বিজ্ঞান ব্যাপারটা কঠিন মনে হলেও, বিজ্ঞান লেখার ভাষাটা যতটা সহজবোধ্য করা যায়, পাঠকের পক্ষে ততই মঙ্গল। এবং তা যে খুব কঠিন এমনটা নয়। সঠিক সুযোগ এলে কীভাবে বিজ্ঞান সাধারণ মানসে জাঁকিয়ে বসতে পারে, তার উদাহরণ হিসাবে বিগত দু’বছরের কোভিডকালীন চিকিৎসা-বিজ্ঞান গবেষণার কিছু ঘটনার উপর চোখ বোলানো যাক।
জেনেটিক টিকা (ভ্যাক্সিন)
আমাদের প্রজন্ম তাজ্জব এক সময়ের জীবন্ত দলিল। বিগত দুই বছরে আড্ডার ঠেকে, চায়ের টেবিলে, কলেজ ক্যান্টিনে ভ্যাক্সিন নিয়ে যে-পরিমাণে আলোচনা হয়েছে, তেমন বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা বিগত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বজুড়ে হয়েছে কি না সন্দেহ। সাধারণ সময়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞান গবেষণা-পদ্ধতির কয়েকটি অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সমস্যা থাকে। বাজার, মার্কেটিং, মুনাফা সামলে নির্দিষ্ট আবিষ্কারটির ব্যবহারিক পর্যায়ে মানুষের হাতে এসে পৌছতে অনেকখানি সময়, অনেক কাঠখড় পেরোতে হয়। কোভিডকালে আমরা কিন্তু এক উলটপুরাণ চাক্ষুশ করেছি। জেনেটিক ভ্যাক্সিন বিপ্লবের কথা বুঝতে হলে আমাদের তিরিশ বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের গবেষকরা সেই প্রথমবার এক বিদেশি প্যাথোজেনের জিন একটি ইঁদুরের শরীরে গুঁজে দিয়ে দেখতে চাইলেন কী কাণ্ডটা ঘটে! এই ধরনের ভ্যাক্সিন বা টিকার ক্ষেত্রে, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পেশিতে আমরা একটি নির্দিষ্ট রেসিপি পাঠাই, যার সাহায্যে আমাদের কোষ একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করতে পারে। কোভিডের ক্ষেত্রে ফাইজার বা মর্ডানার এম-আর-এন-এ টিকা যে-রসায়নটি পাঠায় তার সাহায্যে আমাদের শরীর করোনা ভাইরাসের বাহির-গঠনে খুঁজে পাওয়া স্পাইক প্রোটিনের অনুকরণে একটি অ-বিপজ্জনক প্রোটিন স্ট্র্যান্ড তৈরি করতে সমর্থ হয়, এবং আমাদের কোষ তেমন প্রোটিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরিতেও প্রবৃত্ত হয়। তাই এ-ধরনের টিকার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের প্রোটিন-গঠনের স্পষ্ট রাসায়নিক ধারণা তৈরি হলে মোটামুটি কেল্লা ফতে। এই হল মোদ্দা কথা। ব্যাপার হল, ২০১৯ সাল অবধি আর-এন-এ ভ্যাক্সিন-গবেষণা গতে বাধা ঢিমে তালেই চলছিল, এবং বিজ্ঞানীরা টিকা-প্রণালীর স্টেবিলিটি বা স্থায়িত্ব নিয়ে বেশ চিন্তিতই ছিলেন। স্বভাবতই সে-গবেষণা বিজ্ঞান থেকে গণবিজ্ঞান হয়ে সর্বস্তরে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে কোভিড ১৯-এর প্রথম তরঙ্গ আছড়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই গবেষণা-পদ্ধতি তরান্বিত হতে শুরু করে। কারণ, মুনাফা ও ব্যুরোক্রেসি ছাড়িয়ে জরুরি হয়ে দাঁড়ায় সুস্থ মানবজীবন রক্ষার উদ্দেশ্য। সাধারণ টিকা-গবেষণার তুলনায় আর-এন-এ বা ডি-এন-এ ভিত্তিক টিকার গবেষণা আমাদের চটজলদি ৯৪% কার্যকারিতায় কীভাবে পৌছে যাওয়া যায় তা দেখতে শেখাল। তার সাথে খবরের কাগজের পাতায়, ওয়েব পোর্টালের লিংকে, এবং আরও বিভিন্ন স্তরে গবেষক ও বিজ্ঞানীদের লেখালেখি, আলোচনা ও ডিসকোর্সের সহজলভ্যতা আমাদের সকলের কাছে ভ্যাক্সিনের বিজ্ঞানকে জলবৎ তরলং করতে সাহায্যও করল অনেকখানি, যা বিগত ১০০ বছরে আমরা ঘটতে দেখিনি। ভাবতে অবাক লাগে, এই কোভিডকালীন কর্মযজ্ঞ ও তার নিদারুণ তথা চটজলদি ফলাফল ডি-এন-এ/আর-এন-এ ভিত্তিক ক্যান্সার ভ্যাক্সিনের গবেষণাতেও বিজ্ঞানীদের আত্মবিশাস বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ওয়্যারেবল মেডিকাল প্রযুক্তি
এমনই আরেকটি জরুরি ব্যাপার হল ‘ওয়্যারেবল মেডিকাল ডিভাইস’ বা পরিধানযোগ্য ডায়াগনসিস প্রযুক্তি। নামটা শুনলে একটু ঘাবড়ে যেতে হয় বইকি! কিন্তু সহজ করে ভাবলে দেখা যাবে, এ-জিনিস নিয়ে আমরা দিনরাত নিজেরাই নাড়াচাড়া করছি। বলতে চাইছি, স্মার্ট ওয়াচ-স্মার্ট গ্লাস-স্মার্ট রিং ইত্যাদির কথা। এই ধরনের প্রযুক্তিকে কীভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে বিগত এক দশক ধরে বিশ্বের সর্বত্র গবেষণা হয়ে আসছে ঠিকই, তবে তিন বছর আগেও সাধারণ আলোচনার সর্বত্র এই প্রযুক্তির খোলাখুলি প্রবেশাধিকার ছিল না। জেনেটিক ভ্যাক্সিনের মতোই মোড় ঘোরাল কোভিড। বিজ্ঞানীরা দেখলেন দ্রুত কোভিড পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে যে-পরিমাণে ডেটা বা তথ্য বিশ্লেষণ প্রয়োজন, তাতে সংস্পর্শ সম্পর্কিত সংক্রমণের সম্ভাবনা এড়িয়ে সে-কাজ করতে হলে ওয়্যারেবল প্রযুক্তির ব্যবহারই একমাত্র উপায়। কোভিডকালের পূর্বতন অবস্থায় ডায়াবেটিস, হৃদ্যন্ত্র, কিডনি, ব্লাডার ইত্যাদির মতো স্থায়ী সমস্যার ক্ষেত্রে এমন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হলেও তা ছিল সাধারণ মধ্যবিত্তের ‘পকেট-সিলেবাস’-এর বাইরের ব্যাপার। কিন্তু যখনই আমরা সর্বজনীন সুস্থতার প্রশ্নে উদ্দেশ্য-মুনাফা ইকুয়েশনের ব্যালেন্স পালটে যেতে দেখলাম, তথ্যের প্রশ্নে, সার্বিক সুস্থতার প্রশ্নে, বিগ-ডেটা বিশ্লেষণের প্রশ্নে বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক কাগজপত্র ছাড়াও সাধারণ ডিসকোর্সে তাদের গবেষণা ও কাজের কথাগুলো বলার সুযোগ পেলেন। আমরা জানতে পারলাম, কীভাবে এই ধরনের প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত নানান ধরনের সেন্সর (টেম্পারেচার, প্রেশার, হার্টরেট, চলাফেরা করার ক্ষমতা ইত্যাদি মাপার মাইক্রোচিপ) সহজেই বুঝে নিতে পারে কোভিডের সম্ভাব্য সিম্পটমগুলি! কেবল এখানেই থেমে যাওয়া নয়, বিশ্বের সর্বত্র ব্যবহৃত এই প্রযুক্তির হাত ধরে যে তথ্য সংকলিত হল তার সাহায্যে ডেটা-সায়েন্টিস্টরা এই প্রথম সিম্পটম প্রকাশের আগেই কীভাবে রোগ নির্ধারণ করা যায় সে-পদ্ধতির উপর বিপুল হারে কাজ করার সুযোগ পেলেন এই প্রথমবার। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংকে ভিত্তি করে সেই তথ্যযজ্ঞ ও চিকিৎসা-গবেষণার কথা নাহয় আরেকদিন গুছিয়ে হবে?
কেউ কেউ নন, সকলেই গবেষক!
চিকিৎসাশাস্ত্রের এমনই নানান মেইনস্ট্রিম কাজের বিস্তার তো রয়েছেই, তবে সাধারণ আপাত ‘অ-গবেষক’ মননেও এই কোভিডকালে কীভাবে বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটেছে তার দু’কলি নমুনা না দিলে এ-আলোচনা অধরা থেকে যায়। নার্স, ডাক্তার কিংবা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্কজনিত যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে বার্নেস নামের তেরো বছরের এক ধুরন্ধর ছোকরা তৈরি করে ফেলেছে থ্রি-ডি প্রিন্টেড ইয়ার গার্ড। শুধুই তাই বা কেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিশ্চিত সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে তাইওয়ানের যে ডাক্তারবাবু ‘এরোসোল বক্স’ নামক এক ফুটো সমেত মুখ-ঢাকা বাক্স বানিয়ে গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিলেন তার কথাই বা বাদ রাখি কীভাবে? এই বাক্স রুগিকে পরিয়ে তারপর ফুটোর মধ্যে দিয়ে ওষুধপত্র প্রদান, বা সোয়াব টেস্টিংয়ের মতো কাজগুলো সারার ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে এসেছে। এমনই আরও নানান সহজ অথচ প্রয়োজনীয় সমাধান বের করেছেন আপাত অবৈজ্ঞানিক মানুষেরাই, এবং সে-সমস্ত একাধিক আবিষ্কার পেটেন্টেড হয়েছে ইউরোপ ও পৃথিবীর সর্বত্র। গোটা বিশ্বজুড়ে দেশভিত্তিক পেটেন্ট অ্যাপ্লিকেশনের হিসাবে গড়পড়তা ৩০-৫০% বৃদ্ধিই তার স্পষ্ট প্রমাণ (ইপিও বা ইউরোপিয়ান পেটেন্ট অফিসের ২০২১ সালের তথ্য)। সাধারণ মননে এর থেকে বৃহত্তর গণবিজ্ঞান পুনরাবর্তনের উদাহরণ বিগত ৫০ বছরে খুঁজলেও কি পাওয়া যাবে?
কাজেই বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে বা বলতে বসার উদ্দেশ্য মোটেই জ্ঞান বর্ষণ নয়, বরঞ্চ কিছু-মজার কিছু-কাজের কথা নিয়ে সকলের সাথে দু’দণ্ড আড্ডা দেওয়া, এই মাত্র ইচ্ছা। এরই মাঝে যদি দু’এক কলি নতুন কথা শোনাতে পারি তাতে আপত্তি যেমন নেই, শোনাতে না পারলে আনন্দ তার চাইতে ঢের বেশি। বৈজ্ঞানিক মেজাজের ছত্রছায়ায় আনন্দ ও মজা ভাগ করে নেওয়াটাই আসল কথা। আপনারাই আমাদের, বিজ্ঞানকর্মীদের পেডেস্টাল; রাজশেখর বসু যেমন বলেছেন, ‘সর্বভুক পাঠক হা করিয়া আছেন…!’ অন্যদিকে বিজ্ঞানকর্মীদের চাহিদা অল্পই। খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকার পোস্ট এডিটে বা ওয়েব পোর্টালে রাজনীতি-খেলাধুলো ইত্যাদি বিষয়ক লেখাগুলো যত তাড়াতাড়ি জায়গা করে নিতে পারে; তার ছিটেফোঁটা সুযোগ বিজ্ঞানের বরাতে জুটলেই যথেষ্ট। যারা সত্যই সহজলভ্য বিজ্ঞানকে আরও সহজ করে সকলের সামনে নিয়ে আসতে চাইছেন, বিজ্ঞানের গণতন্ত্রীকরণের কাজে সে-সুযোগটুকু পেতে আপনারা, পাঠককুল তাদের খানিকটা সাহায্য করুন। তারপর সে-ডিসকোর্স বিজ্ঞান হল না গণবিজ্ঞান হল, সে-বিচারের দায়িত্ব-দায়ভার তো আপনাদের হাতেই রইল। এই কোভিডকালে বিজ্ঞান আবার যেভাবে সাধারণ মননে ফিরে এসেছে, তা হতে যেন আমরা আবার বিস্মৃত না হয়ে পড়ি, এটুকুই চাওয়ার!