ওপারে ঢাকার বড়কাটরা, নায়েবে নাজিম দিন কাটান ওখানে; এপারে বড়কাটরার আদলেই ছোট্ট নওগেরা হাভেলি, হতভাগ্য নবাবের পরিবার দিন গুজরান করেন; দুইয়ে তফাত করে দাঁড়িয়ে আছে বুড়িগঙ্গা। মাঝখানে কাঠের পুল। ওপারে চকবাজার; দিল্লি-আগ্রার চক না হোক, জাহাঙ্গীরনগরের চক! পাটনা-আগ্রা-লক্ষ্ণৌ থেকে আসা তওয়ায়েফে ঝনঝন করে ওপারের শহর, বেহালার আওয়াজে ডুবে যায় অলিগলির শহর, কারিগর আর কারিগরের পো তামাকের টিকিয়া বানায়, বেফায়দা ঘুরে বেড়ায় ভবঘুরেরা। বাগ-এ-মীর ময়মনায় ইরান-তুরানের সওদাগরদের আস্তানা, ধূর্ত আর্মেনিয় ব্যবসাদাররা ঘাটে পাটের নৌকোয় দরাদরিতে ব্যস্ত। ফৌজি ছাউনিতে সৈন্যদের হররা।
এপারে কাঞ্চনগাছগুলোতে আবার ফুল আসে। পাপিয়ার উচ্ছ্বসিত ডাক অহরহ রাতের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে মানুষকে। দিনে নিষ্পত্র বাদামগাছে লাল কাঠবেড়ালি সরসর করে বেড়ায়। অগ্নিবর্ণ কলার ছড়া ধরে হাভেলির বাগিচায়। মাওলা বখশের পোষা পানকৌড়ি পথ ভুলিয়ে বুনো পানকৌড়িকে পাখি-শিকারির জালে এনে ফেলে। মরা গাছটা থেকে কিরকির শব্দ করে পোকা ডাকে। মোতিঝিলের প্রাসাদের মতো এ-হাভেলিরও চারদিকে পানি।
নওগেরার মন্থর দিনগুলো উন্মাদ করে তোলে বড়ি বেগমকে। তিনি মেহেরুন্নিসা, তিনি ঘসেতি বিবি, মুর্শিদাবাদের রাজনীতি-কূটকচাল-চতুরালির কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। বিষয়াসক্তি যতটা থাকলে জীবন জহর বনে যায়, ততটাই ছিল তাঁর, আর ছিল ক্ষমতা হাতে পাওয়ার লোভ। এ-লোভ হল কস্তুরীর ঘ্রাণ; আপনার মাঝে আপনি পাগল করে, গোপনে। কোথায় রইল গৌড়ের কষ্টিপাথরে গড়া সেই মোতিঝিল প্রাসাদ, পদ্মফোটা মোতিঝিলে হাঁসের ঝাঁক, বজরা ভাসিয়ে কফিপান, হারেমের আঁধার অলিন্দে সারি-সারি গলির মুখে ভয়ালদর্শন খোজা প্রহরী, নিঃশব্দে ছদ্মবেশী প্রেমিকের আনাগোনা— কোথায় রইল তাঁর ষড়যন্ত্রী সঙ্গীরা… নমকহারাম উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ! সব ক’টা বদমাশ মিলে তাঁর মতো এক সহায়হীনা অনাথা বিধবা মহিলার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে গেল! ভাবতেই ওঁর রক্ত ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে দৌড়োয় রাগে।
দুপুরবেলা দেউড়ির বেতরিবৎ রক্ষীরা ঝিমোয়, কিংবা খিচড়ি পাকায়। অলস গেরস্তি! হায় কেউ তাঁকে খোঁজে না! দিলদারকে অত চোখ-কান খোলা রাখতে বলে দিয়েছেন— মুর্শিদাবাদ থেকে এত্তেলা পাঠানো হল কি না মর্দান বেগকে… নফরের ঘরে জন্ম, এরা কেবল খায় আর নিদ যায়! এদিকের লোকে চাষাভুষো; যেমন বোকা তারা, তেমন তাদের অকথ্য দারিদ্র; ঠাহর করে তাকালেই দেখবে চোখের জল না শুকোতে-শুকোতে ধুলোভরা গালে ধারার দাগ পড়ে গেছে। তকদির বদলাবে বলে এরা কেউ-কেউ এসে ভিড়েছে নবাবি নোকরিতে।
ফরমান অবশ্য পৌঁছয় হাভেলিতে, গ্রীষ্মের শেষদিকে। কাঠফাটা গরমের দিনে হাভেলিতে চাউর হয়ে যায়, বেগমরা ফিরে যাবেন। স্বস্তির বাতাস বয় এবার বড়ি বেগমের মহলে। বদনসীব ছোটি বেগম জীবনে বহু আঘাত সয়েছেন। একদা মুরাদ শের খাঁ ওঁর স্বামীর কাটা মুন্ডু ঝুলিয়ে রেখেছিল আজিমাবাদের পূর্ব তোরণে, প্রধান সড়ক দিয়ে সেদিন আজিমাবাদের নায়েবে নাজিমের বেগম আমেনাকে পুত্র-কন্যাসমেত খোলাবাজার হয়ে তাঁবুতে নিয়ে তুলেছিল বিদ্রোহী আফগানরা, বেইজ্জত করেছিল। সিরাজের বিয়ে কিংবা মসনদে বসার সামান্য কিছু সুখের দিন বাদে তিনি একে-একে শুধু প্রিয়জনের খুন হতে দেখেছেন। ভাগ্যের প্রসন্নতায় বিশ্বাস করবেন কী করে?
শাহীন আর সলিমা সন্ধ্যাবেলা সলতে পাকাতে-পাকাতে বলাবলি করে, ছোটি বেগম নাকি বলেছেন, এ-ফরমান পোকাধরা মাঠে ফসল ফলাবার আহ্বান। কিচ্ছু ফলবে না! শুধু বেগার খাটা সার হবে! দিলদার পরদিন সকালে ঝপাঝপ কুয়োয় বালতি ফেলে বাঁকা হেসে বলে, ‘বড়ি বেগম বলেছেন, ছোটি বেগম এ চাষাভুষার দেশেই থেকে যাক, চাষবাসের কথা এতই জানে যখন!’
১০.
ভরা বরষার বুড়িগঙ্গা নদীবক্ষ চিরে ১৬ মাল্লার পালের বজরা চলেছে। তিন বছর পর জোলো হাওয়া আছড়ে পড়ছে বেগমদের উড়ুনিতে। আমেনা বেগম চোখের কোণে দেখতে পান ঘসেতি বিবি মিনে করা জেওর পরেছেন আজ, বিবির মুখ মুক্তির খুশিতে মাতোয়ারা। আমেনা মুখ ফিরিয়ে নেন, ওই জেওর যেন ভাঙা কেল্লার মাথায় উড়ন্ত নিশানের মতো লাগে। তিনি তো জানেন না, গোপনে ঘসেতিকে গণৎকার এসে কপাল গুনে বলে গেছে— সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে বিবির কিসমতে, ফলে তিনি বড় বোনের দিকে তাকান আর ভাবেন— চক্রান্ত করতে ওস্তাদ একটা মেয়েলোক অতটা অসন্দিগ্ধ হয় কী করে! মুর্শিদাবাদে ঘসেতি বিবির কে বেঁচে আছে, যে তার সঙ্গে গাদ্দারি করেনি? শেষ আশরফিটা অবধি মীরজাফরের জীবন বাঁচাবার জন্য খরচ করেও তো ঘসেতি বিবি চালান হয়ে গেছিলেন নওগেরা হাভেলিতে। শুধু ঘসেতি নন, হাভেলির সবাই আজ বড় খোশমেজাজে আছে, বজরায় করে অবশেষে তারা চলেছে মুর্শিদাবাদের পথে। কোথায় ফিরে যাচ্ছেন ওঁরা দুজন? মীরনের হাতে? যে হাত আমেনার পুত্রের রক্তে রঞ্জিত। বজরা তো এসেছে, কিন্তু জীর্ণ বজরা। আর পুলভা নৌকায় করে বজরার পিছু-পিছু এত দীর্ঘযাত্রার মাল-সামান নিয়ে চাকর-নোকররা কই আসছে না তো! বৃষ্টি নেমেছে, তনসুখ মসলিনের মতো ঝাপসা। নদী চওড়া হতে শুরু করেছে, দু’পাড়ের ঘোগের ডাক আর শোনা যাচ্ছে না।
বজরা বুড়িগঙ্গা আর ধলেশ্বরীর সঙ্গমে পৌঁছল, পেছনে জাহাঙ্গীরনগর। মাথার ওপর কালিগোলা আসমান। চারদিকে অবিশ্রান্ত জলরাশি। নদীতীরে রহিস লোকের বাগিচাওয়ালা মোকামের সারি ফুরিয়ে গেছে কখন! এখন নদীর দুই পাড় উঁচু— বেত-বৈঁচির ঝোপ দুর্ভেদ্য। মীরনের জমাদার বাকির খাঁ ইশারা করলে হুকুম-বরদার সেতাব চাঁদ বজরার তলকুঠুরিতে বেগমদের সবাইকে জড়ো করে তালা মেরে দিল, এদিকে নাকি চুনিলাল-মণিলাল দুই জলদস্যুর ভীষণ উপদ্রব, নবাব বেগমরা যাত্রা করছেন দেখলে মহাবিপদ। বাকির খাঁ মৃদু গলায় বলল, ‘আপনারা কেউ টুঁ শব্দ করবেন না, ঘুমপাড়ানিয়া কথকরা কথা কইবেন না, বাচ্চালোগ ঝুমঝুমি বাজাবে না। এরা শিস বাজিয়ে এই বজরার লোককে ডাকবে দেখবেন! আপনারা পষ্ট শুনতে পাবেন।’… শিশুরা ছাড়া এ-যাত্রায় সরলা কে? কেউ নয়। তবু যা লেখা আছে কপালে, তার সঙ্গে বিবাদ করা যায় কি? বেগমরা আজ এঁদের হুকুম তামিল করছেন!
অনেকক্ষণ চুপ করে অপেক্ষায় থাকলেন ওঁরা; অনেকক্ষণ ঝড়বৃষ্টির শব্দ ডিঙিয়ে আর কিছুই কানে এল না ওঁদের। তারপর অন্ধকারে শুনতে পেলেন শিসের সংকেতে যেন কী জিজ্ঞেস করল দূর থেকে কেউ, নিশ্চয়ই দস্যুরা। বজরা থেকেও শিসের শব্দ এল, লম্বা উত্তর। এভাবে কিছুক্ষণ চলল। ঝপাঝপ কারা যেন দৌড়ে গেল বজরার কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে। গুম গুম শব্দ করে ভারী পেটিকার মতো কী যেন আছড়ে ফেলা হল পাটাতনের ওপর, অনেকক্ষণ। বেগমরা জানলেন না, বাকির খাঁ বজরার ছিদ্রস্থান খুলে দিয়ে বজরাটি ডোবাবার ব্যবস্থা করে অন্য নৌকাতে সরে পড়েছে। যতক্ষণ না এই বজরা বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর সঙ্গমে পুরো ডুবে যাবে, বাকির খাঁ আর তার লোকজন অদূরে নৌকায় অপেক্ষমাণ থাকবে।
১১.
সিয়ার-উল-মুতাখখিরিনের ভাষ্য মতে, মীরন প্রয়াত নবাব আলিবর্দি খাঁ-র দুই বর্ষীয়সী কন্যাকে হত্যা করার জন্য জাহাঙ্গীরনগর-ঢাকার নায়েবে নাজিম জেসারত খাঁ-কে বহুবার প্ররোচিত করে ব্যর্থ হয়। ১৭৫৯-এর জুন মাসে মীরন নিজের এক লোক পাঠিয়ে নির্দেশ দেয়, মুর্শিদাবাদে যাওয়ার নাম করে দুই বেগমকে নৌকায় তুলে ঢাকা শহরের বাইরে এনে নৌকা ডুবিয়ে দিতে। উদ্দেশ্যসিদ্ধির উপযুক্ত স্থানে নৌকো এনে লোকটি বেগমদের ওজু করে পবিত্র হয়ে নিতে বলে। ঘসেতি বিবি অত্যন্ত ভয়ে কাঁদতে থাকেন, কিন্তু আমেনা বেগম স্থিরসংকল্প হয়ে বড়বোনকে প্রবোধ দিয়ে ওজু করে হযরত আলির মাজার শরীফের মাটি গায়ে মেখে নিয়ে মীরনকে বজ্রাঘাতে মরবার অভিশাপ দিতে-দিতে বোন-সহ বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, আলিবর্দির বেগম শরফুন্নিসা-সহ অতগুলো মানুষ হাভেলিতে ছিল, তাঁদের ভেতর বেছে-বেছে মীরন এই দুই বেগমকেই আলাদা করে মারল কেন? নৌকাডুবিতে বাকিরা মরলেন না কেন? সিরাজ-উদ-দৌলার বেগম আর বংশের পিদিম কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখবারও তো কোনো কারণই থাকতে পারে না!
অত প্রশ্ন অবশ্য এ-অধম কাহিনিকারের মনে উদয় হয়নি, আর সকলের মতোই সে-ও বিশ্বাস করে— বুড়িগঙ্গায় হতভাগ্য নবাবের মা আমেনা বেগম আর খালা ঘসেতি বিবিকে ডুবিয়ে মারা হয়, সলিলসমাধি হয় ৭০-৮০ জনের সেই দলের। মৃত্যুর আগে বোনেরা খোদার কাছে ফরিয়াদ করেন, তাঁরা খোদার কাছে অপরাধী কিন্তু মীরনের কাছে তো কোনো অপরাধ করেননি, বরং মীরনের আজ যা আছে সবই তাঁদের দৌলতে। তাঁদের অভিশাপে সে-রাতেই রাজমহলের কাছে মীরন বজ্রাঘাতে মারা যায়। আল্লাতালা পরম দয়ালু ও সূক্ষ্ম বিচারকারী, তিনি গুনাহ্গারকে ঠিক শাস্তি দেন!
নদীবক্ষে নিরুপায় শিশু আর নারীর সেই মৃত্যুদৃশ্যের বিবরণ দিতে এই অধম কাহিনিকার অক্ষম। অধমের কল্পনাপ্রবণ মনশ্চক্ষু বরং যা দেখায় তা খানিকটা নিম্নরূপ—
খাবি খেতে-খেতে নাকে-মুখে পানি ঢুকছে অনর্গল; মৃত্যু নিশ্চিত জেনে এক বোন আরেক বোনের হাত ধরবার জন্য হাত বাড়ান— যেন নদী নয় এ অক্ষয় প্রেম সরোবর, এ-পানিতে সকল ক্ষোভ নিবৃত্ত হয়, সমস্ত পিয়াস মেটে।
১২.
কেউ বলে সিরাজের বেগম লুৎফুন্নিসা আর মেয়ে কুদসিয়াও ছিলেন বজরায়, কেউ বলে কোম্পানির ক্লাইভের হস্তক্ষেপে লুৎফুন্নিসা বেগম আর কুদসিয়া বেগম বেঁচে যান সেবার (তবে কি তাঁরা হাভেলিতেই রয়ে যান?)। হায়দ্রাবাদের নিজামরা ক্লাইভকে উপাধি দিয়েছিলেন— সাবিত জং; যুদ্ধে যিনি ধীরস্থির, ধীরেসুস্থে শিকার ধরা ক্লাইভের স্বভাব।
কেউ বলে, বেগমরা নাকি জাজিরা প্রাসাদে তিন নয়, আট বছর ধরে অসহনীয় দারিদ্রে বসবাস করেন; বহু আবেদন-নিবেদনের পর ইংরেজ সরকার তাঁদের মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নেয়। সেখানকার নেজামতের রেকর্ড থেকে তাঁদের ভাতা পাবার প্রমাণ দাখিল করা সম্ভব, প্রাকৃতিক মৃত্যুর পরে তাঁদের সমাধি হয় খোশবাগে, এমন প্রমাণও আছে।
১৩.
মীরজাফর কোম্পানির ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তির শিরোভাগে আল্লাতালা আর তাঁর রসুলের কসম খেয়ে লিখেছিলেন, ‘ইংরেজের দুশমন আমার দুশমন, তারা ফিরিঙ্গিই হোক বা হিন্দুস্তানি।’ হাভেলির মর্দান বেগ কি আশরফ বেগ সেসব খবর জানে না নিশ্চয়ই। মুর্শিদাবাদ বহু দূর, যদিও সেখানে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে বাংলা অন্ধকার হয়ে যায়। আলিবর্দির দুই কন্যার সলিলসমাধি ঘটবার খবর হাভেলিতে পৌঁছায় কি না, বা কোন রূপে পৌঁছায় কে জানে! বড়ি বেগমের স্বভাব ছিল বাঁদীদের ঘুষ দেওয়া, ঘুষের মোহর আর রত্তি-রত্তি গয়না জমতে-জমতে না কি মর্দান বেগ ধাঁ-ধাঁ করে পয়সাদার হয়ে যাচ্ছিল, আশরফ বেগ তাকে একদিন খুন করে বসে। সূর্য অস্ত গেলে অন্ধকারে ভাই ভাইকে চেনে না, বোন বোনকেও না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র