ছাপ্পান্ন বছর আগের সিনেমা ‘থান্ডারবল’-এ জেমস বন্ড-এর হাতে কোয়ার্টারমাস্টার ওরফে কিউ তুলে দিয়েছিলেন একটি হলুদ ক্যাপসুল। সামান্য সন্দিগ্ধ শন কনারিকে আশ্বস্ত করার জন্য চিররসিক ডেসমন্ড লুয়েলিন বলছিলেন, ‘ভয় নেই— একটা নির্বিষ, সদ্যপ্রস্তুত তেজস্ক্রিয় যন্ত্র বই কিছু নয়’। তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল শুনলে বাদবাকি নশ্বর মানুষ ভয় পেতে পারেন কিন্তু ০০৭ বলে কথা! যেই শুনলেন ওই ক্যাপসুল খেলে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস বন্ডের গতিবিধির হদিশ রাখতে পারবেন, কনারি গপ করে গিলে ফেললেন। হ্যাঁ, জল-টল ছাড়াই।
জেমস বন্ডের খাঁটি ভক্তদের অধিকাংশই কিন্তু কিউকেও বড়ই পছন্দ করেন। কখনও-সখনও হয়তো বন্ডের থেকেও বেশি ভালবাসেন। এরকমই এক ভক্ত শালেভ হুলিও। কম্পিউটার বিশারদ। শুধু কম্পিউটার বললে ভুল হবে, অধিকাংশ বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি নিয়েই তাঁর তুমুল উৎসাহ। এবং চর্চাও। যে-চর্চার ফলে ২০০৮ সালে স্কুলের বন্ধু ওমরি লাভির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বার করে ফেললেন এক নতুন প্রযুক্তি, যার সাহায্যে মোবাইল ফোনের কোম্পানিগুলি তাঁদের উপভোক্তাদের ফোনের সব সমস্যা বৈদ্যুতিন ভাবেই বুঝে উঠতে পারবেন। কাস্টমারদের আর থেকে থেকে দৌড়তে হবে না কোম্পানির অফিসে। শালেভ দূরদর্শী মানুষ, দেখেছেন ঠিক এক বছর আগে স্টিভ জোবসের হাত ধরে আই-ফোন মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে বৈদ্যুতিন পৃথিবীর। তিনি জানেন ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ নয়, ভবিষ্যৎ পৃথিবী দুনিয়াদারি করবে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। শালেভদের নতুন প্রযুক্তি যে ফিউচারিস্টিক, সে-নিয়ে কোনও সন্দেহই তাঁর নেই। সে-কথা মাথায় রেখেই শালেভ এ-প্রযুক্তির নাম দিলেন ‘কিউ সুইট’ (Q suite)। হ্যাঁ, জেমস বন্ডের গ্যাজেটগুরু সেই কোয়ার্টারমাস্টারের নামেই।
শালেভ যখন ‘কিউ সুইট’ বানাচ্ছেন প্রায় সেই সময়েই হাজার আড়াই কিলোমিটার দূরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে মানবাধিকার কর্মী আহমেদ মনসুর তৈরি হচ্ছিলেন সে-দেশের জেলবন্দি সমাজকর্মীদের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি লড়াই লড়ার। আমিরশাহীর কুখ্যাত আইনে তখন সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই সাংবাদিক বা সমাজকর্মীদের জেলে যাওয়া একপ্রকার নিশ্চিত। মনসুরের লড়াই দেখে সে-সময় বাহবা দিয়েছিলেন খোদ সে-দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমিরশাহীর পাশের দেশ সৌদি আরবে ওই সময়েই ফিরে এসেছেন সাংবাদিক জামাল খাশোগি। লন্ডনের সৌদি দূতাবাসে কয়েক বছর কাটিয়ে জামাল ফিরেছেন সরকারপন্থী সংবাদপত্র আল ওয়াতন-এর সম্পাদক হিসাবে কাজ করার জন্য। আর এই ২০০৮-এই মুম্বই হামলার পর ভারতীয় সংসদে প্রথমবারের জন্য তৈরি হবে ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি অ্যাক্ট’। সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করার জন্য ভারত সরকার আমেরিকার এফ-বি-আই-এর আদলে বানিয়ে ফেলবেন এক স্বতন্ত্র এবং অতিশক্তিমান সংস্থা।
আহমেদ মনসুর, জামাল খাশোগি, এন-আই-এ এক দশকেরও বেশি সময় পর শালেভ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছেন এই প্রতিটি নামের সঙ্গেই। তবে শালেভের ভাগ্যচক্রের সঙ্গে আহমেদ বা জামালের ভাগ্যচক্রের মিল নেই। শালেভের কোম্পানির বাজারদর এখন প্রায় দেড় বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। ওদিকে আহমেদ মনসুর ২০১৭ থেকে আমিরশাহীর জেলে বন্দি। জামালের আরও করুণ পরিণতি, ২০১৮ সালে তাঁকে খুন করা হয় ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে। আহমেদ এবং জামাল দুজনেই রাজরোষের শিকার। এবং তদন্তে প্রকাশ, দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের গতিবিধি, ফোন কল, টেক্সট মেসেজের ওপর গোপনে নজর রেখে এসেছে দুই দেশের সরকার। আর সে-কাজে সংযুক্ত আমিরশাহী এবং সৌদি আরবের সরকারের অন্যতম হাতিয়ার ছিল শালেভের তৈরি সফটওয়্যার। এবং সাম্প্রতিক অভিযোগ অনুসারে এই একই কাজ ভারতের ন্যাশনাল ইনিভেস্টিগেশন এজেন্সিও করে চলেছে।
না, ‘কিউ সুইট’ নয়। কিউ সুইট-এর থেকে আরও উন্নত, আরও অর্থকরী এবং আরও অনেক বিতর্কিত এ-সফটওয়্যারের নাম পেগাসাস। এ-নাম হয়তো অধুনা বিতর্কের আগেই শুনে থাকবেন। কারণ, গ্রিক পুরাণের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র হল ডানাওলা ঘোড়া পেগাসাস যার পিঠে চড়ে গ্রিক বীর বেলারোফন পৌঁছতে চেয়েছিলেন অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায়। শালেভের সফটওয়্যারও উড়তে পারে। এক স্মার্টফোন থেকে উড়ে নিমেষের মধ্যে উড়ে পৌঁছে যেতে পারে আরও অসংখ্য স্মার্টফোনে। নিমেষের মধ্যে সমস্ত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য তুলে দিতে পারে কোনও নজরদারি সংস্থার হাতে। যে-কারণে পেগাসাসকে শুধু সফটওয়্যার বললে ভুল হবে, বলা উচিত স্পাইওয়্যার। কিউ সুইট-এর প্রাথমিক কোডিংয়েই লুকিয়ে আছে এই স্পাইওয়্যারের জন্মের ইতিবৃত্ত। কিন্তু মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে নয়, শালেভের ব্যবসা আজ পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ঘোষিত ও অঘোষিত একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে। যে যে দেশ নজরদারি রাখতে চায় বিরোধী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এমনকী সাধারণ মানুষের ওপর, তাদের প্রায় সবাই নাম লিখিয়েছে শালেভের খাতায়। আর পাঁচটা সফটওয়্যার কোম্পানির মতন শালেভের হয়ে সাধারণ কোডাররা কাজ করছেন না, সে-দায়িত্বে রয়েছেন ইজরায়েলের সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সির এলিট হ্যাকাররা। ২০১০ সালে শালেভ এবং ওমরি হাত মেলান ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক অফিসার নিভ কারমির সঙ্গে। নিভ, শালেভ এবং ওমরির নামে গড়ে ওঠে এক নতুন কোম্পানি এনএসও group technologies। এই কোম্পানির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হল পেগাসাস, ফোর্বস পত্রিকা যাকে বলেছে ‘World’s most invasive mobile spy kit’।
ঠিক কীভাবে পেগাসাস কাজ করে সে-বিষয়ে দু’চার কথা বলার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে যাই। কেন পেগাসাসের এই পৃথিবীজোড়া চাহিদা? কেনই বা সমস্তরকম রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে বিশ্বের একাধিক সরকার এই নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছে? এ-প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া ভাল যে, নজরদারির ইতিহাসে ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের খ্যাতি বা কুখ্যাতি অতুলনীয়। পঞ্চাশের দশকে সুয়েজ খাল নিয়ে যখন ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, মিশরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে তখন থেকেই পশ্চিমি দেশগুলি মোসাদের নজরদারি প্রযুক্তির ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। আবার শুধু নির্ভরশীল বললেও ভুল হবে— চৈনিক এবং রাশিয়ান হ্যাকারদের বাড়বাড়ন্তের বহু আগে, সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই আমেরিকার ওপর সবথেকে বেশি নজরদারি চালিয়ে এসেছে মোসাদ। সি-আই-এ সহ মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলির বহু কর্তা সে-কথা প্রকাশ্যে বলেও এসেছেন। তাই শালেভের কোম্পানির ‘ব্র্যান্ড রেপুটেশন’ নিয়ে প্রায় কারোরই কোনও সন্দেহ ছিল না, বিশেষত নিভ কারমি চলে আসার পর। কিন্তু যোগানেরও আগে চাহিদা নিয়ে ভাবতে হবে। আর এখানেই একটি বড় ভূমিকা নিয়েছে বিশ্বের সবথেকে উন্নত প্রযুক্তি সংস্থাগুলির সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের দ্বৈরথ, যে-সংঘাত শেষ পনেরো বছরে বারংবার সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছে।
২০২১-এ এসে তিনশো কোটির কাছাকাছি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছেন। গুগলের জি-মেল ব্যবহার করছেন প্রায় দুশো কোটির মতন মানুষ। আইফোন? সারা পৃথিবী জুড়ে সেও রয়েছে প্রায় একশো কোটি। বুঝতেই পারছেন অ্যাপল, গুগল বা ফেসবুকের মতন কোম্পানিগুলির কাছে কী বিপুল পরিমাণ তথ্যভাণ্ডার রয়ে গেছে। এবং বিশ্বের হেন দেশ নেই যা শেষ দশ-পনেরো বছরে কোনও না কোনও সময়ে এই কোম্পানিগুলির কাছ থেকে এ-তথ্য আদায়ের চেষ্টা করেনি। উপভোক্তাদের গোপনীয়তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কোম্পানিগুলি এই সব তথ্যই কোডের সুরক্ষায় মুড়ে রেখেছে, যে-কোড আইনত আর কারোর হাতে যেতে পারে না। এবং সেই কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির দ্বৈরথ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। সরকারের বক্তব্য এনক্রিপশন অর্থাৎ কোডের সুরক্ষার পূর্ণ সদ্বব্যবহার করে চলেছে সবথেকে বিপজনক অপরাধীরা। ড্রাগ, অস্ত্র চোরাচালান, শিশুদের নিয়ে অশ্লীল ভিডিওর কারবারিদের ধরা ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। অপরদিকে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি জানাচ্ছে উপভোক্তাদের সমস্ত তথ্য বিনা বাক্যব্যয়ে সরকারের হাতে তুলে দিলে সাংঘাতিক ভাবে বিঘ্ন হতে পারে মানুষের গোপনীয়তা। মনে রাখা দরকার এই সমস্ত তথ্যই কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
আর ঠিক এই জায়গাতেই শালেভরা ব্যবসার সুযোগ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা দেখালেন যোগাযোগ সূত্রের প্রথম বা শেষ প্রান্ত অর্থাৎ আমাদের ফোনেই যদি সরাসরি নজরদারির ঘাঁটি বানানো যায় তাহলে এই তথ্যসুরক্ষা নিয়ে অনর্থক কচকচির মধ্যে যাওয়ার দরকারই পড়ে না। অ্যাপল, গুগল বা ফেসবুককে এড়িয়েই দেখে ফেলা যাবে কাকে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে, কী মেসেজ পাঠানো হচ্ছে, বা কখন পাঠানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শালেভদের প্রযুক্তি দিয়ে আমার-আপনার ফোনে আমাদের অজান্তেই স্ক্রিনশট উঠে যাবে বা রেকর্ড হয়ে যাবে আমাদের কথোপকথন। গত এক দশক ধরে এনএসও অবশ্য চুপিসাড়ে অভাবনীয়ভাবে উন্নত করে তুলেছে তাদের প্রযুক্তিকে। কারণ শালেভরা জানেন সাধারণ উপভোক্তারাও ক্রমেই সচেতন হচ্ছেন নিজেদের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য। তাঁরা এখন চট করে অচেনা কোনও লিঙ্কে আঙুল রাখার আগে দু’বার ভাববেন। পেগাসাস তাই বদলে গেছে ‘জিরো-ক্লিক’ স্পাইওয়্যার হিসাবে— আপনি হয়তো কোনও রেস্তোরাঁর ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কটি ব্যবহার করছেন, টেরও পেলেন না কখন স্পাইওয়্যার আপনার ফোনে ঢুকে বসে থাকল। এরকম ঘটনাও দেখা গেছে যেখানে শুধুমাত্র একটি হোয়াটসঅ্যাপ কলের মাধ্যমে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ফোনে অথচ যার ফোন তিনি কলটি ধরেনওনি। অর্থাৎ, সময়-সময় শুধুমাত্র ফোন নম্বরটি জানলেই চলবে। তারপর পুরো প্রক্রিয়ায় সামান্যতম খুঁতের সদ্ব্যবহার করে নজরদারি চালু করে দেওয়া যাবে। আপনার ফোনের অপারেটিং সিস্টেম যদি নতুন আপডেট না পেয়ে থাকে তাহলে ওই একটি কলেই পেগাসাস অপারেটিং সিস্টেমের সুলুকসন্ধান জেনে যেতে পারে।
প্রায় কল্পবিজ্ঞানের মতনই শোনাচ্ছে, তাই না? কিন্তু পেগাসাস ঘোর বাস্তব। শেষ কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে অপরাধ দমনের থেকে রাজনৈতিক মুনাফা লাভের কারণেই পেগাসাস বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং সে-কারণেই প্রশ্ন উঠছে, আইনি চোখে পেগাসাসের ভিত্তি ঠিক কী? এখানে একটি বড় সমস্যা হল Cyber surveillance নিয়ে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের আইনেই স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এবং অনলাইন নজরদারির সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়েও খুব কম দেশেই আইনি চর্চা আছে। আরও একটি বড় সমস্যা হল, শালেভদের কোম্পানি এনএসও এই স্পাইওয়্যারটি বিক্রি করে শুধুমাত্র কোনও দেশের সরকার বা সামরিক বাহিনীকে। আইনের প্রণেতা যারা তাঁরাই যদি জেনেবুঝে আইনভঙ্গ করেন, তাহলে চালু আইনের সাধ্য কী তাকে থামায়? অর্থাৎ, দেশ উন্নত হোক বা উন্নয়নশীল, পেগাসাসের অপব্যবহার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে আইনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
নিভ, শালেভ এবং ওমরিরা অবশ্য ঘুরিয়ে দাবি করছেন পেগাসাসের দরুণ নজরদারি প্রক্রিয়াতেও একটা ভারসাম্য এসেছে। মিলিয়ন খানেক ডলার থাকলেই এখন যে-কোনও ছোট দেশও তার শত্রুদের বিরুদ্ধে এ-অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এক দশক আগেও এ-কথা ভাবা যেত না, অত্যাধুনিক নজরদারির কলকাঠি থাকত হাতে গোনা কয়েকটি উন্নত দেশের কাছে। সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে এনএসও এ-কথাও তুলে ধরছে যে পেগাসাসের সাহায্যে ইওরোপে আইসিস-এর একাধিক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আটকানো গেছে, বা মেক্সিকোর কুখ্যাত ড্রাগলর্ড হোয়াকিন গুজমান ওরফে এল চ্যাপোকে ধরা গেছে। শালেভরা ঘুরিয়ে যেটা বলতে চাইছেন তা হল তাঁদের কোম্পানির উদ্দেশ্য সৎ, কিন্তু খোদ রাষ্ট্রশক্তি যদি তাঁদের সফটওয়্যারকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায় তাহলে এনএসও-র বিশেষ কিছু করার নেই।
শেষ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে তাহলে বলতেই হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তিও যে সততই মঙ্গলকামী হবে এমনটি ভাবা যায় না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুশানা জুবফ-এর ভাষায় আমরা নজরদারি পুঁজিতন্ত্রের যুগে বাস করছি। একনায়কতন্ত্রে তো বটেই, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রেও তাই নজরদারির হাত থেকে সহজে নিস্তার নেই। এ-যুগের পুঁজিবাদীদের মুনাফা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, যা অধিকাংশ সময়ে আমরা স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। জিমেল বা ফেসবুক ব্যবহার করতে টাকা দিতে হচ্ছে না বলে অধিকাংশ সময়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি দিনে প্রায় প্রতিটি মুহূর্তের হাঁড়ির খবর আমরা গুগল, ফেসবুকদের দিয়ে আসছি। আমাদের নিজেদের অবস্থানটাই এত নড়বড়ে যে, এখান থেকে পেগাসাসের বিরোধিতা করাটা নৈতিক ভাবে তো বটেই, বাস্তবিকও বেশ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আইনি সংস্কার অবশ্যই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ, কিন্তু তার বাইরে গিয়েও ভাবনাচিন্তার অবকাশ থাকে। রাষ্ট্রীয় নজরদারির হাত থেকে বাঁচার জন্য আরও উন্নত প্রযুক্তি আমাদের সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। সিলিকন ভ্যালির বৃহত্তম কোম্পানিগুলি নতুন দশকে তাই ‘গোপনীয়তা রক্ষা’কেই তাদের ব্যবসার মূলমন্ত্র করে এগোচ্ছেন। কিন্তু এ-কথাও সত্যি যে, অ্যাপল বা গুগল নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এলে এনএসও-র মতন কোম্পানিরাও আরও উন্নত প্রতি-প্রযুক্তি নিয়ে আসতে পারে। এই প্রযুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ঠিক কী হবে, সে-নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী অতি বড় বোদ্ধারাও করতে চাইবেন না। কিছু প্রযুক্তিবিশারদ তাই উলটো পথ দেখাচ্ছেন, জানাচ্ছেন প্রযুক্তির উপর কম নির্ভরতাও একটা পথ হতে পারে। পেগাসাসের মতন স্পাইওয়্যারের হাত থেকে বাঁচতে তাঁদের নিদান বিভিন্নরকম অ্যাপের ব্যবহার কমাতে হবে। যত কমানো যায় ততই ভাল। দরকার পড়লে ই-মেল-এর মতন প্রয়োজনীয় অ্যাপও বর্জন করে ব্রাউজার ব্যবহার করে ই-মেল দেখে নিন, কিন্তু নিতান্ত দরকার না পড়লে নতুন অ্যাপ ঢোকাবেন না।
মনে হয় না যেন ঈশোপনিষদের কথাই শুনছি? ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’, ত্যাগের দ্বারা ভোগ করো। প্রায় সত্তর বছর আগে ‘বিগ ব্রাদার’দের নজরদারি নিয়ে যিনি ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই জর্জ অরওয়েল-ও খানিক আত্মসমালোচনার সুরে বলে গেছেন, ‘Man is the only creature that consumes without producing’। যত ভোগ, তত পরনির্ভরতা। প্রযুক্তি, অর্থনীতি, আইন— এই সব কিছুর বাইরে এসেও কিছুটা আত্মবীক্ষণ তাই আবশ্যিক। আমাদের নিজেদেরই ভাবতে হবে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ায় ভোগের পরিমাণ ঠিক কতটা হলে গরহজমের ভয়টুকু অন্তত কাটিয়ে উঠতে পারি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র