শিল্পের সমঝদার যে কোনও মানুষই বুঝবেন, বেঙ্গালুরু বা অন্যন্য শহরে গাড়ির স্টিকার হিসেবে ‘রুদ্র হনুমান’-এর যে-ছবিটি আজকাল খুব জনপ্রিয় হয়েছে, সেটি ‘রাইজ অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এপস’ নামে হলিউডের সিনেমাটির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এই ধরনের পূর্ঙ্কল্পনা বিগত কয়েক দশকে বারবারই দেখা গেছে— রামচন্দ্র ও শিবের এখন সিক্স প্যাকের প্রয়োজন, দুর্গাকেও তাঁদের মতো গোমড়ামুখে দুষ্টু লোকদের মারতে হয়, ঠিক যেমন ডি সি কমিক বুকের নায়ক, ব্যাটম্যান বা ওই নতুন সুপারম্যানটির মতো। এমনকী অমর চিত্রকথা নতুন কমিক্সগুলোও রাজা রবিবর্মার স্নিগ্ধ নান্দনিকতা ছেড়ে হিন্দু দেবদেবীদের ছবি আঁকতে আপন করে নিয়েছে আমেরিকার সুপারহিরো স্টাইলের উগ্র পুরুষালি, রাগী, হিংস্র ছবিগুলোকে।
এই চলতি হাওয়াকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং স্বীকৃতি দিয়েছেন দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতারা, যাঁরা একটি বিশেষ ধাঁচের হিন্দুধর্মের অনুগামী— এর নাম তাঁরা দিয়েছেন হিন্দুত্ব, এর মূলে রয়েছে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা এবং উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতার সংস্কৃতিকে তোল্লাই দেওয়া। ফলত, বহু বুদ্ধিজীবিরাই রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে গেছেন। কী দুঃসাহস! যে-লেখকেরা এমনিতে জাহির করতে পছন্দ করেন যে, তাঁরা ধার্মিক নন, নেহাতই আধ্যাত্মিক অথবা নাস্তিক, তাঁরাও বলতে শুরু করেছেন, এ তো আমাদের হনুমান নয়। অথচ মঙ্গলবার (দিল্লিতে) বা শনিবার (মুম্বইতে) যাঁরা হনুমান মন্দিরে ভক্তিভরে ঠাকুরের মাথায় তেল ঢেলে তাঁর কাছে প্রার্থনা করেন, সমস্ত অশুভ নক্ষত্রের প্রভাব জীবন থেকে দূর থেকে, তাঁদের এই বিশ্বাসকে এই লেখকেরা কিন্তু কটাক্ষই করেন।
জনপ্রিয়তা দেখলেই বোঝা যায়, এমন ছবি মানুষের মনে বেশ জায়গা করে নিয়েছে। হিন্দুদের ধর্মকে খেলো করে দেখা, তার ‘শুদ্ধিকরণ’-এর প্রচেষ্ট করায় হিন্দুদের অনেকের যে রাগ, এই শিল্প এবং তার জনপ্রিয়তা কি তবে তারই বহিঃপ্রকাশ? দক্ষিণপন্থী প্রশাসনের উত্থান কি এ রাগের কারণ, না ফলাফল? না কি এ নিছকই জনপ্রিয় লঘুশিল্প? হয়তো এটা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা? নাকি যারা স্বভাবেই সুবিধাবাদী, তারা এটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর চেষ্টা করছেন?
হিন্দু দেবদেবীদের বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থীরা উভয়েই, অবিশ্বাসীর কটাক্ষের আখরে ব্যবহার করেছেন। শিল্পীরাও এর ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক বার্তা প্রকাশ করতে। ওয়াটস্যাপে অনেকেই পাঠানো ছবি পায়, কৃষ্ণ যমুনায় স্নানরতা গোপীদের কাপড় চুরি করে নিচ্ছেন, এটা ধর্ষণকে সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি দেয়। কৌরবদের হাতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের থেকে একে পৃথক করে দেখা হয় না। শিল্পীর কাছে, এবং যাঁরা এ-ছবি পাঠান তাঁদের কাছে, বালক কৃষ্ণের এই দুষ্টুমির সাথে কৌরবদের ঘৃণা-বিদ্বেষের কোনও ফারাক নেই। এটা কি প্রথাগত হিন্দু কাহিনির উত্তরাধুনিক বিকৃতিকরণ, না হিন্দু লোককথার প্রকৃত অনুধাবন? রাগী হনুমানের মতোই এক্ষেত্রেও হনুমান, বা কৃষ্ণ, বা রাম, শিব, দুর্গা অথবা কালীকে দেখার প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিত কী, সেটা কে ঠিক করবে? একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে তাঁদের নবকল্পনা করা হবে কী উপায়ে?
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে রাজা রবিবর্মা নিশ্চিত করেছিলেন সমস্ত হিন্দু দেবদেবীদের যেন ছবিতে ফর্সা ব্রাহ্মণ নর-নারীদের মতো দেখায়। কৃষ্ণবর্ণ দেবতারা হয়ে গেলেন নীলবর্ণ। সাবেকি ভারতীয় শিল্পের হাঁস (হংস) পালটে হয়ে গেল লম্বা গলার, আপাত ভাবে বেশি রাজকীয় ইওরোপীয় রাজহাঁস (রাজহংস) বহু শিল্পীরাই নিজেদের ছবির ছক হিসেবে ব্যবহার করতেন ইওরোপীয় রেনেসঁসের ছবি, যে-কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাধা-কৃষ্ণকে ভারতীয়ের চেয়ে বেশি ইওরোপীয় মনে হয়।
এখন আমেরিকার ডিসি আর মার্ভেল কমিক্সের যুগে হিন্দু দেবতারা হয়ে উঠছেন সুপারহিরো, পৃথিবীর ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে তাঁরা ভীষণ রেগে আছেন, সব সমস্যার সমাধান-মেরামত করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর— ঠিক যেন বাইবেলের ঈশ্বরপ্রেরিত প্রফেট বা আর্কেঞ্জেল।
ভারতীয় দেবদেবীদের ইওরোপীয় বা আমেরিকান রূপে দেখতে আমরা এতটাই আগ্রহী যে, হিন্দু শিল্প ও হিন্দু নীতিবোধের কথা ভুলতে বসেছি। গ্রিক বা রোমান দেব-দেবতাদের যেমন যেমন পেশিবহুল রূপ, বাস্তবের মতো করেই তাঁদের মূর্তি গড়া হয়, হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালে হিন্দু দেবদেবীদের আর একটু নমনীয়, গোলগাল বানানো হয়, নৃত্যশিল্পীর ভঙ্গিমায় তাঁদের দেওয়া হয় একটু কল্পিত মূর্তি, প্রায় সবসময়েই রীতিমতো অঙ্ক কষে বানানো জ্যামিতিক বিন্যাসে বিরাজ করেন তাঁরা। এই শিল্পপদ্ধতিটি মান্যতা পায় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পঞ্চম থেকে পঞ্চাদশ শতাব্দীর মধ্যে।
এমনকী, শিব বা শক্তির ক্রুদ্ধ মূর্তিকেও এতটা লালিত্যের সঙ্গে দেখানো হত, যাতে শবদেহের স্তূপ, ছিন্ন মুণ্ড, বা পাত্রে ভরা রক্তের মতো তাঁদের ভয়াবহ আঙ্গিকগুলোও চোখ এড়িয়ে যায়। এটা এক্সপ্রেশনিস্ট, ইম্প্রেশনিস্ট বা আদর্শধর্মী শিল্প নয়; এটা বার্তাধর্মী শিল্প, বৈদিক যজ্ঞ বা পুরাণের গল্পের যা কাজ, তারও সেই একই কাজ, সাধারণ মানুষের কাছে কিছু ভাবনা, কিছু দর্শন পৌঁছে দেওয়া। জ্ঞানশিক্ষা গ্রহণ করতে কারোর আচার-প্রক্রিয়া লাগে, কারো গল্প লাগে, কারো শিল্প লাগে।
রাগ জিনিসটা অসহায়তার চিহ্ন। হিন্দু দেব-দেবতারা অসীম জ্ঞানের অধিকারী, অসহায় তাঁরা কখনওই হতে পারেন না। এ-কারণেই যুদ্ধক্ষেত্রে বা পরবাসেও তাঁদের কখনও পীড়িত বা ক্রুদ্ধ দেখায় না। তাঁদের সব সময়েই সৌম্য, শান্ত রূপ, কারণ ভূত-ভবিষ্যৎ, ইহকাল-পরকাল মিলিয়ে তারা পুরো ব্যাপারটাই জানেন। বাবা-মা যেমন সন্তানকে হাঁটতে শেখান, তেমনই তাঁরা মানুষের সাথে মানুষের স্তরেই যোগাযোগ করেন। সাধারণ জীব অসাধারণ হয়ে উঠলে যেমন সুপারহিরো হয়, হিন্দু দেবতারা তাঁদের সকল রূপেই অসীম, অনন্ত জীব, তাঁরা রাজার রূপে বা বানরের রূপে ইচ্ছে করে সংকীর্ণ হয়ে আবির্ভূত হন মানুষকে তার নিজের ভিতর দৈবী সম্ভাবনার সন্ধান দেবেন বলে, তাদের নিজেরও উপরে উঠে অন্যকে কাছে টেনে নেবার পথ দেখাবেন বলে।
আমেরিকার সুপারহিরোরা বিশ্ব দখল করতে চাওয়া সুপারভিলেনদের হাত থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেন, কিন্তু হিন্দু দেব-দেবতারা (এদের মধ্যে হনুমানও আছেন) হচ্ছেন শিক্ষক। তাঁরা আমাদের উদ্ধার করেন সংকটের থেকে নয়, বরং সেই সংকীর্ণ ভাববোধের থেকে যার ফলে আমাদের চারিদিকে সবকিছুকে সংকট বলে মনে হয়। জ্ঞান থাকলে আমরা বুঝতে পারি পৃথিবী কী নিয়মে চলছে, এবং আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, একজনের কাছে যা সমস্যা, অন্যের কাছে তাই সমাধান। রাম-রাবণদের বিরূদ্ধে লড়াই করেন রাবণ ‘ইভিল’ বা খারাপ বলে নয় (এ-কথাটি জুডেও-খ্রিস্টান কথা), লড়াই করেন কারণ রাবণ নিজের ক্ষমতা এবং জ্ঞানের নেশায় মত্ত হয়ে নিজের মানুষী উচ্চতায় আর উঠতে পারছেন না। কুকুর যেভাবে হাড় কামড়ে পড়ে থাকে, রাবণ সেইভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন, তাই হনুমানের মতো মুক্ত হয়ে উড়তে পারেন না।
ভারতীয় বোধে হনুমান সমস্যার সমাধান করেন না, যদিও হিন্দি বলয়ে তাঁকে সংকটমোচন বলা হয়। কারণ দেবতারা আমাদের হয়ে সংকট দূর করে দিলে আমাদের বৌদ্ধিক এবং আবেগী উন্নয়নে তাঁরা সাহায্য করতে পারবেন না। আর যদি আমাদের বৌদ্ধিক বা আবেগী উন্নয়ন না-ই হয়, আমাদের মানবজন্মই বৃথা। আমরা কেবলই আনন্দবিলাসী ভোগসর্বস্ব পশু রয়ে যাই। রামের সাথে জঙ্গলে যত বানরের দেখা হয়, তাঁদের মধ্যে একমাত্র হনুমানের বিবর্তন হয় রামদাস (রামের দাস) থেকে মহাবলী (বহুমুখী বহুহস্ত দেবতা যিনি স্বাধীনভাবে পূজিত) রূপে। পশু থেকে দেবতায় এই পরিবর্তন সম্ভব হয় কারণ তিনি ব্রহ্মার মতো পরাবলম্বী থেকে শিবের মতো স্বাবলম্বী হয়ে অবশেষে বিষ্ণুর মতো হয়ে ওঠেন, যাঁকে অন্যরা অবলম্বন করে ভরসা পেতে পারেন।