জ: হ্যাঁ, ওই দু’দিনের জন্যই তো বেঁচে থাকো। তাও মাসের বেশ কয়েকটা উইকেন্ড ঝার যায়…

নীলা: তুমি উইকেন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকো, না? না কি পুরোটাই ফাঁকি? তুমি কি অ্যাট অল কাজ করো নীলাব্জ?

নীলাব্জ: ও মা! কাজ করতেই তো এসেছি। কফিটা নিলেই অনলাইন মিটিং।

নীলা: অনলাইন মিটিং মানে কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে? তুমি কি কোনওদিন অফিসে যাও?

নীলাব্জ কফির দোকানের লোকটার সঙ্গে কিছু কথা বলে তারপর নীলার দিকে তাকায়।

নীলাব্জ: অফিস? মানে ওই লাশকাটা ঘরটায়? ওয়ার্ক ফ্রম হোম তাহলে আছে কেন? মোবাইল আছে, ইন্টারনেট আছে কেন? এখানে মেঘ আছে, হাওয়া আছে, তুমি আছ… অফিস গিয়ে কী করব?

নীলা গম্ভীর: তুমি কি জীবনে একটা দিনও ঠিকঠাক কাজ করো? WFH তোমাদের মতো অলস মানুষের জন্যই তৈরি হয়েছে।

নীলাব্জ: অলস? না, আমরা এফিশিয়েন্ট। অফিসে গিয়ে ৩ ঘণ্টা গসিপ, ২ ঘণ্টা লাঞ্চ, ১ ঘণ্টা স্মোক ব্রেক… তারপর স্প্রেডশিট-এ তিনটে রং লাগিয়ে বলবে, উফ! সারাদিন কত কাজ করলাম!

নীলাব্জর কফি চলে আসে। ওরা হাঁটতে শুরু করে সাদার্ন অ্যাভিনিউ ধরে।

নীলা: WFH-এ প্রোডাক্টিভিটি মাঠে মারা যায়। বাড়িতে মন বসে না। কাজের পরিবেশটাই থাকে না।

নীলাব্জ: বাড়িতে মন বসে না, অফিসে বসে? সিগারেট-ব্রেক, কফি-ব্রেক, আড্ডা-ব্রেক, কাজটা ঠিক কবে হয়?

নীলা চোখ রাঙায়, ‘কমপক্ষে একটা স্ট্রাকচার থাকে। লাইফস্টাইল থাকে। মানুষের ঘুম-টুম সব ঠিক থাকে। WFH-এ তো ঘুম, খাওয়া-দাওয়া সব মাথায় ওঠে। সবাই ধরেই নিচ্ছে আমি বাড়িতে আছি মানে সারাক্ষণ কাজ করছি। সকাল, সন্ধে, রাত্তির সব গুলিয়ে দেয়।

নীলাব্জ: তুমি বলছ নিয়ম মেনে চলতে অর্থাৎ অ্যালার্ম-এর দাস হওয়া, তাই তো? ৬:৩০-এ ওঠো, ৭:৩০-এ বাস ধরো, ৮:৩০-এ বসকে দেখলে লেজ গুটিয়ে থাকো… এরকম জীবন তোমার ভাল লাগে, তাই তো?

নীলা: আর তোমার কি ভাল লাগে? বিকেল চারটেতে লাঞ্চ, সন্ধেবেলা স্নান?

নীলাব্জ: যদি কাজ ঠিকঠাক হয়, তবে হ্যাঁ। তুমি যাকে ডিজঅর্ডার বলছ, আমি তাকে ক্রিয়েটিভিটি বলছি।

নীলা: ঘোড়ার ডিম! ক্রিয়েটিভিটি না হাতি! WFH-এ ঘাড়ে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, অ্যাংজাইটি, একাকিত্ব— সব বেড়ে যায়। সবার বাড়িতে ভাল চেয়ার-টেবিলই থাকে না। বিছানায়, সোফায় বসে…

নীলাব্জ: বস, এটা তাদের প্রবলেম। অফিসে গেলেই কি সব সমাধান? শহরের ধোঁয়া খেয়ে ফুসফুস যায়, ক্যান্টিনের খাবারে পেট যায় আর বসের মুখটা দেখে মেন্টাল হেল্‌থ যায়।

নীলা: আমিও বলতে পারি এটা তাদের প্রবলেম। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গেলেই হয়। গাড়ির কাচ তুলে অফিস গেলেই হয়। এত বাজে বকতে পারো, বাপ রে!

নীলাব্জ: বাজে? অফিসে মানুষের ৮০% রোগ যাতায়াত থেকে হয়।

নীলা: দিয়ে দিলে একটা সংখ্যা! বানালে?

নীলাব্জ: তোমার ভালো লাগে জ্যামে বসে থাকতে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্রেফ নষ্ট।

নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে— ‘আর তো কোনও উপায় নেই অফিসের পরিবেশে থাকার জন্য। একটা জিনিস দেখো। WFH-এ তো কোনও বাউন্ডারি-ই নেই! তাই না? রাত ১১টার কল, ১২টায় মিটিং… বাড়িটাই তো অফিস হয়ে যায়।’

নীলাব্জ: অফিসে বাউন্ডারি থাকে? সারাদিন কাজ করে ফিরে, রাতে কল জয়েন করতে হয় না তোমাকে? এটা বাউন্ডারি?

নীলা: এখন অনেকটাই হাইব্রিড মডেল নীলাব্জ।

নীলাব্জ: হাইব্রিড না হাতি! পুরোটাই WFH করে দেওয়া উচিত!

নীলা: না, নীলাব্জ! WFH মানুষকে অসামাজিক করে দিয়েছে। বন্ধুরা দেখা করেও সবাই যে যার কল নিচ্ছে। কেউ কথা বলছে না। কারণ সবাই WFH করছে! অফিসের জন্য সবাই সব সময়ে উপস্থিত! মানুষে-মানুষে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে।

নীলাব্জ: এটা মোটেও WFH-এর দোষ নয়। এটা এই মানুষগুলোরই দোষ। তোমার বাউন্ডারি তোমার হাতে। তুমি সেট করবে। কল আছে তো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছে কেন? এরা এমনিও মানুষকে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। WFH-কে দোষ দিও না। স্বামী-স্ত্রী WFH করলে দু’জন তাও দু’জনকে দেখতে পায়। অফিস গেলে তো ট্রাফিকেই কেটে যেত!

নীলা: দেখো, ঘরে বসে থাকলে পরিপাটি হওয়াও কমে যায়। ফাটা প্যান্ট, পুরনো টি-শার্ট, চুল-জট নিয়ে সবাই বসে থাকে। একটা চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে…

নীলাব্জ হাসতে শুরু করে দেয়, ‘তুমি সাজুগুজু করতে চাও?’

নীলা: খুব মজা লাগছে তাই না?

নীলাব্জ: আমার কাছে ফ্রিডম হল মজা। অফিসে গিয়ে ব্যাজ দিয়ে এন্ট্রি করতে হবে, এইসব দাসত্ব আমাকে পীড়া দেয়।

নীলা: বেশ, আমি রোজ অফিস যাওয়াকে মহিমা দিচ্ছি না কিন্তু WFH মানুষের মেন্টাল স্টেবিলিটি নষ্ট করে। আরে বাবা, মানুষকে আর একটা মানুষের সংস্পর্শে আসতে হবে। এটার কোনও বিকল্প নেই! মানুষ সারাদিন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে।

নীলাব্জ: WFH তোমাকে বাইরে বেরোতে সুযোগ দিচ্ছে তো! আমি কি বাড়িতে বসে না কি? তোমার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি না? তুমি চাইলে চারটে cafe-তে ঘুরে-ঘুরে কাজ করতে পারো। অফিস হলে? একটি cubicle-এ আটকে থাকতে।

নীলা হাসে: সবাই ক্যাফেতে ঘুরে-ঘুরে কাজ করবে? তোমার মতো ফালতু কাজ সবার?

নীলাব্জ: আমার কাজ ফালতু?

নীলা: বড় কোম্পানিগুলো কেন আবার অফিসে ডাকছে বলো তো? তোমার বুদ্ধিতে তো তারা চলছে না। কেন? কারণ WFH সাস্টেনেবল না।

নীলাব্জ: ভুল করছ। ওরা কন্ট্রোল চায়। ম্যানেজারের ইগো থাকে— সবাইকে চোখের সামনে রাখা চাই। WFH ব্যাটাগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে।

নীলা: তাই নাকি? এদিকে WFH-এ তো কত টিম ভেঙে গেছে, খবর রাখো? কারণ কোলাবরেশন কমে গেছে।

নীলাব্জ: আচ্ছা, তুমিই বলো, টিম বন্ডিং মানে কি কনফারেন্স রুমে স্যান্ডউইচ খাওয়া? না কি কাজ সঠিক সময়ে হওয়া? WFH মানুষকে এফিশিয়েন্সি শিখিয়েছে: চটপট কাজ শেষ করে ফুল্টু মস্তি! নিজের মতো করে। অফিস কলিগের মুখের দিকে তাকিয়ে নয়।

নীলা: তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। আর ফালতু কথা।

নীলাব্জ: তোমার সব কিছুতেই পেসিমিজম! এই খারাপ, ওই খারাপ। প্রেম নেই তো জীবনে, তাই বোধহয়।

নীলা একটু গম্ভীর হয়ে যায়। নীলাব্জ-ও নিজেকে একটু সামলে নেয়

নীলাব্জ: ইয়া, মানে আমি যেটা বলছিলাম, যে নীলা… তোমার আসলে স্ট্রাকচার ভাল লাগে।

নীলা: আর তোমার?

নীলাব্জ হাসে, ‘আমার ক্যাওস ভাল লাগে। যাক গে, এবার মিটিংটা শুরু করি। এই ফুটপাথটাই তো আমার অফিস।

নীলা: বৃষ্টি আসলে, ভিজতে-ভিজতে মিটিং করো। টোটাল ক্যাওস! তোমার তো ভালই লাগবে নিশ্চয়। আমি চলি।

নীলাব্জ হাসে: বাই।

ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী