নীলা-নীলাব্জ: পর্ব ১৭

Neela- Neelabjo 17

সোশাল মিডিয়া ও সেন্সর

নীলা একটা জুতোর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন দেখছিল। হঠাৎ পাশ থেকে নীলাব্জ।

নীলাব্জ: জুতো তো সামনে ডিসপ্লেতে… মোবাইল ফোনে কী খুঁজছ?

নীলা মুখ তোলে না। ‘জুতোর দোকানেও তুমি?’

নীলাব্জ: না, ওই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখলাম তোমার মতো কেউ একটা…

নীলা: অমনি জ্ঞান দিতে দাঁড়িয়ে পড়লে?

নীলাব্জ: জ্ঞান? আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করলাম সামনে এত জুতো সাজানো কিন্তু তুমি তা না দেখে ফোনের দিকে তাকিয়ে কেন?  

নীলা: দাম দেখছি। অনলাইনে একই জুতো অর্ধেক দামে পাওয়া যাচ্ছে।

নীলাব্জ: তাই? কই দেখাও!

নীলা স্ক্রিনটা ঘুরিয়ে নীলাব্জর মুখের সামনে ধরে, ‘হয়েছে বিশ্বাস?’  

নীলাব্জ: আরিব্বাস! তাহলে তো অনলাইন কেনাই ভাল, কী বলো?

আরও পড়ুন: স্কুল থেকে কর্পোরেট, ইউনিফর্ম কি সবাইকেই মিলিটারি করে তোলে? লিখছেন অনুপম রায়…

নীলা: এক্ষেত্রে নিশ্চয়।

নীলাব্জ: অনলাইন এসে পুরো জীবনটাই পালটিয়ে দিয়েছে। এক ঘর যাকে বলে।

নীলা: সব কিছু যে ভাল হয়েছে তা নয়। সোশাল মিডিয়াটা একটু সেন্সর করা দরকার। অতিরিক্ত গালাগাল, অশ্লীলতায়, গা ঘিনঘিন করে একেবারে…

নীলাব্জ: কেলো করেছে! আজ তো লম্বা গল্প আছে মনে হচ্ছে।

ওরা দু’জন জুতোর দোকানটাকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করে।

নীলাব্জ: সোশাল মিডিয়াই আমাদের জীবনের একমাত্র জায়গা যেখানে আমরা একটু মন খুলে কথা বলতে পারি। সেখানেও সেন্সরশিপ বসাতে চাইছ তুমি?

নীলা: মন খুলে কথা আর মন খুলে গালাগালের তফাত আছে। কে অশ্লীল ভিডিয়ো পোস্ট করছে, কে জনতাকে উস্কানি দিচ্ছে, এসব কি ঠিক? পাহারা বসাতে হবে। যে যা খুশি করতে পারে না সমাজমাধ্যমে!

নীলাব্জ: কিন্তু কে ঠিক করে দেবে কী চলবে, কী চলবে না?

নীলা: সরকার!

নীলাব্জ: সর্বনাশ করেছে। তাহলে সরকার নিজের প্রোপাগান্ডা সিস্টেম বানিয়ে দেবে সমাজমাধ্যমকে। সরকারের বিরুদ্ধে যা কিছু লেখা হবে, তা কাঁচি চালিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে। অন্যায় হলেও লিখতে পারবে না। লিখলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে।

নীলা: সে-ভয় তো এখনও আছে। আমরা তো নাগরিক নই, আমরা প্রজা। সারাক্ষণ ভয়ে থাকি। কিছু বললেই মিথ্যে কেস দিয়ে…

নীলাব্জ: তাহলে? তুমি তো নিজেও জানো! তাহলে সরকারকে কেন দায়িত্ব দিচ্ছ?

নীলা: আচ্ছা বেশ, তাহলে প্রাইভেট।

নীলাব্জ: সর্বনাশ করেছে! সে তো স্রেফ মুনাফার জন্য এটা চালাবে। যে বেশি টাকা দিতে পারবে তার জিনিস যেমনই হোক সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে। রেট চার্ট করা থাকবে। টাকা ফেললেই সব দেখাতে পারবে।

নীলা: মানুষের কি বিবেক বলে কিছু নেই? ক্ষমতা আর টাকার কাছে সবাই বিক্রি?

নীলাব্জ: ওই যাদের ক্ষমতা বা টাকা কোনটাই নেই, তাদের কিছুটা আছে এই বিবেক।

নীলা: তাহলে কিছুই করা যাবে না? মুখ বন্ধ করে থাকব? চোখের সামনে এই অসভ্যতা চলতে থাকবে?  

নীলাব্জ: ছাড়ো তো এসব! করতে দাও মানুষকে যা খুশি। তুমি কাঁটা বেছে মাছ খেতে জানো তো, সমাজমাধ্যমে তাই করবে। যার কাঁটা খেতে ভাল লাগে, সে খাবে।

নীলা: মানতে পারছি না। আমাদের পুলিশ কেন আছে? কোর্ট কেন আছে? আইন, বিচার এসব তো আছে। নাহলে তো মানুষ যা খুশি তাই করবে। যা করছে সমাজমাধ্যমে, সেটা তো থামাতে হবেই।

নীলাব্জ: পুলিশ, আইন? এগুলো কাদের জন্য নীলা? ক্ষমতা বা টাকা থাকলে এগুলো তোমার অধীনে। জানো না? পক্ষ ঠিক থাকলে এগুলো তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। এগুলো সব হেরে যাওয়া প্রতিষ্ঠান। মানুষের শয়তানির কাছে এরা মাথা নত করে বসে আছে।

সরকার করবে ফ্যাক্ট চেক? আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায় ক্ষমতা। ক্ষমতার একটাই উদ্দেশ্য, ক্ষমতা ধরে রাখা। তার জন্য তারা মিথ্যে বলবে, মিথ্যেকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করবে আর আমরা সেটাকেই সত্য বলে গ্রহণ করব। এখন সমাজে একটাই সত্য, ক্ষমতার হয়ে ক্রাইম করো, ক্ষমতা তোমাকে ঠিক বাঁচিয়ে নেবে। সুতরাং ক্রাইম বলে কিছু নেই। ঘৃণা ছড়ানো, অসভ্যতা করা, গালাগাল দেওয়া: ক্ষমতার হয়ে এসব করলে এগুলো ক্রাইম নয়।

নীলা: এত নেগেটিভ ভাবলে চলবে না। সরকার কি কিছুই করে না আমাদের জন্য? খাওয়ার জল পাচ্ছি, রাস্তায় হাঁটতে পারছি, আর্মি পাচ্ছি সুরক্ষার জন্য। হাসপাতাল আর স্কুলটা ছেড়ে দিলাম, ওগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তুমি একটু ম্যাক্রো লেভেলে দেখো, ফরেন পলিসি দেখো। এগুলো তো সব সরকারই করছে। তাই না? এই যে রাশিয়ার থেকে সস্তায় তেল কিনছে ভারত তাতে…

নীলাব্জ: তাতে তোমার কী? তাতে আমার কী? তুমি পেট্রোল কততে কিনছ? সেই ১০৫ টাকা। রাশিয়া থেকে কিনুক, চায়না থেকে কিনুক, জাহান্নম থেকে কিনুক, আমাদের কী? আমরা কি সস্তায় পাচ্ছি? ১০৫ টাকার ৪০-৪৫ টাকা চলে যায় শুধু শুল্ক দিয়ে। কেন্দ্র, রাজ্য দু’জনে চালিয়ে খেলছে। দু’জনে মিলে ৪০% তুলে নিচ্ছে। ওই ট্যাক্স কোনওদিন কমবে না। আমরা শুধু বড়-বড় গল্প শুনছি। হ্যাঁ, লাভ হচ্ছে হয়তো। কিছু প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের যারা আসলে কম টাকায় তেলটা কিনছে। আমাদের কাঁচকলা। ওই যে তুমি নিজেই বললে, আমরা প্রজা। আমরা নাগরিক নই। 

নীলা: সবই বুঝলাম, কিন্তু তর্কটা ঘুরিয়ে দিয়েছ। সমাজমাধ্যম এই মুহূর্তে সেন্সর না করলে ফেক নিউজে ভরে যাবে যে! ফ্যাক্ট চেক করবে কে?

নীলাব্জ: ভরে যাবে কী? ভরে গেছে তো! সরকার করবে ফ্যাক্ট চেক? আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায় ক্ষমতা। ক্ষমতার একটাই উদ্দেশ্য, ক্ষমতা ধরে রাখা। তার জন্য তারা মিথ্যে বলবে, মিথ্যেকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করবে আর আমরা সেটাকেই সত্য বলে গ্রহণ করব। এখন সমাজে একটাই সত্য, ক্ষমতার হয়ে ক্রাইম করো, ক্ষমতা তোমাকে ঠিক বাঁচিয়ে নেবে। সুতরাং ক্রাইম বলে কিছু নেই। ঘৃণা ছড়ানো, অসভ্যতা করা, গালাগাল দেওয়া: ক্ষমতার হয়ে এসব করলে এগুলো ক্রাইম নয়। ক্ষমতার ব্যাকিং ছাড়া করলে নিছক বোকামি, তখন এগুলো অন্যায়।

নীলা: তুমি বলছ, গোটা সিস্টেমে কেউ নেই যে সোশাল মিডিয়া পরিষ্কার রাখতে পারবে? তুমি বলছ, একটা শিশু চোখের সামনে একটা অ্যাডাল্ট কনটেন্ট ভেসে উঠলে, উঠবে? কারওর কোনও দায় নেই! বিবেক নেই। আইন যারা বানাচ্ছে, তাদের সংসার নেই? তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নেই? কী রেখে যাচ্ছে? রিল বানিয়ে তো জীবন চলবে না!

নীলাব্জ: এত যদি নেতারা বুঝত, তাহলে দিল্লির পলিউশন কমানোর চেষ্টা থাকত। নেতারা নিজেরাই ওই হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়। নিজের পরিবারও নেয়। কিন্তু ওটা প্রায়োরিটি নয়। আসল উদ্দেশ্য কিন্তু টাকা। ফুসফুসে দুটো কালো প্যাচ থাকলে থাকবে, ব্যাঙ্কে টাকা থাকলেই হল।

নীলা: আরে কিন্তু প্রতিবাদ তো করতে হবে! প্রতিবাদ না করলে তো মেয়েদের ভোটাধিকারও জন্মে আসত না, তাই না? তুমি বুঝতে পারছ না, সমাজমাধ্যম কোন দিকে যাচ্ছে। আর যেতে ইচ্ছে করে না। আমদেরকেই তো চেষ্টা করতে হবে সুস্থ একটা সমাজ গোড়ে তোলার। হাল ছেড়ে দিলে হবে কেন?

নীলাব্জ: আমাদের সময় কোথায়? কোন রাজস্থানের ভিডিয়োকে মালদা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কোন শিশুকে গালাগাল উচ্চারণ করিয়ে রিল ভাইরাল করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের পক্ষে সম্ভব এগুলোকে সারাদিন বসে-বসে রিপোর্ট করা? ফ্যাক্ট চেক করা?

নীলা: আমি তো সেটাই বলছি, আমরা নই। একটা সেন্সর বোর্ড টাইপের। তারা করবে এই কাজগুলো।

নীলাব্জ: আমি বলছি, সেই তো এরা ক্ষমতার দালালিই করবে। এদের দ্বারা হবে না।

নীলা: তুমি অবাস্তব কথা বলছ! তোমার মতে, পুলিশ সরকারি কর্মচারী তাই থানা রেখে কোনও লাভ নেই, তুলে দাও। উকিল, জজ সব দু’নম্বরি, সরকারের দালাল, তাই আদালত বন্ধ করে দাও।

নীলাব্জ: আর একটা পয়েন্ট, মানুষের ফ্রি স্পিচকে আটকানো উচিত নয় বলে আমার মনে হয়। বলতে দাও মানুষকে।

নীলা: কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছ, সবার সেই যোগ্যতাটাই নেই কথা বলার। সবার ফ্রি স্পিচ পাওয়ার যোগ্যতা নেই। ফ্রি ইন্টারনেট আর ফ্রি স্পিচ পেয়ে বাঁদরের মতো আচরণ করছে।

নীলাব্জ: তুমি তো ডেঞ্জারাস কথা বলছ! তুমিও তো আসলে কন্ট্রোল করতে চাইছে। তুমিও ক্ষমতা চাইছ। তোমার মতো করে পৃথিবীটা সাজাতে চাইছ। তুমিও শাসক হতে চাইছ।

নীলা: আমি সুশাসন চাইছি।

নীলাব্জ: খাদ্য নেই, চিকিৎসা নেই, শিক্ষা নেই আর তুমি এসেছ সোশাল মিডিয়াতে সেন্সরশিপ বসাতে?

নীলা: এটা কী লজিক হল? খাদ্য নেই, চিকিৎসা নেই, শিক্ষা নেই বলে কি মানুষ আর কিছু করে না? তুমি এস্কেপিস্ট। তুমি পালিয়ে যেতে চাইছ প্রবলেম দেখে।

নীলাব্জ: আমি এখানেই আছি। বাস্তবে! তোমার মতো আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছি না।

নীলা: ঘোড়ার ডিম। তুমি কোথাও নেই।

নীলাব্জ: মানে?

নীলা: মানে, আমি চললাম। টাটা।

নীলাব্জ: বেশ। তুমি গিয়ে তোমার আইটি সেল তৈরি করো। নীলার নীতিপুলিশ। অল দ্য বেস্ট।

নীলা: ইউ গো টু হেল!

ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী