ফাঁক থেকে সমে
আমার কাছে সোমবার একটা ছুটির দিন। আমি মূলত যে কাজের মধ্যে থাকি, আমার যে কাজের গতিপথ, তার জন্য যে রুটিন ঠিক হয়ে থাকে, অর্থাৎ কিনা মঞ্চে অভিনয়— তাতে আমার কাছে সবচেয়ে ব্যস্ততার দিন শনি, রবি বা ছুটির দিন। ফলে, তার পরের যে সোমবার, তা আমার কাছে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অবকাশটুকু অন্তত বয়ে আনে। ঘুম মানে তো কেবল ঘুম নয়! প্রচেত গুপ্তর ভাষায় যাকে বলে ‘ঘাপটি ঘুম’, অর্থাৎ নানা কাজের ফাঁকে যে ঘুমের সময়সুযোগ খুঁজে নেওয়া। সেই ঘুমের মধ্যে নানারকম মৌতাত থাকে। কিন্তু আমি যে ঘুমের পরিসর খুঁজি, তাতে ওই ‘ঘাপটি’ শব্দটিকে আমি বাদই দিতে চাই। তার মধ্যে হয়তো খানিক স্বপ্ন দেখা যাবে, খানিক দুঃস্বপ্নও মিশে থাকবে, কিছু অপ্রাপ্তির কথা মনে হবে। অথচ, আমি থাকব বিশ্রামে, যা সহজে পাই না বাঙালির ছুটির দিনে। এইরকমভাবে আমার সোমবারকে আমি কয়েকবছর হল আবিষ্কার করেছি।
তার মানে কি সোমবারে আমার কাজ থাকে না? প্রভূত কাজ থাকে। তবু মনে হয়, রোববারেই আমার বেশি কাজ ছিল। যখন রোববারের ছুটিতে অনেকেই আমাদের মতো নট-নটীদের অভিনয় দেখতে আসেন, বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান দেখতে আসেন, তারপর সোমবার যখন সবাই ব্যস্ততায় ডুব দেয়, আমি তখনই আমার আয়েস খুঁজে পাই। সাধারণত রোববারদিনই আমাদের অভিনয় বা অনুষ্ঠানের দিন। কালই যেমন শো ছিল। সকাল সকাল যেতে হয়েছে, ছটফট করেছি, দুপুরে এবং সন্ধেবেলা শো ছিল। তারপরই বুঝতে পেরেছি, রোববার, আমার কাজের দিন, ছুটি নিচ্ছে আমার থেকে, আমার ছুটির দিন, মানে সোমবার আসছে।
বাঙালি যাকে স্ট্রাগল বলে, সেই সময়ের ছুটি অসহ্য!
ঋত্বিক চক্রবর্তীর কলমে মনডে ব্লুজ পর্ব ১৫
কাজই বা বলি কী করে? কাজ করব না বলেই তো এই কাজে এসেছিলাম। আমার প্রত্যেকদিনই ছুটি থাকবে, নিজেই নিজের মালিক হব ইত্যাদি এলোমেলো ভাবনা ছিল এককালে। কিন্তু দেখেছি, তেমনটা হয় না। তবু রবিবার আসে, সোমবার আসে, যে যার মতোই। তবু রবি-সোমের মধ্যে যে শাশুড়ি-বউমার সম্পর্ক, তা আমি দিব্য নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে পেরেছি। শাশুড়িকে তদগত হয়ে বউমার আদর করতে দেখেছি, আবার বউমাকে খুব শ্রদ্ধা নিয়ে শাশুড়ির যত্ন নিতে দেখেছি। এখন রবি আর সোমের মধ্যে কে শাশুড়ি, কে বউমা, এই প্রশ্ন আবার আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
সোমবার আমার অনেকগুলো অকাজের দিন। রুটিন বাঁধা কাজের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতেই সোমবার আমাকে জানান দেয়, কাজ ফুরিয়েছে। কিন্তু তা বললেই হয় না। নিজের কাজ থাকে, সংসারের কাজ থাকে, আবার কোনও মহড়াও থাকে হয়তো। তাও যখন দেখি, সকালে ক্লিন শেভড হয়ে কেউ কাজে বেরিয়ে গেল, আমি তখন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় মৌজ করতে পারি। এমনটা তো ঘটেই। এই সোমবার, যেদিন একথা বলছি, সেদিনও তেমনটাই ঘটেছে।
আমি যে ঘুমের পরিসর খুঁজি, তাতে ওই ‘ঘাপটি’ শব্দটিকে আমি বাদই দিতে চাই। তার মধ্যে হয়তো খানিক স্বপ্ন দেখা যাবে, খানিক দুঃস্বপ্নও মিশে থাকবে, কিছু অপ্রাপ্তির কথা মনে হবে। অথচ, আমি থাকব বিশ্রামে, যা সহজে পাই না বাঙালির ছুটির দিনে। এইরকমভাবে আমার সোমবারকে আমি কয়েকবছর হল আবিষ্কার করেছি।
কিন্তু আজই আবার আমি রওনা দেব মার্কিন মুলুকে। ওদেশেও আমার শো সেই সপ্তাহান্তেই। সোমবার ওখানকার কর্মব্যস্ত জীবনে যখন লোকে ঝুপ ঝুপ করে ডুব দেবে, তখন আমি পুকুরপাড়ে বসে দেখব, ওই ডুব দিয়ে লোকটা কখন ওঠে দেখি। দেখব, কতটা বুদবুদ ভেসে ওঠে জলের ওপর। সেই মায়াতেই কেটে যাবে আরেকটা সোমবার।
সোমবার আমার কাছে বড় প্রেমের দিন।
সোমবার আমার কাছে আনন্দের দিন।
সোমবার আমার কাছে অকাজের দিন।
সোমবার আমার এমন কাজের দিন, যাকে কোনওদিনও কাজ বলে মান্যতা দিইনি, কিন্তু তার ফাঁদে পা দেওয়ার চক্রান্তকে মেনেও নিয়েছি।
তাই সোমবার আমাকে ফাঁক থেকে সমের তালে, সেই তাল মিলিয়ে সমে এসে ফেরত দেয়। সোমবারের সঙ্গে আমার দোস্তি আছে, ভাব-ভালবাসা আছে। রোববারের সঙ্গে, বা অন্যান্য দিনের সঙ্গে টানাপোড়েন চলতেই থাকে। আর সোমবার আমার কাছে সেই অক্সিজেন সিলিন্ডার, যার জন্য আমার দম নিতে কখনও অসুবিধে হয় না।