মেডিসিনারি : পর্ব ১১

Representative Image

স্যর, আপনিও খুলুন, আমিও খুলছি।’

চমকে উঠেছে অনিমেষ। চেম্বারে উল্টোদিকে বসা পেশেন্ট যে এমন একটা কথা বলবে অনিমেষ ভাবতেও পারেনি। অমন যে চিড়বিড়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট নয়না, তার চোখও ছানাবড়া।

—একটু খুলে বলছি স্যর…

সঙ্গে আসা ঝকঝকে তরুণ সাথী সরব। (কাঞ্চন-শোভিত এ-রাজ্যে স্বামী না বলে সাথী বলাই ভাল।) রক্তিম অনিমেষ ব্যোমকে গিয়েছে এসব দেখে।

—স্যর, প্রেগনেন্সির শুরু থেকে আপনার কাছে এই নিয়ে প্রায় ছ’বার এলাম, একবারও আপনাকে দেখতে পেলাম না।

অনিমেষ একটু ধাতস্থ হয়েছে।

পিয়ালি ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, ‘স্যর কাল আপনি আমার সিজার করবেন আর আমি আপনাকে চিনলামই না! আর সত্যি কথা বলতে, আপনিও আমায় চেনেন না। পুরো মুখ না দেখলে কি চেনা যায়?’

ঠিক কথা। মাথা, মুখ, নাক, ঠোঁট ঢাকা থাকলে শুধু চোখ দেখে মহিলাদের চিনে রাখার বয়স অনিমেষ অনেকদিনই পেরিয়ে এসেছে।

‘হ্যাঁ মা, এটা তুমি ঠিকই বলেছ। ইদানীং, পেশেন্টদের চিনতে পারছি না বটে। সে-দিন নার্সিং হোমে একটা পেশেন্ট দেখার সময়, সিস্টার দিদিমণি ছুটে এলেন, স্যর এটা তালুকদার স্যরের পেশেন্ট, আপনার নয়। আপনার পেশেন্ট ওইদিকে।’

আগে তো এমন হত না। অল্প গুটিকয় পেশেন্টকে নামেও যেমন চিনত, ওয়ার্ডে দশটা পেশেন্টের মাঝে তাকে খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধেই হত না।

‘নাও নাও, শুভদৃষ্টিটা তাহলে হয়েই যাক দাদু…’

নয়নার ফিচকেমি যথারীতি।

অনিমেষ কিন্তু ভেবে চলেছে— শুধু কি আজকের মহামারী আর মুখঢাকা অবস্থা! পেশেন্ট-ডাক্তার চেনাচেনির গল্প তো কোনওকালেই শেষ হয়ে গিয়েছে।

ডাক্তারি-জীবনের গোড়ার দিকের একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল। এক ডেন্টিস্ট বন্ধু এক মজার কথা বলেছিল, ‘তোদের কী মজা! তোরা এমটিপি (অ্যাবরশন) করিস আর টেবিল থেকে উঠেই পেশেন্ট তোদের ভুলে যায়। একটু-আধটু ব্লিডিং হলেও রা কাড়ে না। আর আমি শালা একটা দাঁত তুললাম আর বিয়েবাড়িতে চিকেন তন্দুরিতে কামড় দিতে যাব, ‘এই যে ডাক্তার, তোমাকেই খুঁজছিলাম। কী দাঁত তুললে যে তারপর থেকেই একটু-একটু ব্লিডিং হয়েই চলেছে! ওঁর প্লেটে তন্দুরির ঠ্যাংটা কিন্তু অর্ধভুক্ত, শেষ পরিণতির অপেক্ষায়।’

অবশেষে ঢাকনাবিহীন মুখদর্শন হল। এবার আর-এক চমক।

‘এক মিনিট স্যর’, দ্রুত অঙ্গুলি সঞ্চালনে স্মার্টফোন একটা ছবিতে স্থির হল; ছবিটি অনিমেষের।

—স্যর, একটু মিলিয়ে নিলাম। আমার এক বান্ধবীর আপনার কাছে ডেলিভারি হয়েছে, তার রেফারেন্সেই আসা। সে রোজই জিজ্ঞেস করে, স্যরের সঙ্গে দেখা হয়েছে? আজ বলতে পারব, হ্যাঁ দেখা হয়েছে, চেনা হয়েছে। ছবিটা ওই-ই পাঠিয়েছে।

‘চেনা হয়েছে’ কথাটা খট করে অনিমেষের কানে লাগল। সত্যিই কি পেশেন্টরা এখন ডাক্তারকে চেনে? কিন্তু একসময় তো চিনত!

কত বছরই বা আগের কথা। বছর পনেরো-কুড়ি হবে। মফসসলের এক হাসপাতালের অপারেশন ঘর। অপারেশন টেবিলে লাইগেশন অপারেশন। রোগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ও মৃত্যু। সমস্ত হাসপাতালে দমবন্ধকর অবস্থা। অনিমেষের আহ্বানে সব ডিপার্টমেন্টের ডাক্তাররা ওটিতে হাজির। ফিসফিসানি উঠেছিল পুলিশে খবর দেওয়ার, কেউ-কেউ রাজনৈতিক নেতাদের কথাও বলেছিল। কিন্তু ডাক্তাররা ঠিক করেছিল, আমরা এতদিন এখানে কাজ করছি, আমরাই ফেস করব। ততক্ষণে ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়ে গিয়েছে। এই সময়ে আগুনের মতো খবর ছড়িয়ে গণ্ডগোলটা শুরু হয়-হয়। সমস্ত ডাক্তার সেদিন ওটি-সংলগ্ন ঘরে বসার পর পেশেন্টের বাড়ির লোকদের ডেকে পাঠানো হল। বলা বাহুল্য, বাড়ির লোকের চেয়ে সাথীর সংখ্যা অনেক বেশি। ঘটনাক্রম ও পরিণতি জানানো হল। খানিক স্তব্ধতার পর গুঞ্জন উঠল। অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক কর্কশ কণ্ঠ।

উত্তর একটাই, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি।’

আস্তে-আস্তে অনেকে আমাদের চিনতে শুরু করলেন। অর্থোপেডিক ডা. সোমের দিকে তাকিয়ে একজন বললেন, ‘স্যর, আপনি ছিলেন? আমার মা-র ওইরকম ভাঙা পা কত বড় অপারেশন করে ঠিক করেছিলেন।’ ওপাশে তখন কেউ-কেউ মেডিসিনের মহাপাত্র স্যরকে ঘিরে ধরেছে, 

‘স্যর, আপনি থাকতেও কিছু করা গেল না?’

কী আর করা যাবে, আমাদের ডাক্তারবাবুরা চেষ্টা করেছেন। সবই নসিব। হ্যাঁ, এমন কথাও শোনা গেল। অনিমেষের কেন জানি না মনে হয়, তখনও রোগী ডাক্তারবাবুকে চিনত।

এদিকে নয়না ততক্ষণে পেশেন্টকে মোক্ষম প্রশ্নটা করে ফেলেছে, ‘ম্যাডাম আপনি যে বললেন আপনি আমার স্যরকে চিনলেন, তা কতটুকু চেনেন? উনি কাউকে মেরে ফেলতে পারেন, বিশ্বাস করেন?’ 

ততক্ষণে মাস্ক যথাস্থানে। রোগীর অভিব্যক্তি বোঝা গেল না।

অনিমেষের মনে হল, এই কোভিড মহামারীর অনেক আগেই অবিশ্বাসের এক মহামারী ডাক্তার আর রোগীর মাঝে অচেনার মাস্ক হয়ে এঁটে বসেছে।

মহামারী আজ হয়তো সরে গিয়েছে, কিন্তু আদৌ কি রোগী আর ডাক্তারের মাঝের আবরণ সরবে?

স্বার্থ তো অনেকের!