বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাস
একটা ফরাসি সিনেমার নাম ‘Petite Maman’ (পেতিত ম্যামঁ), মানে, ‘ছোট্ট মা’। ২০২১-এর এই ছবির গোড়াতেই দেখানো হয়, একটা ছোট্ট মেয়ের দিদিমা মারা গেছেন, তাই তার মা-বাবার সঙ্গে সে এসেছে দিদিমার বাড়িতে, যেখানে মা ছোটবেলায় থাকত। দিদিমার লাঠিটা সে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। মা’র নাম মারিয়ন। মেয়েটার নাম নেলি। এখানে মা’র সঙ্গে মেয়ের অনেক গল্প হয়, মা তার ছোটবেলার খাতা-বই মেয়েকে দেখায়। ছোট্ট মেয়ে বলে, মা, দিদিমাকে আমি ঠিক করে শেষবার টা-টা করিনি, সেইজন্যে মন খারাপ করছে। মা বলে, শেষবারটা তো কেউ আগে বুঝতে পারে না, তাই ঠিক করে টা-টা করা আর হয় না। একদিন সকালে উঠে নেলি দ্যাখে, মা চলে গেছে। কেন গেছে, এ-বিষয়ে তার বাবা তেমন কিছু বলে না। নেলি বাড়ির পাশের জঙ্গলে খেলতে গিয়ে দ্যাখে, তারই বয়সি (আট বছর) একটা মেয়ে খেলছে। তার সঙ্গে আলাপ হয়, তারও নাম মারিয়ন। সে গাছের ডাল-টাল দিয়ে একটা ছোট্ট ঘর বানাচ্ছে, যেমন নেলির মা’ও ছোটবেলায় বানিয়েছিল, সে-গল্প নেলিকে করেছিল। মারিয়নের সঙ্গে তার বাড়ি গিয়ে নেলি দ্যাখে, এ তো দিদিমারই বাড়ি, শুধু জঙ্গলের অন্যদিকে, আর এখনকার মতো এতটা পুরনো নয়। বাড়ির বাথরুমে একই টালি, দেওয়ালে একই জায়গায় লুকোনো আলমারি, কিছু আসবাবও এক, একটা ঘরে গিয়ে দ্যাখে মারিয়নের বই-খাতা, এবং একটা দরজা খুলে দেখতে পায় তার দিদিমাকে (যিনি অনেকটা কমবয়সি) ঘুমোতে। মেয়েটা ভয়ে সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসে। ঢুকেই বাবাকে ডাকে, কারণ কে জানে সে অতীতেই আটকা পড়ে গেছে কি না। কিন্তু আশ্বস্ত হয়, বাবা বসে আছে, আর দিদিমার ঘরে কেউ নেই। তার মানে, এই বাড়িটা তার বর্তমানে, আর ওই বাড়িটা আছে অতীতে, তার ছোট্ট মা’র বাড়ি। পরের দিন আবার ছোট্ট মারিয়নের সঙ্গে খেলতে যায়, ওদের বাড়িতেও আবার যায়, দিদিমাকে দ্যাখে সেই লাঠি ঠকঠক করে আসতে (তাঁর পায়ে একটা ডিফেক্ট আছে), সেই ডিফেক্ট যাতে সন্তানের পায়েও না হয়, সেজন্য ছোট্ট মারিয়নেরও একটা অপারেশন হবে তিনদিন বাদে। এই অপারেশনের কথাও মা নেলিকে বলেছিল। নেলি (এবং ছবির দর্শক) বুঝতে পারে, এই জঙ্গলে মেয়েটি পেয়েছে তার সমবয়সি মা’কে, তার সঙ্গে খেলছে সখী হিসেবে। আর, দিদিমাকে দেখতে এত ইচ্ছে করছিল, তাঁকেও আরেকবার দেখতে পাচ্ছে মেয়েটি, যদিও তিনিও এখন অনেকটা কমবয়সি, আর নেলিকে তো চেনেনই না, কারণ নেলি তো জন্মাবেই আরও বেশ ক’বছর পরে। কোনও রকম নাটুকেপনা ছাড়া একটা অলৌকিক কাহিনি বিবৃত হয়, টাইম ট্র্যাভেলের আশ্চর্য কাণ্ডওয়ালা কোনও জবরজং যন্ত্র বা মহাকাশযান লাগে না, কোনও বিস্ফোরণ ঘটে না, কোনও সতেরো-পাক স্পেশাল এফেক্ট ঠিকরে ওঠে না, কোনও প্রকাণ্ড সাতমহলা মিউজিক বেজে ওঠে না। ছোট্ট বাচ্চা বলেই নেলি ঘটনাটাকে তক্ষুনি, ওই ঘটনাটা হিসেবেই গ্রহণ করে। কারণ তার বিশ্বাসের তো কোনও অবধি নেই। বড়দের মতো তার মন সীমায়িত হয়ে যায়নি। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ছোট্ট বাচ্চার মতো বিশ্বাস শেখো, তার মা যদি তাকে বলে ও-ঘরে জুজু আছে, সে নিশ্চিত হয় যে ও-ঘরে জুজু, তার মা যদি তাকে বলে এ তোর ভাই, সে নিশ্চিত জানে এ তার ভাই। তেমনই, শিশু-বিশ্বাসে সিঞ্চিত এই ছবিতে, একটা অলীক ঘটনাকে নিতান্ত সাদামাটা ব্যাপার হিসেবে দেখানো হয়। কেউ মূর্ছিত হয়ে পড়ে না, নেলি বাবার কাছে অবধি এগুলো নিয়ে গল্প করে না, শুধু নিজের মা’র শৈশবের সঙ্গী হয়ে ঘুরতে-ফিরতে থাকে। অনেক রকম খেলা খ্যালে, মারিয়নের গাছের ডালের বাড়িটা সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করে, দিদিমার কাছে গিয়ে বলে, আমায় একটা টাই পরিয়ে দেবেন? আবার তাঁকে শব্দসন্ধানে কয়েকটা সমাধান বাতলে দেয়। দিদিমা বলেন, বাব্বা, তুমি তো এই বয়সেই অনেক কিছু জানো! এক সময়ে নেলি মারিয়নকে বলে, শোনো, আমি তোমাকে একটা কথা বলছি, তুমি কথা দাও বিশ্বাস করবে। আমি তোমার সন্তান। তোমার মেয়ে। তখন ছোট্ট মারিয়ন বলে, তুমি ভবিষ্যৎ থেকে আসছ? মেয়েটি বলে, আমি তোমার বাড়ির পিছনের পথটা থেকে আসছি। তারপর নেলি মারিয়নকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। মারিয়ন বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দ্যাখে, ছোট্ট মেয়ের বাবাকেও দ্যাখে, যাকে সে অনেক পরে বিয়ে করবে। বাবা চান এখনই নেলিকে নিয়ে যেতে। মারিয়ন জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছ? নেলি বলে, মায়ের কাছে যাচ্ছি। মানে, সে তার ছোট্ট মা’কে বলে, ভবিষ্যতের তার কাছেই সে ফিরছে। বাবার কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে সেই রাতে নেলি ছোট্ট মারিয়নের বাড়িতে যায়, মারিয়নের জন্মদিন পালন করা হয়। একদিকে মা আর একদিকে অনাগত কন্যা যখন ছোট্ট মারিয়নকে কেকটা কাটতে দিয়ে ‘হ্যাপি বার্থডে’ গাইছে, সে বলে আরেকবার গাইতে। রাতে মারিয়ন ও নেলি পাশাপাশি শুয়ে থাকে, অনেক গল্প হয়, কবে সে এই মেয়ের জন্ম দেয়, সে সন্তানকে চেয়েছিল কি না। নেলি যখন বলে, হ্যাঁ, তুমি আমায় চেয়েছিলে, সে বলে, অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমি এখন থেকেই তোমার কথা ভাবছি।
ছবিটা খুব বিখ্যাত হয়েছে, অনেক আবেগ ও ইচ্ছাপূরণ মিলেমিশে রয়েছে এখানে, কেউ বলেছেন শোক নিয়ে এমন চমৎকার স্নিগ্ধ ছবি বহুকাল হয়নি, কিন্তু যে-ব্যাপারটা আমরা বিশেষ লক্ষ করব : এখানে একটা অদ্ভুত কাণ্ডকে ব্যবহার করা হল, অথচ কোনও চমক দোহন করা হল না। ছবিটা সবদিক থেকে নিতান্ত সাদামাটা ভাবে এগোয়, ক্যামেরার কোনও কেরদানি নেই, একটা দৃশ্য ছাড়া কোথাও কোনও আবহসঙ্গীত পর্যন্ত নেই। এ ছবির মূলধন হল : বিশ্বাস। রূপকথার প্রতি শিশুর বিশ্বাস। দর্শকের প্রতি চলচ্চিত্রকারের বিশ্বাস। সিনেমা-মাধ্যমের প্রতি দর্শকের বিশ্বাস। বার্গম্যান বলেছিলেন, সিনেমা ও নাটক হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ম্যাজিক, কারণ কেউ যদি মঞ্চ বা পর্দায় একটা অতি সাধারণ চেয়ারকে দেখিয়ে বলে, এই হল পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্নখচিত সিংহাসন, তক্ষুনি চেয়ারটা সেই সিংহাসন হয়ে যায়। বার্গম্যানের নিজের এক বিখ্যাত ছবিতেও (‘দ্য সেভেন্থ সিল’, ১৯৫৭), প্রথম দৃশ্যেই একটা কালো কাপড়-মোড়া, মুখে সাদা রং করা লোক এসে বলে, সে মৃত্যু। কোনও ভোজবাজি নয়, বিস্ময়কর পরিস্থিতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনও অনবদ্য শিল্প-কৌশল নয়, শুধু একটা চরিত্রের মুখনিঃসৃত একটা সংলাপেই, ছবির প্রধান চরিত্র এবং সমস্ত দর্শক তক্ষুনি বিশ্বাস করে নেয়, সে মৃত্যু। যোদ্ধা সকালবেলা সমুদ্রের জলে মুখটুখ একটু ধুয়ে, প্রার্থনায় বসে এবং তা না করতে পেরে (হয়তো তার প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়) নিজের থলে গোছাচ্ছে, এমন সময় সে মুখ তুলে দ্যাখে ওই অদ্ভুত মূর্তি (বার্গম্যানের মতে, কিছুটা ভয়াবহ, কিছুটা কৌতুকপ্রদ, মুখটায় কঙ্কাল ও ক্লাউনের যুগ্ম দ্যোতনা ব্যবহার করতে চাওয়া হয়েছে) সামনে দাঁড়িয়েছে। পর পর সংলাপগুলো হল :
যোদ্ধা: তুমি কে?
মৃত্যু: আমি মৃত্যু।
যোদ্ধা: তুমি কি আমাকে নিতে এসেছ?
মৃত্যু: আমি বহুদিন ধরে তোমার পাশে পাশে হাঁটছি।
যোদ্ধা: সে আমি জানি।
মৃত্যু: তুমি কি প্রস্তুত?
যোদ্ধা: আমার শরীর প্রস্তুত, আমি নই।
[এরপর যোদ্ধা যেতে চায়, মৃত্যু পথ রোধ করে দাঁড়ায়।]
যোদ্ধা: একটু অপেক্ষা করো।
মৃত্যু: তোমরা সবাই এ কথা বলো। কিন্তু আমি তো কাউকে ছাড় দিই না।
যোদ্ধা: তুমি তো দাবা খ্যালো, তাই না?
মৃত্যু: কী করে জানলে?
যোদ্ধা: আঁকা ছবি দেখে, আর লোকগীতি শুনে।
মৃত্যু: হ্যাঁ, খুব ভাল দাবা খেলি।
যোদ্ধা: আমার চেয়ে ভাল নয়।
মৃত্যু: আমার সঙ্গে দাবা খেলতে চাও কেন?
যোদ্ধা: সেটা আমার ব্যাপার।
মৃত্যু: ঠিক আছে।
[ওরা দুজনে দাবা বোর্ডের দুপাশে খেলতে বসে।]
যোদ্ধা: শর্ত হল, আমি যতক্ষণ না হারছি, বেঁচে থাকব। আর যদি জিতি, তুমি আমায় ছেড়ে দেবে।
খেয়াল করতে হবে, যোদ্ধা একবারও বলল না, ভ্যাট, মৃত্যু এরকম সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকে না কি? তাকে আবার চোখে দেখা যাচ্ছে কবে থেকে? তুমি আদতে কোন সার্কাস কোম্পানির ভাঁড় হে? ভোর-ভোর মানুষকে হ্যারাস করতে এসেছ? কিচ্ছু না। সোজা জিজ্ঞেস করল তুমি কে? উত্তর এল, মৃত্যু। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সঙ্গে মোকাবিলা শুরু হয়ে গেল। মৃত্যু একজন মানুষের সঙ্গে দাবা খেলছে, এবং দাবায় মৃত্যু জিতলে মানুষটার মৃত্যু হবে, এ সাংঘাতিক অদ্ভুত কথাটা বিশ্বাস করতে (এবং ভয় পেতে, এই রে, মৃত্যু জিতবে না তো!) দর্শকদেরও এক মুহূর্ত বাড়তি সময় লাগল না। বার্গম্যানের মতে, ‘It was a delicate and dangerous artistic move’, (সূক্ষ্ম ও বিপজ্জনক, ‘সূক্ষ্ম’— কারণ সমস্ত ভান পরিহারটাকেই, দর্শকের প্রতি পূর্ণ সমর্পণটাকেই এখানে মূল চাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে), কারণ যে কেউ খ্যাঁকখ্যাঁক হেসে উঠে বলতে পারত, ধুস, যত্ত ধাপ্পাবাজি, একটা লোক গুচ্ছের মেক-আপ করলেই মৃত্যু বনে যায়! কিন্তু আশ্চর্য হল, কেউ বলেনি। দেশে দেশে এবং যুগে যুগে কেউ না। এই বিশ্বাস এত মূল্যবান, এর ওপরে ভর করেই গল্প ও তাবৎ শিল্প চলছে। আমরা যখন ছবি দেখতে যাই, যদি সৎ দর্শক হই, তাহলে আমাকে যা বলা হবে তা-ই বিশ্বাস করব বলেই যাই। যে-কোনও শিল্পের প্রতি শিশুর মতো উন্মুখ ও উন্মোচিত থাকাই ভোক্তার প্রাথমিক কর্তব্য। কিন্তু সেই বিশ্বাস উৎপাদনের হাজারটা প্রক্রিয়া, পদ্ধতি, উপায় আছে, নির্দিষ্ট ছবিতে বিশ্বাস করানোর রকমটা যথেষ্ট পছন্দ না হলে আমরা শিস দিয়ে উঠি, বা হইহই করে আপত্তি জানাই। কিন্তু কী আশ্চর্য, বিশ্বাস করানোর জন্য একেবারে কোনও কারচুপিই ব্যবহার না করা হলে, এতটুকু জারিজুরি না করলে, সেই সারল্যের জোরেই, অনেক সময় অনেক উদ্ভট পরিস্থিতি বা গল্পকে তক্ষুনি মেনে নিই। শুধু বলে দিলেই হল, এরকমটা হয়েছে। কোনও কারুকার্য না করে, কোনও প্লটের মারপ্যাঁচ প্রয়োগ না করে, কোনও প্রতিভা-পেঁয়াজি না হামলে, সোজা কথা : এ মৃত্যু। সোজা কথা : মা আর মেয়ে এখন সমবয়সি। তাই দুজনেই খিলখিল হেসে গোলারুটি বানাবে, ঘরে পর্দা টাঙিয়ে নাটকের পার্ট করবে, আবার কখনও আট বছরের মেয়ে আট বছরের মা’কে জিজ্ঞেস করবে, তুমি সবসময় এত বিষণ্ণ থাকো কেন, সে কি আমার কারণে? ছোট্ট মেয়ে জঙ্গলে গিয়ে ছোট্ট মা’কে পেয়ে, এই ঘটনাকে প্রশ্ন করবে না, মিরাকলের নেপথ্যে টেকনিক জানতে চাইবে না, নিজেকে পাগল ভাববে না। এবং দর্শকও তার সঙ্গে সঙ্গে, তারই মতো অনায়াসে সবটা বুঝে ও নিঃশর্তে মেনে নিয়ে পথ চলবে। সাংঘাতিক সাহস না থাকলে এমন অনায়াসে, মানুষের ওপর এতটা নির্ভর করে, প্রায় শিশুর পবিত্রতায়, ব্যাপারটা সরাসরি বলে দেওয়া যায় না। বারে বারে মনে হয়, ধুর, লোকে বিশ্বাস করবে কেন? লোকে তো ব্যঙ্গ করতে মুখিয়ে থাকবে। লোকে তো গালাগাল দিতে উঁচিয়ে থাকবে। কিছু একটা কায়দা অন্তত করি, যাতে এটা বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। কোনও কেরামতিই থাকবে না, শুধু স্ট্রেট বলে দেব, আর সবাই মেনে নেবে, এই বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাসের জন্য— নিজের প্রতি, আর শিল্পের প্রতি পেল্লায় বিশ্বাস দরকার। আর অবশ্যই দরকার ফাটকা খেলার বেপরোয়াপনা। সেই ঐতিহ্য যে সপ্তম সিলমোহর থেকে ছোট্ট মা অবধি প্রবাহিত হচ্ছে, তা সিনেমা-শিল্পের পক্ষে দুরন্ত সুখবর।
কভারের ছবি : ‘Petite Maman’ ছবির একটি দৃশ্য