ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • কাছে যেও না, খিমচে দেবে


    সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (November 6, 2021)
     

    কাছাকাছি গেলেই একটা বিটকেল গন্ধ আসছে। পাজামার দড়িটা প্রায় মাটিতে লুটোচ্ছে। পাজামাটাও তেমনই নোংরা। গায়ে একটা হাফহাতা শার্ট। বয়স বছর চল্লিশ তো হবেই। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিয়ে মুছে নিচ্ছে। সেই লালা শুকিয়ে কষ হয়ে জমে আছে ঠোঁটের দুপাশে। কতদিন দাঁত মাজেনি কে জানে? চুলেও মনে হয় চিরুনি পড়ে না। ছোট বাচ্চার মতো হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, যখন সিঙাড়ার প্লেটটা এগিয়ে দেওয়া হল। খাবলা করে নিয়ে গরম সিঙাড়া মুখে পুরেই থু-থু করে ফেলে দিল। জিভে গরম লেগেছে যে! তারপরেই সে কী রণমূর্তি। বিছানার চাদর ধরে এক টান। তার দিদি কিছুতেই সামলাতে পারে না। প্রথমটা থতমত খেলেও আমার সেই পিসি তাড়াতাড়ি সামলে নিতে চায় তার এই ছোট্ট ভাইটাকে। ‘রতু! শোন বাবা, এরকম করিস না। তোকে তো বলার আগেই তুই মুখে পুরে দিলি। এতে এদের কারও দোষ নেই। অমন করিস না বাবা।’ ভয় আর অপরাধবোধে মুখটা কালো হয়ে কুঁকড়ে গেছে। পিসি প্রায় কেঁদে ফ্যালে আর কী! ছোট্ট আমি মায়ের পেছনে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরেছি জোরসে। এসব কী হচ্ছে আমাদের বাড়িতে? আর সেই কাকা তখন বছর চল্লিশের বলশালী এক রাগী শিশু, যে কিছুতেই বিশ্বাস করছে না যে ইচ্ছে করে তার জিভ পোড়ানোর জন্য গরম সিঙাড়া খেতে দেওয়া হয়নি। এককালে যখন সে দুদার্ন্ত স্মার্ট মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিল, আর তার ছোটবৌদি, মানে আমার মায়ের কাছে এসে রুটি-তরকারি খেয়ে বলত, ‘সবার জন্য গরম সিঙাড়া আনালে কেমন হয়?’— সেই ছেলেটা আসলে সিঙাড়া খুব ভালবাসত বলে মা আনিয়েছিল। 

    আমার পিসি, স্কুলের ভূগোলের দিদিমণি— যার কেউ বিয়ের চেষ্টা করল না— তার জীবনটাই কেটে গেল এই ভাইয়ের দেখভাল করতে গিয়ে। পিসির গলা হেঁড়ে, গায়ের রঙ ময়লা, কম মাইনে, জোরে জোরে কথা বলে, সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি পরে আসে, তাতেও তেলচিটে গন্ধ। সখ্য করার মতো তেমন কিছু তো নেইই, এমনকী সহ্য করার মতোও কিছু নেই। কেবল অন্যপক্ষের সহানভূতি যত দিন বজায় আছে, ততদিন পিষে মরে যেতে হবে না হয়তো এই পরিবারটাকে।

    আমাদের বাড়ি এসেই পিসি, তার জীবনের যত সমস্যা বলতে আরম্ভ করত। কাজের লোকেরা মহা-বদমাইশ হয়ে গেছে, কেউ টিকতে চায় না। দু’দিন কাজ করেই বলে ভাইয়ের ঘরে ঢুকব না, মুছব না, ওঘরে গন্ধ। ‘কী বলে জানো বৌদি? বলে, তোমার অত বড় ভাই ঘরে পেচ্ছাপ করে রেখে দেয়, পাগল-ছেলের ঘর মুছব না। গা গোলায়। কী গন্ধ ছাড়ে, কী করে থাকো বাবা তোমরা, পাগলা-গারদে দিয়ে এলেই তো পারো। তোমারও রেহাই।’ এটা কী কোনও কথা হল, বলো? রতু কি পাগল, বলো? তোমরা তো দেখেছ ওকে। ওর হঠাৎ করে মাথার সমস্যাটা যে কী হল, ঠিক বুঝলাম না গো। ওষুধ তো চলছেই, ডাক্তার তো বলেছে ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তাই বলে আমি কি ওকে পাগলা-গারদে দিয়ে আসতে পারি? মায়ের পেটের ভাই তো!’ বলতে বলতে দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। 

    কখনও রেগে উঠে, কখনও কেঁদে ফেলে সে-সন্ধে গড়িয়ে যেত। আমার জেঠিমা খুব চেষ্টা করত ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়ার, একটু শান্ত করার। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সরে আসত, এত দুর্গন্ধ। মা দেখতাম তাড়াতাড়ি লুচি-তরকারি করছে। জেঠিমা বলত, ‘আবার এসব করছ কেন, আরও দেরি হবে, ততক্ষণে রতু কী করে বসবে কে জানে!’ এখন বুঝি, মা ওদের ক্ষতে একটু মলম লাগানোর চেষ্টা করত মাত্র।

    অথচ একটু আগেই কী অভিযোগের ফিরিস্তি দিচ্ছিল! রতু কোনও কথা শোনে না। তোমরা কল্পনা করতে পারবে না, ওকে চান করানো কী ঝক্কির ব্যাপার। গায়ে জল ঠেকাতে দেয় না। শুধু কী তা-ই? একটু যদি কোথাও চাবি দিয়ে বেরিয়েছি, মানে আমার বেরনো তো হয় মুদির দোকান বা ব্যাংক, সে আর কতক্ষণ লাগে। তাহলেই গোটা বাড়ি দাপিয়ে, বাসনপত্তর ফেলে-ছড়িয়ে তুলকালাম করে রাখবে। চাবি খুলে ঘরে ঢুকতে কী ভয় করে! তখন যা রেগে থাকে, কতদিন তো আমায় দু’চার ঘা বসিয়ে দিয়েছে। জানো তো, মা-বাবার ওপর খুব রাগ হয়। আমায় এই সংসার ঠেলতে দিয়ে চলে গেল। কেন আমি সবার দায়িত্ব নেব? বড় দাদা তো নামেই, তিনি যে কোন পাহাড়ে কখন থাকেন, তার কোনও হদিশই পাই না। তিনি নাকি ট্রেকিং করছেন। এদিকে সংসার যে কী করে চলছে! স্কুলের টিচারের আর কত মাইনে বলো বৌদি? তার ওপর এত বড় ধিঙ্গি ছেলে, ওর শক্তির সঙ্গে আমি এঁটে উঠি? এক এক সময় মনে হয় পাড়ার পার্টি অফিসে গিয়ে বলি আমার জীবনের একটা বিহিত করতে।’ 

    কখনও রেগে উঠে, কখনও কেঁদে ফেলে সে-সন্ধে গড়িয়ে যেত। আমার জেঠিমা খুব চেষ্টা করত ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়ার, একটু শান্ত করার। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সরে আসত, এত দুর্গন্ধ। মা দেখতাম তাড়াতাড়ি লুচি-তরকারি করছে। জেঠিমা বলত, ‘আবার এসব করছ কেন, আরও দেরি হবে, ততক্ষণে রতু কী করে বসবে কে জানে!’ এখন বুঝি, মা ওদের ক্ষতে একটু মলম লাগানোর চেষ্টা করত মাত্র। যদি কিছুক্ষণের জন্যও এদের মনটা একটু ভাল হয়। যাবার সময় রতুকাকা কিছুতেই যেতে চাইত না। বারান্দায় চলে যেত, চেয়ারের হাতল ধরে বসে থাকত। পিসি আবার বুঝিয়ে-বুঝিয়ে রাজি করাত কতক্ষণ ধরে। আবার নিয়ে আসবে এবাড়িতে, এমনকী কালকেই ফের নিয়ে আসবে। সব্বাই থাকবে তখন। সব্বার সঙ্গে আবার গল্প হবে। এমনকী আমার সঙ্গে খেলতে পারবে, এসব মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে দিতে নিচু হয়ে ভাইয়ের পায়ে চটি পরাতে পরাতে অনেকটা শূন্যতা আর কষ্ট চেপে বিজয়া সেরে চলে যেত ভাইবোন। 

    কিন্তু রতুকাকার মতো যদি কোনও ঘরবন্দি বোন থাকে, সেবাড়ির ঝক্কি অনেক বেশি। তার উপচে পড়া শরীর, তার বগল ছেঁড়া নাইটি, তার রাত-বিরেতে গোঙানি, তার ঋতুস্রাবের সময় অবুঝপনা, গোটা ঘরে লেপ্টালেপ্টি করে নোংরা করে রাখা— সব সামলাতে হিমশিম খেয়ে যেতে হয় বাড়ির লোকেদের। বিয়ে হল না কেন বিনির? এখন কথা-চালাচালি হয় পাড়ায়। অমন ডাঁশা চেহারা। বি-এ ফেল তো কী হয়েছে? বি-এ ফেল মেয়েদের কি বিয়ে হয় না? একটু বেশি টাকা দিয়ে তো কত মাথাখারাপ মেয়েদের বিয়ে হয়।  

    ওদের বাড়ির যে পুরনো কাজের দিদি, যাকে ওরা ঠাকরুন বলে ডাকে, সে ছিল বলেই তো মেয়েটা তবু এখনও একটু দেখভাল পায়। ঠাকরুন চলে গেলে বা মরে গেলে যে কী হবে, কে জানে। তখন হয়তো কোথাও দিয়ে আসবে, কোনও মানসিক হাসপাতালে। সেজদাটা ভাল। সে নিশ্চয়ই টাকা দেবে। অন্য ভাইরা তো মুখ ফিরিয়েছে কবেই! অবশ্য, তাদেরও তেমন সামর্থ্য নেই যে! সবাইকে অমানুষ বলে দাগিয়ে দিলে কী করে হবে? ওদেরও তো ছেলে-মেয়ে-সংসার আছে। 

    ঠাকরুন বিকেলে যখন চুল বেঁধে দেয়, তখন রোজ একটাই গল্প বলে বিনিকে। ঠাকরুন যখন ছোট ছিল, তখন কেমন লাল শাড়ি পরে তার বিয়ে হয়েছিল। কী কী গয়না পরেছিল, মানতাসায় কেমন লতাপাতার নকশা করা ছিল। নাকে নোলক পরেছিল, পায়ে রুপোর মল। ঝমঝম করে সারা শ্বশুড়বাড়ি ঘুরে বেড়াত। বিষ্যুদবার করে নাপতিনি আসত আলতা পরাতে। কিন্তু কলকাতার কালেজে পড়া তার স্বামী খুব অসুখে মরে গিয়েছিল। অত ছোট্ট বয়সে বিধবা হওয়ায় ঠাকরুনকে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তার পর কবে যে ঠাকরুন এবাড়িতে এসে বিনির মা’র সঙ্গে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল, মনে নেই। শেষের অংশটা শুনতে বিনির ভাল লাগে না। সে শুধু বিয়ের গল্পটা শুনতে চায়। বিয়েতে কেমন করে সানাই বাজছিল, বিয়েতে ওর বর কেমন করে সেজে এসেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ঠাকরুনের মনে নেই, ওর বরকে কেমন দেখতে ছিল। তবু সে বানিয়ে বানিয়ে বলে।

    সন্ধে শেষ হয়ে আসার মুখে প্রায়শই ছোড়দা-ছোটবৌদি ঝগড়া করে, একটাই টপিক। সন্তান। ছোটবৌদি, পাগল-বোন আছে না জেনে বিয়েটা করে নিয়েছিল, কিন্তু বাচ্চা সে কিছুতেই করবে না। যদি সেই বাচ্চার মাথা-খারাপের রোগ থাকে? যদি বিনির মতো, বিনির মায়ের মতো তার সন্তান হয়? কে দেখবে তাকে? ছোড়দা বলে, ‘সুস্থ সন্তানও তো হতে পারে। আমি সুস্থ নই, দাদা সুস্থ নয়?’ ছোটবৌদি গলা চড়িয়ে বলে, ‘বিনিও তো আছে, ও তো সুস্থ নয়। আর আমার যা কপাল, যেমন স্বামী জুটেছে, তেমন যদি বাচ্চা জোটে!’ অকাট্য যুক্তি। ছোড়দা রাগ করে বেরিয়ে যায়। 

    বিনির মায়ের ডিপ্রেশন ছিল। একদিন হঠাৎ করেই সেই যে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুল, আর কিছুতেই উঠল না, বাড়ির কোনও কাজ করল না, কোনও দায়িত্ব নিল না। মাঝেমাঝে খুব কাঁদত, ব্যস এটুকুই। তার পর দুম করে একদিন মরে গেল চোখ-টোখ উল্টে। কেউ কিছু বুঝল না। বিনি তখন কলেজ যেত। তারপর বিনিও আস্তে আস্তে চুপ করল, আর তারপর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। তিনতলার ঘরে ঠাঁই হল তার। প্রাপ্তির মধ্যে জুটল শুধু ঠাকরুনের পরশ। কোনও কোনও দিন রাতে উঠে নিজেকে ছুঁয়ে দেখে বিনি। কী ভাবে, কেউ জানে না। ওর মনের হদিশ পাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। মাসের শেষের দিকে ওযুধ ফুরোলে মুশকিল। বড়দা-সেজদা-ছোড়দা সবারই টানাটানি চলে। বিনিও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। নিজেকে খিমচে শেষ করে।  বাড়ির লোক বিরক্তিতে বিরক্তিতে তেতো হয়ে ওঠে। 

    এসব বাড়ির লোকজন, কাছের ভাইবোন একে অপরের চোখ লুকিয়ে, এমনকী নিজের চোখও বন্ধ করে, মনে মনে যমের দুয়োরের কাঁটাগুলো সরিয়েই নিতে চায়। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook