রঙিন কি হয় স্মৃতি? না কি বর্ণহীন? স্মৃতির কোনও সাউন্ডট্র্যাক থাকে? এ কি সিনেমার মতো চলমান? না কি একই ছবির খণ্ডচিত্র? চরিত্ররা তো চেনা, মাঝে মাঝে কাল্পনিক মনে হয় কেন? স্মৃতি কি আসলে দেখতে চাওয়া, গড়ে নেওয়া স্বপ্ন? কথা হচ্ছিল স্বপন নায়েকের সঙ্গে, গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে। ওঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনী ‘মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স’ চলছে এখানে। প্রায় নিস্তব্ধ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর। অমসৃণ সাদা দেওয়ালে পরিছন্ন ফ্রেমে বাঁধানো পর পর ছবি। এক-আধটি নির্বাক দর্শক। এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে উপনীত হচ্ছেন স্লো-মোশনে। প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বিশেষ চেষ্টা করছিলাম তা নয়। কানে ভেসে আসছিল কিছু স্বগতোক্তি। ফিরে আসছিল কিছু পুরনো কথা। এই সময়ের ছিটেফোঁটা আবেগ-আক্ষেপ মিশে যাচ্ছিল তাতে।
সুররিয়ালিস্টিক সিনেমার প্রবাদপ্রতিম পুরুষ লুই বুনুয়েলের কথায়, ‘স্মৃতির ভার বড় সাংঘাতিক। ইচ্ছে হলেই একে ফেলে দেওয়া যায় না। এর শরীর বড়ই পলকা। ভঙ্গুর। এসে পড়ে অনিবার্য বিস্মৃতি। মিথ্যে শব্দকল্প। এমন হতেই পারে যে, যাকে পুরনো অভিজ্ঞতা বলে মান্যতা দিতে চাইছি, তা আসলে সমকাল থেকে উঠে আসা এক ফ্যান্টাসি। নিজের মনের অচেনা অলিন্দে এর উৎস। এখানে সত্যি-মিথ্যের সংঘাত নেই। ব্যাপারটি যে ভীষণই ব্যক্তিগত! তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, যে-কোনও মানুষের কাছে তার এই সময়ের মনছবি, অনুভূতি দাঁড়িয়ে আছে এক যুক্তিহীন, অঙ্কহীন, প্রমাণহীন বিশ্বাসের ওপর।’
কিছু কথার পর যখন একটা নিস্তব্ধতা নামল। শুরু করলাম ছবি দেখতে। চৌকো ছবি সব। একরঙা। মেটে, বাদামি, গাঢ় বাদামি কালো, বেইজ, ফিকে হলুদ, সাদা নেই, অমলিন ধূসরতা, জং-ধরা টোন। সিপিয়া কখনোই নয়। আধুনিক ছবির ধারালো, জমজমাট, বহুমাত্রিক উত্তেজনায় মাতিয়ে, উথালপাথাল করে, ডুবিয়ে, ভাসিয়ে নাজেহাল করে দেওয়ার অভিপ্রায় নেই। বরং অনেকটাই নির্লিপ্ত, শূন্য। ফ্রেমের কাছে কান পাতলে যেন শোনা যায়, ‘হাওয়া বয় শন শন, তারারা কাঁপে, হৃদয়ে কি জং ধরে, পুরোনো খাপে।’ জং-ধরা শরীরে, জমিতে যে-বিষণ্ণতা, অমোঘ মৃত্যুর ইশারা থাকে, এই ছবিতে তা নেই। রয়েছে ধুলোর স্তর কিছুটা সরিয়ে তুলোট স্মৃতিকে পুনর্নির্মাণ করে একবার মিলিয়ে দেখার গোপন আনন্দ। আগেই জেনেছি, এই ছবিদের লোকেশন বীরভূমের এক গ্রাম। হয়তো কখনো সেখানে ভেসে আসে শহুরে রেডিওর পল্লীগীতি। কারা যেন কাশবনে ফেলে যায় ছাতা। শন শন হাওয়া দিলে ভেসে আসে খেয়ালি হাঁস। জলে ডোবা উদ্ভিদ, ডাঙাই গাছের ছায়া দেখে আন্দাজ পায় নিমজ্জমান ও নিমজ্জিতের তফাত। ছায়া পড়ে কারুর আটপৌরে দেওয়ালে। দেওয়াল থেকে যায়, মুছে যায় ছায়া, অপসৃয়মান সূর্যের দিক বদলে। জলে ভাসে কী যেন, তার ওপর নিশ্চিন্তে খেলা করে মার্বেল, না কি বেলুন! যত সব ছেলেমানুষি এটা-সেটা। জানতে ইচ্ছে করে, কোথায় ছিল এই প্যান্ডোরার বাক্স, এত অবান্তর সুখস্মৃতি জড়ানো ছেলেবেলার সংগ্রহ। একটা ফেলনা মুকুট, হবে কোনও অলীক রাজপুত্রের সম্বল, ফিরে আসে বার বার নিউমোনিকের মতো। ক্ষণিকের বাসা বাঁধে অনির্দিষ্ট আস্তানায়। অথবা ভেসে যায় শ্যাম পুকুরের গভীর গহনে। কারা যেন পেরিয়ে যায় অগভীর জল। একা বেজে যায় পুরনো রেডিও, শুনশান দিগন্তপাটে। জলে কেউ পেতে দেয় চাঁদমালার গালিচা। ঘড়ির ডায়াল ঘুরে চলে উল্টো দিকে।
স্বপনের ছোটবেলা কেটেছে বনগাঁতে, বহুদিন অবধি মাটির বাড়িতে। সেই মাটি পুড়িয়ে শক্ত ইটের বাড়িও এসেছে সময়ের নিয়ম ধরে। সেই সোঁদা মাঠ-ঘাট, গাছ-পাতালির মিতালি আজও আছে। মাঝবয়সের স্বপন এখন ঘর বেঁধেছেন আর এক গাঁয়ে। বীরভূমে। ফিরে পেয়েছেন ছেলেবেলার সেট। চলচ্চিত্র নির্মাণে বাধা থাকেনি। সেটি রয়ে গেছে মনের ভিতরে। দরকার পড়েনি অভিনেতার। স্মৃতির কথকতায় ছবিটা সাইলেন্ট হয়েও হয়নি। আমরা দেখছি তার লবি স্টিলগুলি। এই প্রদর্শনীতে। এ এক আজব ফ্লিপ-বুক, যা দ্রুত উল্টে যাওয়ার সুযোগ দেয় না। বাধ্য করে প্রতিটি পাতাকে স্পাইন থেকে খুলে নিয়ে সারি বেঁধে টাঙিয়ে দিতে। বুদ্ধিস্ট প্রেয়ার ফ্ল্যাগের মতো। ‘বলতে পারো, এ আমার বহুদিনের ইচ্ছে, অনেক অনুসন্ধানের, প্রচুর স্মৃতিতে অবগাহনের ফল। আমার যা কিছু, আমার মনন, যাপন, ভীষণই দামি, জরুরি যে! সাজিয়ে রেখেছি নিজের মিউজিয়ামে। অবোধ, নির্দোষ, নিষ্পাপ এক শৌখিন আদরে।’
দেখলে ধন্দ লাগে। খুব স্পষ্ট তো নয়! চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো ডিটেল কই? ধুলোট আবহে কিছু রেখায় একের পর এক অবয়ব তৈরি হয়েছে। মরীচিকার মতো। অথচ আঁকা ছবি তো নয়, ফোটোগ্রাফ। ক্যামেরায় ধরা। কেমিক্যালে স্নান করিয়ে, প্রিন্ট করা। ফোটোগ্রাফির আধুনিক প্রযুক্তির বিষুবরেখা থেকে এর তীর্থযাত্রা শুরু পিছন দিকে। পিছোতে-পিছোতে স্বপন এসে থেমেছেন প্রযুক্তির ঊষালগ্নে। তখনও সেখানে রুপোলি রেখার দেখা মেলেনি। লেন্স এসে গেছে, ছায়া ফেলা যাচ্ছে আলো পাওয়া গেলে। আলোতে স্পর্শকাতর একটি রাসায়নিক বস্তু পাওয়া গেছে, তার নাম পটাসিয়াম ডাইক্রোমেট। নেগেটিভের সঙ্গে কেমিক্যালস্নাত ছাপার কাগজের পুঙ্খানুপুঙ্খ শারীরিক স্পর্শে যা জন্ম দেবে ছবির। তবে, পজিটিভ থেকে পজিটিভ। সনাতন পদ্ধতিতে নেগেটিভ থেকে নয়। ছবি রন্ধনের হেঁসেলে এর পরের জরুরি বস্তু হল গাম অ্যাকাশিয়া, যা বেঁধে রাখবে প্রাপ্ত ছায়াকে। খনন শেষে স্বপন সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন ধরনের বর্ণের মাটিকে, যা ধরাবে টোন। বলা যেতে পারে, স্মৃতির হাত ধরে তৈরি হবে মাটির ছবি। প্রিন্ট মেকিং-এর জগতে সিলভার হ্যালাইড প্রযুক্তিকে যদি বলা হয় রুপোর পক্ষীরাজ, তাহলে একে বলব টেরাকোটার ঘোড়া। এর পরেই প্রশ্ন ওঠে, একটি ছবি বই তো আর কিছু নয়! একটা ফোন দিয়ে তুললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। তাহলে এত ঝঞ্ঝাট নেওয়া কেন? স্বল্পবাক শিল্পীর সহজ উত্তর, ‘কন্টেন্ট ও প্রসেস পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে বলে আমার বিশ্বাস। আমি তো স্বেচ্ছায় পিছনে হেঁটে যেতে চেয়েছি। কর্মপদ্ধতিতে প্রাচীনের ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে এনে চলনের মননটির সম্পূর্ণতা খুঁজেছি। এটি আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। শখ। আনন্দ। স্পিরিচুয়ালিটি। যুক্তি দিয়ে বিচারের প্রয়োজন অনুভব করিনি আমি।’
জানিয়ে রাখি, স্বপন নায়েক দীর্ঘদিন চিত্র-সাংবাদিকতা করেছেন। ‘তসবির’ আয়োজিত ‘নো হোয়্যার পিপল, ২০০৮’ ব্রহ্মপুত্রের ওপর মানুষের জীবন নিয়ে মস্ত কাজ, সারা দেশে প্রদর্শিত। ২০১১-তে ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’, জাঁ পল সার্ত্রের ভাবনার প্রভাবে সৃষ্ট একগুচ্ছ চিত্রমালা। ২০১৬-তে ‘রাধা: লাভ ইন ইটারনিটি।’ সাদা-কালো ফিল্মে তোলা সব ছবি; সিলভার জিলেটিন প্রিন্ট। প্রায় এক দশকে মানুষ হিসেবে শিল্পী বদলে গেছেন অনেকটাই। পেশাদার কাজের বাধ্যবাধকতা ও পরিমিতি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। একমাত্র নিজের অন্তরের ডাকে সাড়া দিয়েছেন বারবার। বাজারমুখী হননি। কোনও সংঘাতেও যাননি। সেলিব্রিটি আলোকচিত্রী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে রেখেছেন যাবতীয় সার্চলাইটের বাইরে। ডিজিটালকে পরিহার করে চলেছেন এখনও। আপত্তি বা অসন্তোষে নয়, অ্যানালগের দীর্ঘ অনিশ্চয়তার রোম্যান্সে ডুবে থাকার গভীর আনন্দে। ওঁর সব ছবিই নিশ্চিন্তে অবগাহন করে চলে আলাপের অলস খেয়ালে। ঝালার উত্তেজনায় উৎসাহী নন উনি। থাকেন নিজের পড়াশোনা, বোধ ও উপলব্ধি নিয়ে। ওঁর মতে, জীবনানন্দীয় বিমূর্ততা শিল্পের শ্রেষ্ঠ জায়গা। এই মানসিকতা থেকে জন্ম নিয়েছে এই প্রদর্শনী। রূপায়ণ প্রক্রিয়ায় আরও অনেকটা পিছিয়ে গেছেন স্বপন, ফোটোগ্রাফিতে আল্ট্রা-আধুনিকতাকে আলিঙ্গনের অভিপ্রায়ে।
এই প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত প্রাচীন প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো কঠিন, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শিক্ষাগুরু শান্তিনিকেতনের অর্পণ মুখোপাধ্যায়। অধুনা জনপ্রিয়তা অর্জন করা ‘অল্টারনেটিভ ফোটোগ্রাফি’র জগতে সম্মানিত নাম। ‘মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স’ সম্পর্কে একটি সূত্র পরিবেশন করেছেন উনি। বলেছেন ওরহান পামুকের লেখার কথা। যেখানে শিল্পী নিজের চারপাশের সমকালীনতা থেকে আহরণ করছেন জরুরি খড়কুটো। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অনুভব, সম্পর্ক, স্মৃতি এবং সময়ের পুনর্নির্মাণ। প্রদর্শনীতে পৌঁছলে ছবি ছাড়াও একটি বিষয় চোখ এড়িয়ে যাবে না। আলাদা পাত্রে সংগৃহিত বিভিন্ন বর্ণের মাটি পাত্রস্থ হয়েছে। একপাশে। এই সামান্য বস্তুগুলির দ্রব্যগুণে দ্রবীভূত হয়েছে শিল্পীর ভাবনা। ছোটবেলার নিখাদ স্মৃতিকণিকাগুলি এক নিষ্পাপ আশ্লেষে লীন হয়েছে কাগজের শরীরে। এই আপাত সাধারণ সম্ভার জনপ্রিয় লেন্সছবি না হয়ে ব্যক্তিগত মনছবিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
সবকিছুর একটা রেশ থেকেই যায়। বেরিয়ে এসে রাস্তার ক্যাকোফোনির মধ্যে গলদঘর্ম অবস্থায় একটা কথা মনে হল। তাহলে ‘সহজ পাঠ’-এর হাই কন্ট্রাস্ট, টোনবর্জিত, বাহুল্যবর্জিত, এক মাত্রার ছবি-ই কি আজকের সবচেয়ে উপযুক্ত ইলাস্ট্রেশন? অন্যের চাপিয়ে দেওয়া ইনফর্মেশনের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে-হতে, ক্লান্তির চরম সীমায় দাঁড়িয়ে, শেষ প্রাণবায়ুটুকু অ্যাকুয়ালাঙে সঞ্চয় করার সময়ে আমরা কি ভাবতে পারি যে, কোথাও বোধ হয় থামার সময় এসেছে? সমে পৌঁছে গেছি যে!
স্বপন নায়েকের ‘মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স’ চলবে ৩০ মে পর্যন্ত।
স্থান: গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারি, ৩৩এ যতীন দাস রোড, কলকাতা ২৯ (দেশপ্রিয় পার্ক থেকে রবীন্দ্র সরোবরের দিকে এগোতে প্রথম বাঁ-দিক)।