সত্যজিৎ রায়-এর সিনেমাগুলো বোধহয় আমরা সবাই দেখেছি। ‘আমরা’ বলতে যারা সিনেমায় কাজ করি বা সিনেমা দেখার উৎসাহ বোধ করি। ‘আমরা’ ছাড়া আরও বহু মানুষ তাঁর তৈরি সিনেমাগুলো দেখেছেন টেলিভিশন, ইউটিউব ইত্যাদির দৌলতে। ‘আমরা’ তাঁর তৈরি সিনেমাগুলো একাধিকবার দেখেছি এবং এখনও দেখে চলেছি। তাঁর প্রত্যেকটি সিনেমা অসাধারণ পরিশ্রমে ও দক্ষতায় তৈরি সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর তৈরি সব ক’টি সিনেমা আমার পছন্দের। কয়েকটা বেশি, কয়েকটা কম। সবচেয়ে বেশি পছন্দের তালিকায় পড়ে ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘নায়ক’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ও ‘সোনার কেল্লা’। বাকিগুলো এই সিনেমাগুলোর তুলনায় একটু কম পছন্দের। সেগুলো কেন কম পছন্দের, সেসব আলোচনা করতে গেলে অনেক লিখতে হবে। আপাতত এই লেখার বিষয়ে আসি। এই লেখায় আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের তিনটি চরিত্রের বিষয়ে লিখব, যে চরিত্রগুলো আমরা তাঁর তৈরি সিনেমাগুলোয় দেখেছি। আমাকে সুযোগ দিলে সেই চরিত্রগুলোর অভিনয় করতাম।
প্রদোষ মিত্র (ফেলুদা)
এই চরিত্রটি আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। এমন একটি চরিত্র সত্যজিৎ রায় সৃষ্টি করেছেন, যাঁর ব্যাপারে পড়লেই বা যাঁকে পর্দায় দেখলেই আমার মনে একটা আলোড়ন হয়। সৌমিত্রকাকুর অভিনয় আমার বরাবরই ভাল লাগত কিন্তু তিনি যখন ফেলুদার চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন, তখন থেকে আমি তাঁর আরও বড় ভক্ত হয়ে যাই। সেই চরিত্রের এমন একটা ঋজু মনোভাব আর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা যে, তাঁকে দেখেই একটা শ্রদ্ধা জাগে মনে। যদিও মাঝে মাঝে তিনি নিজের ব্যাপারে গর্ব করতে ছাড়েন না। সরাসরি না করলেও কথাবার্তার ধরন-ধারণে বোঝা যায়। কোনও রকম পরিস্থিতিতে তিনি বিচলিত হন না।
শারীরিক শক্তি আসামান্য কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করেন না। অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁকে অনায়াসে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এরকম একজন মানুষ সঙ্গে থাকলে কারও কোনও বিষয়ে চিন্তা থাকতেই পারে না। আমার বাবা অনেকটা এরকম-ই ছিলেন। সবাই নিজের বাবা-কে ‘নায়ক’-এর আসনে বসিয়ে রাখে, আমিও তাই করতাম। আমার মনে হত, আমার বাবা ভুল করতে পারেন না। ফেলুদার কোনও বান্ধবী নেই, আমারও ছিল না। আমার মনে হত, মহিলা-সঙ্গ আমাকে দুর্বল করে দেবে, দিক্ভ্রষ্ট করে দেবে। আমি কলেজে পড়াকালীন মার্শাল-আর্টস করতাম, পরে বুঝলাম ‘মগজাস্ত্র’-র থেকে বড় শক্তি আর হয় না। ফেলুদার মতো ‘চারমিনার’ টানা শুরু করলাম। তাতে দুটো সুবিধে ছিল, এক, সস্তা হত আর দুই, বেশি কড়া বলে অন্যরা ভাগ চাইত না। আমিও ফেলুদার মতো লম্বা ছিলাম। আমিও তাঁর মতো ক্রিকেট খেলতাম। আমিও মিঠে-পাতার খয়ের ছাড়া সাদা পান খেতাম। আমিও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত ছিলাম। আমিও পুজোআর্চায় খুব একটা বিশ্বাস করতাম না। আমিও বাংলা, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষায় কথা বলায় রপ্ত ছিলাম। আমি স্বয়ং সত্যজিৎ রায়-কে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। যদিও তিনি তখন ফেলুদার গল্প নিয়ে আর ছবি তৈরি করেননি, পরবর্তীকালে সন্দীপ রায় তৈরি করেন এবং আমাকে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দেন। এটা আমার অভিনয় জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
হীরক রাজা
উৎপল দত্ত অভিনীত এই চরিত্রটি আমার খুব পছন্দের। হাস্যকর, অথচ অতি দুর্বৃত্ত। তাঁর ছন্দে কথা বলা ও গলার স্বরের তীব্র ওঠা-নামা একটা মজা এবং ভয়াবহতা সৃষ্টি করে। তাঁর চোখ বড় করে আশ্চর্য হওয়া এবং হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়া একটা হাস্যরস ও অনিশ্চয়তার আবহাওয়া তৈরি করে। যদিও আমি জানি যে, সেই চরিত্রে উৎপল দত্ত-র থেকে ভাল অভিনয় করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়, তবু লোভ হয়। যে-জন্যে সত্যজিৎ রায় তাঁকে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ মগনলাল মেঘরাজ-এর চরিত্রে অভিনয়ে নিয়েছিলেন।
হীরক রাজা তাঁর নিজের সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদ আগলাতে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, রাজ্যের মানুষের ভাল-মন্দের কথা মোটেই ভাবতেন না। তাঁর রাজপরিষদের পরামর্শ যদিও নিতেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিজের নিতেন। যারা তাঁর অনিষ্ট চাইত, তাদের মগজ-ধোলাই করিয়ে দিতেন। পড়াশুনাকে একেবারেই প্রশ্রয় দিতেন না। ‘মানুষ যত বেশি পড়ে তত বেশি জানে। যত বেশী জানে তত কম মানে’। এই আশঙ্কায় শিক্ষা বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অসহায় মানুষজন প্রাণের ভয়ে প্রতিবাদ করতেন না। এমন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ অত্যাচারী শাসক যে শেষপর্যন্ত টিকে থাকবে না, সেটা জেনেও তিনি অত্যচার চালিয়ে যেতেন।
বিশ্বাস করতেন যে, তিনি যা করছেন তা ঠিক করছেন। তাঁর সেই নিজের মূর্তি টেনে ফেলে দেওয়ার জন্যে দৌড়টা ভোলার নয়। মনে করিয়ে দেয় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর সেই জহর রায়ের বর্ষা হাতে দৌড়টার কথা। একটা শারীরিক ভাবে অক্ষম লোকের বাধ্য হয়ে দৌড়নোর অভিনয় ওর থেকে ভাল হতে পারে না বলে আমি মনে করি। ‘হীরক রাজার দেশে’ দেখার পর মনে হয়েছিল, আরও একটা ওই ধরনের ছবি হলে খুব ভাল হয়। হয়তো আমি একটা সুযোগ পেতাম! সব-ই অলীক স্বপ্ন।
লালমোহন গাঙ্গুলী (জটায়ু)
সন্তোষ দত্ত অভিনীত এই চরিত্রটি আপামর জনসাধারণের পছন্দের চরিত্র। এই চরিত্রটাকে ভাল না বেসে পারা যায় না। একেবারেই নিরীহ একজন মানুষ, যিনি অন্যের অনিষ্ট করতে পারেন না এবং চানও না। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তিনি চৌকস এবং বুদ্ধিমান। নিজের লেখা উপন্যাস নিয়ে নিজেই গর্ব করেন। তাঁর ভুল তথ্যে ভরা গল্পগুলো মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা ভেবে উত্তেজনা বোধ করেন কিন্তু সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেই অসহায় হয়ে পড়েন। যেহেতু নিজে দুঃসাহসিক রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক, তাই নিজে সেই সব পরিস্থিতি চেখে দেখতে চান। খাবার-দাবারের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী অথচ শরীর-স্বাস্থ্য একদম ঠিক। সব কিছু শেখার আগ্রহ প্রবল, তাই ফেলু/তোপসের মতো সঙ্গী পেয়ে তিনি আনন্দ চেপে রাখতে পারেন না।
কোনও অনুসন্ধান বা ভ্রমণের মধ্যে না থাকলে ফেলু/তোপসের বাড়ি চলে যান নিছক আড্ডা মারার জন্যে। যাওয়ার সময় কচুরি, সিঙাড়া, জিলিপি, ডালমুট ইত্যাদি কিনে নিতে ভোলেন না। তাঁর সুটকেস-এর রং লাল আর গাড়ির রং সবুজ। তাঁকে ধনী লোক বলা যায় কারণ তাঁর প্রতিটা বইয়ের বহু সংস্করণ বিক্রির ফলে তাঁর রোজগার ঈর্ষণীয়। তিনি আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক। অনেক প্রখ্যাত অভিনেতারা সেই চরিত্রে ভাল অভিনয় করলেও, সন্তোষ দত্ত-র মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। সত্যজিৎ রায়ের লেখায় তাঁর যা শারীরিক বর্ণনা দেওয়া আছে, তার ধারে-কাছেও আমি নেই, তবুও সেই চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছে ‘প্রখর’।