শুধু কবিতার জন্য : পর্ব ৩৬

কয়েকটি কবিতা

১.

আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই যে,

এত এত যুদ্ধজয়ের পরও তোমার মুকুটে যে পালকটি বসানো আছে

সেটি প্লাস্টিকের।

সেই নিয়েই উদ্ধত চোখ ও উঁচু মাথা দুলিয়ে

তুমি এসে দাঁড়িয়েছ বাজারের মাঝখানে, জয়ী হিসেবে।

যেন এই নগর, তার শস্য ও বাসিন্দা তোমার কেনা।

আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই যে,

মানুষের হইহই তিরস্কার তোমার কানে এসে আছড়ে পড়ছে

হাততালি হিসেবে।

যে-হাসি তুমি প্র্যাকটিস করে এসেছ এত শতাব্দী ধরে

আয়নার সামনে, একা স্নানঘরে

আজ তা বিলিয়ে দিতে গিয়ে মনে হচ্ছে জীবন সার্থক তোমার।

ঠোঁটে এসে ছিটকে লাগা টোম্যাট সসকে তুমি চিনতে পারছ

শত্রুর নির্ভুল রক্ত হিসেবে।

হে যোদ্ধা, এবার ঘুমোও।

২.

পৃথিবীর সবচাইতে মিঠে চিঠি, পদত্যাগপত্র।

গোলামিকে মৃদু লাথি-মারা সেই অক্ষরমালা এবার বারান্দায় টাঙানো

তার মাখোমাখো বিনয় থেকে কোটেশন তুলে নিচ্ছে সাংবাদিকেরা

যুক্তির জাগলারি থেকে সরলরেখা টেনে বার করছেন গাণিতিক

একটি শিশু, বাবা’র কোল থেকে নেমে দেখতে পাচ্ছে অন্য গ্রহের যান

তাকে বাবা বলছেন, ‘অমন করতে নেই, এসো’।

চিঠি, পদত্যাগপত্র, সাহসের পতাকা ঝুলে আছে বারান্দা থেকে

লোক জড় হচ্ছে তার নীচে

সভ্যতা গড়ে উঠছে, বাজার বসছে, কারখানা তুলছে ভোঁ

বিপ্লব, দেখতে দেখতে ইশতেহার হয়ে উঠছে কখন।

শিশুটির চোখ গাঁথা হচ্ছে আইসক্রিমে, চেরি’র বদলে।

৩.

তার ওপর এই কাণ্ড।

ওষুধের বাক্স থেকে উড়ে যাওয়া প্রজাপতি এবার ধরে আনো তাহলে

রোগীকে রঙ দাও ঝিলিমিলি ও শোনাও পিয়ানো কনশ্যেতো

নেহাত কম তো নয় এই জীবনের ওঠাপড়া

তুমি, এই হাসপাতালের বেনাম ওয়ার্ডবয়

তুমি, পেশেন্ট পার্টির অবধারিত দেবদূত এবার বার করো ডানা

উড়ে যাও প্রজাপতিটির পিছনে

আশ্বাসের বাতাসে তুলে ধরো তোমার বিজ্ঞাপন

বলো, শেষ কখন রোগীকে দেখেছিলে চোখ মেলতে

কখন শেষ স্যুপে চুমুক দিয়েছিলেন তিনি

কবেই বা বন্ধ করতে বলেছিলেন টিভিতে খবর

এই অসুখের পর্যটনে পেশেন্ট পার্টির রংচঙে তুমি গাইড

মিহি বিক্রি করো মৃত্যু।

শোকের পোশাক খুলে তাকে এই শেষবার পরিয়ে দাও

স্বস্তির হাঁপছাড়া ঝলমলে জামা।

৪.

তুমি দত্তবাড়ির ছেলেকে পাঠিয়েছিলে শিকাগো

ঠাকুরবাড়ির ছেলেকে শিলাইদহ

গদাধর চাটুজ্যেকে তুমিই স্টার থিয়েটারে গিরিশের থ্যাটার দেখতে

অথচ তোমার কোনও অহংকার নেই

পাঁচিলে বসে এমনভাবে পা দোলাচ্ছ যেন বিপ্লব হবে

এমন ভাবে তাকিয়ে আছ নীচে যেন গোটা পৃথিবী এক হাস্যকর মিছিল

অথচ উইলিয়ামকে নাটকের নেশা ধরালে তুমিই

ক্লিওপেট্রা আর মার্গারেট থ্যাচারকে দিলে রাজদণ্ড

আর সক্রাতেসের হাতে তুলে দিলে বিষের উন্মুক্ত বাটি

এই রোলারের মতো ধীরগতিতে বয়ে যাওয়া মহাসময়

যার নীচে আমরা চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি হাসতে হাসতে

আর তুমি তুলে নিচ্ছ আমাদের চেহারা, ন্যাতানো জলছবির মতোই

ও ইতিহাস, এত নির্মম জোকার, তুমি সার্কাসে যাবে না?

৫.

ছোটবেলার লন্ড্রি আকাশে উড়ছে আজ

সাধারণ সাদা জামা ইস্ত্রি করাতে সেই কত দূর উড়ে যেতে হবে

গনগনে রোদ থেকে রবি’দা তুলে নিচ্ছেন লোহার ভারী ইস্ত্রি

আর পাট পাট করে ভাঁজ করছেন মেহনতী মানুষের ডানা

অব্যবহৃত, বিপথচালিত, মিথবাহিত

আমার অতীত নিয়ে, এলোমেলো, দোমড়ানো মোচড়ানো বিগতকাল নিয়ে

আমি লম্বালম্বি উড়ে চলি সেই ভাসমান লন্ড্রি’র প্রতি

ভাঁজ করে রাখা স্মৃতির লোভে, টানটান আক্ষেপরাশির অপেক্ষায়

আমি, যে কোনও দিন কোনও মিছিলে ছিলাম না

মিটিং-এ ছিলাম না, জনসভায় ছিলাম না

কেবল মনে মনে সমর্থন করে গেছি

বিষণ্ণতাকে।

৬.

‘পারিশ্রমিক’ বানান লিখতে গিয়ে কেঁদে ফেলছে যে-মেয়েটি

তার আজ রেশন দোকান যাবার কথা।

তাদেরই পাড়া থেকে উঠেছিল আওয়াজ ‘জবাব চাই, জবাব দাও’

তাদেরই ঝিল থেকে উঠেছিল লাশ, প্রদীপ্ত’র।

এত ঝামেলার মধ্যে সে শিখে উঠতে পারেনি একটিও রবীন্দ্রসঙ্গীত

পড়ে উঠতে পারেনি মনীষীদের জীবনী।

কেবল শিখেছে সে বাবাকে বিদায় জানানো, দরজায় দাঁড়িয়ে

কেবল শিখেছে সে সাইকেলদের ফিরিয়ে দেওয়া, জানলা থেকে

আলুথালু মহাকাশে একদিন উড়ে যাবে বলে

কেবল সে শিখেছে ডানা ভাসানো, মনে মনে।

এখন, এই রেশনের লাইনে ৩৬ নম্বর হয়ে দাঁড়ানো মেয়েটি

একদিন ছায়াপথে ঘুরবে

তার কান্না, ঢুকে যাবে ভ্রমণের বইতে, কোনও অছিলায়।