পাহাড়ের ওপার থেকে ভেসে আসছে শিবরঞ্জনী রাগ। নায়ক-নায়িকার ইহজন্ম আর পরজন্ম মিলিয়ে একাকার করে দিচ্ছে ‘মেরে নয়না শাওন ভাদো’। যুগ-যুগ পর তাদের পুনর্মিলন। চেহারা যদিও হুবহু আগের মতন। দর্শকরা আবেগমথিত, চোখ-ছলছল, তাদের মধ্যে আমিও। ঘণ্টা তিনেক বলিউডের সঙ্গে স্বপ্নে বুঁদ হয়ে ভাসতে আপত্তি নেই আমার। আর, অমরত্ব কে না চায়, হোক না শুধু আত্মার! জন্মান্তরবাদের স্বার্থে এমনকী এটা মানতেও আপত্তি নেই যে, স্বর্গীয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সল্টলেকে সম্প্রতি নিজের ভোট নিজেই দিয়ে গেছেন। আমার মানতে আপত্তি তখনই, যখন স্রষ্টার নাম সত্যজিৎ রায়। কারণটা সহজ। সত্যজিৎ আমাদের সকলের চোখে একজন যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল এবং চিত্রনির্মাতা হিসেবে বাস্তববাদী।
‘সোনার কেল্লা’র মূল বিষয় প্যারাসাইকোলজি। জাতিস্মরবাদ, সম্মোহনী-কলা (hypnotism), এবং টেলিপ্যাথি সেই মূল বিষয়ের উপাংশ। উপন্যাসটি সত্যজিৎ লেখেন যোধপুরের ‘রাজস্থান ইউনিভার্সিটি’র এক বাঙালি প্যারাসাইকোলজিস্টের গবেষণার একটি ‘ঘটনা’য় অনুপ্রাণিত হয়ে, সেই ভদ্রলোক নিজে সত্যজিতের বাড়িতে এসে গল্প করেন একটি ছোট ছেলের বিষয়ে, যে একটি জায়গার কথা বলত ‘পূর্বজন্মের স্মৃতি’ হিসেবে, গবেষক আন্দাজে ছেলেটিকে নিয়ে যান একটি জায়গায়, এবং ছেলেটির বর্ণনার সঙ্গে তা হুবহু মিলে যায়।
সত্যজিৎ যখন কিশোর, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া তখনকার কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৩০ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে প্যারাসাইকোলজির প্রবেশ। আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইন দম্পতি টেলিপ্যাথি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। সেই পরীক্ষা ছিল কিছু মানুষকে নিয়ে একে অপরের চিন্তা অনুমান করানো। সেই অনুমান-ক্ষমতাকে তাঁরা টেলিপ্যাথি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের গবেষণার পন্থা ছিল পুরোটাই অভিজ্ঞতামূলক (empirical)। ১৯৩৬ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডব্লিউ.এস.কক্স এবং ১৯৩৮ সালে মনোবিজ্ঞানী জোসেফ জাস্ত্র প্রশ্ন তোলেন রাইন দম্পতির সেই পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে এবং সেটিকে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক হিসেবে চিহ্নিত করেন। ঠিক একই সময়ে, সারা ভারত আলোড়িত হয় শান্তি দেবী নামক এক শিশুকন্যার দাবিতে। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে মথুরানিবাসী ব্যবসায়ী কেদার নাথের দশ বছর আগে মৃত স্ত্রী লুগড়ি দেবীকে তাঁর পূর্বজন্মের অস্তিত্ব হিসেবে শনাক্ত করেন। তাঁর দাবি এতখানি দৃঢ় ছিল যে, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও তাঁর পক্ষে গলা মেলান। এই সব ঘটনা এবং তার সংশ্লিষ্ট আলোচনা কিশোর সত্যজিৎকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল জানা নেই। তবে শুধু ‘সোনার কেল্লা’ নয়, সত্যজিতের ছোটগল্পের মধ্যেও আমরা দেখি ভৌতিকতার প্রতি তাঁর নিগূঢ় আকর্ষণ। ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’, ‘অনাথবাবুর ভয়’, অথবা ‘গগন চৌধুরী’র স্টুডিও’— একের পর এক ছোটগল্পে আমরা সেই আকর্ষণ লক্ষ করি।
১৯৭০ সালে ফোঁকে ইসাকসন-কে এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ বলেছেন, ‘I don’t disbelieve in things like spiritualism or séances, or planchettes or extrasensory perception… I have been reading a great deal about dreams, about memories, about ESP and rebirth and memory of previous birth and all that, and I can’t brush it all aside.’ আগ বাড়িয়ে তিনি এও বলেছেন, ‘I think at some point they are going to be explained by science.’ এই ভরসার কোনও ভিত্তি ছিল না, অনেকটা ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ গোছের। বিশ্বাসের সপক্ষে তিনি তাঁর বাবা সুকুমার রায় এবং রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি অভিজ্ঞতাও উল্লেখ করেছেন। ‘In 1960, when I was doing research on Tagore for the documentary I made about his life, I was given access to all his manuscripts, everything… I came across sheets of paper that recorded conversations that took place at three separate séances arranged by Tagore. Apparently he was a great believer in these things.’ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কল্পনার সাধক। ১৯৩১ সালে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত আলোচনাতেই আমরা দেখি কীভাবে তাঁর কাছে কল্পনাই সত্য হিসেবে ধরা দিয়েছিল। সেখানে তিনি বলছেন, ‘The infinite personality of Man comprehends the Universe. There cannot be anything that cannot be subsumed by the human personality, and this proves that the Truth of the Universe is human Truth.’ এহেন মানুষ নিখাদ বাস্তবের বাইরেও সত্যকে খুঁজে পাবেন, বলাই বাহুল্য।
জন্মান্তরবাদ মূলত প্রাচ্যের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই উদ্ভূত। সেসব ধর্মের আর পাঁচটা রীতি-নীতি, সংস্কারের প্রতি ‘দেবী’, ‘সদ্গতি’, ‘মহাপুরুষ’, বা ‘গণশত্রু’র সত্যজিৎ অনেক নির্মম, আপোসহীন। ধার্মিক বাবাজিদের প্রতি শ্লেষাত্মক, সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি ক্রুদ্ধ। সেই ক্রোধ আমরা দেখি ‘সদ্গতি’-তে, অনেকের মতে যা তাঁর সবচেয়ে সাহসী ছবি। তার মুক্তিকালে তিনি বলেছেন, ‘Deliverance (Sadgati) is a deeply angry film, but it is not the anger of an exploding bomb, but of a bow stretched taunt and quivering.’ অর্থাৎ, শাণিত বাণের মতোই সে-ছবির ধার। বিভিন্ন ছবিতে তাঁর এই বাণের লক্ষ্য ছিল মিস্টার ভার্গব, কালীকিঙ্কর রায় প্রমুখ রক্ষণশীলতার রক্ষাকারীরা। এবং পরোক্ষভাবে হয়তো এমনকী শ্রীরামকৃষ্ণও। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সহধর্মিণীকে কালীরূপে পুজো করেছিলেন— এই ঘটনার সঙ্গে ‘দেবী’ ছবিতে পূত্রবধূকে শ্বশুরের দেবীরূপে পুজো করার মানসিকতার সাদৃশ্য অ্যান্ড্রু রবিনসন ‘Satyajit Ray: The Inner eye’-এর নবম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। আবার, সারদামণি রামকৃষ্ণের পদসেবা করার সময় রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করছেন তিনি সারদামণিকে কীভাবে দেখেন, এবং রামকৃষ্ণ বলছেন মন্দিরে যে মা রয়েছেন, যে মা তাঁকে জন্ম দিয়েছেন, তিনিই তাঁর পদসেবা করছেন— এর সঙ্গে ছবিতে যে-দৃশ্যে দয়াময়ী শ্বশুরের পদসেবা করছে, তার মিলের কথাও অ্যান্ড্রু লিখেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি বাঙালি হিন্দুদের প্রশ্নাতীত ভক্তি এবং ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে মাথায় রাখলে, ‘দেবী’ও অত্যন্ত সাহসী ছবি।
তাহলে ধর্ম সম্পর্কে সত্যজিতের অবস্থান কী ছিল? কৈশোরে ব্রাহ্মসমাজের অভ্যন্তরে যাতায়াতের সুবাদে তিনি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু জাঁ লুক গোদারের মতো ঈশ্বর নিয়ে তাঁর কোনও নির্দিষ্ট অবস্থান আমরা পাইনি। তিনি নিজেকে সংগঠিত ধর্মের (organized religion) বিরোধী এবং অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) বলে স্বীকার করেছিলেন। ঈশ্বরের প্রশ্নে ‘আগন্তুক’ ছবিতে উৎপল দত্তের মুখ দিয়ে বলেছেন, ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ। কে দেবে এই আলো, কে দেবে প্রাণ?’ অর্থাৎ সোজাসুজি হ্যাঁ বা না নয়, একটু ঘুরিয়ে বর্তমানের প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের সীমাবদ্ধতা বা অক্ষমতাকে তিনি তুলে ধরেছিলেন। অনেকের চোখে হয়তো এটা সযত্নে এবং সুকৌশলে প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাওয়া। অরসন ওয়েলস এ-ব্যাপারে যেমন ছিলেন একদমই চাঁচাছোলা: ‘I have a great love and respect for religion, great love and respect for atheism. What I hate is agnosticism, people who do not choose.’
বাস্তবতা বা রিয়ালিজমের নিরিখে ‘সোনার কেল্লা’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বভাবিক। মুকুলের পুনর্জন্ম যদি মেনে নেওয়া যায়ও, আলাউদ্দিন খলজির সঙ্গে রাজপুতদের যুদ্ধ তো সাত শতক আগে, তার স্মৃতি বয়ে বেড়ানো যুক্তির হিসেবে তুলসীপাতার পরিশোধনক্ষমতার থেকে কয়েকগুণ অলীক! বরঞ্চ, ‘নায়ক’ ছবিতে তাঁরই নির্দেশিত সংলাপে আমরা পাই উল্টো ছোঁয়া— ‘আমি যে আমি, সেটা পরজন্মে আমি বুঝব কী করে?… মার্কস আর ফ্রয়েডের যুগ ভাই।’ ‘সোনার কেল্লা’র আর পাঁচটা দৃশ্য ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর মতো কাল্পনিক হলে শিশুসাহিত্য (বা শিশু-চলচ্চিত্র) হিসেবে এই অলীকতা মেনে নেওয়া হয়তো সহজ হত। তবে পাল্টা তর্ক উঠতেই পারে, সত্যজিৎ রায় ছাড়া কি আর কেউ বাস্তবের পটভূমিকায় আত্মা বা অলৌকিকতা নিয়ে ছবি বানাননি? অবশ্যই বানিয়েছেন। মনমোহন দেশাই আর রামগোপাল ভার্মাদের কথা বাদই দিলাম, মনোজ নাইট শ্যামলন-এর ‘দ্য সিক্সথ সেন্স’ বা আলেহান্দ্রো আমেনাবার-এর ‘দ্য আদার্স’ জাতীয় প্রচুর ছবিও তো আছে। কিন্তু তাঁদের কাজে সামগ্রিকভাবে কোনও স্ববিরোধিতা নেই। এখানেই সত্যজিৎ অনন্য। তাঁর ছবিতে তিনি অজ্ঞেয়বাদী, প্রগতিশীল, অথচ জন্মান্তরবাদী। আপাতভাবে অনেকটা চন্দ্রবিন্দুর চ, রুমালের মা আর বিড়ালের তালব্য শ-এর মতো ঘেঁটে-যাওয়া। হয়তো তাঁর নিজস্ব যুক্তিতে পুনর্জন্মকে মান্যতা দিয়েও তিনি তার সঙ্গে কর্মফল বা তার অনুসারী শোষণের সূক্ষ্ম প্রভেদ টেনেছিলেন। অর্থাৎ পুনর্জন্ম পর্যন্ত ঠিক আছে, তার চেয়ে কয়েক পা এগিয়ে জাত-বর্ণ এবং কর্মফল জুড়লেই নিষিদ্ধসীমা লঙ্ঘন। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ কিন্তু এই ব্যাপারে এতটা ক্ষমাশীল নয়, বিশেষ করে হিন্দুধর্মের প্রতি। তাদের কাছে পরজন্ম এবং কর্মফল একই সরলরেখার দুই বিন্দু, এবং গোমূত্র দিয়ে করোনা তাড়ানোর সঙ্গে তুলনীয়।
২
জয়সলমীর থেকে আসা যাক কাশীতে। ‘অলিগলি চলি রাম, ফুটপাথে ধুমধাম, কালি দিয়ে চুনকাম।’ ছবির ধুমধামের মধ্যে চুনকাম এটাই যে, আসল গণেশমূর্তি কখনও ঘোষালবাড়িতে ছিলই না, তাই খাতায়-কলমে অপরাধের আর্থিক মূল্য হত দু’হাজার টাকা, যদি না নকল গণেশ নিয়ে দাদু-নাতির খেলায় প্রাণ দিতে হত বছর-সত্তরের এক বৃদ্ধকে। শশীবাবু কয়েক দশক ধরে ঘোষালদের ঠাকুর বানাতেন, অথচ সেই মৃত্যু নিয়ে ছবিতে সকলে নির্লিপ্ত, অনুতাপহীন। মানুষ কি এতটাই পরিহার্য, আর একটা গোটা পরিবার কি এতটাই হৃদয়হীন যে, খুনের ২৪ ঘণ্টা পার হতে-না-হতেই আরেক সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ হেসে জাহির করলেন, ‘শুনলেন তো বুড়োর কীর্তি?’ ফেলুদা নীতি ও ন্যায় নিয়ে এত সজাগ, অথচ তাঁকেও আমরা এই প্রায় অহেতুক (বা আরও খারাপ: একটা খামখেয়ালি ‘খেলা’-র দরুন) এক নিরীহ মানুষের হত্যা নিয়ে উত্তেজিত হতে দেখলাম না? হয়তো কাছাকাছি কোনও সচেতন নারীচরিত্র থাকলে, তিনি এই প্রশ্নটা তুলতেন! আসলে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অন্তরাত্মা বা বিবেকের ভূমিকায় সবসময় দেখা গেছে নারীদের। ‘জন অরণ্য’ ছবিতে বৌদি কমলা, ‘সীমাবদ্ধ’-এ শ্যালিকা টুটুল, ‘নায়ক’-এ সহযাত্রী অদিতি। কিন্তু পুরুষবহুল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ সেই নির্লিপ্ততায় আঁচ বা নিষ্ঠুরতায় প্রলেপ দেওয়ার নারীচরিত্র কোথায়? সারা ছবিতে দুজন মাত্র নারী— উমানাথ ঘোষালের স্ত্রী এবং মছলিবাবা’র মঞ্চে ভজন-গায়িকা। দুজনেই নামহীন, দুজনেরই কয়েক মিনিটের ভূমিকা। ‘সোনার কেল্লা’র ক্ষেত্রেও হুবহু তাই। তোপসের মা এবং এক রাজস্থানি লোকগায়িকা ছাড়া কোনও নারীর উপস্থিতি নেই। আর ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তো নারী সাহারায় সীতার মতোই অগোচর। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ নারী আছে বটে, কিন্তু তাদের ভূমিকা ফুলদানির মতোই।
এমনিতে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে নারীচরিত্র অপ্রতুল নয়। সেগুলোতে সংখ্যার ভারের চেয়ে ব্যক্তিত্বের ধার বেশি। ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’র সর্বজয়া, ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা, ‘মহানগর’-এর আরতি, ‘চারুলতা’র চারুলতা, ‘দেবী’র দয়াময়ীদের নিয়ে সমুজ্জ্বল সেই তালিকা। কোমল নারীমাত্রেই কোনও পুরুষে (বা পুরুষতন্ত্রে) সমর্পিত-প্রাণ, বলিউডি এই ধারণা এবং ঘরানা থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন সত্যজিৎই। এবং সেই কোমলতা এবং স্নিগ্ধতার চ্যুতি না ঘটিয়ে। ‘মহানগর’-এ আরতি থেকে মিসেস মজুমদার— কেন্দ্রীয় নারীচরিত্রের এই অমসৃণ উত্তরণের মধ্যে দিয়ে তিনি দেশভাগ-পরবর্তী সংগ্রামকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন; আমরা কদর করতে শিখেছিলাম বাড়ির চৌকাঠ পেরোনো আমাদের মা, মাসি, পিসিদের। শুধুমাত্র একটি দূরবিনের মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছিলেন চারুলতার মতো হাজার-হাজার নিরুদ্ধ হৃদয়কে। ‘দেবী’র শেষ দৃশ্যে দয়াময়ীকে কুয়াশায় বিলীন করেও আমাদের কাছে আদতে বৃহত্তর করে তুলেছিলেন, ‘Wonder Woman’ বা ‘Star Wars: The Force Awakens’-এর প্রকট নারীবাদকে সম্বল না করে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘I find women more interesting. In my experience, I have found that women, by and large, have a stronger fiber, they have a stronger character spine. Possibly because nature has made them physically less strong, they have been endowed with stronger character, with more integrity.’
এহেন সত্যজিৎ শিশুদের ছবিতে নারীদের ব্যাপারে এত অনুদার ছিলেন কেন? এর একটি কারণ সত্যজিৎ নিজেই বলেছিলেন— তিনি ভাবতেন নারীর উপস্থিতি মানেই প্রেম, প্রণয়, বিরহ— যেগুলো থেকে শিশুদের দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। এই চিন্তাধারা নিঃসন্দেহে রক্ষণশীলতায় জারিত; তবু শিশু-উপযোগী শিল্প-সাহিত্যের খাতিরে সেটা যদি মেনে নেওয়াও যায়, জনসংখ্যার বিচারে সেটা শনিবারে-শনিবারে ফুল ধরার মতোই অবাস্তব। মূল চরিত্র তো দূরঅস্ত, তাঁর মতো রিয়ালিস্টের ক্যামেরায় কাশীর বেঙ্গলি লজ বা যোধপুরের সার্কিট হাউসে একজন নারীরও দেখা মিলবে না? আর প্রেম, প্রণয় তো পরিণতদের ব্যাপার, তা শিশু বা কিশোর চরিত্রের নির্ণায়ক হবে কেন? ‘পথের পাঁচালী’-র দুর্গা এবং ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতনের বাইরে তাঁর মূল চরিত্রে কোনও কিশোরী নেই। এবং এই দুটোও আবার রয়েছে মূল সাহিত্য-উৎসটির বাধ্যবাধকতায়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় জনৈক কন্যাসন্তানের দেখা মিললেও, বাকি ছবিগুলিতে বিরল। তবে কি তিনি কিশোর চরিত্র নিয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন? সেটা কি নিছকই পরিচালনা আর অভিনেতা নির্বাচনের সুবিধার্থে? এমনকী কিশোর চরিত্রগুলিও সব একই ধাঁচে তৈরি। এটা দর্শকের মনে হতেই পারে যে, ‘আগন্তুক’-এর সাত্যকি, ‘সোনার কেল্লা’র মুকুল, ‘শাখা প্রশাখা’র ডিঙ্গো, বা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর রুকু আসলে সত্যজিতের নিজের সত্তারই প্রতিরূপ।
তবে শিশুসাহিত্যে বা চলচ্চিত্রের চরিত্রে মেয়েদের ব্রাত্য রাখার দোষ যে সত্যজিতের একার নয়, সেটা সম্প্রতি আমেরিকার প্রিন্সটন এবং এমোরি ইউনিভার্সিটি’র যৌথ গবেষণা ‘Sixty years of gender representation in children’s books: Conditions associated with overrepresentation of male versus female protagonists’ থেকে পাওয়া যায়। গবেষণার ফলানুযায়ী, গত ছ’দশকের শিশুসাহিত্যে পুরুষ এবং নারী চরিত্রের অনুপাত ৩:১। ইদানীং বৈষম্যের মাত্রা হ্রাস পেলেও, রয়ে গিয়েছে। ‘In conclusion, our analysis of the frequency of male and female central characters clearly demonstrates that although female representation has improved over the last 60 years, parity has not yet been achieved in all types of books or by all authors.’ এমনকী হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে.কে.রাউলিং-এর মতো প্রভাবশালী লেখিকাও এই দোষে দুষ্ট। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর প্রকাশকেরা ব্যবসার স্বার্থে তাঁকে মূল শিশুচরিত্র পুরুষ করতে বাধ্য করেছিলেন। অতএব, ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে সত্তরের দশকে এই বৈষম্যের মাত্রা আরও প্রবল ছিল, এবং সত্যজিৎও ব্যতিক্রমী ছিলেন না।
পরিশেষে যা দাঁড়ায় সেটা হল, সত্যজিৎ রায় যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল হলেও সেই যুক্তিবাদ ও প্রগতিশীলতা ছিল সংযত ও পরিমিত। আমার ধারণা: অধিকাংশ দর্শকের কাছে সেই পরিমিতি তাঁর বাস্তবতা এবং সুষমতার পরিচয়। তবুও অনেকের কাছেই তা সীমাবদ্ধতা বা সাহসের অভাব হিসেবে পরিগণিত হতেই পারে। এই দ্বন্দ্বে উনি নিজেই হয়তো নিজেকে বলতেন, ‘মশাই, আপনাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে!’ তাঁর শতবর্ষে অন্ধ অনুরাগে গা না ভাসিয়ে, সেই কর্ষণ বা কাল্টিভেশনই তাঁর কাজের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধার্ঘ।