নীলা-নীলাব্জ : পর্ব ১৪

Illustration by Sayan Chakrabarty

নাসা

নীলা ব্যাঙ্কের কাউন্টারে একটা ফর্ম ভরছিল। আচমকা পিছন থেকে, ‘গুড মর্নিং নীলা! ব্যাঙ্কে?’

নীলা মুখ না তুলেই, ‘কেন আমার কি ব্যাঙ্কে আসা বারণ?’

নীলাব্জ : আরে বারণ কেন হতে যাবে। আসলে আজকাল তো সব অনলাইন হয়ে যায়…

নীলা : হলে তো করেই দিতাম। আসতাম কি?

নীলাব্জ : সে তো বটেই। পেনটা কোথা থেকে পেলে?

নীলা : পেলাম মানে? কিনেছি।

নীলাব্জ : নাসা লেখা পেন কেউ কেনে?

নীলা : কেউ কেনে মানে? কেনে না তো এমনি এমনি বানাচ্ছে?

আরও পড়ুন : সাফল্যের নিক্তি কী? নীতিহীনতা কি জরুরি নয়?
অনুপম রায়ের কলমে পড়ুন ‘নীলা-নীলাব্জ’ পর্ব ১৩…

নীলাব্জ : লেখা ভাল পড়ে? মানে, একটু ধ্যাবড়া না?

নীলা এবার মুখ তোলে, ‘ঝগড়া করবে তো? দাঁড়াও কাজটা শেষ করে নিই, তারপর বসছি।’

নীলাব্জ হাসে, ‘আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।’

ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে নীলা দেখতে পায়, নীলাব্জ একটা কুকুরকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে।

নীলা : এবার বলো, প্রবলেমটা কী তোমার?

নীলাব্জ : আমার? আমার কোথায় প্রবলেম? প্রবলেম তো তোমার। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি?

নীলা : তুমি ব্যাঙ্কে কী করছিলে?

নীলাব্জ : আমার এক বন্ধুর বাবা আসলে কাজ করেন এই শাখায়। ওঁকে একটা ওষুধ দেওয়ার ছিল, তাই দিতে এসেছিলাম।

নীলা : তুমি কি সত্যিই এত পরোপকারী, না কি গুল দিচ্ছ?

নীলাব্জ : তুমি আমাকে কিছুতেই বিশ্বাস করো না। না কি কাউকেই করো না?

নীলা : তোমার আর কিছু বলার আছে? নাহলে বলো, আমি বাস ধরব।

নীলাব্জ : আছে তো বটেই! তোমার কলমটা দেখেই রাগটা হল।

নীলা : কেন? ‘নাসা’ লেখা আছে বলে?

নীলাব্জ : ঠিক।

‘এই যে গোটা মহাকাশ অনুসন্ধান, এই গোটা ব্যাপারটাতেই আমার আপত্তি…’

নীলা : মানে? নাসা আবার কী করল তোমার? ইসরো? ইসরোকেও ঘৃণা করো?

নীলাব্জ : দেশ-বিদেশের ব্যাপার নয়। এই যে গোটা মহাকাশ অনুসন্ধান, এই গোটা ব্যাপারটাতেই আমার আপত্তি।

নীলা : আজব চিড়িয়া তুমি নীলাব্জ! তোমাকে তো প্রগতিশীল বলেই জানতাম। এরকম প্রাচীনপন্থী নাকি তুমি?

নীলাব্জ : এটা প্রগতি বা প্রাচীনপন্থার ব্যাপারই নয়। যে পৃথিবীতে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে, সেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা করে মহাকাশে পাড়ি দেওয়াটা বড্ড চোখে লাগে।

নীলা : এ কী ধরনের বোকা বোকা কথা? সেবাস্টিয়েন বাখ যখন সংগীত তৈরি করেছেন, তখনও তো বহু লোক খেতে না-পেয়ে মারা গেছে। তাহলে কি ওঁর সংগীত সৃষ্টি করা উচিত হয়নি?

নীলাব্জ : এই তুলনাটা ঠিক হল না। উনি অত খরচ করছেন না। পাবলিক মানি এভাবে ধ্বংস হচ্ছে না।

নীলা : পাবলিক মানি তো এমনিই ঘাপলা করে মেরে দিচ্ছে নেতারা, তার চেয়ে মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করা ভাল না?

নীলাব্জ : অল্প টাকার ব্যাপার তো নয় এটা, অনেক খরচ…

এগিয়ে যাওয়া কাকে বলে নীলা? যে পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে মরছে, চিকিৎসা না পেয়ে মরছে, প্রকৃতি শুকিয়ে যাচ্ছে, এই পৃথিবীর কাছে আমাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই? কী রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মর জন্য? পাঁচটা রকেট? তিনটে স্যটেলাইট?

নীলা : মহাকাশে যেতে তো খরচ হবেই। পাবলিক বাস নাকি? আর মানুষের বেসিক স্বভাব এই কৌতূহল। কৌতূহল ছাড়া মানুষ কী? প্রথম দিন থেকে আমরা জানতে চেয়েছি, এটা কী, ওটা কেন? করতে করতে আজকে এই জায়গায় পৌঁছেছি। এখন যখন মানুষ এতটা এগোতে পেরেছে, তুমি এসে বলছ, না, অনেক হয়েছে, আর দরকার নেই? তুমি কি মরে গেছ নাকি?

নীলাব্জ : আমি বলছি মানুষের নৈতিক চেতনা দরকার। একটা তো নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।

নীলা : স্পেস রিসার্চ করলে নৈতিক দায়িত্ব থাকে না? স্যাটেলাইট আবিষ্কার করে মানুষের উপকার হয়েছে, না ক্ষতি?

নীলাব্জ : স্পেস রিসার্চ না হাতি! ওসব আসলে ডিফেন্সের প্রোজেক্ট ছিল। অনেক পরে সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। তোমার, আমার জন্য প্রথমে কিছুই বানানো হয় না। যে এয়ারপোর্টগুলো আমরা ব্যবহার করি, সব আসলে আর্মির জন্য তৈরি হয়। পরে পাবলিকও ব্যবহার…

নীলা : তোমার তর্কের বিষয়টা কী? ডিফেন্স বনাম পাবলিক না কি স্পেস রিসার্চ বনাম পাবলিক?

নীলাব্জ : দুটোই কাছাকাছি। কীভাবে মিলেমিশে আছে, আমরা কেউ-ই ধরতে পারব না। তবে, আজকের জন্য স্পেস রিসার্চ! হ্যাপি?

নীলা : বেশ, তাহলে বলো, অজানার প্রতি তোমার কোনও আকর্ষণ নেই? এই মহাবিশ্বের কোথায়, কী লুকিয়ে রয়েছে সেগুলো জানার? সেই প্রস্তর যুগ থেকে মধ্যযুগ হয়ে এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে চাও? এগোবে না?

নীলাব্জ : এগিয়ে যাওয়া কাকে বলে নীলা? যে পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে মরছে, চিকিৎসা না পেয়ে মরছে, প্রকৃতি শুকিয়ে যাচ্ছে, এই পৃথিবীর কাছে আমাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই? কী রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মর জন্য? পাঁচটা রকেট? তিনটে স্যটেলাইট?

নীলা : পাগল হয়ে গেছ তুমি। যতদিন না পৃথিবী থেকে গরিবি যাবে, ততদিন মহাকাশে রকেট পাঠানো যাবে না? এই তোমার বক্তব্য? তাহলে তো কিছুই করা যাবে না। সিনেমা, নাটক, খেলা সব বন্ধ করে মানুষ শুধু দারিদ্র দূর করা নিয়ে মেতে থাকতে হবে! পারবে তুমি? আর বিনোদন তো ছেড়েই দিলাম, মহাকাশ নিয়ে গবেষণা তো একটা বিশাল…

নীলাব্জ : প্রায়রিটি নীলা! প্রায়রিটি! আমাদের কোনটা প্রায়রিটি হওয়া উচিত? স্বাস্থ্যের দিকে নজর আছে কোনও রাষ্ট্রনেতার? অথবা শিক্ষার? অথবা ক্লাইমেট চেঞ্জ? থানায় দুটো এক্সট্রা পুলিশ নিতে পারে না, শিক্ষককে ডিএ দিতে পারে না, কিন্তু মহাকাশে মানুষ?

নীলা : আরে বাবা এর সঙ্গে স্পেস রিসার্চের বিরোধটা কোথায়? হাসপাতালও হবে, স্কুলও হবে, ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে গবেষণাও হবে, তার সঙ্গে চন্দ্রায়নও হবে।

নীলাব্জ : হবে না। মাথায় রেখো, সরকারের কাছে অফুরন্ত ফান্ড নেই। কিছুর একটা বাজেট না কমিয়ে স্পেস রিসার্চের বাজেট বাড়ানো সম্ভব নয়। মহাকাশ গবেষণা দপ্তরের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর হওয়া উচিত স্বাস্থ্য বা শিক্ষা। কিন্তু পাবলিক নিয়ে তো বিশ্বের কোনও সরকারের মাথা ব্যথা নেই। আমরা শুধু ভোট মেশিন। তোমার কি মনে হয়, মহাকাশ গবেষণা পাবলিকের কথা ভেবে হচ্ছে?

নীলা : বিজ্ঞানীরা মাইনে পাচ্ছে না? পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে বেস্ট ব্রেনগুলো নাসাতে গিয়ে মাইনে ছাড়া চাকরি করছে? ইসরো-তে লোকজন কি ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছে? এই বৈজ্ঞানিক বা ল্যাবের কর্মচারী বা এই গোটা ইকোসিস্টেমটা কি পাবলিক দিয়ে তৈরি নয়?

নীলাব্জ : আমি তা বলছি না। আমি বলছি, উদ্দেশ্য।

নীলা : নিকুচি করেছে তোমার উদ্দেশ্য। কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ওভাবে হয় না। মানে, হতেই পারে, আমি চাইছিলাম ‘ক’ আবিষ্কার করতে চাইছিলাম, কিন্তু হয়ে গেল ‘খ’! কিন্তু ইচ্ছেটা তো থাকতে হবে রে বাবা! হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো কিছুই হবে না।

নীলাব্জ : এদিকে আমাদের পরিবেশ যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেই গবেষণাতে ফান্ড কে দিচ্ছে?

নীলা : দেবে নিশ্চয়।

নীলাব্জ : কিছু দেবে না। আমাদের এই পৃথিবী যদি সত্যিই বাসের অযোগ্য হয়ে যায়, তাহলে কর্পোরেটরা আর ধনীরা রকেট চেপে পালিয়ে যাবে মহাকাশে। ওদের সব ব্যবস্থা করা থাকছে। ওদের জন্যই আমাদের ট্যাক্সের টাকায় স্পেস রিসার্চ হচ্ছে। আমাদের জন্য নয়। তুমি, আমি পড়ে থাকব এই নর্দমাতে। বুঝতে পারছ না তুমি? ফেলে দাও তোমার ওই নাসার পেনটা!

নীলা : এরকম নয় ব্যাপারটা।

নীলাব্জ : তাহলে কীরকম?

নীলা : মহাকাশ নিয়ে গবেষণা কিন্তু আমাদের এই সভ্যতাকে আরও কাছে টানছে। ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ভুলে প্রতিটা দেশ আরও ‘কাছাকাছি’ আসছে।

নীলাব্জ : কাছাকাছি? দেশে দেশে টেনশন আরও বেড়ে যাচ্ছে!

নীলা : না, গোটা বিশ্বের একটা সর্বজনীন লক্ষ্য আছে। এক দেশ, অন্য দেশের সহযোগিতা করছে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে। একটা আন্তর্জাতিক কোলাবরেশন হচ্ছে। বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে ভীষণ দরকারি তা। আর একটা আবিষ্কার মানে তো শুধু কোনও একটা দেশের কাছে সেই তথ্য থাকবে, তা তো নয়। সেই তথ্য তো দুনিয়ার সবার জন্য।

নীলাব্জ : তুমি বাচ্চাদের মতো কথা বলছ নীলা। দেখতে পাচ্ছ না ভূরাজনৈতিক টেনশন শুধু বাড়ছে? আজকে আমেরিকা রকেট পাঠালে, কাল রাশিয়া পাঠায়। তাকে টক্কর দিতে চীন! তার পিছন পিছন ভারত। দেখতে পাচ্ছ না এগুলো? মহাকাশ দখল করবে পুঁজিবাদীরা। তোমাকে, আমাকে দেবে ইন্সটাগ্রামের রিল। বড়জোর দুটো ভ্যাক্সিন। ফেলে দাও পেনটা।

নীলা : না, ফেলব না। তুমি চারদিকে শুধু চক্রান্ত খুঁজে বেড়াও। আমি চন্দ্রযান-৪ কিংবা আর্টেমিসের অপেক্ষাতে থাকি।

নীলাব্জ আর কথা বাড়ায় না। ম্লান একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে এগিয়ে যায়।

অলংকরণ : সায়ন চক্রবর্তী