উল্টো ডিগবাজি
খেলোয়াড়দের ‘কামিং আউট’ এখন সমকামীদের ‘কামিং আউট’-কে দশ গোল দিচ্ছে। একমাত্র শিল্পে হেরোদের দেড়া মূল্য দেওয়া হয়, কিন্তু খেলাধুলোয় জোরে-দৌড়নো লোকের চেয়ে গোড়ালি-মচকে বসে পড়া লোককে তোল্লাই দেওয়া— অ্যাক্কেরে অভাবিত। খেলোয়াড়রা ব্যান্ডেজের আড়ালে ক্ষত, জার্সির আড়ালে বুক-দুরুদুরু, দৃপ্ত চোয়ালের আড়ালে অনিদ্রা ও পিত্তিবমির পাঁচালি লুকিয়ে, বাঁশি বাজামাত্র রইরই ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু আজ, আচমকা, তাঁরা অলজ্জিত উচ্চারণে বলছেন, হ্যাঁ ভাই, মনের চোটে মলম লাগাতে এক্ষুনি ছুটি দরকার। এই উল্টো-স্রোত শুরু হয়েছে ফরাসি ওপেনের আগে নেওমি ওসাকা থেকে, তিনি বলেছেন, সারাক্ষণ উৎকণ্ঠা ঘটে, তা বেড়ে যায় রিপোর্টারদের সামনে প্রশ্নোত্তরের আসরে। আর এই অলিম্পিক্সের শ্রেষ্ঠ স্টার যাঁর হওয়ার কথা ছিল, স্লো-মোশনে যাঁর ইতিহাস-প্রবেশ নিরীক্ষণের জন্য গোটা পৃথিবীকে ক’মাস ধরে থাবড়ে-থুবড়ে তৈরি করেছে মিডিয়া, সেই জিমন্যাস্ট সিমন বাইলস (একটা ভল্ট ঠিকভাবে দিতে না-পেরেই) বলে বসলেন, আমি মানসিক ভাবে ঠিক জায়গায় নেই, অমুক অমুক ইভেন্টে নামব না। আর ভারত ও ইংল্যান্ডের টেস্ট সিরিজের আগে ইংরেজ তারকা বেন স্টোকস-ও অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি নিলেন, মানসিক সমস্যার জন্যই।দেখেশুনে অনেকে স্তম্ভিত হয়ে মাথা চুলকোচ্ছেন, টুকুরটাকুর নিন্দেও চলছে, কিন্তু হড়কা-বানের ন্যায় আছড়াচ্ছে হাঁউমাঁউ প্রশস্তি সাষ্টাঙ্গ স্যালুট, বিশেষত ভাবুক-ভূখণ্ডে সিমন-কে নিয়ে ইউফোরিক উল্লাস: ‘শাবাশ বুকের পাটা!’, ‘মন-মচকানির কথা মেনস্ট্রিমে আনল!’, ‘ভল্ট সবাই দেয়, অল্ট কজন?’ আইকনের হৃদি-কালশিটে উদ্ঘাটন হয়ে উঠল সোনা জেতার চেয়ে শ্রেয় কীর্তি, মহাবীরত্বের দ্যোতক।
ঠিকই, মানসিক স্বাস্থ্যকে চিরকাল হতচ্ছেদ্দা করা হয়েছে, লোকে বিষফোড়া হলে ডাক্তারের কাছে গেছে কিন্তু হৃদয়ে বিষাদ জমলে কদাপি নয়। ‘শিরায় টান লেগেছে, অফিস যাব না’ অ্যালাউ-অজুহাত, কিন্তু ‘মনটা ডাউন আছে, ছুটি চাইছি’— নিতান্ত ফাঁকিবাজি। তাই আজ বিশ্বসেরা খেলোয়াড়রা যখন বলছেন মানসিক ক্লান্তি অবসাদ ভয়ের বশে খেলাটা খেলব না (এবং অন্য বহু খেলোয়াড় তাঁদের চাপের কথা, এবং ইমেজের স্বার্থে চাপের কথা না-বলতে পারার চাপের কথা— কোরাসে বলে উঠছেন তাঁদের দেখে), তখন মন-বিশারদরা উল্লসিত, অ্যাদ্দিনে স্বীকৃতি আদায় হল, দেহ-পটুত্বের সমান যত্ন করতে হবে মন-ফিটনেসের। চলতি ভাবনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মনের স্বাস্থ্য নিয়ে মুখ খোলার জন্য এঁদের দুরন্ত সাধুবাদ প্রাপ্য।
কিন্তু তা বলে ‘খেলতে নামব না, বড্ড ভয় করছে’ ঘোষণাকে (যার অফিশিয়াল বয়ান অবশ্যই অনেক পরিশীলিত, ‘বড্ড প্রত্যাশার চাপ’, ‘নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত মনে হচ্ছে না’, ‘মনোযোগে ছেদ পড়ছে’) এমন হুড়িয়ে হাততালি দিলে, কিঞ্চিৎ খটকাও লাগে। সত্যিকারের সাধনার সা বলতে তো সেই ধ্রুবতানকেই বুঝি: চ্যুত হওয়া যাবে না, যা-ই ঘটুক। সন্তানশোকও রবীন্দ্রনাথকে লেখা থেকে একদিনের জন্যও সরাতে পারেনি, স্ত্রীবিয়োগেও আইনস্টাইন সেদিনকার বিজ্ঞানভাবনা থেকে ছুটি নেননি। বাঙালি বক্তা সন্তানের মৃত্যুর দিনেও বক্তৃতা দিয়েছেন, বাঙালি গায়ক বাবার মরদেহ বাড়িতে রেখে, ফাংশন সেরে এসে দাহ করেছেন। এই অলিম্পিক্সেই সিমন বাইলসের যে সতীর্থ অলরাউন্ড জিমন্যাস্টিকসে সোনা জিতেছেন (সুনিসা লি), তাঁর বাবা বছর-দুই আগে এক দুর্ঘটনার ফলে বুকের নিচ থেকে প্যারালিসিস-গ্রস্ত, আর তাঁদের দুই নিকটাত্মীয় কোভিডে মারা গেছেন। খেলার ইতিহাস তো আমাদের নিয়ত স্বরচিত মিরাকলে বিশ্বাসী হতে শেখায়। গেল ডেভার্স-কে ডাক্তার বলছেন আপনি কোনওদিন হাঁটতে পারবেন না, পা কেটে বাদ দেওয়াই ভাল, এক বছর পর ডেভার্স বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার হার্ডলসে রুপো পাচ্ছেন, পরের বছর অলিম্পিক্সে ১০০ মিটার দৌড়ে সোনা। গ্রেগ লুগানিস অলিম্পিক্সে ডাইভ দেওয়ার সময় তাঁর মাথা স্প্রিংবোর্ডে ঠুকে ফেটে যাচ্ছে আর চারটে স্টিচের ওপর ব্যান্ডেজ বেঁধে গ্রেগ ডাইভ দিচ্ছেন ও সোনা জিতছেন। মোনিকা সেলেস-কে তাঁর কেরিয়ারের তুঙ্গে একজন টেনিস কোর্টের ধারে ছুরি মারছে আর সেলেস তিন বছর পর, যে-বছর সেলেসের বাবার টার্মিনাল ক্যানসার ধরা পড়ছে, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতছেন। বেথানি হ্যামিলটন ১৩ বছর বয়সে সার্ফিং-এ যখন উঠতি তারকা, একটা হাঙর তাঁর বাঁ-হাত খেয়ে নিচ্ছে এবং বেথানি একমাস পরেই আবার সার্ফিং শুরু করছেন ও পরের বছরই জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হচ্ছেন। সৌরভ গাঙ্গুলি অধিনায়ক থাকার সময় ভারতীয় ক্রিকেট দল থেকে বাদ পড়ছেন, বিজ্ঞাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন ‘আমি সৌরভ গাঙ্গুলি, মনে আছে আমাকে?’, তারপর সব অপমান ও অমর্যাদা কাটিয়ে জাতীয় দলে ফিরে বিশ্বকাপ খেলছেন। খেলা পেরিয়েও আমাদের গ্রহের মহান মানুষের ইতিহাস ইস্পাত-প্রতিজ্ঞার ইতিহাস, এমনকী বহু সাধারণ কেরানির কাজ-নিষ্ঠার দৃঢ়তাই, সব মনোবেদনা সংসার-টেনশন দাম্পত্য-অশান্তি জোরসে দূরে ঠেলে সকাল দশটায় অফিস পৌঁছে ফাইল ঠেলার রুটিন-অধ্যবসায়ই, আমাদের সংসারের ছিলা রাখে টান। নিশ্চয়ই ‘পাঁচ বছর আগে যে লোকটার পা ভেঙে গেছিল আজ সে অলিম্পিক্স হাইজাম্পে সোনা পাচ্ছে’-র পাশাপাশি, ‘পরপর দুটো অলিম্পিক্সে ডিসকাস ছুড়ে যে সোনা পেয়েছিল সে এবার কিচ্ছু পাচ্ছে না’-ও ঘটছে। নিশ্চয়ই অবিশ্বাস্য জয়ের পাশাপাশি অভাবনীয় পতনেরও অধ্যায় ক্রীড়া-আসরে লেখা হচ্ছে। কেউ চেঁচাতেই পারে, ‘শুধু জেতার গল্প চলবে না, হারার কাহিনিও বলা-শোনা হোক’— তা দাবি হিসেবে বেশ অভিনব, কাব্যিক, সর্বোপরি ‘woke’, কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন? যাঁদের আমরা ভাবি নির্ঘাত দেবতা, যাঁদের তিনতলার সমান কাট-আউট হয়, তাঁদেরও মধ্যিখানে স্পন্দিত ধড়ফড়ানি-ছটফটানিওলা প্রাণীর হৃদয়, তা জানা ভাল (অন্য মানুষের হ্রস্বতার প্রতি কর্কশতা কমে, আলিঙ্গনের প্রসার জন্মায়), কিন্তু কোনটা অনুসরণযোগ্য— নাছোড় জেদ আর মানসিক জোর খাটিয়ে জেতা, না কি মানসিক দুর্বলতাকে প্রাধান্য দিয়ে না-লড়ে ফিরে আসা? খেলায় যে হেরে গেল, তার প্রতি আমরা হিংস্র তেড়ে যাব না ঠিকই, এও শিখতে হবে খেলোয়াড় মানসিক ঝামেলার কথা বললে তাঁর প্রতি বন্ধুদৃষ্টি নিয়ে তাকাও, কিন্তু তা বলে হাল-ছেড়ে-দেওয়া একটা লোকের পরমতর গুণ হয়ে উঠবে কোন রসায়নে? মানুষই তো একমাত্র প্রাণী যে নিজের কাছে অতিমানুষতা দাবি করে ও আদায় করে ছাড়ে। সেই উদাহরণের বদলে আচমকা নিজের সীমাবদ্ধতা কবুলের উদাহরণকে উচ্চ-বেদীতে প্রতিষ্ঠা করছি কেন? যে-খেলোয়াড়রা বললেন ‘পারছি না’, তাঁদের প্রতি আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি থাক, কিন্তু তাঁদের অপারগতা আচমকা তাঁদের কৃতকার্যতার চেয়ে কুর্নিশযোগ্য ও ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে গেলে মেগা-মুশকিল।
দিকে দিকে লেখা হচ্ছে, সিমন যা করেছেন, তা খেলা জেতার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। সোনার মেডেলের চেয়ে ঝলমলে। ময়দানে নেমে বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় সমানে-সমানে লড়ার চেয়ে বেশি নির্ভীকতার পরিচায়ক। তাই? যখন দল আমার দিকে তাকিয়ে নেতৃত্বের জন্য, দেশ আমার দিকে তাকিয়ে সর্বোচ্চ ট্রফি-জয়ের জন্য, পৃথিবী আমার দিকে তাকিয়ে অমোঘ ইন্দ্রজালের অপেক্ষায়, তখন আমি যদি শুধু আমার দিকে তাকিয়ে (‘নিজেকে আর টানতে পারছি না’, ‘ব্যর্থ হলে অলৌকিক জ্যোতি ভেস্তে যাবে’) দুদ্দাড়িয়ে কেটে পড়ি, তা হয়ে উঠবে সাহসের লক্ষণ? তাহলে ভীরুতা কাকে বলে? কাপুরুষতা কাকে বলে? পালিয়ে যাওয়া কাকে বলে? অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যাঁদের নাম এখানে করা হচ্ছে, তাঁরা সর্বকালের সেরা, অলিম্পিক্স ও বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নশিপ মিলিয়ে সিমন বাইলসের মেডেল-সংখ্যা ৩২, নেওমি ওসাকা এখন বিশ্বের দু’নম্বর মহিলা টেনিস খেলোয়াড় এবং চারবার গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন, আর বেন স্টোকস পৃথিবীর এক সেরা অলরাউন্ডার (গত বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ)। এঁদের জেতার ইচ্ছে ও বুকের পাটা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকতে পারে না, একেবারে সহ্যের শেষ পাঁচিল ভেঙেছে বলেই এঁরা সরেছেন। কিন্তু সেইখানেই তো মহাবিস্ময় ও টনটনে আপত্তি। এত বড় খেলোয়াড় হওয়া মানে শুধু খেলার প্রতিভাটাকে নিয়ত পালিশ করে যাওয়া নয়, চরমতম চাপ সামলানোর শিক্ষাও আয়ত্ত করা। তুমি সচিন তেন্ডুলকর বা লিওনেল মেসি হবে আর তোমার ঘাড়ে তিনশো মণ চারশো টন পার্মানেন্ট পুঁটলি থাকবে না? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গৃহীত হলে যেমন উন্মত্ত গ্ল্যামার হয়, কোটি কোটি টাকার চুক্তি সই হয়, ম্যাপের প্রতি-প্রান্তে নিত্যপুজো হয়, টেক্সট-বইয়ে পাঁচপাতা চ্যাপটার হয়, তেমনই হিমালয়-ওজনের প্রত্যাশা, বিলিয়ন বিলিয়ন মুগ্ধতাকামী দৃষ্টি, উদ্যত ট্রোলের বিষবাষ্পের প্যাঁচ-পয়জারও সামলাতে হয়, নিজের রাত্রি-জুজুদের সঙ্গে দৈনিক কুস্তি লড়তে হয়। এগুলো স্ট্যাচু-দিব্যতারই মাশুল, প্রাপ্তিগুলো উপভোগ করব আর কো-ল্যাটারাল ড্যামেজগুলো পোয়াব না, তা তো সম্ভব না। ভয়, টেনশন, অতীতের দুঃসহ স্মৃতি, ব্যক্তিগত বেদনা-ট্রাক যতই পিষে দেওয়ার চেষ্টা করুক, প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো তার সঙ্গেও সতত পাঞ্জা লড়তে হবে, সেই মানসিক কাঠিন্যের অনুশীলনও ক্রীড়া-প্রস্তুতির আবশ্যিক অঙ্গ। মানুষের মহত্তম অর্জন হল স্ব-চাবুক: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নেমে ‘মনটা কেমন ভাঙচুর হচ্চে’ বলে ধনুক নামিয়ে রাখা যায় না, ম্যারাথনে গোড়ালি ঘুরে গেলেও দৌড় শেষ করতে হয়, অ্যান্টিগা টেস্টে চোয়াল ভেঙে গেলেও ব্যান্ডেজ জড়িয়ে চোদ্দো ওভার বল করতে হয়, অলিম্পিক্সে মন পিছলে গেলেও আত্মজোর জড়ো করে পরবর্তী ভল্টের চেষ্টা চালাতে হয়। এমনকী যদি তাতে কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধি না-ও ঘটে, সোনা না-ও পাওয়া যায়, তবু অংশ নিতে হয়, যে কাজ শুরু করেছি তা শেষ করতে হয়, কাজের প্রতি বিশ্বাস নিবেদন ও দায়বদ্ধতার তা বড় প্রমাণ। (সিমন বলেছেন, তিনি অংশ নিলে বরং দলের পয়েন্ট কমে যেতে পারত, কিন্তু খেলার মধ্যিখানে দল থেকে সেরা খেলোয়াড় নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে বাকিদের কী নড়বড়ে অবস্থা হয়, অনুমেয়। মনে রাখতে হবে, স্ট্র্যাটেজি-প্রণয়ন ও প্র্যাকটিস হয়েছে এটা ধরে নিয়ে: সিমনই প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করবেন)। তাও সিমন, বেন, নেওমির তো ঘরে পদক রাখার জায়গা নেই, কিন্তু তাঁদের কাণ্ড থেকে যদি উঠতি ও ইচ্ছুক খেলোয়াড়েরা (বা খেলার জগতের বাইরে এমনি-এমনি মানুষেরা) নিজের কমতিকে জব্দ না করে সেগুলোকে সস্নেহ প্রশ্রয় দিতে শিখে যান, প্রভূত বখেড়া। আমার প্রিয়জনের ক্যানসার ধরা পড়লে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়, কিন্তু তারপর তো অসহনীয় আতঙ্ক শোক ক্লান্তি বিরক্তি জয় করে আমায় রোজ হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি করতে হয়, এমনকী নিশ্চিত গো-হার জেনেও দাঁতে দাঁতে চেপে শেষ অবধি লড়তে হয়। ‘বড্ড নার্ভাস লাগছে’ বলে তো আমি হাত তুলে দিতে পারি না। আর যদি দিই, তাহলে এ আশা করতে কক্ষনও পারি না যে লোকে বলবে, ‘ওঃ, কী আগুন-সত্তা! ফটাস বলে দিল ভয় করছে, তারপর কেমন বাড়িতে বসে রইল, কুটোটা নাড়ল না!’
পলিটিকাল কারেক্টনেসের প্লাবন এসে সহনশীলতা, সহমর্মিতাকে সর্বত্র উসকে তুলছে, মানুষ-সম্পর্কিত একবগ্গা ধারণাকে সরিয়ে বসাতে চাইছে বহুমাত্রিক মানুষের ছবি, আমাদের বলতে চাইছে গ্রহণ করতে শেখো প্রত্যাখ্যান নয়, এ খুবই ভাল কাণ্ড। নিশ্চয়ই আমাদের জানতে হবে, খেলোয়াড়ের মন থেঁতলে গেলে উপহাস না-করতে, কিন্তু তা বলে সেই চোটকে বাই ডেফিনিশন এক্ষুনি-মেরামতের অতীত ভাবারও মানে নেই, আর জখম-মনুষ্যকে ‘মহিমা তব উদ্ভাসিত’ বলে অয়েলপেন্টিং প্রতিষ্ঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ মানুষ কর্তব্যের তাগিদে, বিরাটের সম্মুখবর্তী হয়ে, চ্যালেঞ্জের ফণাকে মুষ্টিতে চাপার স্বাদের জন্য, মনের ক্ষতকে হাটিয়ে বুজিয়ে ঘষটে, নিজেকে চাগিয়ে বারেবারে ছুড়ে দিতে পেরেছে, নিজের চেয়ে উঁচুতে, নিজেকে পেরিয়ে, এ তার এক প্রধান পরিচয়। ন্যূনতার প্রতি আমাদের উদারতা বাড়াতে গিয়ে, আমরা যেন সেই উত্তরণ-প্রয়াস, সেই অতিক্রমণ-প্রকল্পকে গৌণ না ভেবে ফেলি। ভয়ের চেয়ে সাহস ভাল, চেষ্টা না-করার চেয়ে চেষ্টা করা ভাল, সাইডলাইনে গুটিসুটি মেরে ফোঁপানোর চেয়ে মাঠে নেমে পড়া ভাল— এগুলো মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আজ অব্যাহতিকে, অনীহাকে, অন্তর্ধানকে যদি ক্রিয়াশীলতার চেয়ে, উদ্যমের চেয়ে, জেদের চেয়ে বেশি আদর দিতে শুরু করি, আত্মশঙ্কাকে যদি কোলে তুলে বলি ‘থাক বাবা আর তোকে শ্রম-ইস্কুলে প্রয়োগ-আশ্রমে যেতে হবে না, স্নিগ্ধ কান্নায় ফুলেফেঁপে ওঠ’, তবে জন্ম হবে চমকদার টুইটের, আর বদ মানব-স্বভাবের।