রাম: না, এ রাজ্য থেকে অলিম্পিক্সে কজন গেল তা তো হিসেব করতে হবে?
গীতা: কেন? কটা লোক অলিম্পিক্সে যাচ্ছে, এটা একটা রাজ্যের উন্নয়নের ইনডেক্স হল কবে থেকে? আগে দ্যাখ জলে আর্সেনিক আছে কি না।
রীতা: কিংবা তালিবানরা সমাজ দখল করে নিচ্ছে কি না।
শ্যাম: হাহা, আমাদের দেশে তালিবানের অভাব? মনে রাখিস, এই সেই দেশ, যেখানে জিন্স পরেছে বলে একটা মেয়েকে আত্মীয়রাই পিটিয়ে মেরে ফ্যালে।
রীতা: বা খাপ পঞ্চায়েত রুলিং দেয়, মেয়েদের মোবাইল হাতে নেওয়া বারণ।
নীতা: বা একটা মেয়েকে বেধড়ক প্যাঁদায় বাবা আর ভাইয়েরা, কারণ সে মার সইতে না পেরে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে।
যদু: যাঃ, তা বলে তালিবান বলে দিলি? এখানে মেয়েরা অফিসে কাজ করছে না?
মধু: সিইও হচ্ছে না? চিফ মিনিস্টার হচ্ছে না?
গীতা: হচ্ছে তো, তারপর ধর্ষণকে বলছে সাজানো ঘটনা।
মধু: আহা, এক-আধটা কেসে অমন হয়। এমনিতে তো কেউ মেয়েদের নিচু চোখে দ্যাখে না।
নীতা: তা বটে। মিনিস্কার্ট পরলে কেউ আওয়াজও দেয় না। বাসেট্রামে সারাক্ষণ বুকের তাকিয়ে স্টপেজও পেরিয়ে যায় না।
রাম: সে যদি দেখিস সারা পৃথিবীতেই পুরুষেরা মেয়েদের বুকের দিকে তাকিয়ে আছে।
গীতা: ঠিক। কিন্তু প্রশ্নটা হল, সারা পৃথিবীই কি সেই পুরুষটার তাকিয়ে তাকিয়ে লাল ফেলার জন্যে মেয়েটাকেই দোষ দিচ্ছে? সারা পৃথিবীতেই কি মেয়েরা ছুটে এসে যদি বলে, ‘অমুকদা আমাকে মোলেস্ট করেছে’, তাহলে মা-বাবা বলে ‘চেপে যাও, ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই’?
মধু: এগুলো একটা পলিটিকাল পার্টি আসার পর বেড়েছে।
শ্যাম: একদম না। এ জিনিস আমাদের চিরকেলে ঐতিহ্য। আজ থেকে ২৫ বছর ৪০ বছর আগে, বৌদির ঘরে দুপুরবেলা পরপুরুষ এলে পাড়ার লোকে বাঁশপেটা করেছে। ছাত্রীরা ওড়না ছাড়া সালোয়ার-কামিজ পরলে কলেজের প্রিন্সিপাল বিকট হাঙ্গাম বাধিয়েছে।
রীতা: মোড়লরা গাঁয়ে গাঁয়ে ডাইনি বলে ল্যাংটো করে ঘুরিয়েছে।
মধু: আহা, সে ঠিক, কিন্তু যদি একটা শাসক দল এসে বলে, এই ফতোয়াগুলো ফুটফুটে, আর আধুনিকতার ধারণাগুলো আসলে পাশ্চাত্য অশ্লীলতা…
গীতা: আর একটা মুখ্যমন্ত্রী বলে, মা হয়ে যে রিপড জিন্স পরে সে ভারতীয় সংস্কৃতি জানে না…
নীতা: আর অন্য একটা মুখ্যমন্ত্রী বলে, বেশি রাতে মেয়েরা বাইরে থাকলে ধর্ষিতা তো হবেই…
শ্যাম: তখন এই গার্জেনিগুলো প্রশ্রয় পেয়ে যায়। গুজগুজগুলো গাঁকগাঁক হয়ে ওঠে। মনে হয়, এই কথাগুলো তো ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে অ্যাটেস্টেড হয়ে আসছে।
রাম: ঠিকই, কিন্তু অ্যাট লিস্ট মেয়েদের অপমান করার ক্ষেত্রে আমাদের এই সার্টিফিকেটের প্রেরণা দরকার নেই, মনে রাখিস এটা সতীদাহের দেশ। এখানে এখনও লোকে লেডি ডাক্তার দেখাতে চায় না।
যদু: আহা পাশাপাশি আমরা তো মেয়েদের অ্যাডমায়ারও করি রে বাবা। যারা অলিম্পিক্সে মেডেল পেল তারা কেন শাড়ি পরে খ্যালেনি, সে স্লোগান উঠেছে কি?
রাম: তালিবানরা কী করেছে জানিস? ব্যাংকে গিয়ে মেয়েদের বলেছে, সঙ্গে লোক দিচ্ছি, বাড়ি চলে যান, কাল থেকে আর কাজে আসবেন না।
রীতা: বোঝাই যাচ্ছে, এবার ওদের কী হবে। মাথা থেকে পা অবধি ঢাকা, সারা জীবন বাড়িতে বন্দি, অবিবাহিতা মেয়েরা সব্বাই তালিবানদের যৌনদাসী।
শ্যাম: আগেরবার যখন তালিবানরা কাবুল দখল করেছিল, মেয়েদের রাস্তায় চাবুক মেরেছে, স্টেডিয়াম ভর্তি লোকের সামনে গুলিও করেছে। মৃত্যুদণ্ড।
যদু: তাই তাদের সঙ্গে ইন্ডিয়ার তুলনাটা বাড়াবাড়ি না? এখানে তো মেয়েরা মডেলিং করছে, মামলা করছে, ডিভোর্স করছে, আর যা-ই হোক তোরা তো এই কথাগুলো চায়ের দোকানে বা ফেসবুকে চেঁচিয়ে বলতে পারছিস।
নীতা: আমি পারছি, দেশের অনেক জায়গাতেই অনেকে পারে না। আর, মেয়েদের গুলি করে মারছে না বটে, কিন্তু পণ না দিলে পুড়িয়ে মারছে। মেয়েরা জন্মানোমাত্র জ্যান্ত পুঁতছে। বড় হলে পাচার করছে, বেচছে। প্রেমে রাজি না হলে অ্যাসিড ছুড়ছে। আর রাজি হলে, প্রতি রাতে বৈবাহিক ধর্ষণ করছে।
মধু: তাছাড়া, শুধু মেয়ে-টর্চার দিয়ে দেশের দমঠাস অবস্থা দেখব কেন? কেউ গরু খেলে লোকে ঘিরে ধরে খুন করছে।
রাম: যাব্বাবা, কী থেকে কী! আরে, সেটা তো প্রশাসনিক লেভেলে সংগঠিত হচ্ছে না।
গীতা: কিন্তু প্রশাসনের স্পষ্ট আশকারাও আছে।
যদু: একটা কথা বলব? নিশ্চয়ই এই দেশের সরকার, এই দেশের যে কোনও রাজ্যের সরকার, পিছিয়ে-থাকা টাইপ। আর সাধারণ মানুষও বেধড়ক অশিক্ষিত। কিন্তু এই দেশের মধ্যে অনেকগুলো পকেট আছে, যা লিবারাল। তারা সরকারের ঝোঁকানি দেখে নিজেদের আনকুথ ইচ্ছেগুলোকে উসকেও তোলে না, আবার সরকারের হুমকিতে খুব একটা দমেও যায় না।
শ্যাম: হ্যাঁ, কিন্তু খুব ছোট পকেট। দু’টাকার কয়েন আঁটবে কি না সন্দেহ।
রাম: হাহা, সে হয়তো ঠিক, কিন্তু এখনও মেয়েরা ব্যাংকে কাজ করছে।
রীতা: করছে, কিন্তু এমন দল আছে, যারা ক্ষমতায় এলে স্লোগান ছড়াতে পারে, ‘কেজো মেয়ে ইজ পেজো মেয়ে’। ‘ঘরের লক্ষ্মী বাইরে ঠেলবেন না’।
যদু: আবার ঘুরেফিরে এক জায়গায়! আচ্ছা দ্যাখ, অলিম্পিক্সে জার্মান জিমন্যাস্টিকস টিম বলল, যে-পোশাক পরে জিমন্যাস্টিকস করতে হয় তা মেয়েদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপিত করে, তাই ফুল বডি-স্যুট পরব, যার নাম ইউনিটার্ড। তা ওদের তো প্রাচীনপন্থী বলছিস না? বাহবা দিচ্ছিস তো?
নীতা: বুঝলাম না, ওরা প্রাচীনপন্থী হবে কেন?
যদু: কারণ ওরা ছোট থেকে বড় পোশাকের দিকে গেল। তোদের কথায় তো, যারাই ঢাকতে বলছে, বা মেয়েদের দিকে ছেলেদের তাকিয়ে থাকার জন্য মেয়েদের পোশাককে দায়ী করছে, তারাই খারাপ।
গীতা: কী বকছিস! ওরা জিমন্যাস্টিকসের ট্র্যাডিশনকে চ্যালেঞ্জ করল, মানে, ছেলেদের ঠিক করে দেওয়া পোশাকবিধিটাকেই উল্টে দিল। তাছাড়া, অন্য সব টিম কিন্তু ওই ছোট পোশাক পরেই কমপিট করেছে, তাদের ঘাড়ে জার্মান টিম নিজেদের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। আমাদের আপত্তিটা শাড়ি পরতে বলায় নয়। আপত্তিটা শাড়ি কম্পালসরি করে দেওয়ায়।
রাম: কম্পালসরি তো কেউ করেনি।
শ্যাম: এখনও করেনি, কিন্তু ট্র্যাজেকটরি-টা সেদিকে। সেইজন্যেই মেয়েদের ছোট পোশাক দেখলেই এদেশে টুইটারে এত ট্রোল। জার্মানির ওই মেয়েরাই কিন্তু বিকিনি পরে বেরোবে ইচ্ছে হলেই। তাদের ট্রোল করা হবে না।
রাম: আহা সব দেশের তো মূল্যবোধ এক নয়।
গীতা: সে তো তালিবানরাও তাদের মূল্যবোধ অনুযায়ীই কাজ করছে। তাদের মূল্যবোধ বলে, নারীরা হীন মাংসের তাল, দমন করো আর ভোগ করো। তুই সেটাকে সাপোর্ট কর!
নীতা: মূল্যবোধ খুব মজার ওয়ার্ড। তালিবানরা প্রেস কনফারেন্সে বলেছে, মেয়েরা নিশ্চয়ই কাজকর্মও করবে, পড়াশোনাও, যতক্ষণ তারা তালিবানদের মূল্যবোধ আর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থাকছে। মিডিয়াও স্বাধীন, যা খুশি লিখতে বলতে পারে, যতক্ষণ তারা দেশের মূল্যবোধের মধ্যে থাকছে। সিধে কথা, ততক্ষণ তুমি দিব্যি বাঁচবে, যতক্ষণ আমার বানিয়ে দেওয়া খাঁচায় পায়চারি করছ। নইলে, মুন্ডু ঘচাং।
রীতা: ধর্মীয় অনুশাসনও আবছা। একটা শ্লোকের হাজার রকম ব্যাখ্যা করা যায়। তাই আসল কথাটা ধর্মও না, মূল্যবোধও না, আসল কথাটা আমার ইচ্ছে। আমার হাতে বন্দুক আছে, আমি বললাম, এদেশের মূল্যবোধ অনুযায়ী তুই আমার বিছনায় যাবি। এবার কর ডিবেট।
যদু: যাঃ, অনেকেই বলছে এটা নিউ তালিবান। ইমপ্রুভড ভার্সন।
নীতা: সে তো বটেই। হয়তো মাথার বদলে পাছায় গুলি করবে।
শ্যাম: বা ধর্ষণের পর হামি খাবে।
রাম: তা তালিবানদের নিশ্চয়ই সাধারণ আফগানরা সাপোর্ট করছে, নইলে এত তাড়াতাড়ি সব দখল করে ফেলল কী করে?
গীতা: আজেবাজে বকছিস কেন? লোকে ধর্মতলার বাস ধরার মতো প্লেন ধরতে দৌড়চ্ছে, চাকার সঙ্গে নিজেদের বেঁধেছিল— দুজন ওপর থেকে পড়ে মরে যাচ্ছে, মায়েরা পাঁচিলের ও-পার থেকে বাচ্চাদের এয়ারপোর্টে ছুড়ে দিচ্ছে যাতে কেউ না কেউ নিয়ে যায়, দেখিসনি? তালিবানদের মুখের ওপর প্রতিবাদ মিছিল বেরোচ্ছে, লোকে স্ট্যাম্পিডে মারা যাচ্ছে, বুলেট খাচ্ছে। অ্যাদ্দিন আফগান মেয়েরা পড়ছিল, উকিল হচ্ছিল, পার্লামেন্টে যাচ্ছিল। ছেলেরা জিন্স পরছিল, গিটার বাজাচ্ছিল। আজ একটা মৌলবাদী সংগঠন ওদের সারা জীবনটাকে একঢোকে গিলে নিচ্ছে!
মধু: আরে ভাই দায় তো আমেরিকার। ২০ বছর ধরে ফোঁপরদালালি করে এখন ল্যাজ তুলে পালাল, এদের হাতে লোকগুলোকে ছেড়ে।
যদু: তা ওরা কি পৃথিবীর মরণকাল অবধি গার্ড দিয়ে রাখবে না কি? আফগানরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে না?
শ্যাম: সেই ব্যবস্থাটাই তো বাবা আমেরিকার করার কথা ছিল। শুধু কয়েকটা পেশিওলা লোক মিলে চৌকি দিয়ে বেড়ানোর জন্যে তো আসেনি। গণতন্ত্র গড়ার জন্যে এসেছিল।
মধু: সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের ইজারা নিয়ে রেখেছে। এবার কর গণতন্ত্র রক্ষা! নিজের স্বার্থে ফুসকুড়ি গজালেই চম্পট মারছিস কেন?
রাম: দাঁড়া দাঁড়া, ওরা অন্য দেশের ঘাড়ে চেপে বসলেও দোষ, আবার সে-দেশ ছেড়ে চলে গেলেও দোষ?
নীতা: আরে তোকে যদি আমি বলি সেকেন্ড পেপারের নোটসগুলো সব আমি দিয়ে দেব চিন্তা নেই, আর পরীক্ষার আগে বলি ভাগ শালা নিজের নোটস নিজে লিখিসনি কেন— সেটা বিট্রেয়াল না? যদি বলি তোর সুরক্ষার দায়িত্ব আমার, তারপর রানিং ট্রেনে চড়ে হাত নাড়তে নাড়তে চেঁচাই তুই কেন যথেষ্ট গায়ের জোর সংগ্রহ করতে পারিসনি, স্বাবলম্বী হওয়ার মুরোদ নেই, স্যাভেজ, ক্যালানে— তার মধ্যে কতটা বেইমানি আর অপমান আছে বুঝছিস? বাইডেন এমন করে বুলি ঝাড়ছে যেন, কী করব বলুন মাসিমা, আফগান নেতাগুলো ঢ্যাঁড়স, আফগান সেনাগুলো উদবেড়াল, এদের তো আর মানুষ করা যায় না, তাই টা-টা।
যদু: আমেরিকা নাহয় বেহায়া ঠগ শয়তান, কিন্তু পশ্চিমের অন্য দেশগুলো কী করছে? তারা কি সব আমেরিকার পদনখের ছায়াপিন্ডি? তারা বলছে না কেন, বর্বরতার এই উত্থানে আমরা রুখে দাঁড়াব? শুধু চুকচুক শব্দ করেই দায়িত্ব সেরে দিচ্ছে কেন? তারাও তো গণতন্ত্রের মুরুব্বি?
মধু: আরে শোন, বিট্রেয়াল যদি বলিস, আফগানদের নিজেদের লোক কিছু কম যায়? ওদের প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানি তো হেলিকপ্টার ভর্তি টাকা নিয়ে সটকেছে। কিছু টাকা নাকি পড়ে গেছে, কপ্টারে ধরেনি।
শ্যাম: না না, এখন বলছে ফাঁসির ভয়ে পালিয়েছি, চপ্পলটা অবধি চেঞ্জ করার সময় ছিল না, টাকা নেব কখন?
রীতা: তাহলে হয়তো কপ্টারে কবিতা লিখছিল, সেগুলোই নীচে উড়ে এসেছে। যাক, সবাই কায়দা করে কেটে পড়, আর আল কায়দা আবার জেগে উঠুক।
শ্যাম: তখন রিফিউজিগুলোর প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। রাস্তায় আফগান দেখলেই মার্কিনরা খিস্তি ঝাড়বে।
রাম: সত্যি তো, এত আফগান রিফিউজি কোথায় যাবে? সমস্ত দেশে তো ঢুকতে চাইবে। তখন?
শ্যাম: তখন আশ্রয় দিতে হবে।
মধু: কিন্তু আমার দেশে আমি কেন অন্য দেশের লোক ঢুকতে দেব?
নীতা: কারণ তুই মানুষ। অন্য মানুষ সঙ্কটে পড়লে তুই তাকে আশ্রয় দিবি, এটাই সভ্যতা।
রাম: যাশশালা, তাহলে আমি খাব কী? রোহিঙ্গাদের দেব, আফগানদের দেব, চিন থেকে উইঘুর পালালে বুকে টেনে নেব। আমি শোব কোথায়?
রীতা: ছাদে। কিংবা সিঁড়িতে। কিন্তু কখনও বলবি না যে ওদের লাথি মেরে পথে ফেলে দেব। তোর দাদু-ঠাকুমার কাছে খোঁজ নে, গ্রামতুতো ভাইরা তাদের বাড়িতে থেকে চাকরি খুঁজবে বলে, গ্রামতুতো বোনেরা তাদের বাড়িতে থেকে পাত্র খুঁজবে বলে, তারা নিজেরা রুটি কম খেয়েছে, গাদাগাদি করে বারান্দায় রাত কাটিয়েছে। এটাই আমাদের মূল্যবোধ।
রাম: অ, এটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে দোষ হয় না?
শ্যাম: আরে! তুই বন্যায় ভেসে গেলে তোকে যদি লোকে শেলটার না দেয়? আজ যদি একটা যুদ্ধ লেগে তুই রাতারাতি রিফিউজি হয়ে যাস, আর সবাই যদি বলে আমার ভাতের ভাগ দেব কেন? দৃষ্টিটা বড় কর!
মধু: দৃষ্টিটা বড় করলে তুইও দেখবি, তালিবানরা কিন্তু অ্যাকচুয়ালি তাদের দেশটাকে স্বাধীন করল। ফরেন এলিমেন্ট হাটিয়ে দিল।
গীতা: টেকনিকালি তা-ই, কিন্তু নীতির দিকটা? নিজের লোকেরা যদি ফাঁসি দেয়, আর বিদেশিরা যদি শিক্ষা, আধুনিকতা শেখায়…
যদু: ব্রিটিশরা এই কথাই বলেছিল কিন্তু। ‘আমরা চলে গেলে ইন্ডিয়ানরা দেশটার ভুষ্টিনাশ করবে।’ কোনও দেশ কখনও অন্য দেশের লোকের ঘাড়ে চড়ে তরে যেতে পারে না।
শ্যাম: কেন পারবে না? স্বদেশের লোককে এত রেটিং দিচ্ছিস কেন? অলিম্পিক্সে একজনও সফল ভারতীয় খেলোয়াড় আছে, যে বিদেশি কোচের সাহায্য নেয়নি?
রাম: যাক্কলা, তা বলে স্বাধীন হব না?
রীতা: হ, হয়ে মর। ব্যক্তিস্বাধীনতা খুইয়ে নেত্য কর, দিশি প্রভুর চাবুক খাই, দিশি শিকলে লজ্জা নাই।
মধু: উল্টো ঝামেলাও তো হচ্ছে। ব্রিটিশ মডেল লিলি কোল ইনস্টাগ্রাম থেকে নিজের বোরখা পরা ছবি নামিয়ে নিলেন, এত গালাগাল।
নীতা: আরে, উনি খামকা বোরখা পরা ছবি দিয়েছিলেন কেন? আবহাওয়া নিয়ে একটা বই লিখলে সেটা প্রোমোট করতে আচমকা ‘বৈচিত্র উদযাপন’-এর মেসেজ দিতে হবে? আর, সাদা মেয়ে ফ্যাশন করে বোরখা পরলেই বৈচিত্র উদযাপন হয়ে যায়?
যদু: কেন হবে না? সাদা লোক আমার গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারে, আর সাদা লোক আমার পোশাক পরে পজিটিভ মেসেজ দিতে পারে না?
শ্যাম: ধুর, এসব হচ্ছে ‘হ্যাশট্যাগ ফেমিনিজম’।
গীতা: আসলে ঝামেলা হত না, বিরাট হাততালিই পড়ত, ফট করে পোস্ট-টা আফগান মেয়েদের পরাধীনতার সঙ্গে কোয়েনসাইড করে গেছে।
শ্যাম: কিন্তু বোরখাকে শুধু বন্দিত্বের সিম্বল হিসেবে দেখা তো বিচ্ছিরি ব্যাপার। বোরখা তো ব্যক্তিস্বাধীনতারও সিম্বল হতে পারে।
যদু: শোন, এ যা চলছে, লোকের পিওর থিওরি গুলিয়ে গেছে। হেভি অ্যাংজাইটিতে আছে তো।
মধু: অ্যাংজাইটির কিছু নেই। ক’দিন পর কোভিড সুইপ করবে। তালিবানদের ঝাড়েবংশে মারবে।
নীতা: তার মানে সভ্যতার ভরসা এখন করোনাভাইরাস!
রীতা: বা তালিবানদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, যা শুরু হয়ে গেছে। বা আফগানদের গণ-অভ্যুত্থান, যা হয়তো হবে আর ২০ বছর পরে।
যদু: তদ্দিনে ওদের গানবাজনার কী হবে? আর সিনেমার? আর শয়ে শয়ে থেঁতলে-পিষে যাওয়া মেয়েদের?
শ্যাম: আর্টের ব্যাপারটা জানি না। কিন্তু মেয়েদের নিয়ে এতটা ভাবিস না। তালিবান অর নো তালিবান, ওরা মরবেই। আমার পিসিকে জিমন্যাস্টিকসের ডিস্ট্রিক্ট মিটে যেতে দেওয়া হয়নি। দাদারা ছিটকিনি দিয়ে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। হাফপ্যান্ট পরে ওসব করতে হবে না।
নীতা: আমার জেঠু মাধ্যমিকে ফিফ্থ, ব্যাংকের ম্যানেজার। জেঠিমাকে ডেলি রাতে বেল্ট দিয়ে মেরে বাইরে বের করে দেয়।
মধু: আমার বান্ধবী উদ্দাম বড়লোককে লাভ ম্যারেজ করেছে। ফোনের পাসওয়ার্ড বলে দিতে হয়, নিয়ম করে হাজব্যান্ড ফোন চেক করে।
রীতা: যেদিন চিফ নিউজ এডিটর আমার পেছন টিপল, দৌড়ে গিয়ে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল-এর ম্যাডামকে বললাম, এবার অন্তত স্টেপ নিন, রোজ কমপ্লেন করছি! কোম্পানি আমায় স্যাক করল।
গীতা: তাই ওগুলো নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আফগান মেয়েরা এখন টুইট করছে, আমাদের ইতিহাসের ঘুপচি কর্নারে ছুড়ে ফেলা হল। ক’দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই টুইট করাও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন রুটি বেলবে। বাচ্চাকে আদর করবে। যেমন নর্থ ক্যালকাটা বা সাউথ দিল্লি বা ওয়েস্ট বান্দ্রা বা ইস্ট বেঙ্গালুরুতে করছে। বা বস্তিতে। ফুটপাথে। অজ গাঁয়ে। বেঘো জঙ্গলে।
রাম: আবার সেই গা-জোয়ারি তুলনা! একটা মৌলবাদী স্বৈরাচারী রাষ্ট্র আর একটা রক্ষণশীল পুংতান্ত্রিক সমাজ এক নয় রে বাবা। এখানে তুই চেষ্টা করলে বেরিয়ে আসতেও পারিস। ওখানে সে চান্সটাই নেই।
মধু: সঙ্গে মনে রাখ, ছেলেরাও টুইট করছে। তাদেরও জুতোর তলায় থাকতে ভাল লাগে না। তাদেরও দাড়ির লেংথ কম হলেই চাবুক। তাছাড়া মা-কে বউকে মরতে দেখে প্রত্যেকেরই উল্লাস জাগে তাও ঠিক নয়।
রীতা: যে-সৈনিকরা আফগানিস্তানের যুদ্ধে পা হারিয়েছে, হাত হারিয়েছে, বন্ধু হারিয়েছে, ভাই হারিয়েছে, তারাও তো টুইট করছে: আমাদের সব আত্মত্যাগের রেজাল্ট জিরো?
যদু: সেইটাই মজা। এমন একটি বৃহৎ জগঝম্প, জগৎ কখনও দেখেনি। জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার, আচমকা চোখ মেলে দেখি, হায়, সিমিলার ঝাড়।
শ্যাম: কিন্তু তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। গান বন্ধ হোক, সিরিয়াল বন্ধ হোক, আকাশপানে তাকালে ব়্যাট-ট্যাট-ট্যাট হোক। পরের অলিম্পিক্সে যদি আফগানরা মেডেল পায়, ব্যাস, ট্রা-লা-লা। জয় উন্নয়ন।
রীতা: কীসে পাবে?
গীতা: কেন? শুটিং-এ! বুল’স আই ফর্দাফাঁই!
রাম: বা নতুন ইভেন্টও যোগ হতে পারে: হুইপিং, স্টোনিং।
নীতা: নাঃ, ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড ‘স্টোনড’ বলতে অন্য কথা বোঝে। ঢুকতে দেবে না।