সুরের আশ্রয়-প্রশ্রয়
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অসংখ্য বন্দিশ বা গানে মহিলাদের এক রকমের স্টিরিওটাইপ বা মার্কামারা চরিত্রায়ন লক্ষ না করে পারা যায় না। এইসব সাঙ্গীতিক সৃষ্টির মধ্যে অনেকগুলোই সুর-তাল-লয়ের বাঁধনে বা সঙ্গীতারোপের সম্ভাবনার দিক থেকে অনস্বীকার্য ভাবেই সুন্দর, এমনকী অসাধারণও বলা চলে। কিন্তু তবুও গানের কথায় ফুটে ওঠে বেশ কিছু স্টিরিওটাইপ বা বাঁধা গতের চিত্র— নির্মম এবং অসংবেদনশীল ‘সাস’ বা শাশুড়ি, ননদ বা বরের বোন যে কেবল অসহায় ভ্রাতৃবধূর খুঁত ধরতেই ব্যস্ত, লজ্জাবতী ও ভঙ্গুর অবলা, অর্থাৎ যার বল বা সামর্থ্য নেই। এই ধরনের স্টিরিওটাইপ যে সাঙ্গীতিক চর্চা এবং অনুষ্ঠানের চৌহদ্দির বাইরেও বিরাজমান, সেটা আশ্চর্যের নয়। যেসব সেরা সঙ্গীতশিল্পীদের স্বামী/স্ত্রী বা পরিবারের অন্য কোনও সদস্য তাঁদের ম্যানেজার বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন (সে লিখিত ভাবেই হোক, বা অলিখিত ভাবে), তাঁদের ব্যাপারে প্রায়ই রং চড়িয়ে নানা কুৎসা, নানা নিন্দা রটানো হয়। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এমন যে কোনও কেউই জানবেন, কীভাবে বড় বড় পণ্ডিত বা ওস্তাদদের অনুরাগী এবং অনুগামীরা একদিকে তাঁদের চমৎকার, দিলদরিয়া মানুষ বলে কত সুখ্যাতি করেন, আবার অন্যদিকে তাঁদের স্ত্রীরা নাকি অবুঝ, কলহপ্রবণ বা দজ্জাল, এমনকী তাঁদের সঙ্গে কাজ করাও নাকি অসম্ভব, এইসব মর্মে তাঁদের নিন্দা করে থাকেন। পরনিন্দা-পরচর্চার এই বৃত্তে স্ত্রীরা হয়ে ওঠেন ঘৃণ্য চরিত্র— তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের পূজনীয় তারকাকে স্ত্রী অন্যায় ভাবে আগলে রাখেন এবং অনুরাগীদের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখেন, যদিও তারকা নাকি নিজে তাঁর অনুরাগীদের সাথে সময় কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। এ-ব্যাপারে সত্য-মিথ্যা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা হয়, স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে সত্যটা কখনও স্টিরিওটাইপের দিকে ঝুঁকে থাকে, কখনও উল্টোদিকেই।
আমার মনে হয়, যে মহিলারা এই পরিসরে কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন, পরিস্থিতিটাকে তাঁদের প্রতি সহানুভূতির আঙ্গিক থেকেই দেখা উচিত। কোনও অসামান্য প্রতিভাবান ব্যক্তি, যিনি হয়তো তাঁর কাজের জায়গায় একজন দিক্দ্রষ্টা, এমনকী একজন জিনিয়াসও হতে পারেন, যিনি বহু অনুগামীর পূজ্য একজন পাবলিক ফিগার— এমন এক-একজন মানুষের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন এঁরা। বিভিন্ন সময়ে অনুরাগীরা, তারকাদের থেকে শিক্ষালাভ করতে আগ্রহী ছাত্রেরা, উদ্যোক্তারা, প্রোমোটারেরা সবাই তাঁদের পূজনীয় মানুষটির যত কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব, ততটা সান্নিধ্য চান। সমস্ত অনুরাগীরাই যে অন্যায় সুবিধা নেবে বলে তারকার সান্নিধ্য চায়, তা একেবারেই নয়, তবে এসব ক্ষেত্রে বিপদ-আপদ বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভাবনাও যে থাকে, সে-কথাও সমান ভাবে সত্যি। এই মহিলাদের সমালোচক যাঁরা, তাঁরা খুব কম ক্ষেত্রেই (সাধারণত কখনওই না) ভেবে দেখেন, দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটির হিসেবে কী ভয়ানক ভোগান্তি এঁদের পোহাতে হয়! একটি উদাহরণ দিই। সারাদিন যে অগুনতি, অনাহূত অতিথিরা কিচ্ছু না জানিয়েই আচমকা একগাল হাসি নিয়ে শিল্পীর দোরগোড়ায় হাজির হয়ে যেতে পারেন, তাঁদের জুগিয়ে যাবার জন্য অসংখ্য চায়ের পেয়ালা, জলখাবার, মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজের ব্যবস্থা করা। এসব কাজের পাশাপাশি কিন্তু তাঁদের নিজেদের দৈনন্দিন খুচরো কাজ বা দায়দায়িত্বও সামলে যেতে হয়। যেসব ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাও সঙ্গীতশিল্পী, সেক্ষেত্রে নিজেদের সাঙ্গীতিক চর্চার ক্ষতি করেই এই দিকটা তাঁরা সামলান। স্পষ্ট বোঝা যায়, এই ধরনের কাজ থেকে বাসা বাঁধে (বা বাঁধতে পারে) আক্রোশ, ক্লান্তি, অশান্তি। সবচেয়ে দুঃখের কথা, এ-কাজের জন্য প্রাপ্য কৃতজ্ঞতা তাঁদের জোটে না।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার থেকে আমি আমার তিনজন গুরুর পরিবারের তিনজন মহিলার সাথে নিজের যোগাযোগের কথা বলতে চাই, যাঁদের প্রত্যেকের থেকে আমি অপার উদারতা এবং দাক্ষিণ্য লাভ করেছি। বহু বছর ধরে আমি দিল্লি থেকে পুনা যাতায়াত করতাম, সেখানে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী এবং সুরকার পণ্ডিত জিতেন্দ্র অভিষেকীর বাড়িতে তাঁর থেকে শিক্ষালাভ করব বলে। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী বিদ্যা অভিষেকী যে শুধু আমাকে তাঁদের বাড়িতে তাঁদের শিষ্যদের বৃহত্তর পরিবারের অংশ হয়ে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন তাই নয়, যে সহযোগ এবং সহমর্মিতা তিনি অক্লান্ত ভাবে আমাকে জুগিয়ে গিয়েছিলেন তাকে অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। পুনায় আমার প্রথম তালিমের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় এক মাস। আমি সেখানে পৌঁছনোর সপ্তাহখানেক বাদে বিদ্যাতাই আমায় প্রশ্ন করলেন আমার ছেলেকে নিয়ে; তার বয়স তখন পাঁচ বছরের কিছু বেশি, দিল্লিতে তাকে রেখে আমি পুনায় এসেছিলাম প্রশিক্ষণের জন্য। আলোচনা হতে হতে তিনি আমায় প্রস্তাব দিলেন, ছেলেকে পুনা নিয়ে আসতে। এতে তাঁর এবং পণ্ডিতজীর দাক্ষিণ্য এবং আতিথেয়তার উপর বড় জুলুম হতে পারে, বিশেষ করে যখন পণ্ডিতজী তাঁর অনুষ্ঠানে গাওয়া এবং শিষ্যদের শেখানোর ব্যস্ত জীবন থেকে বেশ খানিকটা মূল্যবান সময় ব্যয় করে আমাকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়েছেন, এ আশঙ্কা প্রকাশ করতে তিনি সেসব উড়িয়েই দিলেন। শিশু ধবল যেন আমাদের সাথে থাকতে পারে, এ বিষয়ে তিনি এক রকম জোরাজুরিই করলেন। যথাসময়ে ধবল এসে পুনায় হাজির হল, এবং আমি যতক্ষণ তালিমে ব্যস্ত থাকতাম, তখন বিদ্যাতাই শুধু আমার ছেলে দেখাশোনার দায়িত্বই নিলেন না, আদর করে তাকে প্রচুর জিনিসপত্র কিনে দিলেন। তাঁর এমন করুণা লাভ করেছে, এমন শিষ্য আমিই একা ছিলাম না। পুনায় যে ছাত্রছাত্রীরা শিখতে আসতেন, তাঁদের জন্য বিদ্যাতাইয়ের ছিল অবারিত দ্বার। যতদিন না তাঁরা নিজেদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারছেন, ততদিন যাতে তাঁদের পেটভরে খাওয়া-দাওয়া হয় এবং মাথা গোঁজার জায়গা হয়, তা নিশ্চিত করতেন বিদ্যাতাই।
কিংবদন্তী শিল্পী পণ্ডিত কুমার গন্ধর্ব নিজের বাসস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের দেওয়াস-কে, সম্ভবত বড় শহরের শশব্যস্ত কোলাহল থেকে একটু দূরে নিজের মতো থাকবেন বলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আগ্রহী ছাত্রী হিসেবে তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতি আমি পেয়েছিলাম। এবং এ অনুমতি পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হত না, যদি না তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী বসুন্ধরা কোমকলি, যিনি নিজে একজন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, আমাকে দয়া করে আপ্যায়ন করতেন। এবং এই সুবিধে যে একজন তরুণ ছাত্রী হিসেবে নিজের মেধার জোরে নয়, সম্ভবত পণ্ডিত বিনয় চন্দ্র মৌদগল্যের সাথে আমার যোগাযোগের জন্য (যিনি নিজেও আমার আর এক গুরু, পণ্ডিত কুমার গন্ধর্ব ও তঁর পরিবারের সাথে এঁর অতি নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ছিল) হয়েছিল, সে-বিষয়েও আমার সন্দেহ নেই। তবে এই সুযোগের জন্য, এবং বসুন্ধরা তাইয়ের উদারতার জন্য, আমি চিরঋণী হয়ে আছি।
শ্রীমতী নয়না দেবীজির ছাত্রী হবার দৌলতে আমার দিল্লিতে তাঁর পরিবারের সাথে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর কন্যা রেনা রিপজিত সিংহ একজন অত্যন্ত খ্যাতনামা ইন্টিরিয়র-ডিজাইন শিল্পী, এবং অতি পরিশিলীতা, মহীয়সী একজন মহিলা। নয়নাজির ছাত্রীরা তাঁকে ভালবেসে বিলিদি বলে ডাকতেন। নয়নাজির বাড়িতে তালিম নিতে যাবার সময়ে আমার তাঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত, তিনি বরাবরই আমাকে স্নেহের এবং উদারতার সঙ্গে খাতির করেছেন। তবে ১৯৯৩ সালে নয়নাজির পরলোকগমনের পরেও বিলিদি যে মমতার সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন, সে ব্যাপারে কোনও কৃতজ্ঞতা প্রকাশই যথেষ্ট হবে না। নিজের মায়ের মৃত্যুর অকল্পনীয় শোকের সাথে লড়াই করতে করতেও বিলিদি নয়নাজির শোকাহত ছাত্রছাত্রীদের আগলে রেখে আমাদের সান্ত্বনা দিতে, সাহস জোগাতে কোনো ত্রুটি রাখেননি। আমাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগত ভাবেই হোক বা দলবদ্ধ ভাবেই হোক, তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন তাঁদের ওখানে যেতে, নয়নাজির রেকর্ডিংগুলো শুনে সেখান থেকে শিখে যেতে। এমনকী তাঁদের বাড়িতে একখানা চমৎকার সুসজ্জিত ঘরেরও তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, যাতে ইচ্ছে করলে আমরা সেখানে বসে রেওয়াজ করতে পারি। অন্য ছাত্রছাত্রীরা গিয়েছিলেন কি না, শুনেছিলেন কি না, অধ্যয়ন করেছিলেন বা রেওয়াজের কাজে ওই ঘরটি ব্যবহার করেছিলেন কি না, আমি জানি না। আমি যে নিজে করিনি, তা আমি জানি। এর নানা কারণ ছিল, যার মধ্যে মূলত ছিল নিজের দৈনন্দিন কার্যকলাপ এবং ব্যস্ততার সাথে বোঝাপড়া। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে, মায়ের বাড়ির প্রবেশপথ আমাদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া তো দূরের কথা, বিলিদি দ্বার অবারিত করে আমাদের দু’হাত বাড়িয়ে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি নয়না দেবী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠান করেন, এবং সেই প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যান তাতে তাঁর মা গর্বিতই হতেন। এই ফাউন্ডেশনের অনেকগুলো প্রকল্পের মধ্যে একটি হচ্ছে সঙ্গীতশিল্পীদের দলগুলোর জন্য স্বাস্থ্য বীমার বন্দোবস্ত করে যাওয়া, এ প্রকল্প তাঁরা গোড়া থেকেই শুরু করেছিলেন এবং আজও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর পরিকল্পিত এবং অনুষ্ঠিত প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান, প্রত্যেকটি প্রকল্পই খুঁটিনাটির প্রতি বিপুল মনোযোগের সাথে এবং অসীম পরিশীলনের সাথে পরিচালিত হয়েছে, যেসব গুণ তাঁর নিজের মার্কামারা। জানাতে দুঃখবোধ করি, সম্প্রতি দিল্লিতে বিলিদি মারা গিয়েছেন। তাঁর প্রয়াণ শুধু তাঁর নিজের পরিবারকে নয়, আমার মতো নয়নাজির বহু শিষ্যকেই অনাথ করে দিয়ে গিয়েছে।
এই অতুলনীয়া নারীদের কাছে তাঁদের স্নেহের জন্য, উদারতার জন্য, এবং বাঁধা গতের স্টিরিওটাইপ ভেঙে দেবার জন্য আমি ঋণী হয়ে আছি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র