ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিকল্প নাটকের অনুবাদ


    শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী (October 1, 2021)
     

    সমস্যা খুবই গভীর, আর হবি তো হ, একেবারে বন্ধুর হাত ধরেই সেই সমস্যার সূত্রপাত। ব্যাপারটা কিছুই নয়, দক্ষিণী এক বন্ধু বাদল সরকারের নাটক পড়তে চাওয়ায় তাকে খানকতক অনুবাদ পাঠিয়েছিলাম— বাজারে একটু খুঁজলেই সেসব অনুবাদ বই আকারে বেশ পাওয়া যায়, সুপরিচিতও বটে। ক’দিন পর এক নাটকের আড্ডায় দেখি সেই বন্ধু এক নিঃশ্বাসে বাদল সরকার, গিরিশ কারনাড ও উৎপল দত্তের নাম করে বসল। হাঁ-হাঁ করে উঠলাম স্বভাবমতো, এ কী কথা! বাদলবাবু যে এঁদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তাঁর কাজে— যাকে তৃতীয় থিয়েটার বলে এত মাতামাতি করি আমরা! বন্ধুটি বলল, যদি আরেকটু বিশদে তৃতীয় থিয়েটার নিয়ে জানা যায়, মন্দ হয় না। দিলাম আবারও বাদল সরকারের ইংরেজি প্রবন্ধগুলি— ‘দ্য থার্ড থিয়েটার’, ‘ভয়েজেস ইন দ্য থিয়েটার’ ইত্যাদি। কিন্তু সেসব তো তৃতীয় থিয়েটারের প্রাথমিক কিছু তত্ত্ব, আলোচনা। তারপর জল অনেকটাই গড়িয়েছে। যে নাট্যভাষকে কেন্দ্র করে তৃতীয় থিয়েটার তথা যেকোনও বিকল্প থিয়েটারের জন্ম, দীর্ঘমেয়াদি ওয়ার্কশপ পদ্ধতিতে, লিখিত ও অলিখিতের যথার্থ মিশেলে সে যে কেমন তিলে তিলে গড়ে ওঠে, সে কীভাবে বোঝা সম্ভব শুধুমাত্র নাটক পড়ে?

    মূল ভাষার জ্ঞান আছে যাঁর, তিনি তবু নাটক পড়ে এবং পাশাপাশি সেই ভাষাতেই পারফর্মার বা নির্দেশকদের লেখা বিভিন্ন ওয়ার্কশপ বা পারফর্মেটিভ নোটস ঘেঁটে টুকরো-টাকরা ধারণা বাগিয়ে নিতে পারেন সেই নাটকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে, তাকে চোখে দেখার আগেই। কিন্তু ভিন্ন ভাষাভাষী যাঁরা? যাঁরা অনুবাদে পড়ছেন সেই নাট্যসাহিত্য? আর নাটক যদি বা অনূদিত হল, জনপ্রিয় ঝলমলে জগতের আড়ালে থাকা এইসব ওয়ার্কশপ নোটসের ভাগ্যে তো বেশির ভাগ সময়েই অনুবাদ জোটে না; দুর্গম কোনও আর্কাইভে তারা স্থান পায় বড়জোর।

    এতটুকু শুনে অনেকেই বলবে, মশাই ব্যাপারটা তো থিয়েটার! নাটক পড়ে সব বোঝা যাবে, এমন আশাই বা করছেন কেন? শুধু পাঠের জন্য তো আর নাটকটা লেখেননি কেউ! এ কথাটা যেমন ঠিক, আবার নাটকটি তার সব অসম্পূর্ণতা, সীমাবদ্ধতা নিয়েও যে শেষ অবধি ছাপার অক্ষরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে— এটিও কোথাও এক ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ অস্তিত্বের দাবি রাখে নিশ্চয়ই। অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যম তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলেও, সাহিত্যমাধ্যমে তার এই রূপটিই প্রকাশিত। তাহলে ভিন্নভাষার পাঠক, যিনি কেবল অনুবাদে নাটকটি পড়ছেন, তাকে পূর্ণতর মাধ্যমটি সম্বন্ধে ওই নাট্যসাহিত্যের সাহায্যেই জ্ঞাত করার দায় কি অনুবাদকের বর্তায়? যদি বর্তায়, তবে সেই দায়িত্ব ঠিক কেমন এবং সেক্ষেত্রে কী করণীয়?

    প্রথাগত ভাবে দেখতে গেলে, জনমানসে অনুবাদের সম্পর্ক প্রাথমিক ভাবে ভাষা ও শব্দের সঙ্গে; সে অনেকাংশেই সাহিত্য-সম্বন্ধীয় একটি ‘গৌণ’ সৃষ্টিশীলতার উদাহরণ— মূল লেখকের ছত্রছায়ায় থেকে অনুবাদকের কাজ যেখানে শুধুমাত্রই মূল ভাষা থেকে উদ্দিষ্ট ভাষায় লেখাটির পুনঃস্থাপন করা। কাজেই, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে অনুবাদকের কিন্তু লেখককে ছাপিয়ে বেশি কিছু বলার দায় নেই; বললে যদি বা তাঁকে বিভ্রান্তির দায়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়, না বললে বিশ্বস্ততার জোরেই বহু সমুদ্র পেরিয়ে যেতে পারেন অনুবাদক। কিন্তু সমস্যার উদয় হয় নাটকের ক্ষেত্রে— বিশেষত যে নাটক মূলস্রোতের মঞ্চ-বিরোধী বিকল্প থিয়েটার, যে নাটক একক ভাবে বহু সময়ই লিখিত হয়নি কেবল একজনের কলমে— বস্তুত যে নাটক কেবল লিখিত হয়েই মহড়ায় আসেনি, বরং মহড়ার মাধ্যমেও জায়গায় জায়গায় লিখিত হয়েছে। এমন এক শিল্প যখন ছাপার অক্ষরে আসছে পাঠকের হাতে, সেই সাহিত্য পড়ে কি তার মাধ্যমগত, গঠনগত বিশেষত্ব নিয়ে কোনই ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়? মূল ভাষায় অভিনীত হবে, বা ওয়ার্কশপের অভিজ্ঞতা লিখিত হবে— এই যুক্তিতে নাট্যকার যদি বা নাটকে এই অভিনবত্বের ছোঁয়া দূরেই সরিয়ে রাখেন, অনুবাদে পড়া পাঠকের কাছেও কি অনুবাদকের সেই অভিনবত্ব পৌঁছে দেওয়ার দায় থাকে না, বিশেষত যে ভাষায় পারফর্ম্যান্স বা গবেষণাধর্মী আর্কাইভাল তথ্যের উপস্থিতি সীমিত, বা নেই বললেই চলে?

    থিয়েটার— বিশেষত বিকল্প থিয়েটার, যেখানে নাটকের মহড়ায় নাট্যকারের শ্যেনদৃষ্টি নির্দেশক বা অভিনেতাদের চালিত করছে না, এমনকী যেখানে নাটকের লেখক হয়ে উঠছেন এঁরা সকলেই— তার অনুবাদ বিষয়ে সচেতন অনেকেই মনে করেছেন, কেবলমাত্র মূলানুগ হয়ে বিশ্বস্ততা রক্ষা করা ছাড়াও অনুবাদকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে লিখিত নাটকের অলিখিত, এমনকী সম্ভাবনাময় নাট্যমুহূর্তটুকুও ধরার চেষ্টা করা। আমাদের দেশে অবশ্য এ নিয়ে আলোচনা খুঁজলে হতাশা ব্যতীত দ্বিতীয় উপসংহার এই মুহূর্তে নেই; বিচ্ছিন্ন ভাবে সুজিত মুখার্জি বা পুরুষোত্তম লাল অনুবাদের তত্ত্ব বা ব্যঞ্জনা নিয়ে কথা বললেও, বা সাহিত্য অকাদেমি আঞ্চলিক সাহিত্যকে অনুবাদে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টায় রত থাকলেও, থিয়েটারের অনুবাদ বিষয়ে আমাদের দেশের তাত্ত্বিক বা অনুবাদকেরা আশ্চর্যজনক ভাবে নিশ্চুপ, এমনকী উদাসীনও। সে কারণেই হয়তো শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সচেতন নাট্যবোদ্ধাও অবাঙালি পাঠকদের জন্য বাদল সরকারের ‘মিছিল’ বা ‘বাসি খবর’-এর অনুবাদে বাদলবাবু লিখিত নাটকের বাইরে একটি শব্দ ব্যয় করেন না, বা তাঁর নিজের অনুবাদ-পদ্ধতি কেন কেবলমাত্র গল্পটুকু বলাকেই মূলানুগ থাকার একমাত্র পন্থা বলে বেছে নিল, তার স্বপক্ষে কোনও যুক্তিও মুখবন্ধে দেন না।

    তুলনায় পাশ্চাত্যে অনুবাদচর্চা— নির্দিষ্ট ভাবে থিয়েটার-অনুবাদ নিয়ে জোরদার স্বর উঠে এসেছে মাঝে মাঝেই। তত্ত্বগত ভাবে, অনুবাদকে কেবলমাত্র একটি ‘linguistic relocation’-এর জড়, আড়ষ্ট উপস্থিতি থেকে বার করে এনে মান্যতা দেওয়া হয় ১৯৭০-এর দশকে, সাংস্কৃতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে; অনুবাদক-তাত্ত্বিক সুজান বাসনেট এবং আন্দ্রে লেফাভ্যের তাঁদের বইতে এই ঘটনার নাম দেন ‘the Cultural Turn in Translation’! অনুবাদের অভিমুখ বদলে যাওয়ায় সাহিত্যের অন্যান্য ধারার মতো থিয়েটারের অনুবাদেও এর প্রভাব পড়ে যথেষ্ট। তার পরের বেশ কয়েকটা দশক জুড়ে আমরা কেবলই দেখব, বার্নার্ড শ’, এলিয়ট বা গলসওয়ার্দির নাটকের সোজা-সাপটা সাহিত্যসুলভ অনুবাদের যুগ পেরিয়ে নাটকের নব্য অনুবাদের উপায়, অসুবিধে, উদ্দেশ্য— সবকিছু নিয়ে ঘোরতর আলোচনা। অনুবাদক তাঁর নিছকই গৌণ অবস্থান থেকে রাতারাতি হয়ে উঠছেন রীতিমতো ‘কালচারাল প্রোমোটার’। সত্তর এবং আশির দশকের শুরুর দিকে যেমন বাসনেট বা শুল্‌ট্‌সের মতো তাত্ত্বিকদের গলায় শোনা গেল সারস্বত চর্চার অঙ্গ হিসেবে থিয়েটার-অনুবাদকে যথাযথ মান্যতা না দেওয়ায় ক্ষোভ, তেমনই শুরু হল অল্প পুঁজি ও লোকবল নিয়েই থিয়েটার-অনুবাদের ‘ফার্স্ট ওয়েভ’। সংলাপের পাশাপাশি অলিখিত অভিব্যক্তিকে অনুবাদের প্রয়াস, অনুবাদের মাধ্যমে লিখিত সংলাপের কথ্য হয়ে ওঠার পদ্ধতি সন্ধান— এমন বেশ কিছু প্রোজেক্ট দেখা গেল পরবর্তী দুই দশকে। প্রায় তিন দশক জুড়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে রবার্ট করিগ্যান, জর্জ ওয়েলওয়ার্থ বা রিক হাইটের মতো সমালোচকেরা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছেন, থিয়েটারের অনুবাদকের কোথায় কোথায় আলাদা হওয়া প্রয়োজন সাহিত্য-অনুবাদকের থেকে— কেন নাটক অনুবাদ করতে গেলে থিয়েটারের প্রশিক্ষণ বিশেষ প্রয়োজন, অনুবাদের আগে কতটা দরকার অভিনেতাদের সঙ্গে দিনযাপন করা তাঁদের বাচনপ্রকৃতি বোঝার জন্য। প্রসঙ্গত, আমাদের আলোচনা বিকল্প থিয়েটারের সূত্র ধরে শুরু হলেও, এখানে বলে রাখা ভাল, উপরোক্ত কোনও সমালোচক বা তাত্ত্বিকই কিন্তু তাঁদের লেখায় আলাদা ভাবে ‘বিকল্প থিয়েটার’ ব্যবহার করেননি, বৃহদর্থে ‘থিয়েটার’ই বলেছেন। তবে যে নমনীয় এবং উচাটন প্রকৃতির টেক্সট নিয়ে তাঁরা কথা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ মঞ্চনাটক বা ক্লসেট ড্রামার এই নমনীয়তা যে খুব চরিত্রগত নয়, বলাই বাহুল্য।

    তবে এত নাম-তারিখ-তত্ত্বের ভিড় সরিয়ে যদি জলটা স্বচ্ছ করে একবার উঁকি মারা যায়, দেখা যাবে থিয়েটার-অনুবাদে সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রে আসলে উপস্থিত একটিই ‘ডাইকোটমি’— অনুবাদটা শেষ অবধি হবে কেমন? পাঠক-কেন্দ্রিক, না দর্শক-কেন্দ্রিক? এবং এখানে এসেই প্রশ্নটা পক্ষ নেওয়ার— অনুবাদের চিরাচরিত সাহিত্যধর্মে বিশ্বাসী হলে পাঠক-কেন্দ্রিক ভার্সনেই দিব্যি চলে যায়। কিন্তু ‘অসম্পূর্ণ’ নাটককে অনুবাদে জবরদস্তি ‘সম্পূর্ণ’ না দেখিয়ে যদি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, এবং নাটকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পারফর্ম্যান্সের সম্ভাবনাময় ইঙ্গিতগুলি তুলে ধরা ‘কালচারাল প্রোমোটার’-এর কাজ হয়, সেক্ষেত্রে অনুবাদক শুধু নাটকের ভাষান্তরেই থেমে গেলে, সে হবে আংশিক ভূমিকা পালন। তাঁর দীর্ঘতর ও আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ উদ্দিষ্ট ভাষা ও সংস্কৃতির পাঠকদের ‘performable’ একটি ভার্সন পড়তে সাহায্য করা। 

    এমন একটি অবস্থানে, নিশ্চিত ভাবেই অনুবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যায় ক্ষমতার রাজনীতি, দুই স্তরে— ভাষাগত স্তরে (মূল ভাষা ও উদ্দিষ্ট ভাষার মধ্যে) এবং পাঠের স্তরে (লিখিত ও অলিখিতের মধ্যে)। ভেবে দেখলে, প্রথাগত থিয়েটারে লিখিত ও অলিখিতের ক্ষমতার সম্পর্ক অনেকটা শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের মতো— লিখিত সেখানে চালক, তার উপস্থিতি ক্ষমতাশালী। এই লিখিতের দ্বারাই চালিত হয় অভিনয় বা পারফর্ম্যান্স— যা তাৎক্ষণিক, ক্ষণস্থায়ী। থিয়েটার অনুবাদে এত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব উঠে আসার প্রধান কারণ এই: হঠাৎই যে ছিল প্রান্তিক, চালিত, তাকে ড্রাইভারের সিটে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বসানো হচ্ছে। ঔপনিবেশিক ন্যারেটিভে ‘সেল্ফ’-এর অভ্যাস যেমন ‘আদার’-এর উপস্থিতিতে বিচলিত হয়, তেমনই ভাষা ও শব্দের ‘স্থায়ী’ ন্যারেটিভে ‘অস্থায়ী’ সম্ভাবনাময়ের উপস্থিতি ততটাই বিব্রত করে নাটকের অনুবাদকে। এক পা এগোলে, লিখিত-বিশুদ্ধতা ভঙ্গের দায়ে জরিমানা হয়ে যাওয়ার দশা।

    আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে যায়। অনুবাদক পারফর্ম্যান্সের সম্ভাবনাকে ব্যক্ত করবেন উদ্দিষ্ট ভাষার টেক্সটে, ভাল কথা। কিন্তু এও তো কোনও স্থায়ী বন্দোবস্ত নয় যে আগামীতে এই একটি সম্ভাবনার ঝুড়িই এই নাটক থেকে বেরিয়ে আসবে। এ অনুবাদকের নিজস্ব পাঠ মাত্র, নির্দেশক বা অভিনেতার মতো। নির্দেশক বা অভিনেতার বদলে যেমন বদলে যায় একই নাটকের অভিনয় বা উপস্থাপনা, তেমনই বদলে যেতে থাকবে অনুবাদও, অনুবাদকের পরিবর্তনে— তেমন হলেই বরং বলা যায়, সেই নমনীয়তা, অনিশ্চয়তা, থিয়েটারের স্বভাবগত। সেক্ষেত্রে, কোনও একজন অনুবাদকের অনুবাদকে মাপকাঠি ধরার চেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রতিটি নাটকে সংলাপ-অতীত সম্ভাবনাগুলির একটি মানচিত্র নির্মাণ করা— কোন কোন সুতোয় টান দিলে যেকোনও অনুবাদকই অলিখিতের সঙ্গে আলাপচারিতার একটা খেই পাবেন।

    থিয়েটারে, বিশেষ ভাবে বিকল্প থিয়েটারে, এমন অনুবাদযোগ্য সম্ভাবনার দেখা পাওয়া যেতে পারে মূলত পাঁচটি সূত্রে— অভিনয়রীতি, অভিনয়ক্ষেত্র, দর্শকের অংশগ্রহণ, তাৎক্ষণিক রদবদল (যাকে আমরা ‘impromptu modification’ বলে থাকি) এবং সময়, স্থান ও অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল নাট্যরীতি। খেয়াল করে দেখুন, এগুলির কোনওটিই কিন্তু নাট্যকার-লিখিত মঞ্চ-নির্দেশনার প্রত্যক্ষ অংশ নয়। সেখানে নাট্যকার অভিনয়ক্ষেত্র কেমন হবে বা কোন প্রশ্ন দর্শকদের করা হতে পারে তার উল্লেখ রাখলেও, নাটকটি সেই বিশেষ মুহূর্তে বা সেই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কীভাবে প্রাক্তন বা আগামী উপস্থাপনাগুলির থেকে ভিন্ন হয়ে উঠছে, তার কথা বলা থাকে না; তা সম্ভবই নয়। স্বভাবতই, অনুবাদক সেই নাটকের মূলভাষার দর্শক ও পাঠক হলে তাঁর পক্ষে এই সম্ভাবনাগুলিকে চিহ্নিত করা এবং case-study হিসেবে একটি ভার্সন অনুবাদে প্রস্তুত করা সাধ্যাতীত নয়; তাতে উদ্দিষ্ট পাঠকেরা (যাদের কাছে সেই নাটকের অভিনয় বা নাট্যতত্ত্বের ফিল্ড-নোটস সহজলভ্য নয়) উপস্থাপনার পূর্ণতর ধারণা পেতে পারেন, যা থিয়েটারের অভীষ্ট সত্য।

    কিন্তু ‘অসম্পূর্ণ’ নাটককে অনুবাদে জবরদস্তি ‘সম্পূর্ণ’ না দেখিয়ে যদি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, এবং নাটকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পারফর্ম্যান্সের সম্ভাবনাময় ইঙ্গিতগুলি তুলে ধরা ‘কালচারাল প্রোমোটার’-এর কাজ হয়, সেক্ষেত্রে অনুবাদক শুধু নাটকের ভাষান্তরেই থেমে গেলে, সে হবে আংশিক ভূমিকা পালন। তাঁর দীর্ঘতর ও আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ উদ্দিষ্ট ভাষা ও সংস্কৃতির পাঠকদের ‘performable’ একটি ভার্সন পড়তে সাহায্য করা। 

    ব্যাপারটাকে আরেকটু খোলসা করার জন্য ধরেই নেওয়া যাক বাদল সরকারের নাটকের অনুবাদের বিষয়টি, এই লেখায় যা থেকে এত সব প্রশ্নের সূত্রপাত। মূলত যে তৃতীয় বা বিকল্প থিয়েটারের কথা বারবার ফিরে আসছে আলোচনায়, বাদলবাবুর নাটকের ক্ষেত্রে সেই তৃতীয়ত্ব পাঠকের কাছে বাহিত হওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম; এবং নাট্যকার এই কাজ নাট্যসাহিত্যে সেভাবে না করে গেলে অনুবাদকের উপরেই এসে পড়ে গুরুদায়িত্ব। নিজের কাজের তত্ত্বায়নের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন, অগোছালো বাদল সরকার এই কাজ করেননি নাটকে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁর ‘মিছিল’, ‘ভোমা’, ‘বাসি খবর’ বা আরও পরে ‘মানুষে মানুষে’ ও ‘ভাঙা মানুষ’-এর মতো নাটক চরিত্রগত ভাবে ‘সাগিনা মাহাতো’ কিম্বা ‘স্পার্টাকাস’-এর মতো আখ্যানধর্মী নয়, অনেক বেশি কোলাজ-ভিত্তিক। কেন কোলাজ? শুধুই কি মুখরোচক, তাক-লাগানো দৃশ্যকল্প তৈরির তাগিদে? না গভীরতর কোনও দর্শন চালনা করছে তাকে? কোন কোন সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক ব্যঞ্জনা তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন যা উদ্দিষ্ট ভাষায় অভিনয়ের পাঠেও অপরিহার্য? এই সমস্ত প্রশ্নের এক-একটি ব্যবহারিক উত্তর পাওয়া প্রয়োজন অনুবাদে; নাহলে ‘মিছিল’ বা ‘ভোমা’র পাঠ ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ বা ‘বাকি ইতিহাস’-এর পাঠ থেকে আদর্শগত ভাবে আলাদা করা কঠিন।

    উপরের আলোচনায় এতবার ‘অলিখিত সম্ভাবনা’কে অনুবাদ করার কথা বলা হয়েছে যে, অনেকের তা থেকে মনে হতে পারে, বুঝি গোটা নাটকটাকেই প্রায় খোলনলচে বদলে নতুন আকারে সৃষ্টি করার পক্ষেই কথা এগোচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা এত সরলরৈখিক নয়। অনুবাদককে আধুনিক সময়ে যখন ‘কালচারাল প্রোমোটার’-এর তকমা দেওয়া হচ্ছে, বা তাঁকে নির্দেশক-অভিনেতার মতোই সক্রিয় অংশগ্রহণের অধিকারী মনে করা হচ্ছে, বুঝতে হবে তাঁর কাজ শুধু নব কলেবরে নাটককে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে অনুবাদ করা নয়। বস্তুত, অনুবাদক এখন ব্যাখ্যাকারী— যাঁর দায়িত্ব ভাষান্তরের পাশাপাশি মূলানুগ সংস্কৃতি বা ইতিহাস বা সম্ভাব্য পারফর্ম্যান্সের খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে একটি উল্লম্ব চর্চায় নিজেকে ও পাঠককে নিয়োজিত করা। সেই ব্যাখ্যার উপর কোনও ‘শেষ কথা’র সিলমোহর থাকবে না অবশ্যই, কারণ তার কাজ ধারণা দেওয়া। এই পরিবর্তনশীলতা এলে তবেই তৃতীয় থিয়েটারের তৃতীয়ত্ব সার্থক, বলা যেতে পারে।

    এমন পরিস্থিতিতে অনুবাদকের তবে কী করণীয়? ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নির্দিষ্ট নাট্যধারার অধীত জ্ঞান তিনি নাটকের মধ্যেই প্রয়োগ করে একটি ভার্সনের দিকে এগোতে পারেন; তবে সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনুবাদটি কেবল ভাষান্তরিত নয়, মূল থেকে একটু সরে-আসাও বটে। মূল নাটক ঠিক কেমন ছিল সাহিত্যের চেহারায়, তা নির্ণয় করা এই অনুবাদ দেখে মুশকিল— অনুবাদ না বলে পুরুষোত্তম লালের ভাষায় একে ‘ট্রান্সক্রিয়েশন’ বলা অনেক বেশি সঙ্গত। এছাড়া অনুবাদক অবশ্যই পারেন অনুবাদের দীর্ঘ মুখবন্ধে তাঁর পদ্ধতির কারণ দর্শাতে, বা সামগ্রিক ভাবে অনুবাদটি কোন কোন ব্যাখ্যার আলোয় পড়া উচিত, তা নিয়ে সচেতন করতে। তবে এক্ষেত্রেও ভিন্নভাষার পাঠককে নাট্যের সঙ্গে হাতে-কলমে পরিচয় করানোর কাজটিও কিছুটা দায়সারা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, উপরন্তু দীর্ঘ মুখবন্ধ গবেষক ব্যতীত খুব একটা কেউ উল্টে দেখেন না আজকের দিনে। তুলনায়, মূলানুগত্য এবং স্বতন্ত্র পাঠ— দুইই বজায় রেখে অনুবাদ করার সবচেয়ে সুবিধাজনক পন্থা হতে পারে পাদটীকার নির্মেদ ব্যবহার। এই পদ্ধতিতে অনূদিত নাট্যসাহিত্যটিকেও রাখা যেতে পারে মূলের কাছাকাছি; আবার নির্দিষ্ট অংশ ধরে একেবারে সেই পাতাতেই পাদটীকায় দেখানো যেতে পারে স্বতন্ত্র পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজন। বিষয়টি সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী— এমনও বলা চলে না, কারণ এক সময় শেক্সপিয়রের সনেট এবং প্রতিটি নাটকের ব্যাপক জনপ্রিয় সংস্করণ আর্ডেন থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই উপায়েই।

    হাতে-কলমে একটা উদাহরণ দিয়েই এই প্রসঙ্গে ইতি টানা যাক। বাদল সরকারের ‘মিছিল’ নাটকটির শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-কৃত অনুবাদের একটি অংশ তুলে নিই বোঝানোর সুবিধার জন্য –

    A bell rings. The Chorus five young men, One, Two, Three, Four and Five, and ayoung woman, Six enter the space in the manner of the audience, disperse through the space and seem to search for places to sit. The bell stops. The lights go out at once. Voices from the dark. [1]

    ONE. What’s happened? Why did the lights go out? [2]

    TWO. Is it a fuse?

    THREE. Loadshedding! What a bother, every day…

    FOUR. No, it’s sabotage. Someone must have cut the wire…

    FIVE. Careful! It’s perfect for pickpockets and thieves…

    SIX. Can’t see a thing. What’ll happen?

    ONE. Hey you, watch where you’re going. You’re practically falling onto me!

    TWO. And how am I supposed to see in the dark, good sir? Am I a cat?

    THREE. Oh move on, can’t you? Don’t just stand there…

    উপরের অনূদিত অংশে কেবলমাত্র থার্ড ব্র্যাকেটে [1] এবং [2] কথাদুটি যোগ করা ছাড়া আর কিছুই আমি পরিবর্তন করিনি। কিন্তু নাটকের শুরুতে একজন ভিন্ন সংস্কৃতির পাঠকের কাছে ওই দুটি জায়গার কিছু ব্যাখ্যা ও সম্ভাবনার স্পষ্ট হয়ে ওঠা প্রয়োজন। কাজেই, ওই দুটি লাইনে আমি পাদটীকা দিয়ে, অনুবাদক হিসেবে এই ব্যাখ্যা দিতে পারি—

    [1]: The direction, perhaps not purposefully, mocks the set standards of the urban theatre where the light goes out after the third bell and everyone is supposed to be ready at their seats for the play to commence. Here, the unreadiness of the six actors who are till now seen as spectators, gets highlighted.

    [2]: The following dialogues might not be uttered in the proper order in which they have been written for the reading purpose. Keeping in mind that there is a case of loadshedding, and all of a sudden, utter chaos is taking place on the road, the dialogues should cross one another and might be repeated to signify restlessness. The actors too must be dispersed throughout the arena to be close to every section of the audience.

    মঞ্চনাটকের থেকে তৃতীয় থিয়েটার কোথায় আলাদা, এবং শুধু তাইই নয়, কোথায় সে মঞ্চনাটককে বিদ্রূপ করে উঠতে পারে হঠাৎই, দর্শকদের মধ্যে মধ্যে অভিনেতাদের অবস্থান, বা পাতায় লেখা গোছানো সংলাপ এলোমেলো ভাবে বলে অস্থিরতার প্রকাশ কীভাবে ঘটানো যেতে পারে এই থিয়েটারে— এই সম্বন্ধে সম্যক একটি ধারণা পাঠককে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব নয়। এই একই উপায়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ‘ভোমা’ নাটকটির অনুবাদও। বাদল সরকার ও কল্যাণী ঘোষের যৌথভাবে কৃত অনুবাদটির একটি অংশ নেওয়া যাক—

    A melody of four descending notes [1]. Each crouches and becomes a seed. Sprouting, standing up, stretching and spreading. Tress, Birds singing. Wind through the leaves.[2] Two of the actors turn into woodcutters felling trees with the customary heave ho…’ etc. Clearing the jungle. Paddy fields. Ploughing. Sowing. Harvesting.[3] Then the group forms a machine, complete with the rhythms and sounds.

    ONE. I know.[4]

    TWO. What do you know?

    ONE. I know now. I didn’t know before.

    THREE. What didn’t you know?

    ONE. Days have gone without knowing. Now I know.    

    এখানেও, যে চারটি পাদটীকার অবকাশ তৈরি করলাম, দেখা যাক কী ব্যাখ্যার প্রয়োজন এদের—

    [1]: The notes might be accompanied vocally by the ones who are outside the acting area, of the team. The sprouting, standing up, stretching and spreading of the seeds into trees may be in tune with the notes, evolving with their progress.

    [2]: These sounds are to be made by the actors who are standing as trees, and the woodcutters have to sing heave ho, etc. The previous tune with which the play began might be carried on by the members outside, as a choric undertone.

    [3]: The actors who were acting as seeds (and later trees) may now come out of their position and participate in the act of sowing and harvesting to imply a community of farmers. Their works should follow a particular rhythm which may be in tune with the original tune that goes on as an undertone.

    [4]: As they have formed a machine just before the beginning of this conversation a machine that is complete with the rhythms and sounds, their conversations might follow a mechanical way to suggest the movement and the sound of the machine. The conversations follow a pattern: a vague statement, followed by a question demanding clarification, followed by another vague statement. If their bodies do the movements of the machine, these might be the sounds as well.

    লক্ষণীয়, এখানেও কিন্তু অনূদিত নাট্যসাহিত্যে বদল আনার প্রায় কোনওই প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু শুধু সেটুকু অংশ একবার, এবং পাদটীকার ব্যাখ্যা ও সম্ভাবনার নির্দেশগুলি সমেত পুরোটা আরেকবার পড়লেই বোঝা সম্ভব, বিকল্পের সচেতনতা কোথায় এবং কেন প্রয়োজন, এবং কীভাবে তা আমাদের পাঠকে আরও ‘নাটকীয়’ করে তুলতে পারে।তবে চর্চা ব্যতীত এর উপযোগিতা শূন্য। প্রাথমিক ভাবে নতুন অনুবাদ-অভিমুখের সন্ধান পাওয়া গেছে মনে হলেও, হতাশার বিষয় এই যে পাশ্চাত্যে— ইউরোপীয় বিকল্প থিয়েটার-অনুবাদে ও মার্কিন মুলুকের নানা off-broadway বা তৎপরবর্তী off-off-broadway-এর ক্ষেত্রে এমন নানা পন্থা দেখা গেলেও, আমাদের দেশে এমন কাজ এখনও তত্ত্বের আঙ্গিকেই সীমাবদ্ধ। তাকে প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার নিদর্শন বিরল; থাকলেও, তা সঠিক ভাবে নথিভুক্ত নয়। অতিমারী-পরবর্তী সময়ে থিয়েটার যখন মূলস্রোত আর বিকল্পের পরিচিত বাইনারি পেরিয়ে ডিজিটাল থিয়েটার হিসেবেও ভবিষ্যতের এক দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হতে চলেছে, এমন অবস্থায় ভাষান্তরে নাটকের পাঠ যদি এখনও লোগোসেন্ট্রিক বন্ধনেই আটকে থাকে, অথচ প্রতিবারই পড়ার সময়ে আওড়ে নিতে হয় ‘ট্যাঁশগরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে’, তবে ভাগ্যহীন সেই নাট্যকার, অনুবাদক, পাঠক, দর্শক— আমরা প্রত্যেকেই।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook