রিল করি কিন্তু ফিল করি না
নেটফ্লিক্স-এ একটি কোরিয়ান সিরিজ মুক্তি পায় কিছু মাস আগে, নাম ‘স্কুইড গেম’। গল্পে দেখা যায়, একটি অনামী সংস্থা থেকে বেশ কিছু অসহায় মানুষকে (যারা টাকা ধার নিয়ে শোধ দিতে পারেনি) আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কয়েকটা খেলার প্রতিযোগিতায়। পুরস্কারে কিছু টাকা জেতার সুযোগ আছে। মানুষগুলি দেনায় ডুবে, তারা পুরস্কারের বিরাট অঙ্কের টাকার লোভে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে ক্রমেই দেখা যায়, খেলাগুলো সহজ হলেও, যে হারবে তার পরিণতি হল মৃত্যু। নিজেকে বাঁচানোর জন্য তখন সবাই লড়তে থাকে— খুন, চক্রান্ত, দল-ভাগাভাগি, সবকিছুই হয় শুধু বেঁচে থেকে খেলার শেষ দেখার জন্য, যেখানে অপেক্ষা করছে অনেক টাকা।
পুরো গল্পটায় রয়েছে সমাজব্যবস্থা, সাম্য, নৈতিকতার কথা। এক ভয়াবহ বাস্তবের ছবি এঁকে, কোরিয়ার মানুষের অবস্থান ও তাদের সমাজব্যবস্থার কথা এই অনুষ্ঠান পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর মানুষের কাছে। মর্মান্তিক সেই সত্যির চেহারা। স্তম্ভিত সারা বিশ্ব। সিনেমার ছাত্র ও শিক্ষকরা বলছেন, এই কাজের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। তীব্র ছাপ ফেলে যায় এর বাস্তবতা ও প্রাসঙ্গিকতা। যুক্তিবাদী, বুদ্ধিমান, সহানুভূতিশীল মানুষ এই কাজ দেখে আশ্চর্য।
উল্টো দিকে আরেক পৃথিবী। সোশ্যাল মিডিয়ার। যেখানে এই অনুষ্ঠানের খুনের দৃশ্য, মানুষের নিরুপায় মৃত্যুর দৃশ্যগুলোর আকারে বানানো হচ্ছে মজার ‘ক্লিপিং’। তৈরি হচ্ছে ‘রিলস’ ও অনলাইনে ‘গেমস’। আপনি বাড়িতে বসে সেই খেলা খেলতে পারেন ও তার ভিডিও প্রকাশ করতে পারেন আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায়। কারণ আপনি খেলায় হারলে মরবেন না, লাইক কম পড়বে। যে কোরিয়ার মানুষের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির আতঙ্কজনক চিত্র ছিল এই নির্মাণে, সেগুলো এখন মোবাইলে গেম হিসেবে খেলা হচ্ছে। তাই এই নির্মাণের আসল দাগ ডাস্টার দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে, আজ সকলই সুন্দর। ছবিতে ফিল্টার, খিস্তিতে গান, বক্তব্যে মধু। যে স্বাধীনতা দিনে এক-জিবি ইন্টারনেট আমাদের এনে দিয়েছে, তাকে ঠিক কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে এখনও প্রবল ভ্রান্তি। সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া তথ্য বা ছবি বা ভিডিও বা কথা নিয়ে খাব না মাথায় দেব, কেউ বুঝতে পারছি না।
তাই এই চূড়ান্ত গন্ডগোলের মধ্যে আমরা ভুলেই গেছি, ভাল আর খারাপের সীমারেখাগুলো। কোন খবরে আনন্দ পেতে হবে, কোনটায় দুঃখ, সেটাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে মোবাইলের স্ক্রিনের হালফিলের আদব-কায়দা। অনুভূতিকে ছাপিয়ে গেছে অনুভূতি প্রকাশ ও প্রমাণ করার দায়। কে সিনেমা দেখে কীভাবে কাঁদল, তা জানাতে হবে আরও ২৮০ জনকে, বইয়ের দু’পাতা শেষ হতে না হতেই সেই বইয়ের আগাগোড়া বিশ্লেষণ করে পোস্ট করতে হবে— এসব তো লেগে আছে দীর্ঘদিন। আমার জীবনের মান বাড়ছে, উপার্জন বাড়ছে, ভাল খাচ্ছি ইত্যাদি জাঁক করে দেখানোর অভ্যাসটা মানবজাতির ছিলই চিরদিন, এখন ডানা মেলে উড়েছে।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটছে কয়েক বছর ধরে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এখন ছোট আকারে প্যারাডাইস দেখা যাচ্ছে। এমনভাবে মানুষ ভিডিও বানাচ্ছেন বিভিন্ন গম্ভীর ও প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে, দেখে মনে হচ্ছে, ‘সব ঠিক হ্যায়!’। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া থেকে মানবাধিকারের লড়াই— সবকিছু নিয়েই কম বেশি খিল্লি লেগেই আছে। এইটা যখন মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে দেখা যায়, তখন বুঝতে হয়, রাষ্ট্রীয় লুকোচুরি-ধাপ্পাখেলা এখন প্রযুক্তির সঙ্গে এমন হাত মিলিয়েছে যে, আগুনের গোলা পড়লেও আবহসঙ্গীতের সাথে নায়িকা দৌড়ে আসতে পারে। নেতা-মন্ত্রীদের নাহয় অভ্যাস আছে হাজারও গন্ডগোলের মধ্যেও ‘সব ভাল আছে’ বলে চলার। প্রযুক্তির অগ্রগতির দৌলতে এখন দেশের সাধারণ মানুষ সেই দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। মানুষের অস্তিত্ব যতই খর্ব করা হোক না কেন, সামাজিক মাধ্যমে শুধুই উল্লাস, উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা, উদযাপন— কোনও কারণ ছাড়াই।
মৃত্যুতে গভীর ভাবে কষ্ট পেতে তাহলে আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম? মানুষের মৃত্যুর পর একটা ‘রেস্ট ইন পিস’ এবং ছবি প্রকাশ করেই শোকপালন করা কি বাধ্যতামূলক হয়েছে? হাজারে হাজারে মানুষ মারা গেলে সেটা নিয়ে তক্ষুনি চারটে শব্দ লিখতেই হবে— এইটুকু আমাদের দায়? গভীরতা, সারা অন্তর দিয়ে অনুভব করা তো দূরের কথা, আরেকজনের ব্যক্তিগত অবস্থানকে সম্মান করাও আস্তে আস্তে চলে যাবে। পড়ে থাকবে অন্তঃসারশূন্য কথা, প্রলেপ দেওয়া অনুভূতি। আমাদের পরিণতি বিলিতি পরিচালক চার্লি ব্রুকার নির্মিত ‘ব্ল্যাক মিরর’ সিরিজের মানুষগুলোর মতো হতে বেশিদিন বাকি নেই।
আজকাল নতুন একটি ব্যাপার এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, নাম হল ‘রিল’— অর্থাৎ ছোট ভিডিও, সঙ্গে গান, নাচ বা বাজনা, যাতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। সেই রিল যখন বাজারে এল, তখন কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন ‘রিল করো, ফিল করো’— আপনার সৃষ্টিতে অনুভূতি ও আবেগের সততা রাখুন। তবে প্রথমটাই হচ্ছে, পরেরটা নেই। ঠিক যেমন কথায় আছে না, ‘ফিল’ পাচ্ছি না।