বিন্দাসিনী: পর্ব ৩

সময়যানে চড়ে পাড়ি

নস্টালজিয়া। কলকাতায় বেড়ে উঠলে এই শব্দটার সঙ্গে, এই অনুভূতিটার সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই শহরটা যেন নস্টালজিয়ায় ভিজে থাকে। আজকে যে নস্টালজিয়ার কথা বলব, তা খুবই নির্দিষ্ট— এই শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা বহুদূরব্যাপী। হয়তো কলকাতায় থাকার কারণেই এই নস্টালজিয়া সম্বন্ধে আমরা আরও বেশি সচেতন হয়ে পড়ি।

এই সময়ের যুব সম্প্রদায়ের অংশ হিসাবে আমি লক্ষ করে দেখেছি, আমাদের আগে যাঁরা যুবক ছিলেন, তাঁদের সময়ের অভিজ্ঞতা, শিল্প, সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের অপার কৌতূহল। ব্যক্তিগতভাবে এই চলে যাওয়া তারুণ্যের প্রতি আমি একটা গভীর আকাঙ্ক্ষা, এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা অনুভব করি। সেইসব হারিয়ে যাওয়া সময়, বা সময়ের কিছু নির্দিষ্ট অংশকে নিয়ে খুব ভাবি।  

শৈশবে বাবার গানের কালেকশন ঝেড়ে-মুছে গুছিয়ে রাখতে খুব ভাল লাগত। বছর কয়েক আগে, ওই জিনিসপত্রগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একটা বিটল্‌স-এর ক্যাসেট খুঁজে পাই। ক্যাসেটটা হাতের মুঠোয় ধরায় যে অনুভূতিটা জাগে, তাকে এক ধরনের অদ্ভুত নস্টালজিয়া ছাড়া আর কিছু বলে বর্ণনা করা যায় না। একটা স্মৃতি ভেসে ওঠে, আর তার সাথে একটা ইচ্ছা— সত্যিই বিটল্‌স-কে চোখের সামনে বিটল্‌স হয়ে উঠতে দেখলে কেমন লাগত।  

আমি যে সত্যিই অতীতে ফেরত চলে যেতে চাই, তা নয়— যদিও আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কথা ভাবলে আইডিয়াটা খুব খারাপ শোনায় না। তবে একটা টাইম মেশিন পেয়ে গেলে, সাময়িক বিশ্ব-ভ্রমণের সুযোগ ছাড়ব না।  

ধরা যাক, ইতিহাসের মাত্র তিনটে নির্দিষ্ট যুগে এই সময়-যাত্রা করতে পারব আমি, নিজের সময়ে ফেরত আসার আগে, নয়তো এই লেখা বোধহয় কোনওদিনই শেষ হবে না। আমার সময়-ভ্রমণের পছন্দগুলো সবই গান, পপ কালচার এবং এই সব কিছু নিয়ে শোনা গল্পের দ্বারা যারপরনাই প্রভাবিত।      

প্রথম যে-যুগে আমি এই সময়যানে চড়ে চলে যেতে চাই, সেটা হল ১৯৬০-এর দশক, এবং যে স্টেশনে থামতে চাই তা ‘দ্য বিগ অ্যাপল’। ষাটের দশকের নিউ ইয়র্ক মানে যেখানে ম্যাডিসন এভিনিউ ‘ম্যাড মেন’-উদ্বেল, যেখানে লিওনার্ড কোহেনের সাথে জ্যানিস জপলিনের ‘চেলসি হোটেল’-এ দেখা হয়, যেখানে জোন বেজ বব ডিলান-কে স্টেজে ডেকে নেন গান গাওয়ার জন্য এবং বাকিটা ইতিহাস। ব্যক্তিগতভাবে, এই সময়ের প্রেক্ষাপটে তৈরি শো এবং সিনেমা যতটুকু দেখেছি, এই দশকের ফ্যাশন এবং নৈশজীবন আমার খুব পছন্দের।

বব ডিলান এবং জোন বেজ, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৪। ছবি: ব্যারি ফেইনস্টাইন

আমি মধ্যযুগীয় অ্যাডভেঞ্চার নভেল-এর বিরাট ফ্যান, সুতরাং দ্বিতীয় যে-যুগে আমি পৌঁছতে চাই তা এই ভালবাসার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।  ঠিক কোন শতাব্দীতে পৌঁছলে এই জীবন আমি দেখতে পাব, তা জানি না, কিন্তু ছবিটা জানি।

এই যুগটাকে পছন্দ করার মূল কারণই হবে তলোয়ার-যুদ্ধ শেখা, ঘোড়ায় চড়ে শহরের পর শহর পেরনো, এমনকী সমুদ্র পাড়ি দেওয়া। কী ভীষণ রোমাঞ্চকর!  

এই দুনিয়াটায় আধুনিক সংযোগের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি সত্যিই জানতে চাই শুধু চিঠির মাধ্যমে ভাবনার আদান-প্রদান কেমন লাগে, বিশেষত যখন আমি জানি যে আমার জন্য এই সময়-ভ্রমণ সাময়িক মাত্র।     

এই আর্থারিয়ান রোমান্স নভেল-এর যুগে কিছু দিন কাটানোর পরই আমি হয়তো বাড়ি ফিরতে চাইব। অবশ্য তার আগে আরও একটা স্টেশন থাকবে— বাড়ির কাছেই। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর কলকাতা।     

আমি জানতে চাই, আমার বাবা-মা যখন বড় হচ্ছিলেন, আমাদের কলকাতা কেমন দেখতে ছিল। আমি সেই সময়ের নাটক দেখতে আর গান শুনতে চাই; মহীনের ঘোড়াগুলির অসামান্য পারফর্ম্যান্স এবং উৎপল দত্তর স্টেজে অভিনয় দেখতে চাই। রাজনৈতিক যে মতাদর্শ সেই সময়ের শিল্পকে প্রভাবিত করেছিল তা জানতে, বুঝতে চাই। আমি জানতে চাই সেই সময়ের প্রেম কেমন ছিল, এবং কীভাবে সেটা, আমি যা জেনেছি— তার চেয়ে আলাদা।

রবীন্দ্রসদনে মহীনের ঘোড়াগুলি, ১৯৭৯

আমি রিল-এ তৈরি সিনেমার পদ্ধতি দেখতে চাই, কথোপকথন শুনতে চাই, আমার বাবাকে সিনেমা বানাতে কী অনুপ্রাণিত করেছিল তা বুঝতে চাই। আমার দাদুকে মঞ্চে বা শুটিং-এর ফ্লোর-এ দেখতে চাই; ওঁর সম্বন্ধে শোনা সব গল্প, যা আমি এখন সিনিয়র অভিনেতা এবং টেকনিশিয়ানদের থেকে শুনি, তা যেন বাস্তব রূপে দেখতে চাই। এক কথায়, আমি ওঁদের জেনারেশনের অনুপ্রেরণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা-বাসনা সব দেখতে, বুঝতে চাই।

আর একবার ওই সময়যানে ফেরত এলে, আমি আমার এই জার্নিটার উপর একটা ফাটাফাটি উপন্যাস লিখব। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না, তাই গল্প বলেই চালিয়ে দেব।

ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

Read in English