সুনীল জলের নেশা
তখন, সত্যি বলতে কী, রোদ্দুরও বেশ অন্যরকম ছিল। কেমন যেন গায়ে-পড়া, কিন্তু গায়ে লাগত না। উত্তাপ ছিল তার বটে, আঁচ ছিল না মোটেই। তাকে হাতের পাতায় নিয়ে খেলানো যেত। কপালের ঠিক মাঝখানে রাখা যেত ছটফটে ফুটবলের মতোই, অথবা বুক পেতে ধরে নেওয়া যেত তার ফালি। তীক্ষ্ণ, অথচ আদুরে। সেইরকমই রোদ উঠত তখন, দোলপূর্ণিমার সকালে, শান্তিনিকেতনে।
শান্তিনিকেতন বিষয়টা আমার জীবনে এসেছিল কবিতার হাত ধরে। প্রথম সেখানে যাওয়া এবং কবিতা পড়া, কৈশোর পার করে এসব যখন হচ্ছে, তখন পরতে-পরতে ভাললাগা তৈরি হচ্ছে আকারে ছোট কিন্তু মননে বিস্তৃত সেই জনপদ ঘিরে। তার পড়ন্ত দুপুরের বীথি ডেকে নিচ্ছে কাছে, তার বিকেলের নদীপাড় খুলে দিচ্ছে আগল, তার রাত্তিরের জোনাকিঝাঁক তৈরি করছে অলৌকিক লণ্ঠন। মোট কথা, কলকাতা থেকে কিছুমাত্র দূরে এমন একখানা জায়গা যে থাকতে পারে, সে-ধারণা আমার ছিল না। শুনেছি কতই তার নাম, রবি ঠাকুরের দৌলতে। কিন্তু কেমন জায়গায় থাকতেন তিনি, কেমন জায়গায় পড়াতেন সকলকে, সেইটা দেখবার পর বুঝলাম, কেন এ-জায়গা সকলের থেকে আলাদা।
টান তৈরি হল বটে একখানা, কিন্তু তখনও দোলে শান্তিনিকেতন দেখিনি। সে যে এক মিথ, সে যে এক আশ্চর্য হাতছানি, এটুকুই শুনেছি। এবং দেখেওছি চেনা পরিচিতদের অনেককেই, দোলের দিন এগিয়ে এলেই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে শান্তিনিকেতন পাড়ি দিতে। কিন্তু কেন সেই অমোঘ টান, তা বুঝিনি। কেননা আমার জন্য সেই টান তৈরি করবেন একজন অলীক মানুষ, আর তাঁর সঙ্গে পরিচয় হতে তখনও বেশ কয়েক বছর দেরি আছে।
পরিচয় হতে অবশ্য আমার চারপাশের চেনা দুনিয়াটাই বদলে যেতে থাকল একটু-একটু করে, কেননা তাঁর চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখতে চাওয়ার একখানা অদম্য নেশা তৈরি হয়েছিল আমার মধ্যে। হয়তো আমাদের অনেকের মধ্যেই, আমরা যারা লেখালেখির চারপাশে এমনিই ঘুরঘুর করতাম তখন। তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নিজের চাইতে কমবয়সিদের সঙ্গে যে বয়স কমিয়ে নিয়ে মেলামেশা করা যায়, তা এই মানুষটিকে, এই কবিকে না দেখলে জানা হত না আমার। সেসব গল্প বরং পরে কখনও হবে, আজ বরং কেবল দোলের গল্পই বলি।
সেবার ঠিক হল, দোলে শান্তিনিকেতনে আমরাও যাব সুনীলদা-স্বাতীদির সঙ্গে। ওঁরা প্রতিবারই যেতেন, শান্তিনিকেতন ওঁদের পুরনো প্রেম। কিন্তু সব বার এমন দল বেঁধে নয়। সেবার হঠাৎ সকলের মাথায় কী পোকা ঢুকল, দোলে আর কলকাতায় থাকতেই চাইল না কেউ। কেউ মানে, এই আমরা কয়েকজন যারা ওঁদের ঘিরে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম দৈবাৎ। তো, কেউ-কেউ টিকিট কেটে নিল ট্রেনের, যাদের গাড়ি আছে, চেপে পড়ল হাইওয়ের পিঠের ওপর। সেবার আমরা, মানে আমি আর দূর্বা ভারি বাড়তি খাতির পেয়েছিলাম। কেননা, আমরা তখন সদ্য বিবাহিত। স্বাতীদি আর সুনীলদা ঠিক করলেন, আমরা দুজন ওঁদের গাড়িতেই যাব এবং ওঁদের বাড়ির একতলার সুন্দর ঘরটায় থাকব।
কী যে সুন্দর সেই বাড়ি ওঁদের! নাম: ‘একা এবং কয়েকজন’। সেবার দোলে সেই নামকরণ সার্থক করে আমরা সক্কলে তাঁবু ফেললাম সেই বাড়ির বারান্দায়। একদিকে বাগান, আরেকদিকে মস্ত পুকুর, মাঝখানে মাথা-তোলা দোতলা বাড়িখানা। আমাদের তো থাকার চিন্তা নেই, কাঁধের ব্যাগদুটো সুনীলদা-স্বাতীদির ঘরে নামিয়ে রেখেই নিশ্চিন্ত। বাকি তরুণ কবিদের দলবল এদিক-সেদিক নিজেদের আস্তানা পেতেছে। সে অবশ্য নামেই আস্তানা, কেননা সকাল থেকে মধ্যরাত তো কেটে যাচ্ছে সুনীলদার সঙ্গ করে। কেবল বালিশে মাথা ঠেকানোর জন্য অন্য ঘর নেওয়া, এই আর কী!
দোলের সকালে বেরোনো হল দল বেঁধে। সুনীলদা চমৎকার সাদা পাঞ্জাবি পরেছেন, স্বাতীদি সেজেছেন ভারি সুন্দর। আমরা সকলে হাঁটছি রঙিন রোদ মাথায় নিয়ে, প্রান্তিক থেকে আম্রকুঞ্জের পথে। হাঁটছি বললাম, যদিও দু’পা হেঁটেই দাঁড়াতে হচ্ছে, কেননা চেনা-অচেনা মানুষজন সুনীলদা আর স্বাতীদিকে দেখে আবির দিতে এগিয়ে আসছেন। তাঁদের চুল থেকে পা ভরে যাচ্ছে দোলের রঙে, মানুষের ভালবাসার আবিরে। এই দৃশ্যের মধ্যে কী যে এক প্রশান্তি ছিল, আজ আর তা ব্যাখ্যা করে উঠতে পারি না। ওঁদের সঙ্গে দেখে আমাদেরও রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন মানুষজন। অচেনা-অজানা মানুষের স্পর্শেও এত মায়া থাকতে পারে, দোলের আবির না-চিনলে তা জানা হত না আমাদের। আমরাও কি ছাড়ছি? আমাদেরও হাতে-হাতে আবিরের ঠোঙা, সেসব থেকে উজাড় করা রংকুয়াশা ছিটকে পড়ছে শান্তিনিকেতনের ঝকঝকে রোদ্দুরে, হাওয়ায়।
অনেকখানি হেঁটে গাছের ছায়ায় জিরানো। স্বাতীদি অবশ্য এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কিছু দূরে আবাসিকদের নাচগান চলছে, সেদিকেও গুটি গুটি পায়ে জড়ো হল অনেকেই। আমি আর দূর্বা অবশ্য সুনীলদার ছায়া ছাড়লাম না। বিশাল আমগাছের ঠান্ডা ছায়ার তলায় আরেকজন ছায়ামানুষ বসে তখন। তাঁর সারা শরীর থেকে তখন আবিরের গোলাপি গুঁড়ো ঝরে পড়ছে মাটিতে, যেন সময়ের শরীর থেকে আয়ুর ফোঁটা। কত মানুষ এসে দেখা করছেন তাঁর সঙ্গে, সকলের দিকে একই রকম হাসিমুখ নিয়ে তাকাচ্ছেন সুনীলদা। আর দোলের ওই চড়া রোদের তাপে তাঁর বয়স গলতে-গলতে কমে দাঁড়াচ্ছে সাতাশে। আমাদের চোখের সামনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রূপান্তরিত হচ্ছেন নীললোহিতে।
বাড়ি ফিরতে-ফিরতে বেলা একটা বাজল। সকলে মিলে বসা হল ‘একা এবং কয়েকজন’-এর বারান্দায়। উৎপল আর ধনঞ্জয়, ওঁদের বাড়িঘরের দেখভালের ভার এই দুজনের উপরেই থাকত। আমরা হাজির হওয়া মাত্রই গরম-গরম মাছভাজা এসে উপস্থিত। সে অবশ্য উপলক্ষমাত্র, আসলটা সুরা। ছুটির দিন দুপুরে ভদকা ছিল সুনীলদার প্রিয় পানীয়, স্বাতীদিও ভারি ভালবাসতেন। আমাদেরও আড্ডার দুপুরগুলোয় তেমন অভ্যেস হয়ে গেছিল। তবে দোলের কথা আলাদা, সেদিন নিয়ম মানলে রঙের অসম্মান করা হয়। তাই শুরু হল পাত্রে-পাত্রে স্বচ্ছ পানীয়ের ঢেউ। সুনীলদার নিজস্ব কায়দা ছিল একখানা, ভদকা পানের। এক কোয়া পাতিলেবুর রস প্রথমে ভদকায় মেশানো, তারপর একখানা কাঁচালঙ্কা মাঝ বরাবর চিরে দিয়ে গ্লাসে ফেলে দেওয়া। যেন হ্রদে ডিঙি নৌকা ভাসছে। সেই ঝালনোনতা নেশা যখন গলা দিয়ে নামত, অদ্ভুত এক ঝাঁঝালো তৃপ্তি উশখুশ করে উঠত। আর সুনীলদা শান্তিনিকেতনে গেলে অন্য মানুষ। ধুলো আর পথ তাঁর সঙ্গ ছাড়তে চাইত না সেখানে। তাই এক-দু’পাত্রের পর শুরু হত গান। কখনও রবি ঠাকুরের, কখনও লালন শাহের। যৌবনে সুনীলদাও বেঁধেছিলেন কয়েকখানা গান, আমাদের উপরোধে কিঞ্চিৎ লজ্জা-লজ্জা মুখে সেসবও শোনাতেন।
সেবার দোলের দিন সূর্য ঢলে আসা অবধি চলেছিল পান আর গান। ভারি এক ঝিম আর আমেজ এসে জাপটে ধরেছিল। কখন যে এলিয়ে পড়েছিলাম পাশের ঘরের বিছানায়, খেয়াল নেই। ঘুম ভেঙেছিল সোজা অন্ধকারে, ঝিঁঝির ডাকে। সেদিন দুপুর থেকে বারান্দার মেঝে ছেয়ে গেছিল গোলাপি রঙের ছায়ায়, যেন সন্ধে আগাম তার রং পাঠাচ্ছে। এর পরেও দোলে বেশ কয়েকবার গেছি সেখানে, কিন্তু এমন রঙিন স্মৃতি আর কখনও তৈরি হয়নি।
এত যে সাত কাণ্ড রচনা করলাম, তার কারণ একটাই। সুনীলদা চলে গেছেন বহু বছর হল, দোলে আর শান্তিনিকেতন যেতে পারিনি তারপর থেকে। নেশায় আর গানেও মেতে ওঠা হয়নি। এই বছর দোলে, আমি আর দূর্বা বড়দের পায়ে-পায়ে আবির দিয়ে বেড়াচ্ছি, আটকে গেলাম ওর মাসি আর মেসোর বাড়িতে। দেরাজ থেকে ভদকা বার হল, কড়াইয়ে চাপল মাছ ভাজা। এত বছর পর, আবার সেই এক উপকরণ। লোভ সামলাতে পারলাম না। পাতিলেবুর রসের ছিটে আর কাঁচা লঙ্কার ডিঙি নৌকাকে ভরসা করে পাড়ি দিলাম তিন পাত্রের হ্রদ সফরে। কিন্তু বলার কথা এইটাই যে, এক ফোঁটাও নেশা হল না। অথচ কোথাও আয়োজনের কমতি কিছু নেই। বরং ফিরে এসে সারা দুপুর কাজ করলাম, লিখলাম। একবারও আমেজে জড়িয়ে এল না চোখ, সেবারের দোলের দুপুরবেলার মতো। তারপর, যখন বিকেল গুটিয়ে নিচ্ছে তার ডানা, বুঝলাম, নেশা আসলে পানীয়ে থাকে না, সঙ্গের মানুষটার মধ্যে থাকে। আমাদের নেশা ছিলেন সেই অলীক মানুষ, নীললোহিত। কেবল সুরায় আজ আর দোলের রং লাগে না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র