সন্ধ্যাকালীন রন্ধনপ্রণালী
১.
সীমান্তের দিকে যেতে যেতে কে যেন
ছুঁড়ে দিল অজস্র বৃষ্টি, ভেসে গেল শিকড়ের পাশে
জমে থাকা বীজ।
আরও নীচে, মেঘেরা তাড়া করেছে দিগ্বলয়। তারা ঘূর্ণমান।
তারা উনুনের পারে জমানো কাঠের পাশে নেমে এল। বিসদৃশ নামে এই দেশে কিছু নেই
বললেই পরিহাস মনে হবে। মনে হবে অপচয়।
এদিকে জানলা দিয়ে ঢুকে আসছে মেঘ
সেইখানে আর্ত নৈঃশব্দ্য, কঠিন ঋতুর মতো।
সেখানে কোনও শঠ লুকিয়ে রেখেছে আমারই নিজ প্রতিকৃতি
আমি ব্যক্তিগত ভঙ্গিমার পুনরুদ্ধার চাই
তাই এই আগুনে বসানো ডেকচির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আছি।
২.
পদ্মসম্ভব।
অবিলম্বে কিছু বুনো ফল জমা হল করতলে
জানি হ্লুদপাতার ওপর দিয়ে তেলের মতন বেয়ে যাচ্ছে আমার অক্লান্ত প্রতিভা
তবু এইখানে সুর নেই কোনও, স্বর নেই
শুধু পর পর টিনের চাকতি বাজছে আর প্রতিধ্বনি ফিরে গেছে আকাশের দিকে
রেখে গেছে অকিঞ্চিৎকর বৈকালিক বিভা।
প্রতিশ্রুতিহীন বৈকালিক বিভা।
যা লুব্ধ, যা লুপে ঘুরতে ঘুরতে ওইই পদ্মসম্ভব
সাতখানি দীপ জ্বলে উঠল চতুর্দিকে।
আর নীচে কেরোসিন স্টোভে চা ফুটছে
আমরা হাত-পা জড়ো করে অপেক্ষা করছি
এই অপেক্ষা, মুদ্রাদোষ যেন। যেন সর্বস্ব ক্ষয়ে গেলে
আজ আর ক্ষতি নেই। চায়ের টেবিলের একপাশে দিগন্তের ধার,
তার পরে মহাশূন্য। সেইখানে সাতটি পদ্ম ফুটে আছে।
কার জন্য সে পতনের দিকে যাব? ওগো আসন্ন সন্ধ্যার সে তরল
দৃষ্টিপাতগুলি আমার এই চায়ের পাত্রে ঢেলে দাও
৩.
এই বলে আনাজ প্রকৃতার্থে বিমূঢ়
আর ওইপাশে একাকী শূকর খাঁচার মধ্যে বসে আছে
বিমূঢ় সেও। রূঢ়তা এক ধরনের তিক্ত কষা ফলের নাম
যা অল্পে অল্পে গলা বন্ধ করে দেয়।
৪.
এই চা। এই সমাধানী মসৃণ।
পরের পাতায় লিখিত রয়েছে অন্তহীন পা।
ততক্ষণে ফের পাহাড়প্রদেশে বৃষ্টি নেমে এল। বড় বড় হ্লুদ ফুলের বনে
নেমে আসছে পতঙ্গ যেন যাত্রাপথ শেষে ইতিহাসভঙ্গি,
যেন লেখা আছে ওই পাথরের বেদিতে। আমাদের লোকেদের
ইতিহাস কই?
ভগ্ন লাঙলগুলি শুধু পড়ে আছে মাঠে।
আর স্থির হাওয়া আমাদের মুখে চেয়ে পড়ে আছে।
আমি আমার হাতের দিকে তাকাই। মাটির দাগ মুছে দেওয়া যাবে বলে
স্মৃতিবিলোপের আশ্চর্য কৌশলগুলি মনে পড়ে।
কিন্তু আজ কোনও ক্ষেত দেখতে পাচ্ছি না। কোনও জল পাম্প নেই।
আর দিবানিশি প্রতিক্রিয়ার আড়ে ঘুমোচ্ছে কুকুর।
মিতব্যয়ী পর্যটক। ম্যাপ নেই। তার মধ্যে আমরা হিসেব করছি এ কোন যাতায়াত
৫.
আর ভাষা সে তো কেবলই অর্থের দিকে উড়ে যায়
তোমাদের টক বনে কেবলই প্রচণ্ড স্মৃতি
কোনও রীতি না মেনেই ঘুরপাক খাচ্ছে ছোট গুম্ফার টানা বারান্দায়
সেখানে কুমড়ো ও কীসের মূল সাজানো রয়েছে জানি না
যাও প্রবঞ্চক। এই তুষিত অরণ্য থেকে
পরা ও অপরা জ্ঞানগুলি নিয়ে ফিরে যাও।
এখানে দুপুরে ফলের ত্বকে বেজে উঠেছে
বিশ্রম্ভালাপ। শাঁসে কাম। কোমরের দিকে
আড় হয়ে পড়ে আছে রুপোর উজ্জ্বল পাটি।
সমস্ত শীল ও প্রজ্ঞারূপ ছিন্ন করে তোমার ওই উজ্জ্বল পাটি।
কিন্তু ওই কুহকী পুঁথির দিকে চেয়ে থাকলে সভ্যতা এগোবে?
৬.
দিনান্তে বাষ্পাকুল মেঘে উঠে বসছে ওই পাহাড়ের
রাঁধুনি সকল। এই দিগ্বলয়ব্যাপী যৌথতার বোধ দেখে তটস্থ লাগে।
ভাবি।
ছোট শূকরের পাল নেমে যায় চুল্লির ওই পার।
পেছনে মতানৈক্য। পেছনে প্রভূত বেদনার মতো ঘাসবনে আগুন জ্বলছে।
ইত্যবসরে ছাই উড়ে আসছে হৃদয়ের অব্যবহিত ওপরে।
এদিকে পায়ের নীচে শুকনো পাতা ডাল ভাঙছে পট পট করে।
তবুও কেন এই নিবিষ্টতা ভাঙে না আমি বুঝতে পারি না।
না কি এসবই পরাকৃত কৌশল আমার,
না কি এইসব আমারই হৃতকাম ও রন্ধনপ্রণালী?
যা শুধু হৃদয়ের চারিভিতে ছাই হয়ে জমে আছে।
আমি কি মাটির ভাঙা বাসনগুলির সঙ্গে কিছু কথা বলে নেব আজ?
কিছু স্বীকারোক্তি রেখে দেওয়া যায় কি না গোপনে ত্রস্ত উপত্যকায়,
ঠোঁট বিষয়ক?
এর মাঝখানে, বিষ্যুদবারে, সন্ধ্যাকালে, হঠাৎ করে সব ফুরিয়ে এল।
৭.
মত্ত জিজ্ঞাসা তাঁদের। উড়ন্ত পাখায়
তাই বারবার ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে। আমি আমার পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকি
এই শিরাগুলি প্রত্ন। প্রপিতামহের।
আমি তাঁদের বিস্ময়গুলি নিয়ে শামুকের দিকে কাঁকড়ার দিকে
কামঠের দিকে চলে যেতে থাকি
অভ্যাসের বাইরে আমার ঘ্রাণেচ্ছা কতদূর যাবে?
৮.
ঘ্রাণ। না কি ঝিঁঝিঁ। না কি পাহাড়ি গুম্ফার ঘণ্টার ধ্বনি
কে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সন্ধ্যার দিকে আমাকে নিয়ে যাবে
কে নিয়ে যাবে পূর্বাপর শোক অস্থিরাজি প্রাচীন অজ্ঞতায়।
বর্ণনার ভিতর। অবর্ণনীয় অপরা বিস্মৃতিতে। এদিকে অগ্নিসম্ভব
পুঁথিগুলি শিথানে বালিশের মতো পড়ে আছে। তার স্পর্শে মাথায়
ফুটে উঠছে সহস্রদল পদ্ম। মারের বাহনেরা জানলায় হা হা স্বরে হাসছে।
বহু আগে, এইখান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা ঘুরে যায়।
আজ বনমধ্যে আমাদের পায়ে পায়ে মুছে গেল সেই দাগ
আমরা পথ হারালাম প্রায়। ঈষৎ স্থূল ও বঙ্কিম কোমরের
মতো পথচিহ্ন দেখা দিল সন্ধ্যায়, অব্যবহিত আগে।
ফিরবার পথে জ্বলে ওঠে আলো, স্থানীয় বেকারিতে।
এই অজস্র গুঁড়ো চিনি ছড়িয়ে রেখেছে কে?
যেন স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে শৃঙ্গারের
মতো, আন্দাজে। যেন অজস্র পতঙ্গের ডানা সূর্যাস্তের
নিঃস্তব্ধ জুড়ে সন্ধ্যাকে করে তোলে মেধাবী স্পর্শাতুর। যেন ওই ভোম, শূন্য প্রায়।
গান কই? নেই। এদিকে শ্বাসরোধ হয়ে আসে বসার ভঙ্গিমায়।
তাই পথে পথে হেঁটে যাচ্ছি আর জামার মধ্যে কুড়িয়ে রাখছি
তন্তু, পতঙ্গের ডানা আর মিষ্টি কন্দ, ফের। ওপরের ডাল থেকে সে কোন
ফল খুলে আজ হাতে নেব বিলাসের? অস্থির লাগে এই অপরিণামদর্শী কামনায়।
৯.
সন্ধ্যায় ঘন নীল ফলদের ডেকে বলি অতর্কিতে
ভোলানোর মতো, আহা কতদিন পরে এলে
এই নাও তন্তুময় দ্রব্য। মুখ মোছো। কিন্তু দ্বিধা করি।
এইভাবে নিজেকে স্তোক দেওয়া অসম্ভব মনে হয়।
যখন রুপোর ভিতর থেকে উঠবে ঈষৎ অস্ফুট শব্দ, অতর্কিত বিভ্রমগুলি
উনুনের ধোঁয়া ছেড়ে উঠে যাবে পাহাড়ের গায়ে, খোদিত অক্ষরে, নিজেকে স্তোক
দেওয়া অসম্ভব মনে হবে।
ওদিকে এরকমই একদিন দীর্ঘ সমাধির শেষে উঠে দাঁড়িয়ে
দেখি কখন বসন্ত এসে গেছে। রসে থই থই
করছে ভুবন। নীচে কোন গ্রামে সবিশেষ মুরগিরা কাঠের উনুনে রসুন
ও আদাপাতার মধ্যে সেদ্ধ হচ্ছে। সেই গন্ধঅলা হাওয়া
পাক খেয়ে উঠে আসছে এই অবধি, এই বারান্দায়। এই বসন্তেও অভুক্ত থেকে
যাব ভেবে চোখে জল আসে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র