‘উপন্যাস লেখেন নাকি…’
সেই দিনটার কথা আজও খুব স্পষ্ট মনে পড়ে। দিন বলতে অবশ্য সন্ধেই। বেশ দেরি-সন্ধে যাকে বলে। সাড়ে ন’টা বেজে গেছে, অনেকের জন্য সেটা দস্তুরমতো রাতই। ঘোর বর্ষা, জুলাইয়ের মাঝামাঝিই হবে সম্ভবত। আমি তখন চাকরি করি একটি পাক্ষিক বাংলা পত্রিকায়, ভারতজোড়া খ্যাতির পর যারা কলকাতায় নিজেদের দপ্তর খুলেছে, বাংলা ভাষায় নিজেদের পায়ের ছাপ রাখবে ভেবে। এখানে বলে নেওয়া ভাল, সে-ই আমার প্রথম চাকরি। সবে-সবে হাতে লেখা ছেড়ে কম্পিউটারে টাইপ করা শিখছি, ৫০০ শব্দের একখানা কপি নির্ভুলভাবে লিখতে ঘণ্টাখানেক লেগে যাচ্ছে। তাই কাজ সেরে বাড়ির দিকে রওনা দিতে রোজই দেরি হচ্ছে ভালরকম। সেদিনও দেরিই হয়েছে বেশ।
সকাল থেকেই টিপটিপ পড়ছিল, বিকেলের দিকে সেটা গিয়ে দাঁড়াল ঝমঝমে, সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের ঝলকানি আর বাজের কড়কানি। বুঝলাম, বাড়ি ফিরতে বেগ পেতে হবে ভালরকম। আমাদের আপিসটা ছিল রবীন্দ্র সদন আর বিড়লা তারামণ্ডলের মাঝামাঝি, থিয়েটার রোডের মুখ ঘেঁষে। জমজমাট জায়গা, তাতে সন্দেহ নেই। আপিসে আটকা পড়লে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়েই অনেকখানি সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। কাজ শেষ করে দিচ্ছিলামও তাই, কিন্তু যখন দেখলাম, প্রায় ন’টা বাজতে চলেছে, অথচ বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণই নেই, তখন আস্তে আস্তে পাততাড়ি গোটাতে হল। সহকর্মীরা একটু আগেভাগেই বেরিয়ে গেছে, সম্ভবত বিপদ বুঝেই। নিরাপত্তারক্ষী ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন, আমি বেরলে আলো নিভিয়ে তালা ঝুলিয়ে বিদায় নেবেন তিনিও। তাঁকে স্বস্তির নিশ্বাস উপহার দিয়ে আমিও বেরলাম অগত্যা।
এমনিতে ফেরার ঝামেলা বিশেষ নেই, থিয়েটার রোডের মুখ থেকে মেট্রো নিয়ে সোজা টালিগঞ্জ, তারপর এক-অটোতে সেখান থেকে গড়িয়া। তখন আমরা গড়িয়াতেই থাকি, বহুকালের বাস সেখানে। মেট্রোয় চড়া ইস্তক যদিও এক মহা-আতঙ্ক পেয়ে বসল আমায়, আর তা হল, টালিগঞ্জ টু গড়িয়া অটো পাওয়া। সে-সময়ে এসব দিকে অটোরাজ চলছে, যাকে বলে। একদিকে গড়িয়া টু গোলপার্ক, অন্যদিকে গড়িয়া টু টালিগঞ্জ। বাস প্রচুর চলে, কিন্তু ফিরতি পথের দেদার ভিড়ে সেসব বাসে জায়গা পাওয়ার আশা বা সুযোগ, কোনওটাই থাকে না। তাছাড়া বৃষ্টির দিন হলে তো কথাই নেই। অতএব, টালিগঞ্জে নেমে বাড়ি ফেরার একমাত্র উপায় ওই অটো।
এখন মুশকিল হচ্ছে, সেই অটো পাওয়ার জন্য যে-লাইনখানা হয়, তেমন লাইন শীতের দুপুরে চিড়িয়াখানার সামনে বা শাহরুখের নতুন ছবি রিলিজের পর হল-এর সামনেও দেখা যায় না। আর বৃষ্টির সময়ে অটো পেতেও বহু দেরি হয়। যদি-বা পাওয়া গেল, তাহলে অটোচালকদের অনেকরকম মর্জি থাকে। ঘুরে যেতে হলে পাঁচ টাকা বেশি, পুরোটা না-গিয়ে অর্ধেক পথে নামিয়ে দেওয়া ইত্যাদি অনেকরকমের ব্যাপার ছিল। যাত্রীদেরও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই বৃষ্টির সন্ধেয় অটোর লাইনে ঠায় দাঁড়ানো আর তারপর ঠিকঠাক অটো পেয়ে গন্তব্যে পৌঁছনোর মধ্যে একটা লটারি জেতার মতো ব্যাপার ছিল।
মেট্রো থেকে যখন টালিগঞ্জে নামছি, তখন আরেক দফা হুড়মুড়িয়ে নামল আকাশ ভেঙে। বুঝলাম, আজ কপালে প্রভূত দুঃখ অপেক্ষা করে আছে। এই মুষলধার বৃষ্টিতে কতক্ষণ যে লাইনে দাঁড়াতে হবে, কেউ জানে না, অটো পাওয়া তো অনেক পরের কথা। এত কিছু ভেবেও নিরুপায় মানুষ সেটাই করে, অগত্যা আমিও অটোর লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে লাইনের শুরুটা দেখা পর্যন্ত যাচ্ছে না। যাত্রীদেরও মনমেজাজ বিগড়ে আছে, এর ছাতার জল ওর গায়ে লাগলে ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে, বহু মানুষ ভিজছেনও বটে। আর এসবের মধ্যে মিনিটদশেক অন্তর দেবদূতের মতো একটা ক’রে অটো আসছে, নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী যাত্রী বেছে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাতে লাইন জুড়ে ক্ষোভ উপচে পড়ছে। কিন্তু ওই অবধিই। সকলেই জানে, ব্যর্থ আক্রোশ নিয়ে তুমুল বৃষ্টি ভিজে সেই অটোচালকের দাক্ষিণ্যের জন্যই প্রতীক্ষায় থাকতে হবে। তাই শত চেঁচামেচির পরও আবার যখন একখানা অটো ঝাপসা বৃষ্টির পর্দা ঠেলে আবির্ভুত হচ্ছে, তখন সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। যতদূর এইভাবে যাওয়া যায় আর কী!
আমি বরাবরই গোবেচারা ধরনের, বড়সড় প্রতিযোগিতা দেখলে এমনিই নিজেকে আড়াল করে নিই। এখানেও তাই হল। বুঝলাম, যথারীতি, এই কম্পিটিশনের বাজারে অটো পাওয়া আমার হবে না। এদিকে পাশ দিয়ে একের পর এক বাদুড়ঝোলা বাস জল ছিটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেখানেও যে নিজের রোগাসোগা চেহারাটা সেঁধিয়ে দেব, সে-সাহস আমার নেই।
এইভাবে দাঁড়িয়ে যে কতক্ষণ গেছে, তার ঠিক হিসেব নেই। এটুকু বুঝতে পারছি, শম্বুকগতিতে এগতে এগতে এখন লাইনের গোড়াটা দেখতে পাচ্ছি। বৃষ্টি নাগাড়ে পড়েই চলেছে, তার বিরাম নেই। এক অটো থেকে অন্য অটোর সময়ের ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
এমন সময়ে এক তরুণ অটোচালক, আবারও, সেই দেবদূতের মতোই, ‘রানিকুঠি, রানিকুঠি’ হাঁকতে হাঁকতে এলেন। বেশ ধীর গতিতে আমার পাশ দিয়ে অটো নিয়ে যাচ্ছেন যখন, আমি একবার ভাগ্যকে ট্রাই করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গড়িয়া যাবেন?’
উত্তরে আমাকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। বুঝলাম, কপালে সিধে যাত্রা তো নেই-ই, আরও অনেক অপেক্ষা লেখা আছে। কী আর করা!
হাল ছেড়ে দিয়ে সেই অপেক্ষাই করছি, ততক্ষণে ছাতার এপাশ-ওপাশ থেকে বৃষ্টির ছাঁট আমাকে অর্ধেকেরও বেশি ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। এমন সময়ে, হঠাৎ, সেই তরুণ অটোচালক ঘুরে আবার আমার পাশে তাঁর দেবযান নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। তখনও তাঁর গাড়িতে কোনও সওয়ারি নেই।
‘উঠে আসুন।’
ওই একক অটোমেশন দেখে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি লোকজন আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন যে, সেটা বিলক্ষণ টের পেলাম। তাঁদের মনে যে-প্রশ্ন, সে-প্রশ্ন আমারও। খামকা একচক্কর ঘুরে এসে কেবল আমাকে তুলে নিয়ে রওনা দিলেন কেন এই চালক যুবক? আমিও আচ্ছা বেকুব, কিছু জিজ্ঞেস না-করেই হাতে চাঁদ পাওয়ার ভঙ্গিতে সটান উঠে বসেছি। ততক্ষণে কিডন্যাপের দুর্ভাবনাও একবার মাথায় খেলে গেছে, নেহাত হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে কিডন্যাপ করার প্ল্যান কারও পক্ষে নেহাতই অলীক বলে আর পাত্তা দিইনি। কিন্তু প্রশ্নটা মনে খচখচ করেই চলেছে। মতলবটা কী?
অনুরোধ আর হুকুমের মাঝামাঝি একখানা স্বরে কথাটা বললেন তিনি। আমিও আগুপিছু না-ভেবে ছাতা বন্ধ করে পিছনের সিটে উঠে পড়লাম। এসব ক্ষেত্রে কথা বাড়ানো মানেই সুযোগ হারানো। একটানা গড়িয়া যাওয়া যখন স্বপ্নের মতোই, তখন রানিকুঠি অবধিই চলে যাওয়া যাক নাহয়, তারপর আবার যুদ্ধে নামা যাবে।
উঠে তো পড়লাম, কিন্তু সেই তরুণ অটোচালক আর কোনও সওয়ারি না-নিয়েই সাঁ ক’রে টালিগঞ্জ পেরিয়ে ছুট দিলেন আমাকে নিয়ে।
ওই একক অটোমেশন দেখে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি লোকজন আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন যে, সেটা বিলক্ষণ টের পেলাম। তাঁদের মনে যে-প্রশ্ন, সে-প্রশ্ন আমারও। খামকা একচক্কর ঘুরে এসে কেবল আমাকে তুলে নিয়ে রওনা দিলেন কেন এই চালক যুবক? আমিও আচ্ছা বেকুব, কিছু জিজ্ঞেস না-করেই হাতে চাঁদ পাওয়ার ভঙ্গিতে সটান উঠে বসেছি। ততক্ষণে কিডন্যাপের দুর্ভাবনাও একবার মাথায় খেলে গেছে, নেহাত হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে কিডন্যাপ করার প্ল্যান কারও পক্ষে নেহাতই অলীক বলে আর পাত্তা দিইনি। কিন্তু প্রশ্নটা মনে খচখচ করেই চলেছে। মতলবটা কী?
নেতাজিনগর পেরচ্ছে অটো। আরও চারজনের জায়গা খালি দেখে অনেক অপেক্ষারত নাগরিক এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেও যুবক নির্বিকার। যেন আমাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই আজ এই বৃষ্টির রাতে তাঁর অবতারণা। চুপচাপ বসে ভাবছি, ব্যাপারখানা খুব সিনেম্যাটিকও বটে, এমন সময় তিনি একবার পিছনদিকে হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘উপন্যাস লেখেন নাকি দাদা?’
শুনেছি স্পষ্টই, কিন্তু প্রশ্নটা ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। লেখালিখি আমি করি ঠিকই, বেশ কিছু কবিতার বই বেরিয়ে গেছে তখন, খবরের কাগজেও মাঝেমধ্যে টুকিটাকি লিখি, কিন্তু উপন্যাস লিখে ওঠা হয়নি। কোনওদিন হবে যে, এমন ধারণাও সে-রাতে আমার মাথায় ছিল না। ইনি আমার সঙ্গে অন্য কারওকে গুলিয়ে ফেলেননি তো?
চুপ করে থাকাটা অভদ্রতা, বিশেষত তাঁরই দু’হাতে যখন আমার ভাগ্যের চাকা, তাই বললাম, ‘উপন্যাস? কই না তো? সেরকম কিছু লিখিনি।’
শুনেই বললেন, ‘তাহলে লিখুন, লিখুন। উপন্যাস পড়তে আমার হেবি লাগে। টাইম পাই না বেশি, কিন্তু পাড়ার লাইব্রেরি থেকে তুলে এনে রেগুলার পড়ি।’
শুনে ভাল লাগল, এই খাটুনির কাজের মধ্যেও পড়ার অভ্যেস ছাড়েননি। কিন্তু আমাকে কথাগুলো বলা হচ্ছে কেন?
আবার বললেন, ‘আপনার লেখা তো পড়ি কাগজে। মাঝে মাঝে টিভিতে আসেন তো? সেটাও দেখি। আপনি শ্রীজাত তো?’
এই প্রশ্ন আমাকে সত্যিই হতবাক করে দিল। আমাকে অন্য কেউ ভেবে তুলে আনলে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হতাম ঠিকই, কিন্তু ইনি ওই ঝমঝম বৃষ্টিতে চূড়ান্ত চাহিদার ভরা বাজারে আমাকে ‘আমি’ হিসেবে চিনতে পেরেই এক চক্কর গাড়ি ঘুরিয়ে এনে তুলে নিয়ে আসছেন, এ-জিনিস আমাকে কল্পনাতীত মাত্রায় বিস্মিত করল।
একটা ঢোক গিলে বললাম, ‘আপনি চেনেন আমাকে?’
বোকার মতো প্রশ্ন, তাও, নিজের অবিশ্বাসকে ঝালিয়ে নিতে কে না চায়।
‘চিনব না? এই পরশুই তো টিভিতে দেখলাম কথা বলছেন। লাস্ট রোববার কাগজে লেখা, সেটাও পড়েছি। ওইসব ছোট লেখায় মন ভরে না, বুঝলেন? উপন্যাস লিখুন।’
এর কোনও উত্তর হয় না। আমি চুপ। অলীক এক অপেক্ষার রাত আমাকে বৃষ্টির পর্দার ওপার থেকে সত্যিই এক দেবদূত পাঠিয়েছে। এরকম পড়ে-পাওয়া-পাঠকের চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে? আমার অন্তত জানা নেই।
‘দেখলাম, বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছেন, অটোর যা সিন, ফালতু হয়রানি হয়ে যাবে। তাই তুলে নিলাম। আপনারা গুণী মানুষ, এটুকু করব না?’
বাকি রাস্তাটুকু আমি আর কথা বলতে পারিনি। চাইওনি। কেবল কৃতজ্ঞতা আর বিস্ময়বোধে আমার মন, মাথা— দুই-ই নত হয়ে গেছিল। নামার সময়ে ভাড়া দিতে চাইলাম, কিছুতেই নিলেন না। নাম জানতে চাইলাম, তার উত্তরে বললেন, ‘আমাদের নামধাম কে মনে রাখে দাদা? জেনে লাভ নেই। আপনি উপন্যাস লিখলে পড়ব, ব্যস।’
বলে অটো ঘুরিয়ে রাস্তার দু’ধারে জলের কুচো স্রোত বইয়ে দিয়ে মিলিয়ে গেলেন আবার, বৃষ্টির সেই পর্দার ওপারেই।
তার বহু বছর পর যখন প্রথমবার উপন্যাস ছাপা হয় আমার, মনে পড়েছিল সেই যুবকের কথা। পাঠকের নাম হয়। দেবদূতের হয় কি? জানা নেই আমার।