দুবাইয়ের রেকর্ড ম্যানিয়া
আমার এক পাড়াতুতো প্রাজ্ঞ মেসোমশাই একটা দামি কথা বলেছিলেন। দুবাই সম্পর্কে না অবশ্য, পাড়ার নাড়ুদার সম্পর্কে। নাড়ুদার অভ্যেস ছিল সবকিছু বাড়িয়ে বলা। যা খাবে, যা দেখবে, যা শুনবে, সবটাই নাকি সেরা। সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে সুন্দর— এসব ছিল তার মুখের লব্জ। অথচ বেশিরভাগ সময়েই দেখা যেত, নাড়ুদার বলা ব্যাপারস্যাপারগুলো আসলে সাধারণ, বড়জোর সাধারণের থেকে একটু এগিয়ে। একবার যখন নাড়ুদা চায়ের ঠেকে এরকম কোনও গল্প ফেঁদেছে, মেসোমশাই মন্তব্য করলেন, ‘এরে কয় সুপারলেটিভ সিনড্রোম।’ নাড়ুদা কী বুঝল, কে জানে! রাগ করে উঠে চলে গেল।
জগৎবিখ্যাত বুর্জ খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, মেসোমশাই দুবাই এলে কি ফাটা রেকর্ডের মতো বলেই চলতেন, গোটা দেশটারই সুপারলেটিভ সিনড্রোম? এই বুর্জ খলিফা দুবাইয়ের আইকন, অভিনব স্থাপত্যের কারণেই বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়। ওয়ার্ল্ড’স টলেস্ট বিল্ডিং শিরোপাটা সম্ভবত এখনও ধরে রেখেছে। শুনলাম, এর লিফটগুলোও নাকি রেকর্ড স্পিডে চলে। ১২৪ তলার অবজারভেশন ডেকে পৌঁছতে সময় নেয় মাত্র একমিনিট। সেকেন্ডে দশ মিটার স্পিড। বিশ্বের দ্রুততম এলিভেটর হওয়ার রেকর্ড এদেরই দখলে। আরও অনেক অনেক রেকর্ড আছে বুর্জ খলিফার আস্তিনে, সবচেয়ে উঁচু রেস্তরাঁ আর ভিউয়িং প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি ইত্যাদি। অত মনে রাখা নাড়ুদা ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
বুর্জ খলিফা প্রথম একঝলক দেখেছিলাম ২০১৫ সালে, হোটেলের জানালা থেকে। সেবার হিউস্টন যাওয়ার পথে একরাত দুবাইতে লে ওভার থাকলেও এয়ারলাইন্সের বাসে হোটেল আর পরদিন সকালে ফের এয়ারপোর্ট ছাড়া আর কোথাও বেরনোর সময় বা সুযোগ ছিল না। তাই জানালার কাচের ওপারে রাতের শহর আর আলো-ঝলমলে বুর্জ খলিফা দেখেই সন্তুষ্ট ছিলাম। এবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে দেখলাম, মুহূর্তে-মুহূর্তে বদলে যাওয়া আলোর খেলায় শাহরুখ খানের ছবিও আসছে ঘুরেফিরে। অথচ, ২০২২ সালে শাহরুখের সেরকম বড় ফিল্ম রিলিজ ছিল না। তবু এই সৌদিদের শাহরুখ অবসেশন এমন যে, যত্রতত্র নায়কের নাম, ছবি দেখবেন। অবাক হলাম জেনে যে, বুর্জ খলিফার কিছু তলায় বসবাসের ফ্ল্যাটও আছে। সেই মহার্ঘ মাথা গোঁজার ঠাঁই কারা কেনেন? মুখ ফুটে প্রশ্ন করার আগেই সর্বজ্ঞ ড্রাইভার সাহেব একটু রহস্যের সুরে বললেন, ‘আপনাদের দেশের এক ব্যবসায়ীর বুর্জ খলিফায় বাইশটা ফ্ল্যাট আছে, জানেন?’
বালির ওপর বাড়ি থেকে জলের তলায় রেস্তরাঁ, পদে পদে চমকে দেয় দুবাই! পড়ুন ডেটলাইন পর্ব ৩১…

আমি তো ভিরমি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম! ততক্ষণে মনের ভেতর হাতড়ানো শুরু হয়ে গেছে। আদানি, আম্বানি-কার? জানা গেল, সেই বিস্ময় মানবটির নাম জর্জ ভি নিরিয়ামপরাম্বিল। আদতে কেরলের বাসিন্দা জর্জ জিইও গ্রুপের মালিক। এখন অবশ্য বুর্জের ভেতর থাকেন। তাঁর বাসস্থান নাকি সোনায় মোড়া। লোকে তাঁকে বলে, ‘কিং অফ বুর্জ খলিফা’। দেশোয়ালি ভাইয়ের জন্য গর্ব অনুভব করব কি না, ভাবতে ভাবতেই শুরু হয়ে গেল আলোর নাচন। নাকি জলের নাচন? বুর্জের সামনেই দুবাই মলের ডান্সিং ফাউন্টেন। যাঁরা টিকিট কেটে বুর্জে ঢুকতে না চান, তাঁরা দিব্যি এখানে দাঁড়িয়ে বুর্জ আর ফোয়ারা দুই উপভোগ করতে পারেন।
কী মুশকিল বলুন তো! দুবাইয়ের কোনও দ্রষ্টব্য সম্পর্কে লিখতে গেলেই আগে বলতে হবে তার রেকর্ড। দুবাই ফাউন্টেন সত্যি অপূর্ব, বিশ্বের উচ্চতম ফোয়ারা, পঞ্চাশ তলা বাড়ির সমান জল ওঠে। আর কী অসাধারণ কোরিওগ্রাফি! রঙিন ফোয়ারার নৃত্য বহু শহরেই দেখা যায়, কিন্তু দুবাই সেরাদের মধ্যে জায়গা পাবে অবশ্যই। দৃশ্য আর শ্রাব্যের এমন যুগলবন্দি ভাবা যায় না। গানের নির্বাচন কী চমৎকার! ধ্রুপদী থেকে আজকের হিট নাম্বার, হলিউড থেকে আরবি, কী নেই। যে-কোনও বয়সের মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনবে। আর সেই গানের তালে যে ছন্দ জলের শরীরে, জীবন্ত নৃত্যশিল্পীর থেকে কিছু কম নয়। মনে হবে, ইউরোপের কোনও শহরে আধঘণ্টার অপেরা দেখলেন। প্লে-লিস্টে একদিকে যেমন আছে ‘টাইম টু সে গুড বাই’ বা ‘আই উইল অলওয়েজ লাভ ইউ’-র মতো কালজয়ী গান, তেমনই আছে আরব দুনিয়ায় জনপ্রিয় ‘ইয়া আনা ইয়া লা’, ‘সামা দুবাই’। রাত আটটা নাগাদ যখন পৌঁছলাম দুবাই মলে, তখনও ফাউন্টেন শো শুরু হতে আধঘণ্টা বাকি আছে।

সপ্তাহের দিনগুলোতে একরকম আর সপ্তাহান্তে আরেকরকম শিডিউল। আমরা মলের ভেতর স্যুভেনির শপে গিয়ে দু-চারটে জিনিস কিনতে না কিনতে তাড়া লাগালেন ড্রাইভার কাম গাইড। লেকের ধারে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। অনেক আগে থেকেই সবাই ভাল জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। বারানসির ঘাটে সন্ধ্যারতি দেখার মতো আর কী! দেরিতে গেলেন তো পেছনে ঠাঁই হবে। পা উঁচু করে দেখতে হবে। আমরা কলকাতার বাঙালি, পুজোর গড়িয়াহাট, ঈদের নিউ মার্কেটে ভিড় সাঁতরাতে অভ্যস্ত। ঠিক ঠেলেঠুলে একচিলতে জায়গা বের করে দাঁড়ালাম। সামনের বিশাল লেকটা কৃত্রিম, সেখানে নৌকোয় ঘুরছে অনেকে। যখন শুরু হল ফোয়ারার ম্যাজিক, চারপাশে উল্লাসের ঢেউ। আকাশছোঁয়া জলের কেরামতি দেখে ঘন ঘন ওয়াও ধ্বনিতে ভরে উঠেছে বাতাস। আর সেই আলোর নাচনের প্রেক্ষাপটে রাজকীয় বুর্জ খলিফা রূপকথার আমেজ এনে দেয়।
আমি বলব, এরপর যদি কেউ ঠিক করেন, বুর্জ খলিফার ভেতর ঢুকবেন না, তাহলে মস্ত কিছু মিস হবে না। বাইরে থেকে এত অসামান্য যে স্থাপত্য, তার ভেতরে লিফটে করে অনেক উঁচুতে উঠে দুবাই শহরের প্যানোরামিক ভিউ দেখা নিঃসন্দেহে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, কিন্তু অপরিহার্য নয়। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। পকেট ভারী থাকলে বিশ্বের উচ্চতম রেস্তরাঁয় বসে ফাইন ডাইনিং হয়তো না ভোলার মতো স্মৃতি হলেও হতে পারে। বরং ফেরার পথে যেটা একেবারে মিস করবেন না, সেটা হল দুবাই অ্যাকোয়ারিয়াম অ্যান্ড আন্ডারওয়াটার জু। প্রথমে আমরা উকিঝুঁকি মেরে দেখছিলাম, গেটের ভেতরে স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপাশে বিরাট বিরাট রঙিন মাছেদের খেলা। কিন্তু সেটা ট্রেলারও নয়, বুঝলাম ভেতরে ঢুকে। মাছ, কচ্ছপ, কুমির, হাঙর, অক্টোপাস তো বটেই, আরও কত যে নাম না-জানা জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদ। তিনটে জোন আছে এই অ্যাকোয়ারিয়ামে— রেন ফরেস্ট, রকি শোর, ওশেন। অ্যাকোয়ারিয়ামের থেকে আন্ডারওয়াটার জু নামটা আমার বেশি পছন্দ হল। যেখানে তিনশোর বেশি প্রজাতির তেত্রিশহাজার প্রাণী আছে, চারশোর বেশি হাঙর আছে, একটা আস্ত শার্ক টানেল আছে, ২৭০ ডিগ্রি ঘুরপাক খেয়ে যেখানে মনে হয় আপনার চারপাশে, এমনকী, মাথার ওপরেও শুধু হাঙরের হাঁ, সেটাকে অ্যাকোয়ারিয়াম বললে কেমন জানি খেলো হয়ে যায় ব্যাপারটা। হ্যাঁ, মাথার ওপরেও সমুদ্র, কারণ পুরোটাই কাচে (ফাইবার গ্লাস নিশ্চয়ই) মোড়া। শুনলাম, এর ভেতরে নাকি পেঙ্গুইনদের সঙ্গে মোলাকাত করার একটা জোন রয়েছে। কিন্তু অতটা আর সম্ভব হল না।

একে তো রাত বাড়ছিল, তার ওপর ওই যে কোনকালে শুনে নিয়েছিলাম এক থাই সুন্দরীর ‘ভবাপাগলা’-সদৃশ বাণী ‘নো মানি নো হানি’! পদে পদে সেটা টের পাই চলার পথে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। রমজান মাস চলছে বলে একটা দারুণ খাবার খেলাম দুবাই মলের এক রেস্তরাঁয়— উজি। মাংস মেশানো ভাত, ওপরে কাজু, কিসমিস ছড়ানো। এরকম বর্ণনায় অবশ্য উজির মাহাত্ম্য কিছুই বোঝানো যায় না। স্পেশ্যাল মশলার সুগন্ধে খাওয়ার আগেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং হয়ে যাবে। আর মাংস তিন-চাররকম মেশানো। মল থেকে বেরিয়ে উবেরের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে মনে হল, আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এত রাতেও মাটি থেকে আগুনের হল্কা উঠছে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ বটে আমরা, কিন্তু এরকম দমবন্ধ করা গরমে অভ্যন্ত নই। এসি মলের ভেতর বুঝতে পারিনি, আর লেকের ধারে ড্যান্সিং ফাউন্টেনের জলের ছাঁটে, দমকা হাওয়ায় বেশ আরামই লাগছিল। হোটেলে ফিরে অনেকক্ষণ ধরে ঠান্ডা জলে স্নান করে স্বস্তি পেলাম।
আমার মতো ভীতু যাঁরা রাজস্থানের জয়সলমিরে ডেজার্ট সাফারি নামক অ্যাডভেঞ্চারের ফাঁদে কখনও পা দিয়েছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁরা দুবাইয়ের মরুভূমিতে আর সে ভুল করবেন না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে হাত-পা ভেঙে (ঘাড়ও মটকে যেতে পারে বলে আমার ধারণা), মাথা ঘুরে, রবীন্দ্রনাথের অসম মেলে চড়ার বর্ণনার মতো ‘দেহের রস রক্ত যদি হত দই, তাহলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্রাণটা তার থেকে মাখন হয়ে ছেড়ে বেরিয়ে আসত’ জাতীয় অভিজ্ঞতা খামকা কেন যে পয়সা খরচ করে নেয় মানুষ, কে জানে! জিপ আর উট, এই ডেডলি কম্বিনেশনকেও আমি সারাজীবন এড়িয়ে চলব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। আরেকটা বিপজ্জনক বস্তু হল স্যান্ড ডিউনস, বালির খাদ বলা যায়, যার ভেতর মোটামুটি নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে নেমে যায় জিপ, আবার উঠে আসে এবং জিপের আরোহীরা উল্টেপাল্টে ভয়ংকর চিৎকার করতে থাকে। তাও হাজার হাজার টাকা খরচ করে এই ‘থ্রিল’ নিতেই হবে। যতই আপনারা হাসুন ‘সোনার কেল্লা’-য় জটায়ুর উটে চড়ার ভঙ্গি দেখে, আমি এতটুকু হাসি না।

আমার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা হাল্কা টাল খেল সহকর্মীদের চাপাচাপিতে। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কী হবে শুধু শুধু ডেজার্ট সাফারিতে পয়সা নষ্ট করে, এরপর আমেরিকায় গিয়ে শপিং করতে হবে তো, এসব বলে। কিন্তু ভবি ভোলার নয়। অগত্যা পালের ভেড়া হয়ে মরুভূমিতে আমাকে পা রাখতেই হল। কিন্তু সত্যি বলছি, আমি রাজস্থানের থর মরুভূমির অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে আরাবিয়ান ডেজার্টে জিপেও উঠিনি, উটেও না। তবে সোনালি বালিয়াড়ির বুকে দুরন্ত সূর্যাস্ত দেখেছি। বিকেল ফুরনোর সঙ্গে সঙ্গে কেমন ঝপ করে ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে মরুর বুকে, মনে হয় দিনের প্রখর রোদের ওপর যেন আরামের মলম লাগিয়ে দিল কেউ।
বলার মতো আরও অনেক কিছু করেছি। রংচঙে তাঁবুতে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে দেদার বারবিকিউ কাবাব আর শরবত খেয়েছি, মরুবালিকাদের নাচ-গানের সঙ্গে মিল খুঁজেছি রাজস্থানিদের আর ফেরার সময় আমবাঙালির মতো এতটুকুও বিশ্বাস না করে উচ্চারণ করেছি, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন।’